কাকে বলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা! by মিজানুর রহমান খান

মহাত্মা গান্ধী ১৯২২ সালে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায় স্বীকার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এই আদালতের কাছে আমার এটা লুকানোর কিছু নেই যে বিদ্যমান সরকারব্যবস্থার প্রতি আমার বিরাগ প্রকাশ করাটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।’ ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম সরকার বা রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য না করা সত্ত্বেও গতকাল রোববার খবর বেরিয়েছে যে, রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে মামলা করতে চট্টগ্রামের পুলিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চেয়েছে। এ বিষয়ে যে প্রাথমিক আশঙ্কা তৈরি হয়েছে তাতে আমরা সংশয়গ্রস্ত যে আমাদের সমাজ আট শ বছর পেছনের ইঙ্গ-মার্কিন সমাজে ফিরছে কি না।
‘অসত্য খবর’ প্রকাশকে দণ্ডনীয় করে ইংল্যান্ডে ১২৭৫ সালে সেডিশাস লাইবেল বা রাষ্ট্রদ্রোহমূলক মানহানি আইন পাস হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র দুবার এই আইন করে আবার সেগুলো বাতিল করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট অ্যাডামসের কর্তৃত্ববাদী ফেডারেলিস্ট সরকার ১৭৯৮ সালে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন করেছিল। তিনি ও তাঁর সরকার আজকের আমেরিকার দুই প্রধান দল ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান এবং সংবাদপত্রের সমালোচনায় ভীত ছিলেন। বাক্স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণে কংগ্রেস কোনো আইন করতে পারবে না, এটা সংবিধানে লেখা ছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট অ্যাডামস তবু সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে ওই আইন পাস করেছিলেন এবং তাঁর সময় অন্তত ১০ জন সম্পাদক ও লেখক দণ্ডিত হয়েছিলেন। কেউ কেউ দেশান্তরিত হন। ১৯১৮ সালে দুই বছরের মেয়াদে শেষবারের মতো এ রকম আইন দেখেছেন মার্কিনরা। ব্রিটেনে এই আইনের আওতায় সবশেষ বিচার হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। ২০১০ সালে ব্রিটেন আইনটি বাতিলের অন্যতম মুখ্য কারণ হিসেবে যা উল্লেখ করেছিল, তা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য একটি শিক্ষণীয় হয়ে আছে। সেখানে বলা আছে, বিশ্বের বহু দেশ ব্রিটেনে এই আইন আছে—সেই যুক্তি দেখিয়ে নিজের দেশে তা টিকিয়ে রাখে। কিন্তু আসলে তারা এই আইনটি রাজনৈতিক ভিন্নমত দমিয়ে রাখতে ব্যবহার করে থাকে।
দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় মানহানির সংজ্ঞা এবং ৫০০ ধারায় অনধিক দুই বছরের দণ্ড ও অর্থদণ্ড এবং উভয়বিধ দণ্ড প্রদানের বিধান আছে। এটা সবার জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু ৫০১ ও ৫০২ ধারা নির্দিষ্টভাবে সাংবাদিক ও প্রকাশকদের জন্য প্রযোজ্য। এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে বিচারপতি মোস্তাফা কামালের কাছে জানতে চেয়েছিল, এই দুটো বিধান রহিত করা যায় কি না। সাংবাদিকেরা এমন কিছু বহুকাল ধরে দাবি করে চলছিলেন। কিন্তু বিচারপতি মোস্তাফা কামাল তাঁর লিখিত প্রতিবেদনে বললেন, সাংবাদিকের জন্য এক আইন আর নাগরিকের জন্য আরেক আইন, এটা হতে পারে না। কারণ, তাতে ২৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত আইনের সমতার নীতির লঙ্ঘন ঘটে। তবে তিনি এটা লিখেছিলেন যে, ‘সংশ্লিষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত’ ব্যক্তিকেই মানহানির প্রতিকার চাইতে হবে।
কোনো ক্ষতিকর বা অনিষ্টকর বা অশ্লীল বিষয়–সংবলিত কোনো রিপোর্ট বা কোনো পত্রিকা বা সাময়িকীতে লিখন, মুদ্রণ, প্রকাশ, বণ্টন বা বিক্রি ইত্যাদি ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬ ও ১৭ ধারার আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ ছিল, কিন্তু সংবাদপত্রসেবীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালের ১৮ নম্বর আইন দ্বারা তা বাতিল করা হয়েছে। তাই মানহানির প্রতিকারের জন্য দণ্ডবিধি ছাড়া অন্য কোনো সংবিধিবদ্ধ আইন নেই। দেওয়ানি আইনে অবশ্য ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ চাইতে পারেন।
