অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা শঙ্কা নিয়ে রিপোর্ট দিয়েছিলেন বাংলাদেশের গোয়েন্দারাও
অস্ট্রেলিয়ার
জাতীয় ক্রিকেট দল বাংলাদেশে আসার নির্ধারিত সময় ছিল ২৮শে সেপ্টেম্বর। এর
আগের দিন ২৭শে সেপ্টেম্বর পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ এক গোয়েন্দা রিপোর্ট
মারফত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অস্ট্রেলিয়া জাতীয় ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ
সফরে আসার আগের নানা হুমকি ও আশঙ্কার কথা জানায়। দেশীয়, আঞ্চলিক ও
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে হুমকির চিত্র তুলে ধরা হয় ওই প্রতিবেদনে। ওই
রিপোর্টে হুমকির চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি সম্ভাব্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি
বজায় রাখতে ১৮ ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদনটিতে
অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের সফরে সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড ঘটার সম্ভাব্য নয়টি
লক্ষ্যবস্তুর কথা বলা হয়। এ ছাড়া পাকিস্তানে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের
সফরকালে জঙ্গিদের আক্রমণ এবং এ বছর পাকিস্তানে জিম্বাবুয়ে সফরের সময়
আত্মঘাতী বোমা হামলার প্রসঙ্গও তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয়,
অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দল বাংলাদেশ সফরকালে দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক
পরিস্থিতিতে স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক সন্ত্রাসীমূলক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার
আশঙ্কাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাদের বাংলাদেশ সফরকালে সার্বক্ষণিক
পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সম্ভাব্য নিরাপত্তা ঝুঁকি
সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়ে, বর্তমান বিশ্বের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে
নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অস্ট্রেলিয়া জাতীয় ক্রিকেট দল বাংলাদেশ
সফরকালে গুরুত্ব অনুধাবন করে দেশীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি
বিবেচনা করে বিভিন্ন ধরনের হুমকির আশঙ্কা বিবেচনায় নেয়া উচিত। দেশীয়
প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা হুমকি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে
দেশের রাজনৈতিক সংকটের মূলে রয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও
জোটভুক্ত জামায়াতে ইসলামী ও তাদের মদতপুষ্ট ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের আটক, কাদের মোল্লা,
কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকরসহ অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় নেতাদের
মৃত্যুদণ্ডাদেশ, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলসহ সর্বোপরি অস্তিত্বের সংকটের
কারণে দলটির নেতাকর্মীরা বিগত বছরগুলোতে প্রতিনিয়ত যানবাহনের উপর অতর্কিত
হামলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর আক্রমণ, ককটেল বা পেট্রলবোমা
নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগ, রাস্তা অবরোধ করাসহ নানাবিধ অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড
সৃষ্টির মাধ্যমে সারা দেশে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। সামপ্রতিক
সময়ে যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এর মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায় আপিল
বিভাগে বহাল থাকায় জামায়াত-শিবির যে কোন ধরনের সন্ত্রাসীমূলক কার্যক্রমের
চেষ্টা চালাতে পারে। এ ছাড়া ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনের পর বর্তমান
সরকার তাদের পূর্বের নীতি তথা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, উগ্র জঙ্গি সংগঠনের
বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান, জঙ্গি সংগঠন নিষিদ্ধকরণসহ ব্যাপক অভিযান, কর্মমুখী
আধুনিক শিক্ষানীতি, নারী নীতির বাস্তবায়ন অব্যাহত রেখেছে। ফলে
জামায়াত-শিবির, বিএনপিসহ স্বার্থান্বেষী মহল দেশে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি
করার অপচেষ্টায় যে কোন রকম অরাজক কর্মকাণ্ড চালাতে পারে বলে জানা যায়। এতে
বলা হয়েছে, সামপ্রতিক বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ও
আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ উগ্র মৌলবাদী সংগঠনের কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে।
কোন কোন সমভাবাপন্ন রাজনৈতিক দল হেফাজত ও হরকাত-উল-জিহাদ (হুজি) এর প্রগতি
বিরোধী বিশেষ করে নারী অধিকার বিরোধী কার্যক্রমকে সমর্থন করছে।
বিএনপি-জামায়াতসহ ২০দলীয় জোট অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির লক্ষ্যে তৎপরতা
চালাতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়, নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরীর বাংলাদেশ এবং
