জম্মু ও কাশ্মির ভারতের অংশ নয় by জি. মুনীর
ভারতের
বরাবরের দাবি ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভারতের এই
দাবিকে অসার প্রমাণ করে জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের হাইকোর্ট সম্প্রতি রায়
দিয়েছেনÑ জম্মু ও কাশ্মির কখনোই ভারতের অংশ ছিল না এবং এখনো এর অংশ নয়। এই
রায়ে আদালত বলেছে, ভারতের সংবিধানে জম্মু ও কাশ্মিরকে সীমিত সার্বভৌম
ভূখণ্ডের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। বিচারপতি হাসনাইন মাসুদি ও বিচারপতি জনকরাজ
কোতয়ালের ডিভিশন বেঞ্চ এই রায় দিয়েছেন।
এ দুই বিচারপতির দেয়া ৬০ পৃষ্ঠার এই রায়ে বলা হয়েছে, ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদে এই রাজ্যকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে; যা সংশোধন, বাতিল বা রদ করা যাবে না। আদালত বলেছে, সংবিধানের ৩৫ক অনুচ্ছেদে বিদ্যমান আইনে কাশ্মিরকে সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। সংবিধানে ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদকে অস্থায়ী বিধান হিসেবে উল্লেখ করা হলেও একবিংশ ধারায় এটিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ধারা সংবিধানের, ৩৭০ সম্বর ধারাকে ‘স্থায়ী, অপরিবর্তনশীল বিশেষ বিধান’ স্থায়ী স্থান করে নিয়েছে। আইনসভায় এটি সংশোধন, বাতিল বা রদ করা যাবে না। (The bench ruled : "Article 35A gives 'protection' to existing laws in force in the State. Article 370 though titled as 'Temporary Provision' and included in Para XXI titled 'Temporary, Transitional and Special Provisions' has assumed place of permanence in the Constitution. It is beyond amendment, repeal or abrogation, in as much as Constituent Assembly of the State before its dissolution did not recommend its amendment or repeal.")
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদটি সংবিধানের মাধ্যমে ‘সংশোধন বাতিল বা রদের অযোগ্য’ বলে ঘোষণা থাকলেও ভারতীয় জনতা পার্টি তথা বিজেপি এই অনুচ্ছেদটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। বর্তমানে এ দলটি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন থাকায় বিষয়টি এরা আরো গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। জানা গেছে, জম্মু ও কাশ্মির সরকারের কাছে যত দ্রুত সম্ভব উল্লিখিত এই রায়ের একটি কপি চেয়ে পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। হাইকোর্ট কিসের ভিত্তিতে এই রায় দিয়েছে, তার ব্যাখ্যাও চাওয়া হয়েছে।
এ দিকে আদালতের এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে রাজ্যটির স্থানীয় দলগুলো ও রাজনৈতিক নেতারা, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের হয়ে কাজ করছেন। পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (পিডিএফ) প্রেসিডেন্ট এবং আওয়ামী মোথিদা মাহাজ (এএমএম) নেতা হাকিম মোহাম্মদ ইয়াসিন এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। রাজনৈতিক নেতারা বলেছেন, এখন জম্মু ও কাশ্মির সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদকে আরো জোরদার করে তোলা।
হাকিম মোহাম্মদ ইয়াসিন গত ১৬ অক্টোবর বলেছেন, ‘এটি স্বাগত জানানোর মতো একটি প্রত্যাশিত রায়। অ্যাসেম্বলির ভেতরে ও বাইরে দাবি ছিল ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদকে সুরক্ষা দেয়ার। অতএব হাইকোর্টের এই রায় একটি ওয়েলকাম ডিসিশন। এখন জম্মু ও কাশ্মির সরকারের জন্য, বিশেষ করে মুফতি সাহেবের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কিভাবে ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদকে আরো জোরদার করে তোলা যায়, কী করে এসব ক্ষয়িষ্ণু অনুচ্ছেদ পুনরুদ্ধার করা যায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদেই জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের সীমিত সার্বভৌমত্ব ও বিশেষ মর্যাদার অনুমোদন রয়েছে।
