৪০০ বছরের ঐতিহ্যে সন্ত্রাসের থাবা
বোমা
হামলায় রক্তাক্ত হলো শিয়া মুসলিমদের তাজিয়া মিছিল। কারবালার শোককে ধারণ
করে শিয়া সম্প্রদায়ের বার্ষিক এ আয়োজনে বোমা হামলার ঘটনায় রক্তরঞ্জিত হলো
৪০০ বছরের ঐতিহ্য। সন্ত্রাসের কালো থাবায় শোকের মিছিলেই প্রাণ গেলো কিশোর
সাজ্জাদের। আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। প্রায় চারশ’ বছর ধরে ধর্মীয়
সম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন হিসেবে পুরান ঢাকার হোসেনি দালান থেকে মহররমের
তাজিয়া মিছিল বের হয়ে আসছে। এবারই প্রথম এতে হামলার ঘটনা ঘটলো।
গত শুক্রবার মধ্যরাতে তাজিয়া মিছিল বের করার প্রস্তুতি নেয়ার সময় দুর্বৃত্তদের পাঁচটি হাতবোমার বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়ে উঠে হোসেনি দালানের ইমামবাড়া। শোক মিছিলের প্রস্তুতি বাদ দিয়ে দিগ্বিদিক ছুটতে হয় জড়ো হওয়া হাজারো মানুষকে। বোমা হামলায় লুটিয়ে পড়লেন নারী-শিশুসহ শতাধিক মানুষ। আতঙ্কিত হয়ে পরে পুরো এলাকার অধিবাসীরা। কান্না আর আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে শোক মিছিল। যে যেভাবে পেরেছেন ছুটে গেছেন নিরাপদ দূরত্বে। ছুটতে গিয়ে পদদলিত হয়েছেন অনেকে। পরক্ষণেই আহতদের উদ্ধার করে নেয়া হয় ঢাকা মেডিক্যালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে। যদিও তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি উপলক্ষে ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিল পুরো এলাকায়। কিন্তু এত নিরাপত্তার মধ্যেও দুর্বৃত্তরা হামলার পর নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে ছুটে যান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। রাতেই পুরো এলাকা কর্ডন করা হয়। জব্দ করা হয় বিস্ফোরিত বোমার বিভিন্ন খণ্ডাংশ। উদ্ধার করা হয় তাজা বোমাও। ঘটনার পর পর পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অন্তত ৪-৫ জনকে আটক করেছে। গতকাল এ ঘটনায় চকবাজার থানা পুলিশের পক্ষ থেকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গতকালই মামলাটির তদন্তভার ডিবিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। এদিকে ঘটনার প্রায় ১৪ ঘণ্টা পর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ এ হামলায় আইএসের দায় স্বীকারের কথা জানায়। যদিও সরকারের দায়িত্বশীলরা এ ঘটনায় আইএসের সংশ্লিষ্টতা উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতেই পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালানো হয়েছে। যদিও গতকাল পর্যন্ত হামলায় জড়িত কাউকে আটক করতে পারেনি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। এ বোমা হামলার পর অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য তাদের নাগরিকদের জন্য নতুন করে ভ্রমণ সতর্কতা জারি করেছে। নিন্দা জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে ‘কিছু হলেই’ আইএস-এর নামে দায় স্বীকারের যেসব বার্তা আসছে, তার পেছনে ‘অন্য কোন উদ্দেশ্য’ রয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ‘সাংগঠনিকভাবে’ আইএস-এর অস্তিত্ব থাকার কোন প্রমাণ পায়নি গোয়েন্দারা। অথচ একটা কিছু হলেই তাৎক্ষণিকভাবে আইএস বিবৃতি দিচ্ছে। এটা প্রপাগান্ডা হতে পারে, এর পেছনে উদ্দেশ্য থাকতে পারে। মন্ত্রী বলেন, আমরা তদন্ত করছি। যারাই হরকাতুল জিহাদ, তারাই হুজি, তারাই জেএমবি, তারাই আনসারুল্লাহ, তারাই শিবির। সবই একসূত্রে গাঁথা।’ ঘটনার পরদিন হাসপাতালে আহতদের দেখতে গিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, আমরা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছি, এটা স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের কাজ। পুলিশের এএসআই হত্যাকাণ্ড আর এই বোমা বিস্ফোরণ একই সূত্রে গাঁথা। এসআই হত্যার ঘটনায় আটক মাসুদ রানার তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ বোমা ও ককটেল উদ্ধার করেছে। ওই বোমার সঙ্গে হোসেনি দালানে বিস্ফোরিত বোমার মিল রয়েছে। এতে মনে হয় একই চক্র এ নাশকতা ঘটিয়েছে। আইজিপি বলেন, এই চক্রটি হত্যা ও নাশকতা চালানোর জন্য বিভিন্ন গ্রুপকে দায়িত্ব দিয়েছিল। যাদের একটি গ্রুপ এএসআইকে হত্যা করেছে, আরেকটি গ্রুপ হোসেনি দালানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়।