আনসারুল্লাহ বাংলা টিম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুবই সক্রিয় এবং সরকারের
বিরুদ্ধে বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্য ও সরকার উৎখাতের জন্য বিভিন্ন ধরনের
অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে। হিযবুত তাহরীর বাংলাদেশের বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টি
আকর্ষণের জন্য ক্রিকেট দলটির সফরকালীন সময়ে লিফলেট বিলি করতে পারে। এ ছাড়া
দেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাত-উল-জিহাদ (হুজি), জামায়াতে মুজাহেদীন বাংলাদেশ
(জেএমবি) এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কার্যক্রমকে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে ক্রিকেট দলের নিরাপত্তা হুমকি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগের বছরগুলোতে বাংলাদেশে বেশ কিছু জঙ্গি গোষ্ঠী সদস্যদের আটক করা হয়েছে। এদেশের বর্তমান সন্ত্রাস-বিরোধী অবস্থানের কারণে সারা বিশ্বে যে উজ্জ্বল অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে তা ম্লান করতে পশ্চিমা বিরোধী যে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আসন্ন ম্যাচকে বেছে নিয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য যে কোন ধরনের অপতৎপরতার বিষয়টি উপেক্ষা করা যায় না। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা হুমকির বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের লাহোরে শ্রীলঙ্কার জাতীয় ক্রিকেট দলের সফরকালে ২০০৯ সালের ৩রা মার্চ জঙ্গি গ্রুপগুলো সশস্ত্র আক্রমণ করে এবং ওই ঘটনায় ছয়জন পাক পুলিশসহ একজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয় এবং কিছু শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড় আহত হয়। এ ছাড়া সর্বশেষ গত ২৯শে মে পাকিস্তানের লাহোরে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে পাকিস্তান-জিম্বাবুয়ে ম্যাচ চলাকালীন স্টেডিয়ামের বাইরে আত্মঘাতী বোমা হামলায় হামলাকারী, পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টর ও অন্য একজন বেসামরিক লোক নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় এর প্রতিবাদে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব পাস হওয়াসহ পাকিস্তান ও তুরস্কে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তুর কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অস্ট্রেলিয়া জাতীয় ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফরকালে আক্রমণের সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে রয়েছে- দেশী-বিদেশী খেলোয়াড়, খেলা পরিচালনার সঙ্গে জড়িত ম্যাচ অফিসিয়াল এবং অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারী, আইসিসি সংস্থার ব্যক্তিবর্গ, বিদেশী ও দেশীয় প্রচার মাধ্যমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, দেশী-বিদেশী দর্শক, হজরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং যেসব হোটেলে খেলোয়াড় ও ম্যাচ অফিসিয়ালরা অবস্থান করবেন। এ ছাড়া দেশী-বিদেশী খেলোয়াড়, খেলা পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ম্যাচ অফিসিয়াল এবং অন্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চলাচলের সময়ে তাদের বহন করা যানবাহন। একই সঙ্গে যেসব ভেন্যুতে খেলা অনুষ্ঠিত হবে ওই সব ভেন্যুও লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য ১৮টি সুপারিশ দেয়া হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে। সুপারিশে বলা হয়েছে, হজরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন চেক পয়েন্টে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে যে কোন প্রকার নাশকতামূলক কার্যক্রম বন্ধ করা যায়। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী ও সন্দেহভাজন বিদেশী নাগরিকদের আগমন বা বহির্গমন রোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদেশী খেলোয়াড় ও অতিথিরা হোটেল সোনারগাঁও বা যেসব হোটেল/ভবনে অবস্থান করবেন সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ আবাসস্থলে সিসি টিভি স্থাপন করা। বিদেশী খেলোয়াড় ও অতিথিদের বিমানবন্দর থেকে হোটেলে ও হোটেল থেকে খেলার ভেন্যুতে আসা-যাওয়ার পথে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ ও ট্রাফিক মনিটরিং করতে হবে। খেলোয়াড়দের হোটেল থেকে ভেন্যু এবং ভেন্যু থেকে হোটেলে চলাচলের সময় যে কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে একটি অতিরিক্ত বাসের (টিম বাসের বিকল্প) ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি খেলোয়াড়দের অনুশীলন, ওয়ার্মআপ ম্যাচ শপিংসহ হোটেলের বাইরে অবস্থান/চলাচলকালীন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, খেলার আগে প্রতিটি ভেন্যু সুইপিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ডগ স্কোয়াডের মাধ্যমে নিরাপত্তা তল্লাশি ও ভেন্যুর আশপাশের এলাকার নিকটবর্তী ভবনগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া। দর্শকদের মাঠে প্রবেশের আগে আর্চওয়ে এবং হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে তল্লাশির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সকল সদস্যের পরিচিতি নিশ্চিত করা, বিশেষ করে বিদেশী খেলোয়াড় ও অতিথিদের সহযোগিতার জন্য তাদের সঙ্গে দেশের স্থানীয় যে সকল গাইড/প্রতিনিধি থাকবে তাদের প্রাক-পরিচয় যাচাই করার ব্যবস্থা করা দরকার। স্বাগতিক দেশ হিসেবে খেলায় বাংলাদেশের জয়-পরাজয়ের প্রতিক্রিয়া বিবেচনার বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকলে উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। যে কোন বিপর্যয় পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সুবিধাজনক স্থানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্ট্রাইকিং রিজার্ভ ফোর্স, অগ্নিনির্বাপক গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখতে হবে। খেলার ভেন্যুতে গেটগুলোতে যথাযথ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা, টিকিট বিক্রি ও খেলা চলাকালীন আইনশৃঙ্খলা ও স্টেডিয়ামের নিরাপত্তার জন্য বিসিবির সঙ্গে সাদা পোশাকে ও ইউনিফর্মধারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয় রক্ষা করা প্রয়োজন। খেলোয়াড়দের খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে করতে দেশের সকল গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিসিবির মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় রাখতে একটি কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। দেশীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা এবং গ্রেপ্তার অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন। খেলার ভেন্যুগুলো দিবারাত্র খেলার সময়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতসহ বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পুলিশ/র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব সদস্য কর্তব্য পালনের সময় নিজের নিরাপত্তাসহ যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। খেলোয়াড় ও অতিথিদের চলাচলের সময়ে কোন রাজনৈতিক দল বা সংগঠন যাতে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে কোন কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে। প্রটেকশন না দিয়ে কোন খেলোয়াড়/কর্মকর্তা হোটেল ত্যাগ করতে না পারে ওই ব্যবস্থা রাখতে হবে। অস্ট্রেলিয়া জাতীয় ক্রিকেট দল বাংলাদেশ সফরকালে যে কোন প্রকার নাশকতামূলক ঘটনা বা সন্ত্রাসী হামলা সংক্রান্ত অগ্রিম গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করতে রাজনৈতিক দল/সংগঠন ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের এবং ক্রিকেট সমর্থক ও গোষ্ঠীর উপর নজরদারি বাড়াতে দেশের সকল গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে।
আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে ক্রিকেট দলের নিরাপত্তা হুমকি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগের বছরগুলোতে বাংলাদেশে বেশ কিছু জঙ্গি গোষ্ঠী সদস্যদের আটক করা হয়েছে। এদেশের বর্তমান সন্ত্রাস-বিরোধী অবস্থানের কারণে সারা বিশ্বে যে উজ্জ্বল অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে তা ম্লান করতে পশ্চিমা বিরোধী যে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আসন্ন ম্যাচকে বেছে নিয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য যে কোন ধরনের অপতৎপরতার বিষয়টি উপেক্ষা করা যায় না। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা হুমকির বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের লাহোরে শ্রীলঙ্কার জাতীয় ক্রিকেট দলের সফরকালে ২০০৯ সালের ৩রা মার্চ জঙ্গি গ্রুপগুলো সশস্ত্র আক্রমণ করে এবং ওই ঘটনায় ছয়জন পাক পুলিশসহ একজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয় এবং কিছু শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড় আহত হয়। এ ছাড়া সর্বশেষ গত ২৯শে মে পাকিস্তানের লাহোরে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে পাকিস্তান-জিম্বাবুয়ে ম্যাচ চলাকালীন স্টেডিয়ামের বাইরে আত্মঘাতী বোমা হামলায় হামলাকারী, পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টর ও অন্য একজন বেসামরিক লোক নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় এর প্রতিবাদে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব পাস হওয়াসহ পাকিস্তান ও তুরস্কে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তুর কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অস্ট্রেলিয়া জাতীয় ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফরকালে আক্রমণের সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে রয়েছে- দেশী-বিদেশী খেলোয়াড়, খেলা পরিচালনার সঙ্গে জড়িত ম্যাচ অফিসিয়াল এবং অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারী, আইসিসি সংস্থার ব্যক্তিবর্গ, বিদেশী ও দেশীয় প্রচার