ছি ছি এত্তা জঞ্জাল! by হাসান ফেরদৌস
যুক্তরাষ্ট্র
নিজেকে গণতন্ত্রের মহা পূজারি হিসেবে দাবি করলেও নির্বাচনের নামে এ দেশে
যে কাণ্ড হচ্ছে, তা দেখে নাকে রুমাল চেপে ধরা ছাড়া অন্য পথ আছে বলে মনে হয়
না। ২০১৬ সালে এ দেশের মানুষ তাঁদের নতুন প্রেসিডেন্ট ও আইনসভার সদস্যদের
নির্বাচন করবেন। এখন চলছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ের
নির্বাচন বা প্রাইমারি।
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই নির্বাচনে দলের প্রার্থী কে হবেন, সে সিদ্ধান্ত নেন সে দলের হর্তাকর্তারাই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে সে সিদ্ধান্ত নেন দলের সাধারণ সমর্থক ও সদস্যরা। পুরোদস্তুর এক নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁরাই ঠিক করে দেন শেষ পর্যন্ত ব্যালটে কার নাম উঠবে।
উদ্দেশ্যের সাধুতা নিয়ে প্রশ্ন নেই, ব্যাপারটা যে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক, সে ব্যাপারেও তর্ক নেই। কিন্তু যে কায়দায় বিভিন্ন প্রার্থী এই প্রাক্-নির্বাচনী বাছাইপর্বের পুলসিরাত পার হতে গিয়ে একে অপরকে কুপোকাত করতে কোমর বেঁধে নেমেছেন, তা দেখে বলতে হয়, ছেড়ে দে ভাই, কেঁদে বাঁচি। এই কাজ করতে গিয়ে কী পরিমাণ অর্থের শ্রাদ্ধ হচ্ছে, সে আরেক কেলেঙ্কারি।
প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য রিপাবলিকান পার্টির যেসব প্রার্থী প্রাইমারি পর্যায়ে লড়ছেন, তাঁদের কথাটাই ধরি। এমনিতে রিপাবলিকানদের সুনাম আছে, কাদা-ছোড়াছুড়িতে তাঁরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। একে অপরের সম্বন্ধে ডাহা মিথ্যা কথা বলতে তাঁদের কারোর চোখের পাতাটি পর্যন্ত কাঁপে না। এবার যাঁরা প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দলের মনোনয়ন চাইছেন, তাঁদের কথাই ধরা যাক। পালের গোদা ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে ছাড়া বাকি সবাইকে মিথ্যুক ও জোচ্চোর বলে সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছেন। আরেক প্রার্থী টেড ক্রুজ অনবরত বাইবেল জপে যাচ্ছেন, কিন্তু বাড়তি দু-চারটে ভোটের আশায় জলজ্যান্ত মিথ্যা বলতে তাঁর বাধে না। এঁদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত তরুণ মার্কো রুবিও নিজেকে সবার ত্রাতা প্রমাণ করতে নিজের জীবনবৃত্তান্তে সত্য-মিথ্যার এমন পলেস্তারা লাগিয়ে চলেছেন যে কোনটা সত্য আর কোনটা কল্পনা, ভোটারদের তা বোঝা অসম্ভব। উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানো যাক।
অভিযোগ উঠেছে, আইওয়া অঙ্গরাজ্যে প্রথম নির্বাচনে টেক্সাসের সিনেটর টেড ক্রুজ যে জিতেছিলেন, তার অন্যতম কারণ তাঁর নির্বাচনী কমিটির পক্ষ থেকে ই-মেইল ও টেলিফোন করে জানানো হয়, শল্যচিকিৎসক বেন কারসন প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। যেহেতু তিনি আর নির্বাচনে থাকছেন না, তাহলে কারসনকে ভোট দিয়ে কী লাভ? তার চেয়ে বরং আপনার মূল্যবান ভোটটি টেড ক্রুজের বাক্সেই ফেলুন। অথচ কারসন কখনোই বলেননি তিনি নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর ক্রুজের এই গোপন চালাকিটি প্রকাশিত হয়। আর তাতে ট্রাম্প মহা হুলুস্থুল বাধিয়ে দেন। নির্বাচনে অল্প ব্যবধানে তিনি প্রত্যাশিত প্রথম স্থানের বদলে দ্বিতীয় স্থান দখল করেন। সাংবাদিকদের ডেকে তিনি ঘোষণা দিলেন, টেডের নামে তিনি মামলা করবেন। কারণ, তিনি জালিয়াতি করে নির্বাচনে জিতেছেন। বেন কারসনও টেডের বিরুদ্ধে তাঁর উষ্মা প্রকাশ করতে বিলম্ব করলেন না। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে নিজের অপরাধ স্বীকার করে মাফ চাইতে বাধ্য হন ক্রুজ।
