কেন দেশ ছাড়তে বলা? by কামাল আহমেদ
নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় হত্যাকাণ্ড |
শুক্রবার
ঢাকায় নিজের বাসায় স্ত্রীর সামনেই খুন হয়েছেন যে নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়
ওরফে নিলয় নীল, তাঁকে গত মে মাসে পুলিশ বলেছিল ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশ ছেড়ে
চলে যান।’ নীলাদ্রিকে তাঁর বন্ধুরা মুক্তচিন্তার অধিকারী ব্লগার হিসেবে
বর্ণনা করেছেন। তাঁর হত্যাকাণ্ডের যেসব বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে
স্পষ্ট ধারণা মেলে যে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো বাধা না মানাই তাঁর জন্য
কাল হয়েছে।
পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে এই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য বা কারণ সম্পর্কে কিছু না বললেও মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেছেন যে এর আগে অন্য ব্লগারদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, এ ক্ষেত্রেও হত্যাকাণ্ডের ধরন একই রকম। এটাও একধরনের পরোক্ষ স্বীকৃতি যে মত প্রকাশের (ব্লগে লেখা ও তা প্রকাশ) কারণেই তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে।
ইন্টারনেট সাধারণ নাগরিকদের যে ক্ষমতায়ন করেছে, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে যে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে, সেখানে তাঁর পরিচয় নিলয় নীল। তিনি ফেসবুকে মত প্রকাশের পাশাপাশি ইস্টিশন নামের একটি অনলাইন পোর্টালেও লেখালেখি করতেন। তাঁর ওই সব লেখার কোনো কোনোটিতে ধর্মের প্রচলিত রীতিনীতি ও বিশ্বাসের সমালোচনা ছিল। তিনিও জানতেন যে ধর্মবিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করায় ঝুঁকিটা অনেক বেশি। তাই তাঁর বিপদের কথা, আশঙ্কা-উদ্বেগ জানাতে গত ১৫ মে তিনি গিয়েছিলেন পুলিশের কাছে। কিন্তু পুলিশ তাঁকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশ ছেড়ে যাওয়ার যে পরামর্শ দিয়েছে, সে কথাটি তিনি যেমন ফেসবুকে লিখেছিলেন, তেমনি জানিয়েছিলেন লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার সংবাদদাতাকে (গার্ডিয়ান-এর প্রতিবেদনে সংবাদদাতা তেমনটিই লিখেছেন)।
পুলিশের কথার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে পুলিশ যেমন রুষ্ট হয়, তেমনি ক্ষুব্ধ হন ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী ও রাজনীতিকেরা। কিন্তু আমরা তো অন্তত এ ক্ষেত্রে পুলিশের কথা বিশ্বাস করতে চাই না। পুলিশের ওই উপদেশের মানে দাঁড়ায়—মুক্তচিন্তার দেশ এটি নয়, মত প্রকাশের স্বাধীনতা চাইলে দেশ ছাড়ুন। পুলিশ নিশ্চয়ই তাদের অভিজ্ঞতা থেকে ওই উপদেশ দিয়েছে। কেননা, তাদের নিশ্চয়ই মনে পড়েছে যে এর আগে আরও চারজন ব্লগারকে তারা রক্ষা করতে পারেনি। জঙ্গি দমনে সাফল্যের দাবি যে অনেকাংশেই ফাঁপা, সেটা হয়তো তাঁরা কেউ কেউ আন্তরিকভাবেই উপলব্ধি করেন, যখন তাঁরা দেখেন যে ক্ষমতাসীনদের অনেকেই ভোটের হিসাব কষে ইসলামপন্থী রাজনীতি তোষণ করেন।
নীলাদ্রির আগে যেসব ব্লগার প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করা এবং মামলার বিচার নিশ্চিত করার ফুরসত কই পুলিশের? তাদের অগ্রাধিকার তো সরকারের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মাঠছাড়া করা। গত পাঁচ মাসে আরেকজন নিহত ব্লগার অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী বন্যা আহমেদ এবং পিতা অধ্যাপক অজয় রায় একাধিকবার সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে তার দুই ধরনের জবাব এসেছে। একটি হচ্ছে গতানুগতিক, ‘অপরাধীদের ধরার জন্য সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত আছে।’ আর, অপরটি রাজনৈতিক এবং গূঢ় অর্থবাহী, ‘অত্যন্ত স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে সরকারকে এগোতে হচ্ছে।’
জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর দাবি যদি সঠিক হয়, তাহলে গত ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় হলেন ইসলামি জঙ্গিদের চতুর্থ শিকার। নীলাদ্রিকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে যে জঙ্গিগোষ্ঠী আনসার আল-ইসলাম, তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে ‘যদি তোমাদের “বাকস্বাধীনতা” কোনো সীমানা না মানতে প্রস্তুত থাকে তবে তোমাদের হৃদয় যেন আমাদের “চাপাতির স্বাধীনতার” জন্য উন্মুক্ত থাকে।’
