শহীদ নূর হোসেন ভাইয়ের চাওয়া পূরণ হলো না by শাহানা বেগম
১৯৮৭
সালে আমি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। ফলে নূর হোসেন ভাইয়ের কথা যে খুব বেশি মনে
আছে, তা নয়। কিন্তু এটা মনে আছে যে ৯ নভেম্বর রাতেই আব্বা বলছিলেন, দেশের
অবস্থা ভালো নয়, আগামীকাল কিছু একটা হতে পারে। নূর হোসেন ভাই বাসায় থাকতেন
না, ডিআইটির কাছে একটা জায়গায় থাকতেন। এক অজানা উদ্বেগ ও আশঙ্কা থেকে ১০
নভেম্বর সকালে ফজরের নামাজ পড়েই আব্বা ও আম্মা নূর হোসেন ভাইয়ের আস্তানায়
চলে যান। পরে তাঁদের মুখে শুনেছি, তাঁদের দেখে নূর হোসেন ভাই আঁতকে ওঠেন,
তড়িঘড়ি করে শরীরটা চাদরে মুড়ে দেন। কিন্তু আব্বা ঠিকই খেয়াল করেছিলেন,
ভাইয়ের বুকে কী যেন লেখা আছে। তাঁরা ভাইকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে বাসায় আনার চেষ্টা
করেও ব্যর্থ হন। তবে বাসায় ফেরার সময় আব্বার মনে এক অজানা আশঙ্কা ঘনীভূত
হতে থাকে। নূর হোসেন ভাইও অনেকটা পথ তাঁদের এগিয়ে দিয়ে যান। আর তারপরের
ইতিহাস আপনারা সবাই জানেন।
এখনো ছবি দেখে ভাইয়ের মুখটা মনে পড়ে, চাক্ষুষ স্মৃতি অনেকটাই ঘোলাটে হয়ে গেছে। নূর হোসেন ভাইকে সব সময় খুব রাগী মনে হতো। মনে হতো তিনি কিছু একটা খুঁজছেন আর সেটা না পেলে বাড়ি ফিরবেন না। হ্যাঁ, তিনি গণতন্ত্রের খোঁজে পথে নেমেছিলেন, সেই পথ তাঁকে জীবন থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে।
আমার ভাই দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিয়েছেন, সে জন্য আমরা গর্বিত। আমার আব্বা যত দিন জীবিত ছিলেন, তত দিন তিনি নিজের শহীদ পুত্রকে নিয়ে গর্বই করতেন। আমরা গরিব ছিলাম কিন্তু আব্বা কখনো নিজের মৃত ছেলেকে বিক্রি করেননি, কারও দরজায় গিয়ে ধরনা দেননি। আমরা গর্বিত, ১০ নভেম্বর দেশে এখন নূর হোসেন দিবস পালিত হয়। দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান ভাইকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন, ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’। এ গর্ব কতজনের ভাগ্যে জোটে।
তবে আজ বুকের মাঝখানটা হাহাকার করে ওঠে: যে গণতন্ত্রের জন্য আমার ভাই জীবন দিলেন, সেই গণতন্ত্র আজ কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলতে পারি না। কিন্তু দেশের সার্বিক অবস্থা ভালো নয়, সেটা বলতে পারি। আমি মনে করি, দেশের সব মানুষ যদি ভালোভাবে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারে, তাদের জীবনের নিরাপত্তা থাকে, তাহলে সেটাই গণতন্ত্র। আমরা সেই গণতন্ত্রই চাই। এই গণতন্ত্র বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে, দেশের মধ্যে বিভেদ থাকলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।
আব্বা মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগেই বড় ভাই আলী হোসেনের কাছে দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘ছেলেটা যা চেয়েছিল, তা তো হলো না। এখনো দেশে এত হানাহানি, এত সন্ত্রাস!’