নেভাডা অঙ্গরাজ্যে রিপাবলিকান ককাসের আগে টেড ক্রুজের নির্বাচনী কমিটি থেকে আরেক কাণ্ড করা হলো। তাঁর পক্ষ থেকে প্রচারিত এক ভিডিও বিজ্ঞাপনে দেখানো হলো, সিনেটর রুবিও মন্তব্য করছেন, বাইবেলে সব প্রশ্নের জবাব নেই। ইভানজেলিক্যালদের ভোটের জন্য এই দলের সব প্রার্থী বগলে বাইবেল নিয়ে ঘুরছেন। সেখানে সেই বাইবেল নিয়ে এমন মন্তব্য? দেখা গেল রুবিও সে কথা তো বলেননি, বরং বলেছেন ঠিক উল্টো কথা। ঘটনাটা এই রকম। হোটেলের লবিতে বাইবেল হাতে বসেছিলেন টেড ক্রুজের ধর্মযাজক পিতা ও তাঁর কমিটির এক কর্মী। সে সময় তাঁদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন সিনেটর রুবিও। তাঁদের দুজনের হাতে বাইবেল দেখে রুবিও বললেন, খুব ভালো বই, এই বইতেই সব প্রশ্নের জবাব রয়েছে। আসল ভিডিও দেখিয়ে যখন বলা হলো ক্রুজ ও তাঁর সমর্থকেরা মিথ্যাচার করছেন, তখন তিনি সব দোষ চাপালেন তাঁর নিজের প্রধান মুখপাত্র রিক টেইলরের ওপর—রীতিমতো লোকজন ডেকে তাঁকে বরখাস্ত করার কথা ঘোষণা করলেন। ততক্ষণে অবশ্য ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। রুবিও জানালেন, এই লোকটা আগাগোড়া নিজের ও অন্যের ব্যাপারে মিথ্যা বলে যাচ্ছে, সে জন্য বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। ট্রাম্প বললেন আরও শক্ত কথা, ‘এই লোককে মিথ্যা বলায় কেউ ঠকাতে পারবে না।’
নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা যে একে অপরের বিরুদ্ধে মিথ্যা বলবেন, সে ব্যাপারটা এ দেশে এত পরিচিত যে সাউথ ক্যারোলাইনার একটি দৈনিক চার্লস্টন পোস্ট সেখানে প্রাইমারি ভোটের আগে ‘হুইস্পার ক্যাম্পেইন’ নামে এক বিশেষ ডিজিটাল সাইট চালু করে। যেকোনো ভোটার সেখানে গিয়ে দেখে নিতে পারেন কোন প্রার্থী কার বিরুদ্ধে কী মিথ্যাচার করছেন। মিথ্যাচারের জন্য সবচেয়ে পরিচিত ও পরীক্ষিত পদ্ধতি হলো ‘রোবোকল’ বা স্বয়ংক্রিয় টেলিফোন বার্তা। যাঁরা ভোটের ব্যাপারে এখনো তাঁদের সিদ্ধান্ত নেননি, তাঁদের আলাদা করে বাছাই করে প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রার্থীর নামে টেলিফোনে ডাহা মিথ্যা কথা বলে তাঁর মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেওয়া এই ‘রোবোকল’-এর উদ্দেশ্য।
এ রকম মিথ্যা প্রচারে যে কাজ হয়, তার সেরা প্রমাণ সিনেটর জন ম্যাককেইন। ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ। নিউ হ্যাম্পশায়ারের প্রাইমারিতে জয়লাভ করায় সবাই ধরে নিয়েছিল সাউথ ক্যারোলাইনার প্রাইমারিতেও ম্যাককেইন জিতবেন। ঠিক শেষ মুহূর্তে এক মোক্ষম চাল দিলেন বুশের প্রধান পরামর্শদাতা কার্ল রোভ। তিনি গুজব ছড়ালেন যে ম্যাককেইনের একটি কৃষ্ণাঙ্গ অবৈধ কন্যাসন্তান রয়েছে। রাজ্যের লাখ লাখ মানুষের মধ্যে বেনামি টেলিফোন বার্তায় সে গুজব রটিয়ে দেওয়া হলো। গুজবটি খুব চালাকির সঙ্গে ছড়ানো হয়েছিল। টেলিফোন করে ভোটারদের অতি নিরীহভাবে জিজ্ঞেস করা হতো, ‘আপনি যদি জানতে পারেন যে জন ম্যাককেইনের একটি অবৈধ কন্যাসন্তান রয়েছে, তারপরেও কি আপনি তাঁকে ভোট দেবেন?’