বিদেশি প্রচারমাধ্যমগুলোতেও বিষয়টি আলাদা গুরুত্ব পেয়েছে। বিবিসিতে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে চলতে থাকা প্রচারযুদ্ধের ওপর আলোকপাত করে বলা হয়েছে যে একদিকে ‘মুক্তমনা’ হিসেবে পরিচয়দানকারীরা দাবি করছেন ধর্মীয় বিশ্বাসের সমালোচনা করতে না পারার মানে দাঁড়াবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিসর্জন। আর অন্যদিকে, জঙ্গি মতাদর্শের অনুসারী নন, কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসে আস্থাশীলদের কেউ কেউ বলছেন যে দেশে প্রধানমন্ত্রী এবং রাজনীতিকদের সমালোচনা ও তাঁদের নিয়ে ব্যঙ্গ করার জন্য মানুষকে জেল খাটতে হয়, সে দেশে এটি কোন ধরনের স্বাধীনতা যে ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাতকে মেনে নিতে হবে?
বিবিসি রেডিওর ট্রেন্ডিং নামের একটি অনুষ্ঠানে একজন ব্লগার বলেছেন যে দেশটি এখন একটি ‘খোলা জেলখানা’ (ওপেন প্রিজন), সেখানে তিনি এখন মত প্রকাশের সময় নিজেই নিজেকে সংবরণ (সেন্সর) করেন। তবে ওই অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু দাবি করেছেন যে দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও গণমাধ্যমে সরকারের সমালোচনা অহরহই চলছে।
সরকার-সমর্থক সম্পাদক-উপদেষ্টা-সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারাও অনেক দিন ধরেই তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে চলেন। কিন্তু ব্লগারদের মৃত্যু কিংবা রাজনীতিকদের সমালোচনা বা ব্যঙ্গ করার জন্য মামলা বা কারাদণ্ডের পরিসংখ্যানগুলো বলে ভিন্ন কথা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে তথ্যপ্রযুক্তি আইন বা আইসিটির আওতায় রাজনীতিকদের প্রতি কটাক্ষ করার জন্য এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে প্রায় তিন ডজন। মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য বিশ্বব্যাপী কাজ করছে এমন দুটি প্রতিষ্ঠান—কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) এবং রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস উভয়ের ওয়েবসাইট দুটোতে গেলেই যে কেউ দেখতে পারেন যে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন কী। সিপিজে একটি বৈশ্বিক মানচিত্রে হটস্পটগুলো চিহ্নিত করে রেখেছে, যেখানে ১৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও আছে। আর রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসে এ বছরে বিশ্বে আটজন নেটিজেনের (ইন্টারনেটের নাগরিক-সাংবাদিক) প্রাণহানির কথা বলা হয়েছে। সেখানে নীলাদ্রিকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের তিনজনের কথা বলা আছে। নীলাদ্রি যুক্ত হলে আমরা সিরিয়াকে ছুঁয়ে ফেলব।
কারও অভিমত বা বিশ্লেষণ সবার পছন্দ হবে কিংবা সেগুলো অন্যদের গ্রহণ করতে হবে—এমন কথা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেউই বলতে পারেন না। কারও মতামত আপত্তিকর হলে তাঁকে হত্যা করা ঠিক বলে যাঁরা মনে করেন, তাঁরা সম্ভবত ‘তোমাদের কর্ম ও কর্মফল তোমাদের জন্য এবং আমার কর্ম ও কর্মফল আমার জন্য’ (আয়াত ৬, সূরা কাফিরুন) কথাটির মর্মার্থ বুঝতে অক্ষম।
রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার কথাটাও এ ক্ষেত্রে আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। দ্বিদলীয় ধারার যে রাজনীতি দেশে কয়েক দশক ধরে চলে আসছিল, সেটিও আমরা সুস্থভাবে চলতে দিইনি। ভিন্নমতাবলম্বীদের আমাদের মন্ত্রীরা প্রায়ই অন্য দেশে পাঠিয়ে দিতে চান। রাজনীতিতে ভিন্নমতের কোনো জায়গা না থাকলে দমবন্ধ হওয়া পরিবেশে অগণতান্ত্রিক শক্তির কালো হাত আরও শাণিত হবে এবং ছোবল মারবেই। আর পুলিশ না হলেও অন্য কেউ ওই পরামর্শই দেবে যে মুক্তচিন্তার দেশ এটি নয়, মুক্তচিন্তা করতে হলে দেশ ছাড়তে হবে।
পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে এই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য বা কারণ সম্পর্কে কিছু না বললেও মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেছেন যে এর আগে অন্য ব্লগারদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, এ ক্ষেত্রেও হত্যাকাণ্ডের ধরন একই রকম। এটাও একধরনের পরোক্ষ স্বীকৃতি যে মত প্রকাশের (ব্লগে লেখা ও তা প্রকাশ) কারণেই তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে।
