উচ্ছেদের নামে দেদার বাণিজ্য by দীন ইসলাম ও রুদ্র মিজান
উচ্ছেদ
অভিযানের নামে দেদার বাণিজ্যে নেমেছেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ
(রাজউক)-এর কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। এসব বাণিজ্যে নেতৃত্ব দিচ্ছেন
অথরাইজড অফিসাররা। তাদের হয়ে কিছু কর্মচারী ভয়ভীতি দেখানোর কাজ করছেন। এরই
মধ্যে উচ্ছেদ টিমের কিছু সদস্যের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে সিন্ডিকেট। তারাই
সবকিছু ম্যানেজ করছে। এসব অপকর্মে মোবাইল কোর্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী
ম্যাজিস্ট্রেটরা মৌন সম্মতি দিচ্ছেন বলে জোরালো অভিযোগ রয়েছে। কারণ অবৈধ
লেনদেনের বিষয়টি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা জেনেও কিছু বলছেন না। এ সুযোগটি
কাজে লাগাচ্ছেন রাজউকের অথরাইজড শাখার কর্মকর্তারা। গতকাল সরজমিন গুলশান ও
গ্রীন রোড এলাকায় রাজউকের উচ্ছেদ অভিযান প্রত্যক্ষ করে নানা অভিযোগের
সত্যতা মিলেছে। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান জিএম জয়নাল
আবেদীন ভূঁইয়া মানবজমিনকে বলেন, উচ্ছেদ অভিযান সরকারের বিভিন্ন মহলে
প্রশংসিত হচ্ছে। এটা নিয়ে বাণিজ্য মেনে নেয়া হবে না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ
নিয়ে আসলে ব্যবস্থা নিতে সুবিধা হবে। দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া
হবে। রাজউক সূত্রে জানা গেছে, আবাসিক ভবন ও কার পার্কিংয়ের বাণিজ্যিক
ব্যবহার বন্ধ এবং ফুটপাথের অবৈধ র্যাম্প অপসারণ করতে অভিযান পরিচালনা করছে
রাজউক। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে শুরু হওয়া এ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে
ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, উত্তরা ও বারিধারা আবাসিক এলাকায়। এরই মধ্যে এসব
এলাকার ভবন মালিকদের নানা কায়দা-কানুনের মাধ্যমে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। অনেক
ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানার অর্থ বাবদ দেড় লাখ টাকা
ঘোষণা করলেও ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে তা ৫০ হাজার টাকা হয়ে যাচ্ছে। বিনিময়ে
এক্সট্রা ৫০ হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এক ভবন মালিক মানবজমিন প্রতিনিধিকে
জানান, দেড় লাখ টাকা জরিমানা ঘোষণার পর ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দেয়ার
বিষয়টি এন্ট্রি করা হয়েছে। বাকি ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দেয়ার পর ৫০ হাজার টাকা
মাফ করে দেয়া হয়। এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। এটা ধরবে কারা। যারা উচ্ছেদ
অভিযানের সঙ্গে যুক্ত তারা এ কাজ করলে কার কি বলার আছে? তবে অভিযান
পরিচালনাকারী কর্মকর্তাদের কাছে উচ্ছেদের বিষয়ে জানতে গেলে সহাস্যে বলা হয়,
বিশেষ অভিযান বন্ধ করতে বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল থেকে তাদের হুমকি-ধমকি
দেয়া হচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে ব্যবহার করে হয়রানি করার হুমকিও দেয়া
হচ্ছে। আমরা আমাদের কাজ করে যেতে চাই। কিন্তু নানামুখী বাধায় দ্বিধান্বিত