যে অবৈধ কন্যাসন্তানের কথা বলা হচ্ছে, তাঁর নাম ব্রিজেট। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের এক অনাথ আশ্রম থেকে মেয়েটিকে দত্তক নিয়ে এসেছিলেন ম্যাককেইন দম্পতি। সম্পূর্ণ মিথ্যা সেই রটনার জোরে সাউথ ক্যারোলাইনার প্রাইমারি জিতে নেন জর্জ বুশ। সেবার এই পরাজয়ের ধাক্কা ম্যাককেইন আর সামলে উঠতে পারেননি। সেই থেকেই সাউথ ক্যারোলাইনার পরিচয় রিপাবলিকানদের ‘নোংরা প্রচারণার স্বর্গ’ হিসেবে।
এখন সমস্যা হবে প্রকৃত নির্বাচনের সময় ভোটের ফলাফল পাল্টে দেওয়ার জন্য যদি কোনো নোংরা চাল চালা হয়। রিপাবলিকানদের ঝুলিতে তেমন ‘সিক্স’-এর অভাব নেই। ২০০৮ ও ২০১২ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী বারাক ওবামাকে ঠেকানোর জন্য তাঁর ‘ভোট ব্যাংক’ নামে পরিচিত আফ্রিকান-আমেরিকান ও হিস্পানিক ভোটারদের লক্ষ্য করে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র করা হয়। তিনি মুসলমান—সে মিথ্যা প্রচার ও ‘রোবোকল’ তো ছিলই। এ ছাড়া যা করা হয়, তার মধ্যে ছিল বাসায় বাসায় প্রচারপত্র বিলি করে ভোটের মিথ্যা তারিখ ও সময় জানানো। এমনকি কোথায় ভোট গ্রহণ হচ্ছে, মিথ্যা ঠিকানা দিয়ে মানুষের ঘরে ঘরে জানিয়ে আসা হয়। এ ঘটনা ঘটে মূলত গ্রামাঞ্চলে, অপেক্ষাকৃত দরিদ্র এলাকায় ও পরিণত বয়সের ভোটারদের বেলায়, যাঁদের পক্ষে সে সত্য যাচাই সব সময় সম্ভব হয় না।
ব্যাপারটা যে মোটেই হাসি-ঠাট্টার নয়, সে কথা বোঝাতে কমেডিয়ান টারাড্যাকটিল (টারা ডেভলিন) একটি ওয়েবসাইট চালু করেছেন, যার নাম ‘রিপাবলিকান ডার্টি ট্রিকস’। হাসিঠাট্টার মধ্য দিয়েই টারা এই ওয়েবসাইটে খুব ভালো করে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে নির্বাচনের সময় এ দেশের রক্ষণশীল রাজনীতিকেরা, যাঁরা ঈশ্বরের নাম ও পারিবারিক মূল্যবোধের কথা বলতে গিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, তাঁরা কীভাবে সাধারণ ভোটারদের ঠকাতে আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছেন।
মূল নির্বাচন হতে এখনো অনেক দেরি। আশার কথা হচ্ছে, রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট, যে পক্ষ থেকেই শঠতা বা মিথ্যাচারের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে, তাদের খপ করে ধরে ফেলার জন্য এখন বিস্তর সচেতন মানুষ জেগে রয়েছেন—টারাড্যাকটিল তাঁদের একজন। গণতন্ত্রের জন্য সেটাই আশার কথা, কারণ গণতন্ত্র আর যা-ই হোক, গ্যালারিতে নিরাপদ দূরত্বে বসে উপভোগ করার মতো কোনো খেলা নয়।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই নির্বাচনে দলের প্রার্থী কে হবেন, সে সিদ্ধান্ত নেন সে দলের হর্তাকর্তারাই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে সে সিদ্ধান্ত নেন দলের সাধারণ সমর্থক ও সদস্যরা। পুরোদস্তুর এক নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁরাই ঠিক করে দেন শেষ পর্যন্ত ব্যালটে কার নাম উঠবে।
