ইতালির নাগরিক হত্যা: সিসি ক্যামেরার ফুটেজের ভরসায় পুলিশ
গুলশানের
কূটনৈতিকপাড়ায় হঠাৎ করে ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজার কেন খুন হলেন, তা বুঝে
উঠতে পারছে না পুলিশ। ঘটনাস্থলের খুব কাছে দুটি প্রতিষ্ঠান ও একটি
দূতাবাসের ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা আছে। সেসব ক্যামেরার ফুটেজের ওপর
ভরসা করছে পুলিশ। তবে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত এসব ফুটেজ থেকে খুনিদের
শনাক্ত করার মতো কোনো তথ্য মেলেনি বলে জানা গেছে।
সিজার হত্যার সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) জড়িত থাকার ব্যাপারে বিভিন্ন সূত্র থেকে যেসব তথ্য আসছে, তা নাকচ করে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গতকাল সচিবালয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠন আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই। মন্ত্রী বলেন, ঘটনা অনুসন্ধানে পুলিশ ছাড়াও চারটি গোয়েন্দা সংস্থা ও বিশ্বস্ত গুপ্তচরেরা কাজ করছে। ব্যক্তিগত বিরোধ, এনজিও কার্যক্রম নিয়ে বিরোধ, জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা—সব বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত চলছে। তিনি বলেন, এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তবে হত্যাকারীরা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
সিজার হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বিগ্ন পুলিশ প্রশাসন। গুলশান-২-এর ৯০ নম্বর সড়কের যে স্থানে হত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার ৩০০-৪০০ গজের মধ্যে মিসরীয় দূতাবাস। এরপর রয়েছে নেদারল্যান্ডস ও স্পেন দূতাবাস। এ রকম স্পর্শকাতর এলাকায় কীভাবে অস্ত্রধারীরা গুলি করে পালিয়ে গেল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
পরিস্থিতি নিয়ে সদর দপ্তরে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা বৈঠক করেন। ওই বৈঠকের পর রাজধানীর কূটনৈতিকপাড়ায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এ ছাড়া টহল ও তল্লাশি জোরদার করা হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি সংস্থার জন্য বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সিজার হত্যার ঘটনা তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম এ কমিটির প্রধান। তদন্ত কমিটিকে সহায়তার জন্য পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের বাছাই করা দক্ষ ও চৌকস কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত সহায়তা দল গঠন করা হয়েছে। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল হায়দার এই দলের প্রধান।
তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, পুলিশ নিশ্চিত, এটি ছিনতাইয়ের ঘটনা নয়। নিহত সিজারের কাছে মোবাইল ফোন ও হাতব্যাগে জগিংয়ের কাপড় পাওয়া গেছে। তাঁর কোনো কিছু খোয়া যায়নি।
গত সোমবার সন্ধ্যায় গুলশান-২ নম্বরের ৯০ নম্বর সড়কের গভর্নর হাউসের দক্ষিণ পাশের সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে ফুটপাতে দুই অস্ত্রধারী সিজারকে (৫০) রিভলবার দিয়ে পর পর তিনটি গুলি করে আগে থেকে অপেক্ষায় থাকা একজনের মোটরসাইকেলে চড়ে ৮৩ নম্বর সড়ক ধরে দ্রুত পালিয়ে যায়। পরে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে সিজারের মৃত্যু হয়। তিনি নেদারল্যান্ডসভিত্তিক আইসিসিও কো-অপারেশন নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রুফ (প্রফিটেবল অপরচুনিটিজ ফর ফুড সিকিউরিটি) কর্মসূচির প্রকল্প ব্যবস্থাপক ছিলেন। গুলশান-১ নম্বরের ৩০ নম্বর সড়কের ১৬ নম্বর বাড়িতে আইসিসিও কো-অপারেশনের কার্যালয়। তাঁর কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া পরিচয়পত্রে দেখা যায়, তিনি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের হেলথ ক্লাবের সদস্য ছিলেন।
মামলা দায়ের: সিজার হত্যার ঘটনায় গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আইসিসিও কো-অপারেশন বাংলাদেশ কার্যালয়ের এদেশীয় প্রতিনিধি হেলেন ভ্যান ডের বিক বাদী হয়ে গুলশান থানায় মামলা করেন। এতে বলা হয়, সোমবার রাত সোয়া আটটার দিকে পুলিশের করা ফোনে তাঁরা জানতে পারেন তাঁদের সহকর্মী সিজার গুলশান-২ নম্বরের ৯০ নম্বর সড়কে গুলিবিদ্ধ হন এবং পরে তিনি হাসপাতালে মারা যান। মামলায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়, অজ্ঞাত আসামিরা সিজারকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।
