জামাইয়ের আদর চলুক, শাস্তি হোক সাংবাদিকের by ফারুক ওয়াসিফ
হাসপাতাল থেকে পিকআপ ভ্যানে করে সাংসদপুত্র বখতিয়ারকে নিয়ে যাওয়া হয় আদালতে। |
নারায়ণগঞ্জের
সাত খুনের আসামি তারেক সাঈদ পথ দেখিয়েছেন। সেই পথে হাসপাতালের ভিআইপি
কেবিনে পৌঁছে গেছেন ইস্কাটনের জোড়া খুনের আসামি সাংসদপুত্র রনি। ‘ঘোড়া
দেখে খোঁড়া’ পুরোনো দিনের প্রবাদ। নতুন প্রবাদ হবে, ‘জেলে গেলে রোগী’।
অথবা ঢাকাই সিনেমার ঢঙে বলা যায়, ভিআইপি কেন আসামি? মানুষের মুখ আছে, মানুষ
নানান কথা বলবে। কিন্তু মানী লোকের মান রাখাও তো কর্তৃপক্ষের কর্তব্য।
সম্মানী লোকের আরাম-আয়েশ দরকার। তাই রনি কারাগারের বদলে হাসপাতালে।
যদ্দেশে যদাচার—যেখানে যেমন চলে আর কি।
গত বছরের ১৩ এপ্রিল নেশাগ্রস্ত রনির এলোপাতাড়ি গুলিতে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁরা মামুলি লোক। একজন চালান রিকশা, আরেকজন অটো। আর নারায়ণগঞ্জের যে সাত হতভাগ্যের মৃত্যুর জন্য তারেক সাঈদের বিচার হওয়ার কথা, তাঁরাও কেউকেটা কেউ নন। সবাইকে সমান চোখে দেখা ঠিক না। নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্নার মতো ব্যক্তিকে বিনা বিচারে মাসের পর মাস আটকে রাখা যেতে পারে। মারাত্মক অসুস্থ বলে তাঁর পরিবার হা-হুতাশ করলেও কুছ পরোয়া নেহি। হাসপাতাল তাঁর জন্য নয়। হাতের পাঁচ আঙুল যদি এক সমান না হয়, তাহলে যে হাতে খুন করা হয় আর যে হাতে কলম ধরা হয়, তা কেমন করে সমান হবে? সব আসামিরই তো আর মেরুদণ্ডে সমস্যা নেই।
কী সুন্দর মিল তারেক আর রনি সাহেবের। দুজনেই মেরুদণ্ডের ব্যথার দোহাই দিয়ে হাসপাতালস্থ হয়েছেন। অবশ্য বাংলাদেশে এখন মেরুদণ্ড থাকাটাই এক বিরাট সমস্যা। ব্যথা না হলে কি করে আমরা জানতাম যে তারেক ও রনিরও মেরুদণ্ড আছে এবং সেখানে ব্যথা হয়।
কিন্তু চিন্তার কারণটা অন্য জায়গায়। আসামিদ্বয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। একজন ক্ষমতাশালী এক রাজনৈতিক নেতার জামাই, অন্যজন সাংসদের পুত্র। দফায় দফায় তাঁরা সরকারি হাসপাতালে এসে থাকছেন, ঘুমাচ্ছেন। তাহলেও তাঁদের আসল অসুখটাই এখনো শনাক্ত করতে পারছেন না ডাক্তাররা। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারাধ্যক্ষ মো. নেছার আলম প্রথম আলোকে বলেন, অর্থোপেডিক সমস্যার কারণে বখতিয়ার রনিকে গত ৩১ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। অথচ তিনি কিনা ভর্তি আছেন মেডিসিন বিভাগের অধীনে। ওদিকে তাঁর তত্ত্বাবধানকারী মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এস এম হাফিজ বলছেন, বখতিয়ারের সমস্যা আসলে কিডনিতে। সেটাই সই, কিডনির চিকিৎসাই হোক! তা না, তাঁকে দেওয়া হচ্ছে সাইকোথেরাপি। মুনের সুখের জন্য সাইকোথেরাপি খারাপ না। তবে বিচার শুরু হওয়ার আগে আগেই তাঁকে মানসিক রোগী বানানোর কৌশলটা দারুণ। এখন ডাক্তাররা যদি সার্টিফিকেট দিয়ে দেন, রনি মানসিকভাবে অসুস্থ, তাহলেই তো কেল্লা ফতে। পাগলের গুলিতে জোড়া হত্যার মামলা তাহলে হালকা হয়ে যায়। রনির আইনজীবীরা ডাক্তারের সার্টিফিকেট দেখিয়ে বলতে পারবেন, রনি সুস্থ মস্তিষ্কে গুলি করেননি! এই বেলা রনির পথ ধরতে পারেন তারেক সাঈদের মতো অভিযুক্তরা। তাঁরও উচিত কোমর বা নাক-টাকের অসুখের কাহিনি না সাজিয়ে সরাসরি ‘পাগল’ সেজে থাকা। পাগল বলেই তো ‘ভিআইপি কেবিনের সামনে খোশগল্প করতে করতে রনি বলে ফেলেন, ‘আমার মা পিনু খান এমপি ও মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক। বাবাও এমপি ছিলেন। আমিও একজন সিআইপি। আমার নাম বখতিয়ার আলম রনি, আওয়ামী লীগের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ও একটি ব্যবসায়ী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। অথচ ডিবি পুলিশ আমাকে ইস্কাটনের জোড়া খুনের মামলায় ফাঁসিয়ে দিল। শিগগিরই আমার জামিন হবে।’ (প্রথম আলো , ২৭ ফেব্রুয়ারি) পাগল বটে, ক্ষমতার পাগল।
গত বছরের অক্টোবরে গুলশানের রাস্তায় বেপরোয়া রেসিং কারের ধাক্কায় রিকশাযাত্রী মায়ের কোলে থাকা এক কচি শিশু মরে যায়। ঘটনার আট দিন পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে পুলিশ একটা মামলা করে বটে। পরে জানা যায়, নিহত শিশুর পরিবার মামলাটি তুলে নেয়। কেন তুলে নেয়, কিসের বিনিময়ে তুলে নেয়, তা আর জানা যায় না। যা-হোক, আইনগতভাবে বিষয়টির মীমাংসা হয়ে যাওয়ার পর আমরা বলতে পারি, আসলে রেসিং কারটি কেউ চালাচ্ছিল না, আর ওটার আঘাতে সেদিন কেউই খুন হয়নি। আশা করি, অচিরেই আমরা জানতে পারব, তারেক ও রনিও পাগলামির বশে অপরাধ করে ফেলেছেন। তাঁরা কারও মৃত্যুর জন্য সরাসরি দায়ী নন। যাঁরা মরেছেন, তাঁদেরই আসলে কপাল খারাপ। আসলে ওই তিনটি ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা মৃত বটে, তবে হত্যার শিকার নন। কেউ তাঁদের হত্যা করেনি! পত্রিকাগুলো সব মিথ্যা লিখেছে! এ জন্য সাংবাদিকদের শাস্তি হোক আর আসামিদের রাখা হোক জামাই-আদরে।
সর্বশেষ, আদালতে তারেক সাঈদ, র্যাবের আরও দুই কর্মকর্তাসহ ২৩ আসামির উপস্থিতিতে সাক্ষ্যগ্রহণের সময় এজলাসকক্ষ থেকে সাংবাদিকদের বের করে দেওয়া হয়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি তাই যাহা আসে কই মুখে’। আমাদের মনে হয়, দেখে শুনে চুপিয়া যাওয়াই ভালো। তার পরও চলচ্চিত্রকার ঋতিক ঘটকের সুবর্ণরেখার সেই খ্যাপাটে চরিত্রের কথা মনে আসে, ঘুলঘুলি দিয়ে মুখ বাড়িয়ে যে বলেছিল, ‘আমি কিন্তু সব দ্যাখতাছি’।
গত বছরের ১৩ এপ্রিল নেশাগ্রস্ত রনির এলোপাতাড়ি গুলিতে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁরা মামুলি লোক। একজন চালান রিকশা, আরেকজন অটো। আর নারায়ণগঞ্জের যে সাত হতভাগ্যের মৃত্যুর জন্য তারেক সাঈদের বিচার হওয়ার কথা, তাঁরাও কেউকেটা কেউ নন। সবাইকে সমান চোখে দেখা ঠিক না। নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্নার মতো ব্যক্তিকে বিনা বিচারে মাসের পর মাস আটকে রাখা যেতে পারে। মারাত্মক অসুস্থ বলে তাঁর পরিবার হা-হুতাশ করলেও কুছ পরোয়া নেহি। হাসপাতাল তাঁর জন্য নয়। হাতের পাঁচ আঙুল যদি এক সমান না হয়, তাহলে যে হাতে খুন করা হয় আর যে হাতে কলম ধরা হয়, তা কেমন করে সমান হবে? সব আসামিরই তো আর মেরুদণ্ডে সমস্যা নেই।
কী সুন্দর মিল তারেক আর রনি সাহেবের। দুজনেই মেরুদণ্ডের ব্যথার দোহাই দিয়ে হাসপাতালস্থ হয়েছেন। অবশ্য বাংলাদেশে এখন মেরুদণ্ড থাকাটাই এক বিরাট সমস্যা। ব্যথা না হলে কি করে আমরা জানতাম যে তারেক ও রনিরও মেরুদণ্ড আছে এবং সেখানে ব্যথা হয়।