এদিকে রাতে বোমা হামলার পর সকালে তাজিয়া মিছিল বের করা নিয়ে সংশয় দেখা দিলেও হোসেনি দালান কর্তৃপক্ষ সকালে মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত নেয়। মিছিলে কয়েক হাজার লোক অংশ নেন। হোসেনি দালান থেকে মিছিলটি ধানমন্ডির ঝিগাতলায় গিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়।
হামলাকারী দু’জন: ঘটনার পর সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার বরাত দিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, তাজিয়া মিছিলের হামলায় অংশ নিয়েছিল দুই দুর্বৃত্ত। দু’জনের মধ্যে একজন হাতে তৈরি গ্রেনেডগুলো ছুড়ে মারে। অপরজন ছিল তার সহযোগী। সিসিটিভি ফুটেজে হামলাকারী দুজনের একজনকে বোমা নিক্ষেপ করতে দেখা গিয়েছে বলে গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। ওই কর্মকর্তা জানান, ইমামবাড়ার ভেতরের কবরস্থানের এক পাশ থেকে বোমা হামলা চালানো হয়। ওই জায়গাটি কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। একারণে দুর্বৃত্তরা ওই স্থানে গিয়ে হামলা চালায়। সিসিটিভির ফুটেজে তাদের চেহারা পরিষ্কারভাবে দেখা যায় না। তবে চেহারা দেখে তাদের চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা চলছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ইমামবাড়ায় সাধারণ সময়ে তাদের নিজস্ব ১৬টি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো থাকে। তাজিয়া মিছিল উপলক্ষে আরও ১৬টি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছিল পুলিশের পক্ষ থেকে। সবগুলো ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব ফুটেজ বিশ্লেষণ করে হামলাকারীদের শনাক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ছদ্মবেশে ঢুকেছিল দুর্বৃত্তরা: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হামলাকারী দুর্বৃত্তরা ছদ্মবেশে ইমামবাড়ায় ঢুকেছিল। তাজিয়া মিছিল উপলক্ষে ইমামবাড়ার ভেতরে শিয়া মুসলিম ছাড়াও সুন্নি মুসলিমরা যোগ দেন ও নানা বিষয়ে ‘মানত’ করে থাকেন। পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা, দুর্বৃত্তরা শিয়া ছদ্মবেশে ইমামবাড়ার ভেতরে ঢুকেছিল। সিসিটিভি ফুটেজে তাদের শরীরে তাজিয়া মিছিলের অংশ নেয়ার জন্য লাল-নীল কাপড়ও ছিল। গ্রেনেড নিক্ষেপকারী দুইজন মানুষের ভিড়ের সঙ্গে মিশে হোসেনি দালানের ভেতরে কবরস্থানের কর্ণারে গিয়ে অবস্থান নেয়। হামলার পর দুর্বৃত্তরা ইমামবাড়ার পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়। গোয়েন্দা সংশ্লিষ্টরা জানান, বোমা বিস্ফোরণের পরপরই সবাই পড়িমরি করে দৌড়াতে থাকে। এই সুযোগে হামলাকারীরাও নিরাপদে পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে বের হয়ে যায়। কারণ হিসেবে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, ইমামবাড়ার সামনের রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসংখ্য সদস্য মোতায়েন ছিল। হামলাকারীরা এ কারণে সামনের দিকে আসেনি। আর ইমামবাড়া কর্তৃপক্ষ বরাবরের মতো ভেতরে নিজেরাই ভলান্টিয়ার দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব নিয়েছিল। বাইরে অংশে মোতায়েন করা হয়েছিল র্যাব-পুলিশ সদস্যদের। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের ধারণা ছিল অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরির জন্য কেউ হামলা চালাতে চাইলে ইমামবাড়ার সামনের রাস্তায় হামলা হতে পারে। ইমামবাড়া কর্তৃপক্ষও ভাবতে পারেনি দুর্বৃত্তরা ভেতরে ঢুকে হামলা চালাতে পারে।