ইন্টারনেট সাধারণ নাগরিকদের যে ক্ষমতায়ন করেছে, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে যে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে, সেখানে তাঁর পরিচয় নিলয় নীল। তিনি ফেসবুকে মত প্রকাশের পাশাপাশি ইস্টিশন নামের একটি অনলাইন পোর্টালেও লেখালেখি করতেন। তাঁর ওই সব লেখার কোনো কোনোটিতে ধর্মের প্রচলিত রীতিনীতি ও বিশ্বাসের সমালোচনা ছিল। তিনিও জানতেন যে ধর্মবিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করায় ঝুঁকিটা অনেক বেশি। তাই তাঁর বিপদের কথা, আশঙ্কা-উদ্বেগ জানাতে গত ১৫ মে তিনি গিয়েছিলেন পুলিশের কাছে। কিন্তু পুলিশ তাঁকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশ ছেড়ে যাওয়ার যে পরামর্শ দিয়েছে, সে কথাটি তিনি যেমন ফেসবুকে লিখেছিলেন, তেমনি জানিয়েছিলেন লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার সংবাদদাতাকে (গার্ডিয়ান-এর প্রতিবেদনে সংবাদদাতা তেমনটিই লিখেছেন)।
পুলিশের কথার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে পুলিশ যেমন রুষ্ট হয়, তেমনি ক্ষুব্ধ হন ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী ও রাজনীতিকেরা। কিন্তু আমরা তো অন্তত এ ক্ষেত্রে পুলিশের কথা বিশ্বাস করতে চাই না। পুলিশের ওই উপদেশের মানে দাঁড়ায়—মুক্তচিন্তার দেশ এটি নয়, মত প্রকাশের স্বাধীনতা চাইলে দেশ ছাড়ুন। পুলিশ নিশ্চয়ই তাদের অভিজ্ঞতা থেকে ওই উপদেশ দিয়েছে। কেননা, তাদের নিশ্চয়ই মনে পড়েছে যে এর আগে আরও চারজন ব্লগারকে তারা রক্ষা করতে পারেনি। জঙ্গি দমনে সাফল্যের দাবি যে অনেকাংশেই ফাঁপা, সেটা হয়তো তাঁরা কেউ কেউ আন্তরিকভাবেই উপলব্ধি করেন, যখন তাঁরা দেখেন যে ক্ষমতাসীনদের অনেকেই ভোটের হিসাব কষে ইসলামপন্থী রাজনীতি তোষণ করেন।
নীলাদ্রির আগে যেসব ব্লগার প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করা এবং মামলার বিচার নিশ্চিত করার ফুরসত কই পুলিশের? তাদের অগ্রাধিকার তো সরকারের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মাঠছাড়া করা। গত পাঁচ মাসে আরেকজন নিহত ব্লগার অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী বন্যা আহমেদ এবং পিতা অধ্যাপক অজয় রায় একাধিকবার সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে তার দুই ধরনের জবাব এসেছে। একটি হচ্ছে গতানুগতিক, ‘অপরাধীদের ধরার জন্য সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত আছে।’ আর, অপরটি রাজনৈতিক এবং গূঢ় অর্থবাহী, ‘অত্যন্ত স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে সরকারকে এগোতে হচ্ছে।’
জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর দাবি যদি সঠিক হয়, তাহলে গত ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় হলেন ইসলামি জঙ্গিদের চতুর্থ শিকার। নীলাদ্রিকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে যে জঙ্গিগোষ্ঠী আনসার আল-ইসলাম, তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে ‘যদি তোমাদের “বাকস্বাধীনতা” কোনো সীমানা না মানতে প্রস্তুত থাকে তবে তোমাদের হৃদয় যেন আমাদের “চাপাতির স্বাধীনতার” জন্য উন্মুক্ত থাকে।’
বিদেশি প্রচারমাধ্যমগুলোতেও বিষয়টি আলাদা গুরুত্ব পেয়েছে। বিবিসিতে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে চলতে থাকা প্রচারযুদ্ধের ওপর আলোকপাত করে বলা হয়েছে যে একদিকে ‘মুক্তমনা’ হিসেবে পরিচয়দানকারীরা দাবি করছেন ধর্মীয় বিশ্বাসের সমালোচনা করতে না পারার মানে দাঁড়াবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিসর্জন। আর অন্যদিকে, জঙ্গি মতাদর্শের অনুসারী নন, কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসে আস্থাশীলদের কেউ কেউ বলছেন যে দেশে প্রধানমন্ত্রী এবং রাজনীতিকদের সমালোচনা ও তাঁদের নিয়ে ব্যঙ্গ করার জন্য মানুষকে জেল খাটতে হয়, সে দেশে এটি কোন ধরনের স্বাধীনতা যে ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাতকে মেনে নিতে হবে?
