ইউপি নির্বাচন আমাদের কোথায় নিচ্ছে?
বাংলাদেশের নির্বাচনী সহিংসতাকে আর কেবল ভোটকেন্দ্রিক সহিংসতার উপলক্ষ
হিসেবে গণ্য করা কঠিন হবে। এটা সম্ভবত হিংসাশ্রয়ী একটি সমাজ তৈরির
উদ্বেগজনক উৎস হয়ে থাকবে। কোথাও সরকারি দলের কোনো প্রার্থী প্রশাসনের
সহযোগিতা না পেয়ে ভোট বর্জন করেননি। হানাহানিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।
কারণ আমরা একজন নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করেছি। একজন বিশ্ববিদ্যালয়-ছাত্রকে
হত্যা করেছি। এ পর্যন্ত দুই পর্বে অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছে। দ্বিতীয়
পর্বে আহত ব্যক্তিদের সংখ্যা এতটাই ব্যাপক যে, প্রথম আলো লিখেছে,
‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ আহত হয়েছেন কয়েক শ মানুষ।’ সমকাল
লিখেছে, ৪৪ জন গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। প্রথম পর্বে ১১ ও
দ্বিতীয় পর্বে ৯ জন নিহত হয়েছে। দুজনের কম প্রাণহানির ঘটনাই কি নির্বাচন
কমিশনকে এই দাবি করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে যে, প্রথম পর্বের চেয়ে কম
সহিংসতা ও জবরদস্তি ঘটেছে। তাদের এই দাবি যথেষ্ট দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য বলে
গণ্য হওয়ার আশঙ্কাটাই বেশি করি। কারণ নির্বাচনে সহিংসতা বা হানাহানি
প্রধানত সেখানেই ঘটে, যেখানে দুই বিবদমান পক্ষ মোটামুটি শক্তিধর হিসেবে
গণ্য হয়। এরকম অবস্থা খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। সুতরাং এই নির্বাচন অবাধ
হয়েছে কি হয়নি, তা বুঝতে হলে সব থেকে বড় মাপকাঠি হলো ক্ষমতাসীন দল দলীয়
প্রার্থী কী করে বাছাই করেছিল, সেদিকে নজর দেওয়া। এতে সন্দেহের অবকাশ কম যে, মনোনয়ন-প্রক্রিয়াই অবাধ নির্বাচনের ধারণাকে
পর্যুদস্ত করেছে। এটা শাসক দলের বেলাতেই নয়, বিএনপির তরফেও কমজোরি সত্য।
গতকালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ২৪ ও বিএনপির ৩ জন বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী
হয়েছেন। আর সার্বিকভাবে ৬৩৯টির মধ্যে যে ২০৪টির ফল পাওয়া গেছে, এর মধ্যে
আওয়ামী লীগ ১৪৮ ও বিএনপি ১৯টিতে জয় পেয়েছে। এখন এটা বলা অতিরঞ্জিত হবে না
যে, বাংলাদেশের সমাজ ১৪৮: ১৯ অনুপাতে বিভক্ত নয়। সমাজ যে বিভক্ত তা কেউ
অস্বীকার করেন না। বিএনপি তার দেউলেপনায় বিপর্যস্ত তা নিয়েও খুব মতপার্থক্য
দেখি না। পরিহাসের ছলে একটা কথা বলি। সেটা হলো যত যা কিছুই ঘটুক, আমাদের গ্রামীণ
সমাজে ১৬৭ (১৪৮+১৯) জন মানুষের মধ্যে ১৪৮ জন আওয়ামী লীগ এবং মাত্র ১৯ জন
বিএনপি করে, সেটা বাস্তবতা নয়। আসন বা মাথা গণনা কোনো হিসাবেই এটা চলে
না। সুতরাং নির্বাচন একটা সামাজিক মরণব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছে। সব থেকে লক্ষণীয় যে, সমাজে গুলিবিদ্ধ হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়িয়ে
দিচ্ছে এই নির্বাচন। কিন্তু আবারও আমরা জানলাম না যে, পুলিশ কোথাও
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রথমে কাঁদানে গ্যাস কিংবা রাবার বুলেট ব্যবহার
করেছে এবং তাতেও সামলাতে না পেরে একান্ত নিরুপায় হয়ে গুলি ছুড়তে হয়েছে—এমন
খবর জানা গেল না। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ঐতিহ্যগতভাবে দুই মারমুখো প্রতিপক্ষের মধ্যে
ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া এবং দেশীয় অস্ত্রের ব্যবহার লক্ষ করা যেত। কিন্তু সেই
দৃশ্যপট ভীষণ রকম বদলে যাচ্ছে। আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। মঠবাড়িয়ায়
দেখেছি পুলিশ নামমাত্র সতর্কতা কিংবা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা ছাড়াই গুলি
চালিয়ে পাঁচজন মানুষকে হত্যা করেছে। এবং এটা তারা জেনেশুনে করেছে যে, যাদের
ওপর তারা গুলি ছুড়ছে, তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থক। আবার এবারে
আমরা দেখলাম ভোলায় পুলিশ এনটিভির একজন স্টাফ রিপোর্টারকে পায়ে গুলি
করেছে। অন্যদিকে আগের পর্বে মহেশখালীতে শত শত রাউন্ড গুলি হয়েছে। সেখানে
অন্তত ৩০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। পুলিশ ও জনতা উভয়ে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার
করেছে। এখন আমরা অনুমান করতে পারি যে, যেসব এলাকায় হিংসা-হানাহানির
ঘটনা ঘটেছে, সেখানে একধরনের প্রতিকারের দরকার পড়বে। বিষয়টিকে কেবলই
নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। এটা সামগ্রিকভাবে
সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ার ইঙ্গিতবহ।
মানুষ আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে নালিশ জমা পড়ার সংখ্যা খুবই কম।
অবশ্য কম কি বেশি তা বোঝার উপায় নেই। পুলিশ বলুক তারা সারা দেশে কত
অভিযোগ পেয়েছিল আর কত প্রতিকার তারা দিয়েছে। সিইসি বলুন, তাঁরা কত নালিশ
পেয়ে কতটার সুরাহা দিয়েছেন। এটা না থাকলে মানুষ তো আইন হাতে তুলে নেওয়ার
প্রবণতা দেখাবে! আমাদের বিরাট ভাগ্য বলতে হবে, কারণ সিইসি বলেছেন, সামগ্রিক দিক বিবেচনায় ‘অর্জন’ ম্লান হয়ে গেছে। আসলে
তাঁদের স্বীকার করতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা ও সংহতি অধিকতর দুর্বল বা
ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। নির্বাচন এভাবেই শেষ হবে। কিন্তু আগামী পাঁচ বছর ধরে এই
বিরোধের জের চলবে। তাই একটা রিকনসিলিয়েশন লাগবে। সেটা কীভাবে সম্ভব তা
আমার জানা নেই। শুধু জানি ভোট দেশের বহুস্থানে দীর্ঘমেয়াদি রেষারেষির
প্রজনন উৎস হয়ে থাকবে। গ্রাম আদালত আরও কম কার্যকর হবে। প্রবীণ ও বিশিষ্ট
নাগরিকদের নিয়ে যে সালিস ব্যবস্থা, সেটাও আরও দুর্বল হবে। গ্রামে-গঞ্জে
আগ্নেয়াস্ত্রের নিনাদ মিলিয়ে যাবে না। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে শুক্রবার
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট আইআরআইরের একটি
সমীক্ষা রিপোর্ট পড়লাম ডেইলি স্টারে। বাংলাদেশ সঠিক পথে যাচ্ছে,
আশাজাগানিয়া খবর বটে। এটা বৈষয়িক উন্নতির মাপকাঠিতে হলে কথা নেই। কিন্তু
নৈতিক বা টেকসই উন্নতির দিক থেকে হলে বলব এটা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ আমরা
সঠিক পথে চলছি না। আইআরএ বলছে, ৮৩ ভাগ বাংলাদেশি মানুষ মনে করে সামাজিক
নিরাপত্তা খুবই ভালো কিংবা মোটামুটি ভালো। আর ৭৭ ভাগ মনে করছে
রাজনৈতিকভাবে দেশটা স্থিতিশীল। গত দুই পর্বের নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী
ও ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও হানাহানি বিবেচনায় নিলে আমরা
সামাজিক নিরাপত্তাকে উত্তম বিবেচনা করতে পারি না।
আমরা কোথায় যাচ্ছি? দলীয় ইউপি নির্বাচন আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
No comments