নিক্ষেপ করা হয় ৫টি গ্রেনেড: গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় মোট ৫টি হাতে তৈরি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এর মধ্যে তিনটি বিস্ফোরিত হয়েছে। একটি অবিস্ফোরিত রয়েছে আর অপর একটি পিন খোলা হলেও সেটি বিস্ফোরিত না হয়ে অকার্যকর হয়ে যায়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা জানান, হামলায় ব্যবহৃত বোমাগুলো জিআই পাইপ কেটে ভেতরে ডেটোনেটর বসিয়ে তৈরি করা হয়। এর ভেতরে বিস্ফোরক থাকলেও স্প্লিন্টার ছিল না। প্রতিটি গ্রেনেডের ওজন ছিল আনুমানিক ৬০০ গ্রাম করে। বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা জানান, হাতে তৈরি এসব গ্রেনেডের ভেতরে ১৫০ ভোল্টের ৪টি করে ব্যাটারি যুক্ত করা ছিল। আর পিন খোলার ৫ সেকেন্ডের মধ্যে বিস্ফোরিত হবে এমনভাবে এসব তৈরি করা হয়েছিল। বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ছানোয়ার হোসেন বলেন, হামলায় ব্যবহৃত বোমাগুলো মধ্যমমানের। বিস্ফোরণের পর জিআই পাইপের ক্ষুদ্রাংশগুলো স্প্লিন্টার হিসেবে মানুষের শরীরে গিয়ে আঘাত হেনেছে। এদিকে গতকালও ঘটনাস্থল থেকে গ্রেনেডের ক্লিপ উদ্ধার করেছে র্যাব-১০ এর একটি দল। র্যাব ১০-এর অধিনায়ক (সিও) জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর জানান, ঘটনাস্থল থেকে র্যাব চারটি হ্যান্ড গ্রেনেডের ক্লিপ উদ্ধার করেছে। এগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা: এদিকে শিয়া মুসলিমদের ওপর হামলার ঘটনায় গতকাল চকবাজার থানার এসআই জালাল উদ্দিন বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা (নং ১৯) দায়ের করেন। সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ (সংশোধিত ২০১৩) এর ধারা ৬(২) এর (এ) (বি) (সি) (ডি) (ই) মোতাবেক অপরাধ হয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়। মামলায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়েছে। মামলার অভিযোগে বলা হয়, মুসলিম শিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যরা প্রতিবছর পবিত্র আশুরা উপলক্ষে শোক মিছিল বের করে থাকে। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মিছিলে হাজার হাজার লোক অংশ নেয়। তাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাদেরকে ঐতিহ্যবাহী শোক মিছিল থেকে বিরত রাখা, বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিরাজমান সংহতি বিনষ্ট করা এবং জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করার লক্ষ্যে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাদের পরিকল্পনা এবং ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বোমা/গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একজনকে হত্যা ও শতাধিক ব্যক্তিকে জখম করে। পাশাপাশি ইমামবাড়ার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ধ্বংসের প্রচেষ্টা চালায়। ঘটনাস্থল এবং ঘটনার বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর একটি অংশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে তাদের ষড়যন্ত্র ও ধারাবাহিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বোমা/গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটনায় এবং তাদের অপর একটি অংশ ঘটনা সংঘটনে আর্থিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও নির্দেশনা প্রদান করে।
সন্দেহভাজন ৪-৫ জন আটক: তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় বোমা হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে ৪-৫ জনকে আটক করা হয়েছে। ঘটনার পরপর ইমামবাড়া কর্তৃপক্ষ তাদের আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে বলে জানা গেছে। গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, যাদের আটক করা হয়েছে তাদের কাছ থেকে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। আটককৃতদের একজন মাদকাসক্ত। পুলিশ এরই মধ্যে সন্দেহভাজনদের ধরতে অভিযান শুরু করেছে।