বিবিসি রেডিওর ট্রেন্ডিং নামের একটি অনুষ্ঠানে একজন ব্লগার বলেছেন যে দেশটি এখন একটি ‘খোলা জেলখানা’ (ওপেন প্রিজন), সেখানে তিনি এখন মত প্রকাশের সময় নিজেই নিজেকে সংবরণ (সেন্সর) করেন। তবে ওই অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু দাবি করেছেন যে দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও গণমাধ্যমে সরকারের সমালোচনা অহরহই চলছে।
সরকার-সমর্থক সম্পাদক-উপদেষ্টা-সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারাও অনেক দিন ধরেই তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে চলেন। কিন্তু ব্লগারদের মৃত্যু কিংবা রাজনীতিকদের সমালোচনা বা ব্যঙ্গ করার জন্য মামলা বা কারাদণ্ডের পরিসংখ্যানগুলো বলে ভিন্ন কথা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে তথ্যপ্রযুক্তি আইন বা আইসিটির আওতায় রাজনীতিকদের প্রতি কটাক্ষ করার জন্য এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে প্রায় তিন ডজন। মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য বিশ্বব্যাপী কাজ করছে এমন দুটি প্রতিষ্ঠান—কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) এবং রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস উভয়ের ওয়েবসাইট দুটোতে গেলেই যে কেউ দেখতে পারেন যে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন কী। সিপিজে একটি বৈশ্বিক মানচিত্রে হটস্পটগুলো চিহ্নিত করে রেখেছে, যেখানে ১৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও আছে। আর রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসে এ বছরে বিশ্বে আটজন নেটিজেনের (ইন্টারনেটের নাগরিক-সাংবাদিক) প্রাণহানির কথা বলা হয়েছে। সেখানে নীলাদ্রিকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের তিনজনের কথা বলা আছে। নীলাদ্রি যুক্ত হলে আমরা সিরিয়াকে ছুঁয়ে ফেলব।
কারও অভিমত বা বিশ্লেষণ সবার পছন্দ হবে কিংবা সেগুলো অন্যদের গ্রহণ করতে হবে—এমন কথা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেউই বলতে পারেন না। কারও মতামত আপত্তিকর হলে তাঁকে হত্যা করা ঠিক বলে যাঁরা মনে করেন, তাঁরা সম্ভবত ‘তোমাদের কর্ম ও কর্মফল তোমাদের জন্য এবং আমার কর্ম ও কর্মফল আমার জন্য’ (আয়াত ৬, সূরা কাফিরুন) কথাটির মর্মার্থ বুঝতে অক্ষম।
রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার কথাটাও এ ক্ষেত্রে আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। দ্বিদলীয় ধারার যে রাজনীতি দেশে কয়েক দশক ধরে চলে আসছিল, সেটিও আমরা সুস্থভাবে চলতে দিইনি। ভিন্নমতাবলম্বীদের আমাদের মন্ত্রীরা প্রায়ই অন্য দেশে পাঠিয়ে দিতে চান। রাজনীতিতে ভিন্নমতের কোনো জায়গা না থাকলে দমবন্ধ হওয়া পরিবেশে অগণতান্ত্রিক শক্তির কালো হাত আরও শাণিত হবে এবং ছোবল মারবেই। আর পুলিশ না হলেও অন্য কেউ ওই পরামর্শই দেবে যে মুক্তচিন্তার দেশ এটি নয়, মুক্তচিন্তা করতে হলে দেশ ছাড়তে হবে।
No comments