সন্ত্রাস ও গণতন্ত্র খাদের কিনারায় বাংলাদেশ
বাংলাদেশে
ইসলামপন্থি জঙ্গিদের বিস্তার ঘটেছে। এক্ষেত্রে দেশটি অবস্থান করছে খাদের
কিনারায়। রয়েছে সন্ত্রাস ও গণতন্ত্রের মাঝামাঝি অবস্থানে। এ জন্য প্রয়োজন
একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। সন্ত্রাসকে দূর করতে হবে। বাংলাদেশকে বাঁচাতে
হলে অবদান রাখতে হবে পশ্চিমাদের। এ নিয়ে অনলাইন দ্য ডিপ্লোম্যাটে দীর্ঘ এক
নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ২৮শে সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ওই নিবন্ধের শিরোনাম
‘বাংলাদেশ অন দ্য ব্রিঙ্ক: বিটুইন টেরোরিজম অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’। এর লেখক
আলেকজান্দ্রা স্টারক। তিনি জর্জটাউন ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
বিষয়ে পিএইচডি করছেন। তিনি লিখেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সমঝোতায়
আসতে বাংলাদেশের প্রধান দুটি বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা
উচিত নীতিনির্ধারকদের। যদিও বাংলাদেশের রাজনীতি গভীরভাবে মেরুকরণ করা তবুও
সম্মিলিত রাজনৈতিক চাপ ও উন্নয়ন সহায়তার মাধ্যমে উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে
হবে- যাতে তারা ঐকমত্যে আসেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে আওয়ামী লীগ যাতে
অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করে- বিএনপির সাম্প্রতিক এক সিদ্ধান্ত এমন দাবির
দৃশ্যত ইতি ঘটেছে। এতে ইঙ্গিত মেলে যে, সমঝোতা হওয়ার জন্য একটি চমৎকার
সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ওই লেখায় তিনি সন্ত্রাস ও গণতন্ত্রের মধ্যে বাংলাদেশ
কেমন আছে এবং এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কি করা উচিত তা নিয়ে
আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যরা
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও দুর্নীতি বিরোধী পদক্ষেপে সমর্থন দিয়ে উভয়পক্ষকে
আশ্বস্ত করতে পারে যে, নির্বাচন হবে সুষ্ঠু। ওই নিবন্ধে বাংলাদেশে
নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
বলা হয়, এর ইতি ঘটাতে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে। মানবাধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা হিউম্যান
রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত অভিজাত
বাহিনী র্যাব সরকারবিরোধীদের ওপর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম,
নির্যাতনে লিপ্ত। র্যাবকে জবাবদিহির আওতায় আনা হলে সরকারের দুর্নীতিবিরোধী
প্রচেষ্টায় আস্থা সৃষ্টি হবে। এতে রাজনৈতিক সহিংসতার যে স্পৃহা, তার
প্রতিশোধ নেয়ার প্রবণতা কমবে। রাজনৈতিক অকার্যকারিতা ও রাষ্ট্রসমর্থিত
মানবাধিকার লঙ্ঘন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং রাষ্ট্রের
বৈধতাকে নষ্ট করছে। বাংলাদেশ নিয়ে বিদ্রূপাত্মক একটি দৃৃষ্টিভঙ্গি আছে। তা হলো-
এখানে গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটেছে। এর ফলে রাজনৈতিক সহিংসতা ও মৌলবাদের
সৃষ্টি হচ্ছে। একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন ও র্যাবের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন
করা হলে এ অবস্থার বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি ফেরানো যাবে। ওই নিবন্ধে আরও বলা হয়,
সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে দমন করতে বাংলাদেশ সরকারকে তার প্রচেষ্টায় সহায়তা
করা উচিত নীতিনির্ধারকদের। সম্প্রতি ব্লগারদের ওপর আক্রমণ রাজনৈতিক অঙ্গনে
ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামা’আতুল মুজাহেদীনের
বিরুদ্ধে সরকারের ক্রমবর্ধমান চাপ প্রয়োগের সুন্দর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে দমনপীড়নের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে সৃষ্টি হয়েছে
বেশ কিছু সন্ত্রাসী গ্রুপ, যাদের চিহ্নিত করা কঠিন। এর মধ্যে অনেক গ্রুপ
প্রচারণার নিম্ন স্তরে রয়েছে। তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সেলে বিভক্ত। তারা
ব্যক্তিবিশেষের সঙ্গে যুক্ত। তারা নিঃসঙ্গ নেকড়ের মতো হামলা করে। গোয়েন্দা
সহায়তা ও সরকারকে সন্ত্রাসীবিরোধী প্রশিক্ষণ দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়
বাংলাদেশকে সহায়তা করতে পারে। সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে নিষিদ্ধ করে তাদের
মূলোৎপাটনে সহায়তা করতে পারে। নিবন্ধে আরও বলা হয়, ‘নাস্তিক ব্লগারদের মতো
ব্যক্তিদের নিরাপত্তা সহায়তায় বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে পারে আন্তর্জাতিক
সম্প্রদায়। এসব ব্লগারের কণ্ঠ তাদের ওপর হামলার কারণে নীরব হয়ে গেছে। এ বছর
চারজন ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে। নিহত ব্লগাররা ৮৪ নাস্তিকের হিটলিস্টে
ছিল। এতে অন্যরা যে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবেন এমন আশঙ্কা জাগিয়ে তুলেছে।
এমন হুমকির মুখে যারা রয়েছেন তাদেরকে নিরাপত্তা দিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করা