অভাবের সংসার ছিল আমাদের। আব্বার রোজগারের সঙ্গে বড় ভাই আলী হোসেন ও নূর হোসেন রোজগার করতেন, তাঁরাও সংসারে টাকা দিতেন। নূর হোসেন ভাই মারা যাওয়ার পর আব্বা এ নিয়ে কখনো আক্ষেপ করেননি, বরং শেষ দিন পর্যন্ত ছেলেকে নিয়ে গর্বই করতেন। মারা যাওয়ার আগে আব্বা কাউকে চিনতে পারতেন না, কিন্তু নূর হোসেন ভাইয়ের ছবি দেখলে তাঁর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠত।
দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অনেকেই জীবন দিয়েছেন। কিন্তু আমরা তাঁদের সবাইকে মনে রাখিনি। সেদিক থেকে আমরা ভাগ্যবান, আমার ভাইকে আপনারা সবাই মনে রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রীও আমাদের খোঁজখবর নেন। এমনকি আমার বড় ভাই আলী হোসেন এখন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত গাড়ির চালক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি আমাদের মিরপুরে মাজার রোডে একটি জমি দিয়েছেন, ফলে আমরা এখন একরকম ভালোই আছি। একইভাবে আমাদের অন্য শহীদদেরও স্মরণ করতে হবে। ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকে আমার আব্বা ও আম্মাকে অনেক সভা-সেমিনারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাঁরা সেখানে এই কথাই বলেছেন।
এর সঙ্গে আমি আরেকটি কথা বলতে চাই। আমার ভাইসহ যাঁদের এভাবে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, আমরা তাঁদের হত্যার বিচার চাই। বিচার হলে আমরা অন্তত বলতে পারব, তাঁদের আত্মা শান্তি পেয়েছে। আর বিচার হওয়াটাও গণতন্ত্রের অন্যতম মানদণ্ড।
অনুলিখন: প্রতীক বর্ধন
শাহানা বেগম: শহীদ নূর হোসেনের বোন।
এখনো ছবি দেখে ভাইয়ের মুখটা মনে পড়ে, চাক্ষুষ স্মৃতি অনেকটাই ঘোলাটে হয়ে গেছে। নূর হোসেন ভাইকে সব সময় খুব রাগী মনে হতো। মনে হতো তিনি কিছু একটা খুঁজছেন আর সেটা না পেলে বাড়ি ফিরবেন না। হ্যাঁ, তিনি গণতন্ত্রের খোঁজে পথে নেমেছিলেন, সেই পথ তাঁকে জীবন থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে।
আমার ভাই দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিয়েছেন, সে জন্য আমরা গর্বিত। আমার আব্বা যত দিন জীবিত ছিলেন, তত দিন তিনি নিজের শহীদ পুত্রকে নিয়ে গর্বই করতেন। আমরা গরিব ছিলাম কিন্তু আব্বা কখনো নিজের মৃত ছেলেকে বিক্রি করেননি, কারও দরজায় গিয়ে ধরনা দেননি। আমরা গর্বিত, ১০ নভেম্বর দেশে এখন নূর হোসেন দিবস পালিত হয়। দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান ভাইকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন, ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’। এ গর্ব কতজনের ভাগ্যে জোটে।
তবে আজ বুকের মাঝখানটা হাহাকার করে ওঠে: যে গণতন্ত্রের জন্য আমার ভাই জীবন দিলেন, সেই গণতন্ত্র আজ কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলতে পারি না। কিন্তু দেশের সার্বিক অবস্থা ভালো নয়, সেটা বলতে পারি। আমি মনে করি, দেশের সব মানুষ যদি ভালোভাবে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারে, তাদের জীবনের নিরাপত্তা থাকে, তাহলে সেটাই গণতন্ত্র। আমরা সেই গণতন্ত্রই চাই। এই গণতন্ত্র বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে, দেশের মধ্যে বিভেদ থাকলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।
আব্বা মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগেই বড় ভাই আলী হোসেনের কাছে দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘ছেলেটা যা চেয়েছিল, তা তো হলো না। এখনো দেশে এত হানাহানি, এত সন্ত্রাস!’
অভাবের সংসার ছিল আমাদের। আব্বার রোজগারের সঙ্গে বড় ভাই আলী হোসেন ও নূর হোসেন রোজগার করতেন, তাঁরাও সংসারে টাকা দিতেন। নূর হোসেন ভাই মারা যাওয়ার পর আব্বা এ নিয়ে কখনো আক্ষেপ করেননি, বরং শেষ দিন পর্যন্ত ছেলেকে নিয়ে গর্বই করতেন। মারা যাওয়ার আগে আব্বা কাউকে চিনতে পারতেন না, কিন্তু নূর হোসেন ভাইয়ের ছবি দেখলে তাঁর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠত।
দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অনেকেই জীবন দিয়েছেন। কিন্তু আমরা তাঁদের সবাইকে মনে রাখিনি। সেদিক থেকে আমরা ভাগ্যবান, আমার ভাইকে আপনারা সবাই মনে রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রীও আমাদের খোঁজখবর নেন। এমনকি আমার বড় ভাই আলী হোসেন এখন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত গাড়ির চালক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি আমাদের মিরপুরে মাজার রোডে একটি জমি দিয়েছেন, ফলে আমরা এখন একরকম ভালোই আছি। একইভাবে আমাদের অন্য শহীদদেরও স্মরণ করতে হবে। ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকে আমার আব্বা ও আম্মাকে অনেক সভা-সেমিনারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাঁরা সেখানে এই কথাই বলেছেন।
এর সঙ্গে আমি আরেকটি কথা বলতে চাই। আমার ভাইসহ যাঁদের এভাবে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, আমরা তাঁদের হত্যার বিচার চাই। বিচার হলে আমরা অন্তত বলতে পারব, তাঁদের আত্মা শান্তি পেয়েছে। আর বিচার হওয়াটাও গণতন্ত্রের অন্যতম মানদণ্ড।
অনুলিখন: প্রতীক বর্ধন
শাহানা বেগম: শহীদ নূর হোসেনের বোন।
No comments