পিডিএফ প্রধান এই আহ্বানও জানান, রাজ্য সরকার যেন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিনাশকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়। তার দাবি, জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যকে অঞ্চলের নামে যারা বিভক্ত করতে চায়, তাদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে। রাজ্য সরকারকে এদের চিহ্নিত করে শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে।
ইতিহাস বলেÑ জম্মু ও কাশ্মির ১৮৪৬ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ছিল ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি প্রিন্সলি স্টেট, যা শাসন করত রাজপুত ডুগরা রাজারা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে নামমাত্র সার্বভৌম স্টেটগুলোকে বলা হতো প্রিন্সলি স্টেট বা ন্যাটিভ স্টেট। ১৮৪৬ সালে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের পর জম্মু ও কাশ্মির স্টেট গঠন করা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এর সাথে কাশ্মির উপত্যকাকে সংযুক্ত করে গোলাব সিংয়ের কাছে হস্তান্তর করে ৭৫ লাখ রুপির ইনডেমনিটি পরিশোধের বিনিময়ে। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হয়। তখন এই রাজ্যে মুসলমানেরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু এই স্টেট ছিল অমুসলিম মহারাজা হরি সিংয়ের শাসনাধীনে। তখন প্রশ্ন দেখা দেয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই জম্মু ও কাশ্মির কার পক্ষে যোগ দেবেÑ পাকিস্তানের পক্ষে, না ভারতের, না এই দুই দেশের কোনোটির সাথে সংযুক্ত না হয়ে নিরপেক্ষ স্বাধীন কাশ্মির রাষ্ট্র গঠন করবে? এ নিয়ে নানা বিশৃঙ্খলা চলার মধ্য দিয়েই মহারাজা হরি সিং সামরিক সহায়তার বিনিময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই রাজ্যকে ভারতীয় ডোমিনিয়নে যোগ দেয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করে ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর। এ নিয়ে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই রাজ্যের পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর নিয়ন্ত্রণ চলে যায় পাকিস্তানের হাতে, যা আজ আজাদ কাশ্মির ও গিলগিটস্তান নামে পরিচিত। একাংশ চলে যায় ভারতের নিয়ন্ত্রণে, যা ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মির নামে পরিচিত। উল্লেখ্য, কাশ্মিরের ২০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে চীনের হাতে, যা আকসাই চীন নামেও পরিচিত।
এখানে একটা কথা বলা দরকার, জম্মু ও কাশ্মির হাইকোর্ট সুস্পষ্টভাবে এক রায়ে বললেন, জম্মু ও কাশ্মির ভারতের কোনো অংশ নয়। ২০১০ সালের দিকে ভারতের স্পষ্টবাদী লেখিকা অরুন্ধতী রায় ঠিক একই কথা বলে ছিলেন : ‘কাশ্মির ইজ নট অ্যা পার্ট অব ইন্ডিয়া।’ এই সত্য উপলব্ধির ওপর ভর করে ওই সময় নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে তিনি বলেছিলেন : ‘কাশ্মির শুড গেট আজাদি ফ্রম ভুখে নাঙ্গে ইন্ডিয়া।’