উচিত সরকারের। নিবন্ধে আলেকজান্দ্রা স্টারক লিখেছেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক
সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পণ্ডিতজন ও বিশ্লেষকদের কাছে এ বিষয়টি তেমন নজর
কাড়ে নি। বাংলাদেশে এখন বড় হুমকি ও প্রত্যাশিত গণতন্ত্রের মডেল- এ দুটি
জিনিসই আছে। কট্টর ইসলামপন্থি গ্রুপগুলো ক্রমবর্ধমান হারে সহিংসতায়
জড়াচ্ছে। ইসলাম ও রাজনীতি নিয়ে একরকম লড়াই চলছে এখানে। যারা ইসলামকে
উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও শান্তিপূর্ণ সম্পর্কের অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখে এবং যারা
কট্টরপন্থি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমাজকে দেখে, প্রতিবেশী দেশগুলোতে সন্ত্রাস
পাচার করতে চায়- তাদের জন্য বাংলাদেশ হবে গুরুত্ব বোঝানোর একটি স্থান। এতে
বলা হয়, বাংলাদেশ হলো বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ মুসলিম দেশ। এখানে মাথাপিছু
বার্ষিক আয় ১০৮০ ডলার। বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম এ
দেশটি। স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশটি স্থিতিশীল গণতন্ত্রের পথে ধাবিত। তবে
বেশ কয়েকবার সামরিক অভ্যুত্থান তাতে বাধাগ্রস্ত করেছে। উদার ইসলামের সঙ্গে
ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ধারণা মিলিয়ে বাংলাদেশে যে মডেল, তা হতে পারে
আঞ্চলিকতার জন্য মডেল। কট্টর ইসলামী সহিংসতার হুমকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। এর
মূল নিহিত রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তার পরের সহিংসতার মধ্যে। অপেক্ষাকৃত
কম কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দক্ষিণ এশিয়ায়
কট্টরপন্থি ইসলামী গ্রুপগুলোকে ‘না’ বলতে পারে। তাদের জন্য থাকতে পারে
আধুনিক ইসলামিক গণতন্ত্র। তা করতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতাকে
উৎসাহিত করা যেতে পারে। রাজনৈতিক সহিংসতার রয়েছে এক জটিল ইতিহাস। ১৯৭১ সালে
পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই দুটি প্রধান
রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক অঙ্গনে আধিপত্য বিস্তার করে আছে। তার একটি হলো
ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অন্যটি হলো তাদের ঘোর
প্রতিদ্বন্দ্বী মধ্য-ডানপন্থি বিএনপি। এ দলটির সঙ্গে রয়েছে সবচেয়ে বড়
ইসলামপন্থি দল জামায়াতে ইসলামীর মিত্রতা। স্বাধীনতার পর থেকে তারাই
পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় এসেছে। দু’দলের মধ্যে দুর্নীতি ও সহিংসতার কারণে এর
মাঝে ঘটেছে সামরিক অভ্যুত্থান। ২০০৯ সালে নির্বাচনে জয়লাভের পর আওয়ামী লীগ
নেতৃত্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠিত করে ‘বিতর্কিত’ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত।
উদ্দেশ্য, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানপন্থিদের
নৃশংসতায় সহায়তা করেছিল তাদের বিচার করা। এর বেশির ভাগই পরে জামায়াতে
ইসলামীর নেতা হয়েছেন। তাদেরকে শাস্তি দেয়ায় তীব্র বিক্ষোভ হয়েছে। রাজনীতিতে
ঘটেছে মেরুকরণ। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত যখন আবদুল কাদের মোল্লাকে ২০১৩
সালের ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণ, গণহত্যার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় তখন
ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগাররা বিক্ষোভ করেন। তাতে যোগ দেয় হাজার হাজার মানুষ। তারা
কাদের মোল্লার শাস্তিকে লঘু বলে মন্তব্য করে তার ফাঁসি দাবি করে। তাদের এই
আন্দোলন শাহবাগ আন্দোলন নামে পরিচিত। এ সময় পাল্টা বিক্ষোভ ডাকে হেফাজতে
ইসলাম। তারা যানবাহন ভাঙচুর এবং বিভিন্ন শহরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত
হয়। তারা সরকারের কাছে ১৩ দফা দাবি তুলে ধরে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে যে জাতীয়
নির্বাচন হয় তার কাছাকাছি সময়ে এ ঘটনা ঘটে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একে
বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা বলে অভিহিত করে। আওয়ামী লীগ নির্দলীয়
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। জবাবে বিএনপি
ও জামায়াত নির্বাচন বর্জন করে। ডাক দেয় হরতাল। এতে তাদের সমর্থকরা রাস্তা
অবরোধ করে। বাস, গাড়িতে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে
জড়ায়। এ উত্তেজনা এ বছরও অব্যাহত ছিল। আগের বছর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের প্রথম
বর্ষপূর্তিতে জানুয়ারি মাসে ফের হরতাল আহ্বান করে বিএনপি। এই দশকের পর দশক
ধরে চলমান উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে উগ্র ইসলামপন্থিদের দ্বারা। তারা সরাসরি
তহবিল না পেলেও, আঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পায়।
নিজেদের ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশে দ্রুত
বৃদ্ধি পাওয়া রাজনৈতিক সহিংসতাকে অবজ্ঞা করেছে।
No comments