কিন্তু চিন্তার কারণটা অন্য জায়গায়। আসামিদ্বয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। একজন ক্ষমতাশালী এক রাজনৈতিক নেতার জামাই, অন্যজন সাংসদের পুত্র। দফায় দফায় তাঁরা সরকারি হাসপাতালে এসে থাকছেন, ঘুমাচ্ছেন। তাহলেও তাঁদের আসল অসুখটাই এখনো শনাক্ত করতে পারছেন না ডাক্তাররা। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারাধ্যক্ষ মো. নেছার আলম প্রথম আলোকে বলেন, অর্থোপেডিক সমস্যার কারণে বখতিয়ার রনিকে গত ৩১ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। অথচ তিনি কিনা ভর্তি আছেন মেডিসিন বিভাগের অধীনে। ওদিকে তাঁর তত্ত্বাবধানকারী মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এস এম হাফিজ বলছেন, বখতিয়ারের সমস্যা আসলে কিডনিতে। সেটাই সই, কিডনির চিকিৎসাই হোক! তা না, তাঁকে দেওয়া হচ্ছে সাইকোথেরাপি। মুনের সুখের জন্য সাইকোথেরাপি খারাপ না। তবে বিচার শুরু হওয়ার আগে আগেই তাঁকে মানসিক রোগী বানানোর কৌশলটা দারুণ। এখন ডাক্তাররা যদি সার্টিফিকেট দিয়ে দেন, রনি মানসিকভাবে অসুস্থ, তাহলেই তো কেল্লা ফতে। পাগলের গুলিতে জোড়া হত্যার মামলা তাহলে হালকা হয়ে যায়। রনির আইনজীবীরা ডাক্তারের সার্টিফিকেট দেখিয়ে বলতে পারবেন, রনি সুস্থ মস্তিষ্কে গুলি করেননি! এই বেলা রনির পথ ধরতে পারেন তারেক সাঈদের মতো অভিযুক্তরা। তাঁরও উচিত কোমর বা নাক-টাকের অসুখের কাহিনি না সাজিয়ে সরাসরি ‘পাগল’ সেজে থাকা। পাগল বলেই তো ‘ভিআইপি কেবিনের সামনে খোশগল্প করতে করতে রনি বলে ফেলেন, ‘আমার মা পিনু খান এমপি ও মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক। বাবাও এমপি ছিলেন। আমিও একজন সিআইপি। আমার নাম বখতিয়ার আলম রনি, আওয়ামী লীগের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ও একটি ব্যবসায়ী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। অথচ ডিবি পুলিশ আমাকে ইস্কাটনের জোড়া খুনের মামলায় ফাঁসিয়ে দিল। শিগগিরই আমার জামিন হবে।’ (প্রথম আলো , ২৭ ফেব্রুয়ারি) পাগল বটে, ক্ষমতার পাগল।
গত বছরের অক্টোবরে গুলশানের রাস্তায় বেপরোয়া রেসিং কারের ধাক্কায় রিকশাযাত্রী মায়ের কোলে থাকা এক কচি শিশু মরে যায়। ঘটনার আট দিন পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে পুলিশ একটা মামলা করে বটে। পরে জানা যায়, নিহত শিশুর পরিবার মামলাটি তুলে নেয়। কেন তুলে নেয়, কিসের বিনিময়ে তুলে নেয়, তা আর জানা যায় না। যা-হোক, আইনগতভাবে বিষয়টির মীমাংসা হয়ে যাওয়ার পর আমরা বলতে পারি, আসলে রেসিং কারটি কেউ চালাচ্ছিল না, আর ওটার আঘাতে সেদিন কেউই খুন হয়নি। আশা করি, অচিরেই আমরা জানতে পারব, তারেক ও রনিও পাগলামির বশে অপরাধ করে ফেলেছেন। তাঁরা কারও মৃত্যুর জন্য সরাসরি দায়ী নন। যাঁরা মরেছেন, তাঁদেরই আসলে কপাল খারাপ। আসলে ওই তিনটি ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা মৃত বটে, তবে হত্যার শিকার নন। কেউ তাঁদের হত্যা করেনি! পত্রিকাগুলো সব মিথ্যা লিখেছে! এ জন্য সাংবাদিকদের শাস্তি হোক আর আসামিদের রাখা হোক জামাই-আদরে।
সর্বশেষ, আদালতে তারেক সাঈদ, র্যাবের আরও দুই কর্মকর্তাসহ ২৩ আসামির উপস্থিতিতে সাক্ষ্যগ্রহণের সময় এজলাসকক্ষ থেকে সাংবাদিকদের বের করে দেওয়া হয়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি তাই যাহা আসে কই মুখে’। আমাদের মনে হয়, দেখে শুনে চুপিয়া যাওয়াই ভালো। তার পরও চলচ্চিত্রকার ঋতিক ঘটকের সুবর্ণরেখার সেই খ্যাপাটে চরিত্রের কথা মনে আসে, ঘুলঘুলি দিয়ে মুখ বাড়িয়ে যে বলেছিল, ‘আমি কিন্তু সব দ্যাখতাছি’।
No comments