এই বক্তব্যের পর তার বিরোধীরা এই বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল বলে হইচই শুরু করে দেয়। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়েরের জন্য সরকারের কাছে দাবি তোলে । এর জের ধরে ২০১০ সালের ২৯ নভেম্বর ভারতের পুলিশ নয়াদিল্লিতে ভারতীয় এই স্পষ্টবাদী বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মীর বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করে। তার বিরুদ্ধে পুলিশ শ্রীনগরে ২১ অক্টোবরে আয়োজিত ‘আজাদি : দ্য অনলি ওয়ে’ শীর্ষক এক সেমিনারে তথাকথিত ভারতবিরোধী বক্তব্য রাখার অভিযোগ তোলে এই মামলায়। এ সময় তাকে গ্রেফতারের নানা হুমকিও চার দিক থেকে আসতে শুরু করে। কারণ তিনি বক্তব্যে দাবি করেছেন, জম্মু ও কাশ্মির উপত্যকা কখনোই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল না। আর এটিই হচ্ছে একটি ঐতিহাসিক সত্য। তিনি এ কথাও বলেছেন, ভারত সরকারের উচিত কাশ্মিরের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা মেনে নেয়া। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার মেনে নেয়া।
তার বিরুদ্ধে এই রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার নানা ক্রিয়া-প্রক্রিয়া যখন চলছিল, তখন অরুন্ধতী রায় ২০১০ সালের ২৮ নভেম্বর ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় একটি কলাম লেখেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেনÑ দিল্লি পুলিশকে কোর্ট আদেশ দিয়েছে আমার বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করতে। আমার মনে হয়, সম্ভবত তাদের উচিত জওয়াহেরলার নেহরুর বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদ্রোহের একটি মরণোত্তর মামলা করা। কেনো তা করা উচিত, এর জবাবও তিনি তার এ লেখায় দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৪৭ সালের ২৭ অক্টোবর জওয়াহেরলাল নেহরু ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো এক টেলিগ্রামে লিখেছিলেন : 'I should like to make it clear that the question of aiding Kashmir in this emergency is not designed in any way to influence the state to accede to India. Our view which we have repeatedly made public is that the question of accession in any disputed territory or state must be decided in accordance with wishes of people and we adhere to this view.' (Telegram 402 Primin-2227 dated 27th October, 1947 to PM of Pakistan repeating telegram addressed to PM of UK).
এ ছাড়া এর চার দিন পর ৩১ অক্টোবর তিনি আরেকটি টেলিগ্রাম পাঠান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানের কাছে, যাতে তিনি উল্লেখ করেন : "Kashmir's accession to India was accepted by us at the request of the Maharaja's government and the most numerously representative popular organization in the state which is predominantly Muslim. Even then it was accepted on condition that as soon as law and order had been restored, the people of Kashmir would decide the question of accession. It is open to them to accede to either Dominion (India or Pakistan) then."
কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই দু’টি টেলিগ্রামেই নেহরু কাশ্মিরের জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের পাকিস্তান বা ভারতে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বাস্তবে তা তিনি করেননি। সে প্রতিশ্রুতি তিনি ও তার দেশ শতভাগ ভঙ্গ করেছে। বরং তা না করে তিনি আরো দু’টি প্রিন্সলি স্টেট হায়দরাবাদ ও জুনাগড় দখল করতে সেখানে ভারতীয় সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। এবং সামরিক অভিযান চালিয়েই ভারত স্টেট দু’টি দখল করে। অথচ এই দু’টি রাজ্য পাকিস্তানের সাথে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সে ইতিহাস কারো অজানা নয়।
