টেন্ডারবাজি বন্ধ করতে চাইলে লাশ পড়বে -ডিসিকে উপজেলা চেয়ারম্যান by দীন ইসলাম
কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক (ডিসি) সৈয়দ বেলাল হোসেনকে নাজেহাল করলেন একই জেলার মিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান কামারুল আরেফিন। তিনি ক্ষমতার দম্ভ দেখানোর পাশাপাশি অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেন ডিসিকে। বলেন, জেলা প্রশাসক হিসেবে আপনার কি কচুর ক্ষমতা আছে? আপনি আমার কি করতে পারেন? জানেন আমার ক্ষমতা কি? আমার ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার কোন ধারণা নেই। এরপর উপজেলা চেয়ারম্যান হুমকিস্বরে চিৎকার করে ‘আমার’ স্থলে আমরা শব্দ ব্যবহার করে বলে উঠেন, আমরা না চাইলে এ জেলায় কোন কিছুই করা সম্ভব নয়। এরূপ বিরূপ শব্দ চয়নের মাধ্যমে আরও অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন ওই চেয়ারম্যান। ঘটনার দিনই অর্থাৎ ১লা ডিসেম্বর উপজেলা চেয়ারম্যানের এমন কাণ্ড সম্পর্কে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও খুলনার বিভাগীয় কমিশনারকে চিঠির মাধ্যমে জানিয়েছেন কুষ্টিয়ার ডিসি। এরপর ৩রা ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ উপজেলা চেয়ারম্যান কামারুল আরেফিনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবকে চিঠি দেয়া হয়েছে। উপ- সচিব ড. শাহিদা আকতার স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামারুল আরেফিন কর্তৃক কুষ্টিয়ার ডিসির সঙ্গে অসৌজন্যমূলক, ঔদ্ধত্যপূর্ণ এবং দম্ভোক্তিপূর্ণ আচরণের বিবরণ ডিসির পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। তার (উপজেলা চেয়ারম্যান) বিভিন্ন আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ইতিমধ্যে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবরে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। একজন জনপ্রতিনিধি এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের এমন আচরণ মোটেও কাম্য নয় বরং সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম এবং জনশৃঙ্খলার প্রতি হুমকিস্বরূপ। উল্লেখ্য, ওই জনপ্রতিনিধি এর আগে সাবেক পুলিশ সুপারসহ অন্যান্য কর্মকর্তা/ কর্মচারী ও সাধারণ জনগণের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন। এমতাবস্থায়, ওই জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। এর আগে কুষ্টিয়ার ডিসি বেলাল হোসেন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার চেয়ারম্যান কামারুল আরেফিনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ সম্পর্কে জানিয়ে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠিতে তিনি জানান, ১লা ডিসেম্বর মিরপুর উপজেলায় বিজিবি কুষ্টিয়া সেক্টরের ২৪তম প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত প্রীতিভোজে যোগদান শেষে কুষ্টিয়ার ডিসি উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও), মিরপুরের কার্যালয়ে আকস্মিকভাবে পরিদর্শনে যান। এ সময় ইউএনও’র কার্যালয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, মিরপুর ও অফিসার ইনচার্জ মিরপুরের উপস্থিতিতে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, মিরপুর কামারুল আরেফিন ডিসি’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। কুশলাদি বিনিময়ের পর উপজেলা চেয়ারম্যান আমাকে (ডিসি) উদ্দেশ্য করে বলেন, এখন থেকে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় ডিসি বা অন্য কোন সদস্য টেন্ডার নিয়ে কোন প্রকার প্রশ্ন বা আলোচনা করার সুযোগ পাবেন না। কেননা, গত ২৬শে নভেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ৪৬ কোটি টাকার টেন্ডার নিয়ে গঠিত সিন্ডিকেট তিনি ভেঙে দিয়েছেন। এরূপ মন্তব্যের বিরোধিতা করে ডিসি উল্লেখ করেন যে, দীর্ঘদিন থেকে কুষ্টিয়া জেলায় টেন্ডার নিয়ে একটি অশুভ চক্র সক্রিয় থাকলেও এই প্রথম ডিসি ও পুলিশ সুপারের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ওই সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া হয়েছে। প্রকৃত অর্থে এ কারণেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডারে কোন প্রকার