তদন্ত কমিটি গঠন: তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি মিছিলে বোমা হামলার ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ- ডিএমপি। এই কমিটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তায় কোন ব্যত্যয় ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখবে। আগামী সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) শেখ মুহাম্মদ মারুফ হাসান। অন্য দুই সদস্য হলেন- ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মাশরুকুর রহমান খালেদ।
গত শুক্রবার মধ্যরাতে তাজিয়া মিছিল বের করার প্রস্তুতি নেয়ার সময় দুর্বৃত্তদের পাঁচটি হাতবোমার বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়ে উঠে হোসেনি দালানের ইমামবাড়া। শোক মিছিলের প্রস্তুতি বাদ দিয়ে দিগ্বিদিক ছুটতে হয় জড়ো হওয়া হাজারো মানুষকে। বোমা হামলায় লুটিয়ে পড়লেন নারী-শিশুসহ শতাধিক মানুষ। আতঙ্কিত হয়ে পরে পুরো এলাকার অধিবাসীরা। কান্না আর আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে শোক মিছিল। যে যেভাবে পেরেছেন ছুটে গেছেন নিরাপদ দূরত্বে। ছুটতে গিয়ে পদদলিত হয়েছেন অনেকে। পরক্ষণেই আহতদের উদ্ধার করে নেয়া হয় ঢাকা মেডিক্যালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে। যদিও তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি উপলক্ষে ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিল পুরো এলাকায়। কিন্তু এত নিরাপত্তার মধ্যেও দুর্বৃত্তরা হামলার পর নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে ছুটে যান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। রাতেই পুরো এলাকা কর্ডন করা হয়। জব্দ করা হয় বিস্ফোরিত বোমার বিভিন্ন খণ্ডাংশ। উদ্ধার করা হয় তাজা বোমাও। ঘটনার পর পর পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অন্তত ৪-৫ জনকে আটক করেছে। গতকাল এ ঘটনায় চকবাজার থানা পুলিশের পক্ষ থেকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গতকালই মামলাটির তদন্তভার ডিবিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। এদিকে ঘটনার প্রায় ১৪ ঘণ্টা পর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ এ হামলায় আইএসের দায় স্বীকারের কথা জানায়। যদিও সরকারের দায়িত্বশীলরা এ ঘটনায় আইএসের সংশ্লিষ্টতা উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতেই পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালানো হয়েছে। যদিও গতকাল পর্যন্ত হামলায় জড়িত কাউকে আটক করতে পারেনি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। এ বোমা হামলার পর অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য তাদের নাগরিকদের জন্য নতুন করে ভ্রমণ সতর্কতা জারি করেছে। নিন্দা জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে ‘কিছু হলেই’ আইএস-এর নামে দায় স্বীকারের যেসব বার্তা আসছে, তার পেছনে ‘অন্য কোন উদ্দেশ্য’ রয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ‘সাংগঠনিকভাবে’ আইএস-এর অস্তিত্ব থাকার কোন প্রমাণ পায়নি গোয়েন্দারা। অথচ একটা কিছু হলেই তাৎক্ষণিকভাবে আইএস বিবৃতি দিচ্ছে। এটা প্রপাগান্ডা হতে পারে, এর পেছনে উদ্দেশ্য থাকতে পারে। মন্ত্রী বলেন, আমরা তদন্ত করছি। যারাই হরকাতুল জিহাদ, তারাই হুজি, তারাই জেএমবি, তারাই আনসারুল্লাহ, তারাই শিবির। সবই একসূত্রে গাঁথা।’ ঘটনার পরদিন হাসপাতালে আহতদের দেখতে গিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, আমরা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছি, এটা স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের কাজ। পুলিশের এএসআই হত্যাকাণ্ড আর এই বোমা বিস্ফোরণ একই সূত্রে গাঁথা। এসআই হত্যার ঘটনায় আটক মাসুদ রানার তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ বোমা ও ককটেল উদ্ধার করেছে। ওই বোমার সঙ্গে হোসেনি দালানে বিস্ফোরিত বোমার মিল রয়েছে। এতে মনে হয় একই চক্র এ নাশকতা ঘটিয়েছে। আইজিপি বলেন, এই চক্রটি হত্যা ও নাশকতা চালানোর জন্য বিভিন্ন গ্রুপকে দায়িত্ব দিয়েছিল। যাদের একটি গ্রুপ এএসআইকে হত্যা করেছে, আরেকটি গ্রুপ হোসেনি দালানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়।