মাধ্যমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, দেশী-বিদেশী দর্শক, হজরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং যেসব হোটেলে খেলোয়াড় ও ম্যাচ অফিসিয়ালরা অবস্থান করবেন। এ ছাড়া দেশী-বিদেশী খেলোয়াড়, খেলা পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ম্যাচ অফিসিয়াল এবং অন্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চলাচলের সময়ে তাদের বহন করা যানবাহন। একই সঙ্গে যেসব ভেন্যুতে খেলা অনুষ্ঠিত হবে ওই সব ভেন্যুও লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য ১৮টি সুপারিশ দেয়া হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে। সুপারিশে বলা হয়েছে, হজরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন চেক পয়েন্টে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে যে কোন প্রকার নাশকতামূলক কার্যক্রম বন্ধ করা যায়। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী ও সন্দেহভাজন বিদেশী নাগরিকদের আগমন বা বহির্গমন রোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদেশী খেলোয়াড় ও অতিথিরা হোটেল সোনারগাঁও বা যেসব হোটেল/ভবনে অবস্থান করবেন সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ আবাসস্থলে সিসি টিভি স্থাপন করা। বিদেশী খেলোয়াড় ও অতিথিদের বিমানবন্দর থেকে হোটেলে ও হোটেল থেকে খেলার ভেন্যুতে আসা-যাওয়ার পথে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ ও ট্রাফিক মনিটরিং করতে হবে। খেলোয়াড়দের হোটেল থেকে ভেন্যু এবং ভেন্যু থেকে হোটেলে চলাচলের সময় যে কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে একটি অতিরিক্ত বাসের (টিম বাসের বিকল্প) ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি খেলোয়াড়দের অনুশীলন, ওয়ার্মআপ ম্যাচ শপিংসহ হোটেলের বাইরে অবস্থান/চলাচলকালীন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, খেলার আগে প্রতিটি ভেন্যু সুইপিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ডগ স্কোয়াডের মাধ্যমে নিরাপত্তা তল্লাশি ও ভেন্যুর আশপাশের এলাকার নিকটবর্তী ভবনগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া। দর্শকদের মাঠে প্রবেশের আগে আর্চওয়ে এবং হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে তল্লাশির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সকল সদস্যের পরিচিতি নিশ্চিত করা, বিশেষ করে বিদেশী খেলোয়াড় ও অতিথিদের সহযোগিতার জন্য তাদের সঙ্গে দেশের স্থানীয় যে সকল গাইড/প্রতিনিধি থাকবে তাদের প্রাক-পরিচয় যাচাই করার ব্যবস্থা করা দরকার। স্বাগতিক দেশ হিসেবে খেলায় বাংলাদেশের জয়-পরাজয়ের প্রতিক্রিয়া বিবেচনার বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকলে উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। যে কোন বিপর্যয় পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সুবিধাজনক স্থানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্ট্রাইকিং রিজার্ভ ফোর্স, অগ্নিনির্বাপক গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখতে হবে। খেলার ভেন্যুতে গেটগুলোতে যথাযথ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা, টিকিট বিক্রি ও খেলা চলাকালীন আইনশৃঙ্খলা ও স্টেডিয়ামের নিরাপত্তার জন্য বিসিবির সঙ্গে সাদা পোশাকে ও ইউনিফর্মধারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয় রক্ষা করা প্রয়োজন। খেলোয়াড়দের খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে করতে দেশের সকল গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিসিবির মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় রাখতে একটি কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। দেশীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা এবং গ্রেপ্তার অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন। খেলার ভেন্যুগুলো দিবারাত্র খেলার সময়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতসহ বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পুলিশ/র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব সদস্য কর্তব্য পালনের সময় নিজের নিরাপত্তাসহ যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। খেলোয়াড় ও অতিথিদের চলাচলের সময়ে কোন রাজনৈতিক দল বা সংগঠন যাতে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে কোন কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে। প্রটেকশন না দিয়ে কোন খেলোয়াড়/কর্মকর্তা হোটেল ত্যাগ করতে না পারে ওই ব্যবস্থা রাখতে হবে। অস্ট্রেলিয়া জাতীয় ক্রিকেট দল বাংলাদেশ সফরকালে যে কোন প্রকার নাশকতামূলক ঘটনা বা সন্ত্রাসী হামলা সংক্রান্ত অগ্রিম গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করতে রাজনৈতিক দল/সংগঠন ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের এবং ক্রিকেট সমর্থক ও গোষ্ঠীর উপর নজরদারি বাড়াতে দেশের সকল গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে।
No comments