কাশ্মিরের মানুষের পক্ষে কথা বলার জন্য যখন অরুন্ধতীকে রাষ্ট্রদ্রোহী প্রমাণের তোড়জোড় চলছিল নানা মহল থেকে, তখন তিনি ২০১০ সালের ২৬ অক্টোবর এক বিবৃতি প্রকাশ করে একটি কথাই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তার ভাষায়Ñ “আমার বক্তব্যের কপিটি মনোযোগের সাথে পড়ে দেখলে বুঝতে পারবেন, সেখানে আমার মৌল আহ্বানটি ছিল ন্যায়বিচার। আমি কথা বলেছি কাশ্মিরের জনগণের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য, যারা এখন বসবাস করছেন বিশ্বের ‘মোস্ট ব্রুটাল মিলিটারি অকুপেশনে’র অধীনে।”
কাশ্মিরের মানুষ তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার চায়। এরা চায় না ভারত থেকে বেরিয়ে পাকিস্তানে যোগ দিতে। কিংবা পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে ভারতে যোগ দিতে। কাশ্মির ভারতের নয়, পাকিস্তানেরও নয়। কাশ্মির কাশ্মিরিদের। এরা চায় স্বাধীন কাশ্মির। আজাদ কাশ্মির। শুধু জম্মু ও কাশ্মির নয়, লাদাখ মুজাফ্ফরাবাদ, মিরপুর সমগ্র কাশ্মির এদের। সে কাশ্মিরের কথাই বলছে কাশ্মিরিরা। সে কাশ্মির পাওয়ার পথ একটাই : আজাদি দ্য অনলি ওয়ে। সে জন্য চাই এক অমোঘ সত্যের উপলব্ধি : ‘কাশ্মির ইজ নট অ্যা পার্ট অব ইন্ডিয়া’। এই দুই সত্য মেনে নেয়ায় ভারতের ব্যর্থতা ক্ষমাহীন সীমাহীন। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গই যেন এ ক্ষেত্রে ভারতের অঙ্গভূষণ। জওয়াহেরলাল নেহরুর আরেকটি প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েই এ লেখার ইতি টানতে চাই। ১৯৪৭ সালের ২১ নভেম্বর তিনি তার ৩৬৮ নম্বর চিঠিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে লিখেছিলেন :'I have repeatedly stated that as soon as peace and order have been established, Kashmir should decide of accession by Plebiscite or referendum under international auspices such as those of United Nations.' (এভাবে পরবর্তী সময়ে নেহরু কাশ্মিরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রশ্নে রেফারেন্ডাম দেয়ার প্রতিশ্রুতি বারবার উল্লেখ করেছেন)
নেহরুর প্রতিশ্রুত কাশ্মিরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সেই রেফারেন্ডাম বা গণভোটের কথা ভারতীয় শাসকেরা কোনো দিন মুখে আনছেন না। আশা করি, কাশ্মিরের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে নেহরুর দায়ভার পরিমাপ ও তা পালনে তার ও তার পরবর্তী ভারতীয় নেতাদের ব্যর্থতার মাত্রাটা এবার অন্তত উপলব্ধিতে নেবেন। কাশ্মির সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসবেন। অনেক হয়েছে আর নয়। স্বাধীনতার কথা বলতে কাশ্মিরিরা আর কত নির্যাতিত হবেন?
এ দুই বিচারপতির দেয়া ৬০ পৃষ্ঠার এই রায়ে বলা হয়েছে, ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদে এই রাজ্যকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে; যা সংশোধন, বাতিল বা রদ করা যাবে না। আদালত বলেছে, সংবিধানের ৩৫ক অনুচ্ছেদে বিদ্যমান আইনে কাশ্মিরকে সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। সংবিধানে ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদকে অস্থায়ী বিধান হিসেবে উল্লেখ করা হলেও একবিংশ ধারায় এটিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ধারা সংবিধানের, ৩৭০ সম্বর ধারাকে ‘স্থায়ী, অপরিবর্তনশীল বিশেষ বিধান’ স্থায়ী স্থান করে নিয়েছে। আইনসভায় এটি সংশোধন, বাতিল বা রদ করা যাবে না। (The bench ruled : "Article 35A gives 'protection' to existing laws in force in the State. Article 370 though titled as 'Temporary Provision' and included in Para XXI titled 'Temporary, Transitional and Special Provisions' has assumed place of permanence in the Constitution. It is beyond amendment, repeal or abrogation, in as much as Constituent Assembly of the State before its dissolution did not recommend its amendment or repeal.")