গতকাল দুপুরে গুলশান থানা থেকে বেরিয়ে হেলেন ভ্যান ডের বিক সাংবাদিকদের বলেন, সিজার হত্যার ঘটনায় তাঁরা শোকাহত। এ ঘটনায় তিনি থানায় মামলা করেছেন। কারা, কেন হত্যাকাণ্ড করেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নো কমেন্ট।’ হেলেন ভ্যান ছাড়া আইসিসিও বাংলাদেশের কার্যালয়ের অন্য কেউ কথা বলতে চাননি। তবে গত সোমবার রাতে আইসিসিও কো-অপারেশনের মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগের ব্যবস্থাপক আলো রানি ঢালী প্রথম আলোকে বলেন, সিজারের সঙ্গে কারও কোনো বিরোধ ও শত্রুতা ছিল না। তিনি গত মে মাসে প্রুফসে প্রকল্প ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দেন।
গুলশান থানার ওসি মো. সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় কাউকে আটক করা হয়েছে কি না, তা বলা যাবে না। গতকাল দুপুরে ডিবি কর্মকর্তারা সিজারের বাসা ও অফিস থেকে দুটি ল্যাপটপ, দুটি পেনড্রাইভ ও একটি মোবাইল নিয়ে আসেন। এসব পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মাহফুজুল আলম রাসেল প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাস্থল ঘেঁষে সিসি ক্যামেরা না থাকায় খুনিরা এটি হত্যাকাণ্ডের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্য কয়েকটি কারণকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক কারণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, সিজারের মুঠোফোনের সূত্র ধরে বিভিন্ন লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সিজার গুলশান-২ নম্বরের বাসাটিতে সাবলেট থাকতেন। ঘটনাস্থল থেকে তাঁর বাসায় হেঁটে যেতে পাঁচ মিনিট লাগে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সিজারের ভাড়াবাড়ির বাসিন্দা, ওই ভবনের নিরাপত্তাকর্মী ও তাঁর সহকর্মীদের বক্তব্য নিয়েছে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের আগে সিজারের বাসায় কারা এসেছিল, তাদের সঙ্গেও কথা বলা হচ্ছে।
তদন্তভার ডিবিতে: সিজার হত্যা মামলার তদন্তভার ডিবিকে দেওয়া হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, মামলাটি ডিবিতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন গুলশান থেকে মামলার নথিপত্র ডিবি গ্রহণ করবে।
পেছন থেকে তিনটি গুলি করা হয়: কাছাকাছি দূরত্বে পেছন থেকে ইতালির নাগরিক সিজারকে তিনটি গুলি করা হয় বলে লাশের ময়নাতদন্তকারী কর্মকর্তা জানিয়েছেন। গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে ময়নাতদন্তের পর ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ আবু শামা সাংবাদিকদের বলেন, একটি গুলি লেগেছে বাঁ হাতের বাহুতে। সেটি বেরিয়ে গেছে। দুটি গুলি পিঠ দিয়ে ঢুকেছে। তার মধ্যে একটি বুকের দিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আরেকটি আটকে ছিল। ময়নাতদন্তের সময় বুকের ভেতর আটকে থাকা গুলিটি বের করা হয়েছে বলে জানান তিনি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, উদ্ধার হওয়া গুলিটি রিভলবারের।
গতকাল সহকর্মীরা সিজারের লাশ দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে যান।
পুলিশের গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. আ. আহাদ বলেন, ময়নাতদন্তের পর সিজারের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের হিমঘরে রাখা হয়েছে। ইতালি দূতাবাস কিংবা সিজারের সহকর্মীরা চাইলে লাশ সৎকারের ব্যবস্থা করতে পারবেন।
দুই বছর আগে নিবন্ধন পায় আইসিসিও: এনজিও ব্যুরোর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর নিবন্ধন পায় আইসিসিও কো-অপারেশন বাংলাদেশ। বর্তমানে এই সংস্থাটি বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও রংপুরে কাজ করছে। তাদের ‘খাদ্য নিরাপত্তার জন্য লাভজনক সুযোগ সৃষ্টি’ নামে একটি প্রকল্প রয়েছে। নিহত তাবেলা সিজার আইসিসিও কো-অপারেশন, বাংলাদেশের প্রকল্প ব্যবস্থাপক ছিলেন। গত মে মাসে তিনি বাংলাদেশে আসেন। এখনো সিজার তাবেলার ভিসার সত্যায়নের সব কাজই শেষ হয়নি।
এনজিও-বিষয়ক ব্যুরোর একজন কর্মকর্তা বলেন, কোনো বিদেশি নাগরিককে এনজিওতে কাজের বিষয়ে বাংলাদেশে অবস্থানের জন্য ভিসায় এনজিও-বিষয়ক ব্যুরোর সত্যায়নের প্রয়োজন হয়। প্রাথমিক সত্যায়নের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে আরেকটি সত্যায়ন করা হয়। তাবেলা সিজারের ভিসার সত্যায়নের জন্য গত ১৫ জুন এনজিও ব্যুরো থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু এখনো ফেরত আসেনি। তার আগেই খুন হলেন।
বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার শোক
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজার হত্যার ঘটনায় গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছে। ইইউর রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদু ওই হত্যাকাণ্ডকে সন্ত্রাসী অপরাধ হিসেবে অভিহিত করে দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে বর্বরোচিত ওই হত্যায় দোষীদের শাস্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
গতকাল ইইউর ব্রাসেলস কার্যালয় থেকে দেওয়া বিবৃতিতে সিজার হত্যায় দুঃখ প্রকাশ করে এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করার কথা বলা হয়। আর ঢাকায় ইইউর রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদু এক বিবৃতিতে বলেছেন, সিজার অতিদরিদ্রদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং এই হত্যাকাণ্ড বিষয়টিকে আরও নৃশংস করে তুলেছে।
যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ বিশেষ করে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা লোকজনের সহায়তায় আসা উন্নয়নকর্মীর বিরুদ্ধে এটি নৃশংস ও কাপুরুষোচিত অপরাধ। আমি তাবেলার পরিবার ও বন্ধুদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।’
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র বলেন, ‘গত ২৮ সেপ্টেম্বর ইতালির নাগরিক হত্যার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র অবহিত আছে। আমরা নিহতের পরিবার, তাঁর বন্ধুবান্ধব ও ইতালির প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। ওই হামলা ও বাংলাদেশে অব্যাহত হুমকির ব্যাপারে আমরা সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখছি। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে বাংলাদেশকে শক্তিশালী আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্র।’
ঢাকায় নেদারল্যান্ডস দূতাবাস এক বিবৃতিতে তাবেলা সিজারের হত্যার ঘটনায় তাঁর পরিবার, বন্ধু ও সহকর্মীদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে। সহিংস ওই ঘটনার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি দূতাবাস দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে বর্বরোচিত হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে।
সিজার হত্যার সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) জড়িত থাকার ব্যাপারে বিভিন্ন সূত্র থেকে যেসব তথ্য আসছে, তা নাকচ করে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গতকাল সচিবালয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠন আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই। মন্ত্রী বলেন, ঘটনা অনুসন্ধানে পুলিশ ছাড়াও চারটি গোয়েন্দা সংস্থা ও বিশ্বস্ত গুপ্তচরেরা কাজ করছে। ব্যক্তিগত বিরোধ, এনজিও কার্যক্রম নিয়ে বিরোধ, জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা—সব বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত চলছে। তিনি বলেন, এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তবে হত্যাকারীরা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
সিজার হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বিগ্ন পুলিশ প্রশাসন। গুলশান-২-এর ৯০ নম্বর সড়কের যে স্থানে হত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার ৩০০-৪০০ গজের মধ্যে মিসরীয় দূতাবাস। এরপর রয়েছে নেদারল্যান্ডস ও স্পেন দূতাবাস। এ রকম স্পর্শকাতর এলাকায় কীভাবে অস্ত্রধারীরা গুলি করে পালিয়ে গেল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
পরিস্থিতি নিয়ে সদর দপ্তরে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা বৈঠক করেন। ওই বৈঠকের পর রাজধানীর কূটনৈতিকপাড়ায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এ ছাড়া টহল ও তল্লাশি জোরদার করা হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি সংস্থার জন্য বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সিজার হত্যার ঘটনা তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম এ কমিটির প্রধান। তদন্ত কমিটিকে সহায়তার জন্য পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের বাছাই করা দক্ষ ও চৌকস কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত সহায়তা দল গঠন করা হয়েছে। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল হায়দার এই দলের প্রধান।
তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, পুলিশ নিশ্চিত, এটি ছিনতাইয়ের ঘটনা নয়। নিহত সিজারের কাছে মোবাইল ফোন ও হাতব্যাগে জগিংয়ের কাপড় পাওয়া গেছে। তাঁর কোনো কিছু খোয়া যায়নি।
গত সোমবার সন্ধ্যায় গুলশান-২ নম্বরের ৯০ নম্বর সড়কের গভর্নর হাউসের দক্ষিণ পাশের সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে ফুটপাতে দুই অস্ত্রধারী সিজারকে (৫০) রিভলবার দিয়ে পর পর তিনটি গুলি করে আগে থেকে অপেক্ষায় থাকা একজনের মোটরসাইকেলে চড়ে ৮৩ নম্বর সড়ক ধরে দ্রুত পালিয়ে যায়। পরে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে সিজারের মৃত্যু হয়। তিনি নেদারল্যান্ডসভিত্তিক আইসিসিও কো-অপারেশন নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রুফ (প্রফিটেবল অপরচুনিটিজ ফর ফুড সিকিউরিটি) কর্মসূচির প্রকল্প ব্যবস্থাপক ছিলেন। গুলশান-১ নম্বরের ৩০ নম্বর সড়কের ১৬ নম্বর বাড়িতে আইসিসিও কো-অপারেশনের কার্যালয়। তাঁর কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া পরিচয়পত্রে দেখা যায়, তিনি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের হেলথ ক্লাবের সদস্য ছিলেন।
মামলা দায়ের: সিজার হত্যার ঘটনায় গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আইসিসিও কো-অপারেশন বাংলাদেশ কার্যালয়ের এদেশীয় প্রতিনিধি হেলেন ভ্যান ডের বিক বাদী হয়ে গুলশান থানায় মামলা করেন। এতে বলা হয়, সোমবার রাত সোয়া আটটার দিকে পুলিশের করা ফোনে তাঁরা জানতে পারেন তাঁদের সহকর্মী সিজার গুলশান-২ নম্বরের ৯০ নম্বর সড়কে গুলিবিদ্ধ হন এবং পরে তিনি হাসপাতালে মারা যান। মামলায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়, অজ্ঞাত আসামিরা সিজারকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।
গতকাল দুপুরে গুলশান থানা থেকে বেরিয়ে হেলেন ভ্যান ডের বিক সাংবাদিকদের বলেন, সিজার হত্যার ঘটনায় তাঁরা শোকাহত। এ ঘটনায় তিনি থানায় মামলা করেছেন। কারা, কেন হত্যাকাণ্ড করেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নো কমেন্ট।’ হেলেন ভ্যান ছাড়া আইসিসিও বাংলাদেশের কার্যালয়ের অন্য কেউ কথা বলতে চাননি। তবে গত সোমবার রাতে আইসিসিও কো-অপারেশনের মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগের ব্যবস্থাপক আলো রানি ঢালী প্রথম আলোকে বলেন, সিজারের সঙ্গে কারও কোনো বিরোধ ও শত্রুতা ছিল না। তিনি গত মে মাসে প্রুফসে প্রকল্প ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দেন।
গুলশান থানার ওসি মো. সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় কাউকে আটক করা হয়েছে কি না, তা বলা যাবে না। গতকাল দুপুরে ডিবি কর্মকর্তারা সিজারের বাসা ও অফিস থেকে দুটি ল্যাপটপ, দুটি পেনড্রাইভ ও একটি মোবাইল নিয়ে আসেন। এসব পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মাহফুজুল আলম রাসেল প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাস্থল ঘেঁষে সিসি ক্যামেরা না থাকায় খুনিরা এটি হত্যাকাণ্ডের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্য কয়েকটি কারণকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক কারণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, সিজারের মুঠোফোনের সূত্র ধরে বিভিন্ন লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সিজার গুলশান-২ নম্বরের বাসাটিতে সাবলেট থাকতেন। ঘটনাস্থল থেকে তাঁর বাসায় হেঁটে যেতে পাঁচ মিনিট লাগে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সিজারের ভাড়াবাড়ির বাসিন্দা, ওই ভবনের নিরাপত্তাকর্মী ও তাঁর সহকর্মীদের বক্তব্য নিয়েছে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের আগে সিজারের বাসায় কারা এসেছিল, তাদের সঙ্গেও কথা বলা হচ্ছে।
তদন্তভার ডিবিতে: সিজার হত্যা মামলার তদন্তভার ডিবিকে দেওয়া হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, মামলাটি ডিবিতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন গুলশান থেকে মামলার নথিপত্র ডিবি গ্রহণ করবে।
