খালাস চেয়ে যা বললেন ঐশী
পুলিশ
কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে হত্যার দায়ে
মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া মেয়ে ঐশী রহমান ২৫টি যুক্তি দেখিয়ে খালাস চেয়ে
হাইকোর্টে আপিল করেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁকে দোষী সাব্যস্তকরণ, সাজা ও রায়
প্রদান আইন অনুযায়ী হয়নি। আবেগের বশবর্তী হয়ে বিচারক সাজা দিয়েছেন। রোববার
দুপুরে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আইনজীবীর মাধ্যমে ঐশী রহমান এ আপিল
আবেদন করেন। আপিলে ঐশী রহমান বলেন, মিথ্যা সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে তাঁকে
সাজা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বয়সের ক্ষেত্রে মামলার বাদীর বক্তব্য গ্রহণ
করেননি আদালত। মামলার বাদী ঐশীর চাচার মতে, ঐশীর জন্ম ১৯৯৬ সালে। এতে ঘটনার
সময় ঐশীর বয়স হয় ১৬ বছর। তাই বয়স অনুযায়ী শিশু আদালতে ঐশীর বিচার হওয়ার
কথা ছিল। এ ছাড়া ঘটনার সময় তিনটি ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে মর্মে
তদন্ত কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করলেও আসামি ঐশীর হাতের আঙ্গুলের
ছাপ আদালতে হাজির করেননি। এভাবে ২৫টি যুক্তি দেখিয়ে ঐশী বলেছেন, তার বিচার
প্রক্রিয়া ছিল ভুলে ভরা। হাইাকোর্টে তাই তিনি খালাস চেয়ে আবেদন করেছেন।
ঐশীর যুক্তিগুলোর মূল অংশগুলো হলো- ১. দোষী সাব্যস্তকরণ এবং সাজা দেওয়া ছিল
আইনগতভাবে আদালতের ভুল সিদ্ধান্ত। ২. রাষ্ট্রপক্ষ আসামি ঐশীর বয়স প্রমাণ
করতে পারেনি এবং সাজার মাধ্যমে একজন মানুষের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। ৩. এ
ঘটনা সরাসরি দেখেছেন এমন কোনো সাক্ষী তারা সাক্ষ্যতে উল্লেখ করতে পারেনি।
৪. মামলার এজাহারে ঐশীর নাম ছিল না। ৫. এ ঘটনায় মোট ৩৯ জন সাক্ষী দিয়েছেন,
কেউ প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না। ৬. প্রসিকিউশন যে সাক্ষী হাজির করেছিল,
সেসব সাক্ষীর বিবরণে অসামাঞ্জস্যতা ছিল। ৭. ফৌজদারি কার্যবিধি মোতাবেক
আসামির ১৬৪ ধারা মোতাবেক জবানবন্দি গ্রহণের পর সঙ্গে সঙ্গে আদালতে উপস্থাপন
করতে হয়। কিন্তু পুলিশ তা করেছে পাঁচদিন পর। ৮. বয়স বিবেচনায় ঐশী একজন
শিশু, কিন্তু শিশু আইনে তার বিচার হয়নি। ৯. রাষ্ট্রপক্ষের পক্ষ বয়স
সঠিকভাবে প্রমাণ করতে পারেনি। ১০. তদন্ত কর্মকর্তা তথ্য গোপন করে মিথ্যা
সাক্ষী দিয়েছেন। ১১. মামলার বাদী ঐশীর চাচাকে জেরা করার সময় বলেছেন তার ভাই
নিহত মাহফুজুর রহমান বিয়ে করেছেন ১৯৯৪ সালে। মেয়ে ঐশীর জন্ম হয়েছে ১৯৯৬
সালে। এতে ঘটনায় সময় ঐশীর বয়স হয় ১৬ বছর। কিন্তু প্রসিকিউশন ১৯ বছর বয়স
দেখিয়ে তাঁকে শিশু আইনে বিচার করতে দেয়নি। ১২. সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার
কাছে যে সাক্ষী দিয়েছেন; আদালতে সেই সাক্ষ্য পরিবর্তন করেছেন। ১৩.