এদিকে রাতে বোমা হামলার পর সকালে তাজিয়া মিছিল বের করা নিয়ে সংশয় দেখা দিলেও হোসেনি দালান কর্তৃপক্ষ সকালে মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত নেয়। মিছিলে কয়েক হাজার লোক অংশ নেন। হোসেনি দালান থেকে মিছিলটি ধানমন্ডির ঝিগাতলায় গিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়।
হামলাকারী দু’জন: ঘটনার পর সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার বরাত দিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, তাজিয়া মিছিলের হামলায় অংশ নিয়েছিল দুই দুর্বৃত্ত। দু’জনের মধ্যে একজন হাতে তৈরি গ্রেনেডগুলো ছুড়ে মারে। অপরজন ছিল তার সহযোগী। সিসিটিভি ফুটেজে হামলাকারী দুজনের একজনকে বোমা নিক্ষেপ করতে দেখা গিয়েছে বলে গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। ওই কর্মকর্তা জানান, ইমামবাড়ার ভেতরের কবরস্থানের এক পাশ থেকে বোমা হামলা চালানো হয়। ওই জায়গাটি কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। একারণে দুর্বৃত্তরা ওই স্থানে গিয়ে হামলা চালায়। সিসিটিভির ফুটেজে তাদের চেহারা পরিষ্কারভাবে দেখা যায় না। তবে চেহারা দেখে তাদের চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা চলছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ইমামবাড়ায় সাধারণ সময়ে তাদের নিজস্ব ১৬টি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো থাকে। তাজিয়া মিছিল উপলক্ষে আরও ১৬টি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছিল পুলিশের পক্ষ থেকে। সবগুলো ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব ফুটেজ বিশ্লেষণ করে হামলাকারীদের শনাক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ছদ্মবেশে ঢুকেছিল দুর্বৃত্তরা: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হামলাকারী দুর্বৃত্তরা ছদ্মবেশে ইমামবাড়ায় ঢুকেছিল। তাজিয়া মিছিল উপলক্ষে ইমামবাড়ার ভেতরে শিয়া মুসলিম ছাড়াও সুন্নি মুসলিমরা যোগ দেন ও নানা বিষয়ে ‘মানত’ করে থাকেন। পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা, দুর্বৃত্তরা শিয়া ছদ্মবেশে ইমামবাড়ার ভেতরে ঢুকেছিল। সিসিটিভি ফুটেজে তাদের শরীরে তাজিয়া মিছিলের অংশ নেয়ার জন্য লাল-নীল কাপড়ও ছিল। গ্রেনেড নিক্ষেপকারী দুইজন মানুষের ভিড়ের সঙ্গে মিশে হোসেনি দালানের ভেতরে কবরস্থানের কর্ণারে গিয়ে অবস্থান নেয়। হামলার পর দুর্বৃত্তরা ইমামবাড়ার পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়। গোয়েন্দা সংশ্লিষ্টরা জানান, বোমা বিস্ফোরণের পরপরই সবাই পড়িমরি করে দৌড়াতে থাকে। এই সুযোগে হামলাকারীরাও নিরাপদে পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে বের হয়ে যায়। কারণ হিসেবে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, ইমামবাড়ার সামনের রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসংখ্য সদস্য মোতায়েন ছিল। হামলাকারীরা এ কারণে সামনের দিকে আসেনি। আর ইমামবাড়া কর্তৃপক্ষ বরাবরের মতো ভেতরে নিজেরাই ভলান্টিয়ার দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব নিয়েছিল। বাইরে অংশে মোতায়েন করা হয়েছিল র্যাব-পুলিশ সদস্যদের। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের ধারণা ছিল অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরির জন্য কেউ হামলা চালাতে চাইলে ইমামবাড়ার সামনের রাস্তায় হামলা হতে পারে। ইমামবাড়া কর্তৃপক্ষও ভাবতে পারেনি দুর্বৃত্তরা ভেতরে ঢুকে হামলা চালাতে পারে।