পেছন থেকে তিনটি গুলি করা হয়: কাছাকাছি দূরত্বে পেছন থেকে ইতালির নাগরিক সিজারকে তিনটি গুলি করা হয় বলে লাশের ময়নাতদন্তকারী কর্মকর্তা জানিয়েছেন। গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে ময়নাতদন্তের পর ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ আবু শামা সাংবাদিকদের বলেন, একটি গুলি লেগেছে বাঁ হাতের বাহুতে। সেটি বেরিয়ে গেছে। দুটি গুলি পিঠ দিয়ে ঢুকেছে। তার মধ্যে একটি বুকের দিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আরেকটি আটকে ছিল। ময়নাতদন্তের সময় বুকের ভেতর আটকে থাকা গুলিটি বের করা হয়েছে বলে জানান তিনি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, উদ্ধার হওয়া গুলিটি রিভলবারের।
গতকাল সহকর্মীরা সিজারের লাশ দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে যান।
পুলিশের গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. আ. আহাদ বলেন, ময়নাতদন্তের পর সিজারের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের হিমঘরে রাখা হয়েছে। ইতালি দূতাবাস কিংবা সিজারের সহকর্মীরা চাইলে লাশ সৎকারের ব্যবস্থা করতে পারবেন।
দুই বছর আগে নিবন্ধন পায় আইসিসিও: এনজিও ব্যুরোর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর নিবন্ধন পায় আইসিসিও কো-অপারেশন বাংলাদেশ। বর্তমানে এই সংস্থাটি বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও রংপুরে কাজ করছে। তাদের ‘খাদ্য নিরাপত্তার জন্য লাভজনক সুযোগ সৃষ্টি’ নামে একটি প্রকল্প রয়েছে। নিহত তাবেলা সিজার আইসিসিও কো-অপারেশন, বাংলাদেশের প্রকল্প ব্যবস্থাপক ছিলেন। গত মে মাসে তিনি বাংলাদেশে আসেন। এখনো সিজার তাবেলার ভিসার সত্যায়নের সব কাজই শেষ হয়নি।
এনজিও-বিষয়ক ব্যুরোর একজন কর্মকর্তা বলেন, কোনো বিদেশি নাগরিককে এনজিওতে কাজের বিষয়ে বাংলাদেশে অবস্থানের জন্য ভিসায় এনজিও-বিষয়ক ব্যুরোর সত্যায়নের প্রয়োজন হয়। প্রাথমিক সত্যায়নের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে আরেকটি সত্যায়ন করা হয়। তাবেলা সিজারের ভিসার সত্যায়নের জন্য গত ১৫ জুন এনজিও ব্যুরো থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু এখনো ফেরত আসেনি। তার আগেই খুন হলেন।
বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার শোক
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজার হত্যার ঘটনায় গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছে। ইইউর রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদু ওই হত্যাকাণ্ডকে সন্ত্রাসী অপরাধ হিসেবে অভিহিত করে দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে বর্বরোচিত ওই হত্যায় দোষীদের শাস্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
গতকাল ইইউর ব্রাসেলস কার্যালয় থেকে দেওয়া বিবৃতিতে সিজার হত্যায় দুঃখ প্রকাশ করে এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করার কথা বলা হয়। আর ঢাকায় ইইউর রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদু এক বিবৃতিতে বলেছেন, সিজার অতিদরিদ্রদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং এই হত্যাকাণ্ড বিষয়টিকে আরও নৃশংস করে তুলেছে।
যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ বিশেষ করে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা লোকজনের সহায়তায় আসা উন্নয়নকর্মীর বিরুদ্ধে এটি নৃশংস ও কাপুরুষোচিত অপরাধ। আমি তাবেলার পরিবার ও বন্ধুদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।’
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র বলেন, ‘গত ২৮ সেপ্টেম্বর ইতালির নাগরিক হত্যার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র অবহিত আছে। আমরা নিহতের পরিবার, তাঁর বন্ধুবান্ধব ও ইতালির প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। ওই হামলা ও বাংলাদেশে অব্যাহত হুমকির ব্যাপারে আমরা সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখছি। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে বাংলাদেশকে শক্তিশালী আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্র।’
ঢাকায় নেদারল্যান্ডস দূতাবাস এক বিবৃতিতে তাবেলা সিজারের হত্যার ঘটনায় তাঁর পরিবার, বন্ধু ও সহকর্মীদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে। সহিংস ওই ঘটনার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি দূতাবাস দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে বর্বরোচিত হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে।
No comments