হয়ে পড়ি। গতকাল সরজমিন গ্রীন রোডে পরিচালিত উচ্ছেদ অভিযানে গিয়ে দেখা যায়,
আনন্দ সিনেমা হলের পাশে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছে রাজউকের একটি টিম। এ
উচ্ছেদ অভিযানের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন মো. নাসির উদ্দিন এবং
অথরাইজড অফিসার শফিউল হান্নান। এদিন দুপুরের পর কয়েকটি কোচিং সেন্টার ও ভবন
মালিকদের সঙ্গে দেন- দরবার করতে দেখা যায় অথরাইজড অফিসারকে। মোবাইল
কোর্টের এক কর্মকর্তা জানান, অনেকটা মুখ চিনে দফা-রফার মাধ্যমে জরিমানার
অর্থ আদায় করছেন তারা। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার কে আছে? এদিকে উচ্ছেদ
অভিযানকালে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে রাজউকের কিছু কর্মকর্তাকে
কানাঘুষা করতে শোনা যায়। উচ্ছেদ অভিযানে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা
জানান, শফিউল হান্নান নিজেই একা সবকিছু দেখভাল করছেন। নিজের বিরুদ্ধে আনা
অভিযোগ অস্বীকার করে শফিউল হান্নান মানবজমিনকে বলেন, উচ্ছেদ অভিযান নিয়ে
প্রশ্ন ওঠার কোনো সুযোগ নেই। আমরা সবকিছু স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্নভাবে করছি।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের তালিকায় রয়েছে
বার, গেস্টহাউস, বেসরকারি কমিউনিটি সেন্টার, ফিটনেস সেন্টার, স্পা, বিউটি
পারলার, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ক্লিনিক, কলেজ, কোচিং সেন্টার ও বুটিকের
দোকান। এ ছাড়া, আবাসিক এলাকার কোনো প্লটে কেউ যদি বেসমেন্ট বা ভূতলের গাড়ি
পার্কিংয়ের জায়গা বন্ধ রাখেন বা বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করেন, সেগুলোও
উচ্ছেদ করার কথা রয়েছে। আদতে গ্রীন রোড এলাকায় এসব স্থাপনা উচ্ছেদ করা
হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রীন রোড এলাকায় পরিচালিত উচ্ছেদ অভিযানের
স্পটগুলো ঠিকভাবে তদন্ত করলে থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়বে। এদিকে গতকাল রাজধানীর
গুলশানে অভিযান চালিয়ে অর্ধশতাধিক দোকান উচ্ছেদ করেছে রাজউকের ভ্রাম্যমাণ
আদালত। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এই অভিযান চালানো হয়। ফুটপাথ
দখল করে এবং ভবনের নকশায় পার্কিংয়ের অনুমোদন নিয়ে সেই জায়গায় অবৈধভাবে
দোকান গড়ে তোলায় তা উচ্ছেদ করা হয়। তবে উচ্ছেদ চলাকালীন ম্যাজিস্ট্রেটকে
নানা তদবিরের সম্মুখীন হতে হয়। এক পর্যায়ে গতি কমে যায় উচ্ছেদের। শেষ
পর্যন্ত নামকাওয়াস্তে ভাঙ্গা হয় ওই মার্কেটের উত্তর পাশের দোকানগুলো।
সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গুলশান-১ মোড়ে অবস্থান নেয়
রাজউকের এস্কেভেটর-২। কিছু সময় পরেই সেখানে জড়ো হন রাজউকের নির্বাহী
ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবদুল হামিদ মিয়াসহ অন্তত ১০ পুলিশ সদস্য। গুলশান
এভিনিউ’র গুলশান শপিং কমপ্লেক্সের দক্ষিণ পাশে অবস্থান নেন তারা। অবস্থান
দেখেই স্থানীয়রা বুঝতে পারেন ওই শপিং কমপ্লেক্সেই চলবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের
অভিযান। ওই সময়ে ম্যাপ দেখে এস্কেভেটর চালকসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন
ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল হামিদ মিয়া। ততক্ষণে আশপাশের লোকজন জড়ো হন সেখানে।
দোকান থেকে প্রয়োজনীয় মালামাল সরাতে ব্যবসায়ীদের আধা ঘণ্টা সময় দেন
ম্যাজিস্ট্রেট। অল্প সময়েই মধ্যেই মার্কেটের দক্ষিণ পাশের ব্যবসায়ীরা তাদের
দোকানের মালামাল গুছিয়ে শাটার বন্ধ করে দেন। এভাবে পুরো মার্কেটের নিচ
তলার মালামাল গুছিয়ে শাটার বন্ধ করতে থাকেন ব্যবসায়ীরা। এরমধ্যেই শুরু হয়
রাজউকের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান। এস্কেভেটর চালিয়ে মার্কেটের স্থাপনার
অন্তত এক ফিট করে ভাঙা হয়। এছাড়া, বাইরে বিভিন্ন কৌশলে নিচ পাকা করে আরও আট
থেকে নয় ফিট দখল করে রেখেছে ওই মার্কেট। এ বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল
হামিদ মিয়া জানান, তিন দিকেই প্রায় ১০ ফিট করে ফুটপাথের জায়গা দখল করে
মার্কেটটি নির্মাণ করা হয়েছে। এমনকি ভবনের নকশায় পার্কিংয়ের অনুমোদন নিয়ে
সেই জায়গায় অবৈধভাবে দোকান গড়ে তোলা হয়েছে বলে জানান তিনি। অভিযানের শুরুতে
গ্রান্ড ইলেকট্রনিক্স মার্ট, রাসেল এন্টারপ্রাইজ, এসএস ক্রোকারিজসহ প্রায়
১৫-২০টি দোকানের সাইনবোর্ড ও শাটার কেটে দেয় এস্কেভেটর। ভাঙ্গা হয়
মার্কেটের পিলার, উপরের কার্নিশ ও নিচের পাকা ফ্লোর। কিছু সময়ের মধ্যেই
তদবির আসতে থাকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। মার্কেট সমিতির নেতৃবৃন্দ ঘিরে ধরেন
তাকে। তারা অন্তত দুই দিনের সময় চান। সাখাওয়াত নামে এক ব্যবসায়ী নেতাকে
বারবার তদবির করতে দেখা গেছে। তখন দক্ষিণ পাশে অভিযান শেষে উত্তরদিকে
অভিযান শুরু হচ্ছে। কয়েক ব্যবসায়ী নেতা ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে যান মার্কেটের
দক্ষিণ পাশে। অনেকটা আড়ালে। কিছুক্ষণ পরেই অভিযানের দৃশ্যপট পাল্টে যায়।
আগের তুলনায় ভাঙ্গার গতি কমে যায়। নামকাওয়াস্তে এস্কেভেটর চালাতে দেখা যায়
এর চালককে। ব্যবসায়ী নেতাদের জটলাও তখন কমতে থাকে। বেলা পৌনে ৩টার দিকে
গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে অন্তত
২০ পুলিশ সদস্য অবস্থান নেন সেখানে। জড়ো হওয়া লোকজনকে সরিয়ে দিচ্ছিলেন
পুলিশ সদস্যরা। অভিযানের শুরু থেকেই গুলশান মোড়ের ওই মার্কেট সংলগ্ন সড়কে
যানজটের সৃষ্টি হয়। বেলা ৩টার দিকে অভিযানের গতি কমে যাওয়া ও কম ভাঙ্গনের
কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল হামিদ মিয়া জানান,
ব্যবসায়ীদের অনুরোধে শাটার ও দোকানের মালামাল যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এ
জন্য সাবধানে ভাঙ্গা হচ্ছে। তবে অবৈধভাবে দখল করা স্থান তারা নিজেরাই ছেড়ে
দিবেন বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। সর্বশেষ বেলা ৫টার দিকে অভিযান শেষ করার
পর ম্যাজিস্ট্রেট জানান, অবৈধভাবে দখল করা ফুটপাথ নিজেরা ছেড়ে দেবেন মর্মে
মার্কেট কর্তৃপক্ষ মুচলেকা দিয়েছেন। গুলশান শপিং কমপ্লেক্সের মালিকের পক্ষে
এতে স্বাক্ষর করেছেন ব্যবস্থাপক শঙ্কর দত্ত। এতে উল্লেখ করা হয়েছে ১৫
দিনের মধ্যে অবৈধভাবে দখলে থাকা ফুটপাথের জায়গা ছেড়ে দেয়া হবে। রাজউকের
ভ্রাম্যমাণ আদালতের এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন রাজউকের অথরাইজড অফিসার
আদিলুজ্জামান।
No comments