নিক্ষেপ করা হয় ৫টি গ্রেনেড: গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় মোট ৫টি হাতে তৈরি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এর মধ্যে তিনটি বিস্ফোরিত হয়েছে। একটি অবিস্ফোরিত রয়েছে আর অপর একটি পিন খোলা হলেও সেটি বিস্ফোরিত না হয়ে অকার্যকর হয়ে যায়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা জানান, হামলায় ব্যবহৃত বোমাগুলো জিআই পাইপ কেটে ভেতরে ডেটোনেটর বসিয়ে তৈরি করা হয়। এর ভেতরে বিস্ফোরক থাকলেও স্প্লিন্টার ছিল না। প্রতিটি গ্রেনেডের ওজন ছিল আনুমানিক ৬০০ গ্রাম করে। বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা জানান, হাতে তৈরি এসব গ্রেনেডের ভেতরে ১৫০ ভোল্টের ৪টি করে ব্যাটারি যুক্ত করা ছিল। আর পিন খোলার ৫ সেকেন্ডের মধ্যে বিস্ফোরিত হবে এমনভাবে এসব তৈরি করা হয়েছিল। বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ছানোয়ার হোসেন বলেন, হামলায় ব্যবহৃত বোমাগুলো মধ্যমমানের। বিস্ফোরণের পর জিআই পাইপের ক্ষুদ্রাংশগুলো স্প্লিন্টার হিসেবে মানুষের শরীরে গিয়ে আঘাত হেনেছে। এদিকে গতকালও ঘটনাস্থল থেকে গ্রেনেডের ক্লিপ উদ্ধার করেছে র্যাব-১০ এর একটি দল। র্যাব ১০-এর অধিনায়ক (সিও) জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর জানান, ঘটনাস্থল থেকে র্যাব চারটি হ্যান্ড গ্রেনেডের ক্লিপ উদ্ধার করেছে। এগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা: এদিকে শিয়া মুসলিমদের ওপর হামলার ঘটনায় গতকাল চকবাজার থানার এসআই জালাল উদ্দিন বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা (নং ১৯) দায়ের করেন। সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ (সংশোধিত ২০১৩) এর ধারা ৬(২) এর (এ) (বি) (সি) (ডি) (ই) মোতাবেক অপরাধ হয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়। মামলায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়েছে। মামলার অভিযোগে বলা হয়, মুসলিম শিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যরা প্রতিবছর পবিত্র আশুরা উপলক্ষে শোক মিছিল বের করে থাকে। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মিছিলে হাজার হাজার লোক অংশ নেয়। তাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাদেরকে ঐতিহ্যবাহী শোক মিছিল থেকে বিরত রাখা, বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিরাজমান সংহতি বিনষ্ট করা এবং জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করার লক্ষ্যে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাদের পরিকল্পনা এবং ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বোমা/গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একজনকে হত্যা ও শতাধিক ব্যক্তিকে জখম করে। পাশাপাশি ইমামবাড়ার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ধ্বংসের প্রচেষ্টা চালায়। ঘটনাস্থল এবং ঘটনার বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর একটি অংশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে তাদের ষড়যন্ত্র ও ধারাবাহিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বোমা/গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটনায় এবং তাদের অপর একটি অংশ ঘটনা সংঘটনে আর্থিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও নির্দেশনা প্রদান করে।
সন্দেহভাজন ৪-৫ জন আটক: তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় বোমা হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে ৪-৫ জনকে আটক করা হয়েছে। ঘটনার পরপর ইমামবাড়া কর্তৃপক্ষ তাদের আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে বলে জানা গেছে। গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, যাদের আটক করা হয়েছে তাদের কাছ থেকে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। আটককৃতদের একজন মাদকাসক্ত। পুলিশ এরই মধ্যে সন্দেহভাজনদের ধরতে অভিযান শুরু করেছে।
তদন্ত কমিটি গঠন: তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি মিছিলে বোমা হামলার ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ- ডিএমপি। এই কমিটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তায় কোন ব্যত্যয় ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখবে। আগামী সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) শেখ মুহাম্মদ মারুফ হাসান। অন্য দুই সদস্য হলেন- ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মাশরুকুর রহমান খালেদ।
No comments