উদ্দেশ্যের সাধুতা নিয়ে প্রশ্ন নেই, ব্যাপারটা যে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক, সে ব্যাপারেও তর্ক নেই। কিন্তু যে কায়দায় বিভিন্ন প্রার্থী এই প্রাক্-নির্বাচনী বাছাইপর্বের পুলসিরাত পার হতে গিয়ে একে অপরকে কুপোকাত করতে কোমর বেঁধে নেমেছেন, তা দেখে বলতে হয়, ছেড়ে দে ভাই, কেঁদে বাঁচি। এই কাজ করতে গিয়ে কী পরিমাণ অর্থের শ্রাদ্ধ হচ্ছে, সে আরেক কেলেঙ্কারি।
প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য রিপাবলিকান পার্টির যেসব প্রার্থী প্রাইমারি পর্যায়ে লড়ছেন, তাঁদের কথাটাই ধরি। এমনিতে রিপাবলিকানদের সুনাম আছে, কাদা-ছোড়াছুড়িতে তাঁরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। একে অপরের সম্বন্ধে ডাহা মিথ্যা কথা বলতে তাঁদের কারোর চোখের পাতাটি পর্যন্ত কাঁপে না। এবার যাঁরা প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দলের মনোনয়ন চাইছেন, তাঁদের কথাই ধরা যাক। পালের গোদা ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে ছাড়া বাকি সবাইকে মিথ্যুক ও জোচ্চোর বলে সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছেন। আরেক প্রার্থী টেড ক্রুজ অনবরত বাইবেল জপে যাচ্ছেন, কিন্তু বাড়তি দু-চারটে ভোটের আশায় জলজ্যান্ত মিথ্যা বলতে তাঁর বাধে না। এঁদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত তরুণ মার্কো রুবিও নিজেকে সবার ত্রাতা প্রমাণ করতে নিজের জীবনবৃত্তান্তে সত্য-মিথ্যার এমন পলেস্তারা লাগিয়ে চলেছেন যে কোনটা সত্য আর কোনটা কল্পনা, ভোটারদের তা বোঝা অসম্ভব। উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানো যাক।
অভিযোগ উঠেছে, আইওয়া অঙ্গরাজ্যে প্রথম নির্বাচনে টেক্সাসের সিনেটর টেড ক্রুজ যে জিতেছিলেন, তার অন্যতম কারণ তাঁর নির্বাচনী কমিটির পক্ষ থেকে ই-মেইল ও টেলিফোন করে জানানো হয়, শল্যচিকিৎসক বেন কারসন প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। যেহেতু তিনি আর নির্বাচনে থাকছেন না, তাহলে কারসনকে ভোট দিয়ে কী লাভ? তার চেয়ে বরং আপনার মূল্যবান ভোটটি টেড ক্রুজের বাক্সেই ফেলুন। অথচ কারসন কখনোই বলেননি তিনি নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর ক্রুজের এই গোপন চালাকিটি প্রকাশিত হয়। আর তাতে ট্রাম্প মহা হুলুস্থুল বাধিয়ে দেন। নির্বাচনে অল্প ব্যবধানে তিনি প্রত্যাশিত প্রথম স্থানের বদলে দ্বিতীয় স্থান দখল করেন। সাংবাদিকদের ডেকে তিনি ঘোষণা দিলেন, টেডের নামে তিনি মামলা করবেন। কারণ, তিনি জালিয়াতি করে নির্বাচনে জিতেছেন। বেন কারসনও টেডের বিরুদ্ধে তাঁর উষ্মা প্রকাশ করতে বিলম্ব করলেন না। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে নিজের অপরাধ স্বীকার করে মাফ চাইতে বাধ্য হন ক্রুজ।