সিন্ডিকেট কাজ করতে পারেনি বা কোন অপ্রীতিকর ঘটনা সংঘটিত হয়নি। এর জবাবে উপজেলা চেয়ারম্যান কামারুল দম্ভোক্তি করে বলেন, জেলা প্রশাসক বা পুলিশ সুপারের পক্ষে টেন্ডারবাজি বন্ধ করা আদৌ সম্ভব নয়। একমাত্র তিনিই (উপজেলা চেয়ারম্যান) সকল টেন্ডার সংক্রান্ত সিন্ডিকেট বন্ধ করার ক্ষমতা রাখেন। তিনি ওই টেন্ডারবাজি বন্ধ করেছেন। উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও বা ওসি’র সাধ্য নেই তার আদেশ বা নির্দেশের বাইরে কোন কিছু করার। এমনকি কুষ্টিয়া জেলায় তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে টেন্ডারবাজি বন্ধ করতে চাইলে পুলিশ সুপার ও ওসি’র লাশ পড়বে। প্রতিদিন ওসিকে লাশ সংগ্রহ করার কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে। এরপর অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করে গালিগালাজ করতে শুরু করেন উপজেলা চেয়ারম্যান। চিঠিতে ডিসি বেলাল জানান, কামারুল আরেফিন প্রকৃত অর্থেই আন্ডারগ্রাউন্ড চরমপন্থিদের একজন গডফাদার। দীর্ঘদিন থেকে তিনি কুষ্টিয়া জেলায় টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসাসহ সব সন্ত্রাসী অপকর্মের হোতা। কিছুদিন আগে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের ১০০ কোটি টাকা টেন্ডারে সিন্ডিকেট করে ১২ কোটি টাকা সিন্ডিকেট মানি হিসেবে তিনি গ্রহণ করেন। একইভাবে গত ২৬শে নভেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত টেন্ডারেও কামারুল অবৈধ সিন্ডিকেট গঠনের চেষ্টা করেন। যা ডিসি ও পুলিশ সুপারের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে ভেঙে যায়। এর ফলে কামারুল ডিসির সঙ্গে এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করার সাহস দেখিয়েছেন। একই কায়দায় তার নিজ উপজেলা মিরপুরের সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে আগ্রাসী ও সন্ত্রাসী ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি তাদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করে চলেছেন। যা সরকারি কর্মকাণ্ডের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। এতে বলা হয়, আশরাফুল ইসলাম ও হীরক জোয়ার্দারের নেতৃত্বে কামারুলের নিজস্ব একটি সন্ত্রাসী বাহিনী রয়েছে। যার মাধ্যমে কুষ্টিয়া জেলার যাবতীয় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড থেকে তিনি সিন্ডিকেট মানি আদায় করে যাচ্ছেন। বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত আন্ডারগ্রাউন্ড বাহিনীর অন্যতম শীর্ষনেতা মুকুলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তিনি জনগণের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে যাবতীয় অপকর্ম পরিচালনা করে চলেছেন। কামারুল প্রায়শই অনুমতিসহ বা অনুমতি ছাড়া আন্ডারগ্রাউন্ড চক্রের সঙ্গে গোপন সাক্ষাৎ করার জন্য ভারত, নেপাল ও থাইল্যান্ড ভ্রমণ করে থাকেন। যার যাবতীয় তথ্য ইমিগ্রেশন বিভাগে রয়েছে। এছাড়া, তার সার্বিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকে প্রতিদিন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বরাবর প্রতিবেদন পাঠিয়ে থাকে। যা ওই সংস্থাগুলোর কাছে রয়েছে। এর আগে কামারুল আরেফিনের অপকর্মগুলোতে আইনানুগ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় কুষ্টিয়া জেলার সাবেক পুলিশ সুপার মফিজ উদ্দিন আহমেদ (বর্তমানে উপ-পুলিশ কমিশনার, লালবাগ জোন, ঢাকা) ও সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সোহেল রেজার সঙ্গেও একই কায়দায় অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। জেলার সরকারি শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ ধরনের অসৌজন্যমূলক আচরণের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাধারণ জনসাধারণের মধ্যে ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টি করে বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও অপকর্ম পরিচালনা অব্যাহত রাখা কামারুল আরেফিনের একটি অপকৌশল মর্মে প্রতীয়মান হয়। বিষয়টি সদয় অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পাঠানো হলো। এ চিঠির ভিত্তিতেই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে।
No comments