প্রশ্ন হলো কোনো ব্যক্তি কি একই ঘটনায় একই সঙ্গে দুটি আইনের অধীনে মানহানির প্রতিকার চাইতে পারেন? একই অপরাধে কারও দুবার বিচার হবে না। কিন্তু কেউ মানহানির ঘটনায় সিভিল রং বা দেওয়ানি অপকারের প্রতিকার চেয়ে দেওয়ানি আদালতে মোকদ্দমা করতে পারেন। আবার দণ্ডবিধির আওতায় মামলা করতে পারেন। আমাদের আইন কমিশনের অভিমত অনুযায়ী কোনো প্রকৃত সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি তার মানহানির জন্য একসঙ্গে দণ্ডবিধি ও দেওয়ানি উভয় আইনে মামলা করতে পারেন। অ্যাডভেলোরিম ফি বিষয়ে একটি আলাদা আইন আছে। আর সেখানে দণ্ডবিধির আওতায় মানহানি মামলায় আর্থিক ক্ষতিপূরণ চাওয়ার কিংবা তা উশুল করে দেওয়ার কোনো বিধান রাখা হয়নি।
দণ্ডবিধির ১২৪ক এর আওতায় ১৭টি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হলো। ৫৩ জেলায় ৬২ মানহানিসহ মোট মামলা ৭৯। আর তাতে ফৌজদারি আইনে ১ লাখ ৩২ হাজার ৮১১ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছে, যেখানে উপমহাদেশের সুপ্রিম কোর্টের রায়গুলোতে এটা মীমাংসিত যে, কেবল সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি শুধু দেওয়ানি আইনে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারেন। সেখানে আইনের চোখে যারা সরাসরি ‘সংক্ষুব্ধ’ নন, তারা মানহানির জন্য টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন।
গত বছরের নভেম্বরে গুজরাটের হার্দিক প্যাটেলকে যখন রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে অভিযুক্ত করা হলো, তখন তাকে ভিন্নমতের প্রতি সরকারের ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়া অসহিষ্ণুতার নজির হিসেবে দেখা হলো। রাষ্ট্রদ্রোহের আইনের আধুনিক ব্যবহারের নীতি হলো, কোনো সরকারের টিকে থাকার জন্য কোনো প্রকাশনা বা মন্তব্য যদি কোনো ‘স্পষ্ট এবং আসন্ন বিপদ’ সৃষ্টি করে, তাহলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ বলা যাবে। অতীতের একটি ঘটনার জন্য মাহ্ফুজ আনামের দুঃখ প্রকাশের ঘটনায় বর্তমান রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থার প্রতি এ ধরনের কোনো উপাদান আছে মর্মে সমাজের প্রাজ্ঞ ও চিন্তাশীল ব্যক্তিরা মত দেননি। এটাও বিবেচ্য যে ওই সময় শেখ হাসিনা রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। পুলিশের বড়কর্তা নিয়োগ–সংক্রান্ত টাইমস অব ইন্ডিয়ার রিপোর্টকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা বানানোর চেষ্টা ২০১২ সালে কোয়াশ বা খারিজ করেছেন গুজরাটের হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, ১২৪ক ধারায় যদি প্রমাণ না করা যায় যে, কোনো রিপোর্ট বা বক্তব্য সরকারের বিরুদ্ধে নৈরাজ্যকর হয়েছে, তাহলে তা রাষ্ট্রদ্রোহ বলে গণ্য হবে না। বিচারপতি হর্ষ দেবানি বলেছেন, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ‘সরকারের বিরুদ্ধে নাশকতার’ উপাদান থাকতেই হবে।
তাই মাহ্ফুজ আনাম যেভাবে দুঃখ প্রকাশ করে শান্তির সপক্ষে ভূমিকা রেখেছেন, তা কোনোভাবেই ‘সরকারের বিরুদ্ধে নাশকতা’ হতে পারে না। অভিযোগ উঠেছে, ডেইলি স্টার ২০০৭ সালে যাচাই না করে খবর ছেপে এবং ২০১৬ সালে তা স্বীকার করে রাষ্ট্রদ্রোহ করেছে। এই যুক্তি বিবেচনায় নিলেও আমরা দেখি, অপরাধের দায়যুক্ত কার্য সংঘটনকাল হলো ২০০৭ সাল। সংসদে দাবি উঠেছে ২০১১ সালের ১৫তম সংশোধনীতে যুক্ত করা সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদমতে মাহ্ফুজ আনামকে রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে বিচার করতে হবে। অথচ সেখানেও নাশকতার শর্ত দেওয়া আছে। বলা হয়েছে, শক্তি প্রদর্শন বা তাতে উসকানি দিয়ে সংবিধান রদ বা বাতিলের কোনো চেষ্টা হবে অপরাধ। আবার সংবিধানের পরিষ্কার নির্দেশনা হচ্ছে, ২০০৭ সালে সংঘটিত অপরাধ শুধু নয়, ‘অপরাধের দায়যুক্ত যেকোনো কার্যের’ কারণে কারও বিচার ২০১১ সালের বা ভবিষ্যৎসাপেক্ষ কোনো আইনে করা যাবে না। কারণ, ভূতাপেক্ষভাবে এর প্রয়োগ সংবিধানের ৩৫(১) অনুচ্ছেদ নিষিদ্ধ করেছে। বঙ্গবন্ধু নিজেই এই বিধান ১৯৭২ সালে এনেছেন। আর এতে বলা আছে, ‘অপরাধের দায়যুক্ত কার্য সংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এইরূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। এবং অপরাধ সংঘটনকালে বলবৎ কোনো আইনে যেরুপ দণ্ড দেওয়া যেতে পারত তার থেকে ভিন্ন দণ্ড দেওয়া যাবে না।’ সুতরাং মাহ্ফুজ আনাম তার ২০০৭ সালের রিপোর্টের জন্য প্রচলিত কোন আইনের কোন ধারাটি লঙ্ঘন করেছেন, সেটা সবার আগে বিচার্য। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়েরের অনুমোদন প্রদানের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এদিকটি বিবেচনায় নিতে হবে। এ বিষয়ে সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ, তার অনুমতি ছাড়া কোনো আদালত রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা আমলে নিতে পারবেন না। কারণ, আইন এটাও নিষিদ্ধ করে রেখেছে।
মাহ্ফুজ আনামের টিভি বক্তব্যের পক্ষে–বিপক্ষে আমরা নিশ্চয় আলোচনা চালিয়ে যাব। কিন্তু আমরা নিজেদের প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাই না এটা দাবি করে যে, তাঁর কথায়, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিপন্ন বা জনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়া’ কিংবা ‘সংবিধান বাতিলের’ মতো কোনো অপরাধের উপাদান আছে। এতে যদি আমরা একমত হই তাহলে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার কোনো প্রশ্নই আসে না। আমাদের ৩৯ অনুচ্ছেদে যে পাবলিক অর্ডার বা জনশৃঙ্খলা কথাটি আছে, সেটা মাহ্ফুজ আনামের কথায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে, অভিযোগকারীদের তার প্রমাণ দিতে হবে। এই যুক্তির সমর্থনে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকেই সাক্ষ্য হিসেবে হাজির করছি।
১৯৫১ সালে সংসদে একটি বিল এনে তিনি বলেছিলেন, ১২৪ক তে উল্লেখ করা ‘সিডিশন’ (আমাদের দণ্ডবিধির ১২৪কটিও হুবহু এক) কথাটি অত্যন্ত আপত্তিকর ও গর্হিত। আমি ১৯(২) অনুচ্ছেদে বাক্স্বাধীনতার বিধানে ‘জনশৃঙ্খলা’ এনে রাষ্ট্রদ্রোহের ধারণাকে বিস্তৃত করিনি।’
আমরা ১৯৭২ সালেই সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদে ভারতের ওই সংশোধিত ১৯(২) অনুচ্ছেদটিকে অবিকল গ্রহণ করেছিলাম। অবশ্য পরিহাস হলো যদিও নেহরু বলেছিলেন, সিডিশন আইনের কোনো ঠাঁই ভারতে হবে না। কিন্তু তিনি কথা রাখতে পারেননি। রাম নন্দন নামের বিহারের এক লোক ‘জাতিকে বিভক্ত’ করার জন্য নেহরুকে বিশ্বাসঘাতক বলেছিলেন। হুমকি দিয়েছিলেন দিনমজুরদের চরম দারিদ্র্য নিরসনে ব্যর্থ সরকারের উৎখাতে দরকার হলে তিনি আর্মি গঠন করবেন। তিনি রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত হলেন। সুপ্রিম কোর্ট রাম নন্দনের দণ্ড মওকুফ করলেন। সেই ১৯৫৮ সালেই উচ্চ আদালতের রায়ে বাক্স্বাধীনতার জয় হয়েছিল।
রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়েরে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সরকারকে সতর্ক করে বলেছিলেন, সিডিশন আইনকে কিছুতেই ব্যাপকতা নয়, অত্যন্ত সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করতে হবে, নইলে তা সাংবিধানিক বৈধতার পরীক্ষায় পাস করতে পারবে না। বিধানটা দণ্ডবিধির এমন একটি পরিচ্ছেদে রাখা, যেটির শিরোনাম ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ’। সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘রাষ্ট্র বলতে সংসদ, সরকার ও সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ অন্তর্ভুক্ত।’ আমরা বিস্ময়ে বিমূঢ়, যা তাঁর ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার’ বহিঃপ্রকাশ, সেটা কীভাবে, কী করে (আনামের টক শোর আত্মসমালোচনামূলক মন্তব্য) রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে?
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.