নেভাডা অঙ্গরাজ্যে রিপাবলিকান ককাসের আগে টেড ক্রুজের নির্বাচনী কমিটি থেকে আরেক কাণ্ড করা হলো। তাঁর পক্ষ থেকে প্রচারিত এক ভিডিও বিজ্ঞাপনে দেখানো হলো, সিনেটর রুবিও মন্তব্য করছেন, বাইবেলে সব প্রশ্নের জবাব নেই। ইভানজেলিক্যালদের ভোটের জন্য এই দলের সব প্রার্থী বগলে বাইবেল নিয়ে ঘুরছেন। সেখানে সেই বাইবেল নিয়ে এমন মন্তব্য? দেখা গেল রুবিও সে কথা তো বলেননি, বরং বলেছেন ঠিক উল্টো কথা। ঘটনাটা এই রকম। হোটেলের লবিতে বাইবেল হাতে বসেছিলেন টেড ক্রুজের ধর্মযাজক পিতা ও তাঁর কমিটির এক কর্মী। সে সময় তাঁদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন সিনেটর রুবিও। তাঁদের দুজনের হাতে বাইবেল দেখে রুবিও বললেন, খুব ভালো বই, এই বইতেই সব প্রশ্নের জবাব রয়েছে। আসল ভিডিও দেখিয়ে যখন বলা হলো ক্রুজ ও তাঁর সমর্থকেরা মিথ্যাচার করছেন, তখন তিনি সব দোষ চাপালেন তাঁর নিজের প্রধান মুখপাত্র রিক টেইলরের ওপর—রীতিমতো লোকজন ডেকে তাঁকে বরখাস্ত করার কথা ঘোষণা করলেন। ততক্ষণে অবশ্য ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। রুবিও জানালেন, এই লোকটা আগাগোড়া নিজের ও অন্যের ব্যাপারে মিথ্যা বলে যাচ্ছে, সে জন্য বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। ট্রাম্প বললেন আরও শক্ত কথা, ‘এই লোককে মিথ্যা বলায় কেউ ঠকাতে পারবে না।’
নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা যে একে অপরের বিরুদ্ধে মিথ্যা বলবেন, সে ব্যাপারটা এ দেশে এত পরিচিত যে সাউথ ক্যারোলাইনার একটি দৈনিক চার্লস্টন পোস্ট সেখানে প্রাইমারি ভোটের আগে ‘হুইস্পার ক্যাম্পেইন’ নামে এক বিশেষ ডিজিটাল সাইট চালু করে। যেকোনো ভোটার সেখানে গিয়ে দেখে নিতে পারেন কোন প্রার্থী কার বিরুদ্ধে কী মিথ্যাচার করছেন। মিথ্যাচারের জন্য সবচেয়ে পরিচিত ও পরীক্ষিত পদ্ধতি হলো ‘রোবোকল’ বা স্বয়ংক্রিয় টেলিফোন বার্তা। যাঁরা ভোটের ব্যাপারে এখনো তাঁদের সিদ্ধান্ত নেননি, তাঁদের আলাদা করে বাছাই করে প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রার্থীর নামে টেলিফোনে ডাহা মিথ্যা কথা বলে তাঁর মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেওয়া এই ‘রোবোকল’-এর উদ্দেশ্য।
এ রকম মিথ্যা প্রচারে যে কাজ হয়, তার সেরা প্রমাণ সিনেটর জন ম্যাককেইন। ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ। নিউ হ্যাম্পশায়ারের প্রাইমারিতে জয়লাভ করায় সবাই ধরে নিয়েছিল সাউথ ক্যারোলাইনার প্রাইমারিতেও ম্যাককেইন জিতবেন। ঠিক শেষ মুহূর্তে এক মোক্ষম চাল দিলেন বুশের প্রধান পরামর্শদাতা কার্ল রোভ। তিনি গুজব ছড়ালেন যে ম্যাককেইনের একটি কৃষ্ণাঙ্গ অবৈধ কন্যাসন্তান রয়েছে। রাজ্যের লাখ লাখ মানুষের মধ্যে বেনামি টেলিফোন বার্তায় সে গুজব রটিয়ে দেওয়া হলো। গুজবটি খুব চালাকির সঙ্গে ছড়ানো হয়েছিল। টেলিফোন করে ভোটারদের অতি নিরীহভাবে জিজ্ঞেস করা হতো, ‘আপনি যদি জানতে পারেন যে জন ম্যাককেইনের একটি অবৈধ কন্যাসন্তান রয়েছে, তারপরেও কি আপনি তাঁকে ভোট দেবেন?’