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদটি সংবিধানের মাধ্যমে ‘সংশোধন বাতিল বা রদের অযোগ্য’ বলে ঘোষণা থাকলেও ভারতীয় জনতা পার্টি তথা বিজেপি এই অনুচ্ছেদটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। বর্তমানে এ দলটি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন থাকায় বিষয়টি এরা আরো গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। জানা গেছে, জম্মু ও কাশ্মির সরকারের কাছে যত দ্রুত সম্ভব উল্লিখিত এই রায়ের একটি কপি চেয়ে পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। হাইকোর্ট কিসের ভিত্তিতে এই রায় দিয়েছে, তার ব্যাখ্যাও চাওয়া হয়েছে।
এ দিকে আদালতের এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে রাজ্যটির স্থানীয় দলগুলো ও রাজনৈতিক নেতারা, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের হয়ে কাজ করছেন। পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (পিডিএফ) প্রেসিডেন্ট এবং আওয়ামী মোথিদা মাহাজ (এএমএম) নেতা হাকিম মোহাম্মদ ইয়াসিন এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। রাজনৈতিক নেতারা বলেছেন, এখন জম্মু ও কাশ্মির সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদকে আরো জোরদার করে তোলা।
হাকিম মোহাম্মদ ইয়াসিন গত ১৬ অক্টোবর বলেছেন, ‘এটি স্বাগত জানানোর মতো একটি প্রত্যাশিত রায়। অ্যাসেম্বলির ভেতরে ও বাইরে দাবি ছিল ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদকে সুরক্ষা দেয়ার। অতএব হাইকোর্টের এই রায় একটি ওয়েলকাম ডিসিশন। এখন জম্মু ও কাশ্মির সরকারের জন্য, বিশেষ করে মুফতি সাহেবের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কিভাবে ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদকে আরো জোরদার করে তোলা যায়, কী করে এসব ক্ষয়িষ্ণু অনুচ্ছেদ পুনরুদ্ধার করা যায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদেই জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের সীমিত সার্বভৌমত্ব ও বিশেষ মর্যাদার অনুমোদন রয়েছে।
পিডিএফ প্রধান এই আহ্বানও জানান, রাজ্য সরকার যেন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিনাশকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়। তার দাবি, জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যকে অঞ্চলের নামে যারা বিভক্ত করতে চায়, তাদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে। রাজ্য সরকারকে এদের চিহ্নিত করে শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে।
ইতিহাস বলেÑ জম্মু ও কাশ্মির ১৮৪৬ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ছিল ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি প্রিন্সলি স্টেট, যা শাসন করত রাজপুত ডুগরা রাজারা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে নামমাত্র সার্বভৌম স্টেটগুলোকে বলা হতো প্রিন্সলি স্টেট বা ন্যাটিভ স্টেট। ১৮৪৬ সালে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের পর জম্মু ও কাশ্মির স্টেট গঠন করা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এর সাথে কাশ্মির উপত্যকাকে সংযুক্ত করে গোলাব সিংয়ের কাছে হস্তান্তর করে ৭৫ লাখ রুপির ইনডেমনিটি পরিশোধের বিনিময়ে। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হয়। তখন এই রাজ্যে মুসলমানেরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু এই স্টেট ছিল অমুসলিম মহারাজা হরি সিংয়ের শাসনাধীনে। তখন প্রশ্ন দেখা দেয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই জম্মু ও কাশ্মির কার পক্ষে যোগ দেবেÑ পাকিস্তানের পক্ষে, না ভারতের, না এই দুই দেশের কোনোটির সাথে সংযুক্ত না হয়ে নিরপেক্ষ স্বাধীন কাশ্মির রাষ্ট্র গঠন করবে? এ নিয়ে নানা বিশৃঙ্খলা চলার মধ্য দিয়েই মহারাজা হরি সিং সামরিক সহায়তার বিনিময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই রাজ্যকে ভারতীয় ডোমিনিয়নে যোগ দেয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করে ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর। এ নিয়ে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই রাজ্যের পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর নিয়ন্ত্রণ চলে যায় পাকিস্তানের হাতে, যা আজ আজাদ কাশ্মির ও গিলগিটস্তান নামে পরিচিত। একাংশ চলে যায় ভারতের নিয়ন্ত্রণে, যা ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মির নামে পরিচিত। উল্লেখ্য, কাশ্মিরের ২০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে চীনের হাতে, যা আকসাই চীন নামেও পরিচিত।