সাক্ষীর স্থায়ী ঠিকানা থাকা সত্ত্বেও সাক্ষীদের ১৬৪ ধারা মোতাবেক
জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে, যা ছিল আইন বর্হিভূত। ১৪. ঐশীর একমাত্র ভাইয়ের
সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি। ১৫. ডিএনএ পরীক্ষা করার সময় ছয়টি এক্স-রে করতে হয়,
কিন্তু ঐশীর ক্ষেত্রে মাত্র দুটি এক্স-রে করা হয়েছে। আবার দুটি এক্স-রের
কপি আদালতে উপস্থাপন না করে শুধু রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। ১৬. তদন্ত কর্মকর্তা
অভিযোগপত্রে হত্যার সময় তিন প্রকারের অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে বলে উল্লেখ
করেন, কিন্তু আসামির আঙ্গুলের ছাপের কোনো নথি উপস্থাপন করতে পারেননি। ১৭.
২১ নং সাক্ষী ডা. নাহিদ মাহজাবীন মোর্শেদের সাক্ষ্য আমলে নেননি। যিনি তাঁর
সাক্ষ্যে বলেছেন, ঘটনার সময় ঐশীর মানসিক ভারসাম্য ছিল না। ১৮. আসামির
স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে যে সাজা দেওয়া হয়েছে, তা সঠিক ছিল না। ১৯.
আসামির বিরুদ্ধে সঠিকভাবে অভিযোগ গঠন করা হয়নি। ২০. ফৌজদারি কার্যবিধি ৩৪২
মোতাবেক রাষ্ট্রপক্ষ অপরাধ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ২১. ১৬৪ ধারায়
জবানবন্দির রেকর্ড অনুযায়ী রায় দেওয়া হয়নি। ২২. বিচারিক আদালত তথ্য
উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে রায় দ্নেনি। ২৩. আবেগের বশবর্তী হয়ে এ রায় দেওয়া
হয়েছে, সাক্ষীদের প্রতারণা মূলক সাক্ষ্য এবং সাজানো সাক্ষ্যর মাধ্যমে সাজা
দেওয়া হয়েছে। ২৪. রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা ঐশীর বিরুদ্ধে কোনো প্রকার
প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হাজির করতে পারেনি। ২৫. শেষ যুক্তিতে বলা হয় উপরোক্ত
বিষয়গুলো আমলে নিয়ে আদালত যেন তার ফাঁসির দণ্ডাদেশ বাতিল করেন। আপিল
আবেদন শেষে ঐশীর আইনজীবী মাহবুব হাসান রানা সাংবাদিকদের বলেন, “২৫টি যুক্তি
দেখিয়ে ২৫ পৃষ্ঠার আপিল আবেদন করা হয়েছে। আশা করি বয়স বিবেচনায় আসামী ঐশী
রহমান হাইকোর্টে ন্যায় বিচার পাবেন।” ঐশীর আইনজীবী দাবি করেন, নিম্ন আদালতে
ঐশীর ডিএনএ টেস্ট সঠিক ছিল না। ঐশী অপ্রাপ্তবয়স্ক। তাই তাঁর বিচার হওয়া
উচিত শিশু ট্রাইব্যুনালে। যে আদালতে বিচার হয়েছে, তা সঠিক ছিল না।
মা-বাবাকে হত্যার দায়ে গত ১২ নভেম্বর ঢাকার ৩ নম্বর দ্রুত বিচার
ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাঈদ আহমেদ রায়ে ঐশীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। ২০১৩
সালের ১৬ আগস্ট রাজধানীর মালিবাগের চামেলীবাগের বাসা থেকে পুলিশের বিশেষ
শাখার পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমানের ক্ষতবিক্ষত
মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ১৭ আগস্ট নিহত মাহফুজুর রহমানের ছোট ভাই
মো. মশিউর রহমান রুবেল পল্টন থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। একই দিন
পল্টন থানায় আত্মসমর্পণ করেন ঐশী। ২০১৪ সালের ৯ মার্চ ঐশীকে প্রধান আসামি
করে তিনজনের বিরুদ্ধে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল
করেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের পরিদর্শক আবুল খায়ের। পরে গত
বছরের ৩০ নভেম্বর ঢাকার ৩ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ বি এম
সাজেদুর রহমান তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এ মামলায় বিভিন্ন সময়ে ৪৯
সাক্ষীর মধ্যে ৩৭ জন আদালতে সাক্ষ্য দেন।
No comments