যে অবৈধ কন্যাসন্তানের কথা বলা হচ্ছে, তাঁর নাম ব্রিজেট। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের এক অনাথ আশ্রম থেকে মেয়েটিকে দত্তক নিয়ে এসেছিলেন ম্যাককেইন দম্পতি। সম্পূর্ণ মিথ্যা সেই রটনার জোরে সাউথ ক্যারোলাইনার প্রাইমারি জিতে নেন জর্জ বুশ। সেবার এই পরাজয়ের ধাক্কা ম্যাককেইন আর সামলে উঠতে পারেননি। সেই থেকেই সাউথ ক্যারোলাইনার পরিচয় রিপাবলিকানদের ‘নোংরা প্রচারণার স্বর্গ’ হিসেবে।
এখন সমস্যা হবে প্রকৃত নির্বাচনের সময় ভোটের ফলাফল পাল্টে দেওয়ার জন্য যদি কোনো নোংরা চাল চালা হয়। রিপাবলিকানদের ঝুলিতে তেমন ‘সিক্স’-এর অভাব নেই। ২০০৮ ও ২০১২ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী বারাক ওবামাকে ঠেকানোর জন্য তাঁর ‘ভোট ব্যাংক’ নামে পরিচিত আফ্রিকান-আমেরিকান ও হিস্পানিক ভোটারদের লক্ষ্য করে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র করা হয়। তিনি মুসলমান—সে মিথ্যা প্রচার ও ‘রোবোকল’ তো ছিলই। এ ছাড়া যা করা হয়, তার মধ্যে ছিল বাসায় বাসায় প্রচারপত্র বিলি করে ভোটের মিথ্যা তারিখ ও সময় জানানো। এমনকি কোথায় ভোট গ্রহণ হচ্ছে, মিথ্যা ঠিকানা দিয়ে মানুষের ঘরে ঘরে জানিয়ে আসা হয়। এ ঘটনা ঘটে মূলত গ্রামাঞ্চলে, অপেক্ষাকৃত দরিদ্র এলাকায় ও পরিণত বয়সের ভোটারদের বেলায়, যাঁদের পক্ষে সে সত্য যাচাই সব সময় সম্ভব হয় না।
ব্যাপারটা যে মোটেই হাসি-ঠাট্টার নয়, সে কথা বোঝাতে কমেডিয়ান টারাড্যাকটিল (টারা ডেভলিন) একটি ওয়েবসাইট চালু করেছেন, যার নাম ‘রিপাবলিকান ডার্টি ট্রিকস’। হাসিঠাট্টার মধ্য দিয়েই টারা এই ওয়েবসাইটে খুব ভালো করে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে নির্বাচনের সময় এ দেশের রক্ষণশীল রাজনীতিকেরা, যাঁরা ঈশ্বরের নাম ও পারিবারিক মূল্যবোধের কথা বলতে গিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, তাঁরা কীভাবে সাধারণ ভোটারদের ঠকাতে আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছেন।
মূল নির্বাচন হতে এখনো অনেক দেরি। আশার কথা হচ্ছে, রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট, যে পক্ষ থেকেই শঠতা বা মিথ্যাচারের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে, তাদের খপ করে ধরে ফেলার জন্য এখন বিস্তর সচেতন মানুষ জেগে রয়েছেন—টারাড্যাকটিল তাঁদের একজন। গণতন্ত্রের জন্য সেটাই আশার কথা, কারণ গণতন্ত্র আর যা-ই হোক, গ্যালারিতে নিরাপদ দূরত্বে বসে উপভোগ করার মতো কোনো খেলা নয়।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
No comments