এখানে একটা কথা বলা দরকার, জম্মু ও কাশ্মির হাইকোর্ট সুস্পষ্টভাবে এক রায়ে বললেন, জম্মু ও কাশ্মির ভারতের কোনো অংশ নয়। ২০১০ সালের দিকে ভারতের স্পষ্টবাদী লেখিকা অরুন্ধতী রায় ঠিক একই কথা বলে ছিলেন : ‘কাশ্মির ইজ নট অ্যা পার্ট অব ইন্ডিয়া।’ এই সত্য উপলব্ধির ওপর ভর করে ওই সময় নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে তিনি বলেছিলেন : ‘কাশ্মির শুড গেট আজাদি ফ্রম ভুখে নাঙ্গে ইন্ডিয়া।’
এই বক্তব্যের পর তার বিরোধীরা এই বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল বলে হইচই শুরু করে দেয়। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়েরের জন্য সরকারের কাছে দাবি তোলে । এর জের ধরে ২০১০ সালের ২৯ নভেম্বর ভারতের পুলিশ নয়াদিল্লিতে ভারতীয় এই স্পষ্টবাদী বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মীর বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করে। তার বিরুদ্ধে পুলিশ শ্রীনগরে ২১ অক্টোবরে আয়োজিত ‘আজাদি : দ্য অনলি ওয়ে’ শীর্ষক এক সেমিনারে তথাকথিত ভারতবিরোধী বক্তব্য রাখার অভিযোগ তোলে এই মামলায়। এ সময় তাকে গ্রেফতারের নানা হুমকিও চার দিক থেকে আসতে শুরু করে। কারণ তিনি বক্তব্যে দাবি করেছেন, জম্মু ও কাশ্মির উপত্যকা কখনোই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল না। আর এটিই হচ্ছে একটি ঐতিহাসিক সত্য। তিনি এ কথাও বলেছেন, ভারত সরকারের উচিত কাশ্মিরের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা মেনে নেয়া। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার মেনে নেয়া।
তার বিরুদ্ধে এই রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার নানা ক্রিয়া-প্রক্রিয়া যখন চলছিল, তখন অরুন্ধতী রায় ২০১০ সালের ২৮ নভেম্বর ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় একটি কলাম লেখেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেনÑ দিল্লি পুলিশকে কোর্ট আদেশ দিয়েছে আমার বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করতে। আমার মনে হয়, সম্ভবত তাদের উচিত জওয়াহেরলার নেহরুর বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদ্রোহের একটি মরণোত্তর মামলা করা। কেনো তা করা উচিত, এর জবাবও তিনি তার এ লেখায় দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৪৭ সালের ২৭ অক্টোবর জওয়াহেরলাল নেহরু ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো এক টেলিগ্রামে লিখেছিলেন : 'I should like to make it clear that the question of aiding Kashmir in this emergency is not designed in any way to influence the state to accede to India. Our view which we have repeatedly made public is that the question of accession in any disputed territory or state must be decided in accordance with wishes of people and we adhere to this view.' (Telegram 402 Primin-2227 dated 27th October, 1947 to PM of Pakistan repeating telegram addressed to PM of UK).
এ ছাড়া এর চার দিন পর ৩১ অক্টোবর তিনি আরেকটি টেলিগ্রাম পাঠান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানের কাছে, যাতে তিনি উল্লেখ করেন : "Kashmir's accession to India was accepted by us at the request of the Maharaja's government and the most numerously representative popular organization in the state which is predominantly Muslim. Even then it was accepted on condition that as soon as law and order had been restored, the people of Kashmir would decide the question of accession. It is open to them to accede to either Dominion (India or Pakistan) then."
কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই দু’টি টেলিগ্রামেই নেহরু কাশ্মিরের জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের পাকিস্তান বা ভারতে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বাস্তবে তা তিনি করেননি। সে প্রতিশ্রুতি তিনি ও তার দেশ শতভাগ ভঙ্গ করেছে। বরং তা না করে তিনি আরো দু’টি প্রিন্সলি স্টেট হায়দরাবাদ ও জুনাগড় দখল করতে সেখানে ভারতীয় সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। এবং সামরিক অভিযান চালিয়েই ভারত স্টেট দু’টি দখল করে। অথচ এই দু’টি রাজ্য পাকিস্তানের সাথে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সে ইতিহাস কারো অজানা নয়।
কাশ্মিরের মানুষের পক্ষে কথা বলার জন্য যখন অরুন্ধতীকে রাষ্ট্রদ্রোহী প্রমাণের তোড়জোড় চলছিল নানা মহল থেকে, তখন তিনি ২০১০ সালের ২৬ অক্টোবর এক বিবৃতি প্রকাশ করে একটি কথাই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তার ভাষায়Ñ “আমার বক্তব্যের কপিটি মনোযোগের সাথে পড়ে দেখলে বুঝতে পারবেন, সেখানে আমার মৌল আহ্বানটি ছিল ন্যায়বিচার। আমি কথা বলেছি কাশ্মিরের জনগণের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য, যারা এখন বসবাস করছেন বিশ্বের ‘মোস্ট ব্রুটাল মিলিটারি অকুপেশনে’র অধীনে।”
কাশ্মিরের মানুষ তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার চায়। এরা চায় না ভারত থেকে বেরিয়ে পাকিস্তানে যোগ দিতে। কিংবা পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে ভারতে যোগ দিতে। কাশ্মির ভারতের নয়, পাকিস্তানেরও নয়। কাশ্মির কাশ্মিরিদের। এরা চায় স্বাধীন কাশ্মির। আজাদ কাশ্মির। শুধু জম্মু ও কাশ্মির নয়, লাদাখ মুজাফ্ফরাবাদ, মিরপুর সমগ্র কাশ্মির এদের। সে কাশ্মিরের কথাই বলছে কাশ্মিরিরা। সে কাশ্মির পাওয়ার পথ একটাই : আজাদি দ্য অনলি ওয়ে। সে জন্য চাই এক অমোঘ সত্যের উপলব্ধি : ‘কাশ্মির ইজ নট অ্যা পার্ট অব ইন্ডিয়া’। এই দুই সত্য মেনে নেয়ায় ভারতের ব্যর্থতা ক্ষমাহীন সীমাহীন। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গই যেন এ ক্ষেত্রে ভারতের অঙ্গভূষণ। জওয়াহেরলাল নেহরুর আরেকটি প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েই এ লেখার ইতি টানতে চাই। ১৯৪৭ সালের ২১ নভেম্বর তিনি তার ৩৬৮ নম্বর চিঠিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে লিখেছিলেন :'I have repeatedly stated that as soon as peace and order have been established, Kashmir should decide of accession by Plebiscite or referendum under international auspices such as those of United Nations.' (এভাবে পরবর্তী সময়ে নেহরু কাশ্মিরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রশ্নে রেফারেন্ডাম দেয়ার প্রতিশ্রুতি বারবার উল্লেখ করেছেন)
নেহরুর প্রতিশ্রুত কাশ্মিরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সেই রেফারেন্ডাম বা গণভোটের কথা ভারতীয় শাসকেরা কোনো দিন মুখে আনছেন না। আশা করি, কাশ্মিরের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে নেহরুর দায়ভার পরিমাপ ও তা পালনে তার ও তার পরবর্তী ভারতীয় নেতাদের ব্যর্থতার মাত্রাটা এবার অন্তত উপলব্ধিতে নেবেন। কাশ্মির সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসবেন। অনেক হয়েছে আর নয়। স্বাধীনতার কথা বলতে কাশ্মিরিরা আর কত নির্যাতিত হবেন?
No comments