বিভক্তি নেই, আছে by সাজেদুল হক ও উৎপল রায়
একদিন
সবকিছু ভেঙে পড়ে। যে সেতু কোন দিন ভাঙবে না বলে বিশ্বাস জন্মেছিল, তাও
ভেঙে যায়। হুমায়ুন আজাদের উপন্যাসের নায়কের বিশ্বাসের মতো বাংলাদেশের বেশির
ভাগ মানুষের বিশ্বাসই আজ ভেঙে গেছে। যদিও একথা অস্বীকার করার জো নেই, এ এক
অন্য রকম সময়। মুক্তিযুদ্ধের হিরণ্ময় দিনগুলোতে আমাদের এ প্রিয় মাতৃভূমিতে
বুদ্ধিজীবীরা যে মর্যাদার আসনে আসীন ছিলেন তা এখন আর নেই। যদিও তখনও
বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিভক্তি ছিল। বলা বাহুল্য, সে বিভক্তি ছিল আদর্শিক।
আহমদ ছফার মতো মানুষ অবশ্য সে সময়ও বুদ্ধিজীবীরা যে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন তা মানতে রাজি ছিলেন না। ১৯৭২ সালে তিনি লিখেছেন, বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন তা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, এখন যা বলছেন তা শুনলে বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তন হবে না। বুদ্ধিজীবী আর সিভিল সোসাইটি এক কি-না তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে। যদিও রাষ্ট্রচিন্তক আবুল কাসেম ফজলুল হক লিখেছেন, আগে বলা হতো বুদ্ধিজীবী, এখন বলা হয় বিশিষ্ট নাগরিক। বুদ্ধিজীবীই বলি, আর বিশিষ্ট নাগরিকই বলি রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা গুরুতর বিবেচনার দাবি করে।
বুদ্ধিজীবী বা সিভিল সোসাইটির ওপর মানুষের বিশ্বাস যে আজ ভেঙে পড়েছে তা অনস্বীকার্য। এ সত্য কেউ অস্বীকার করেন না যে, আমাদের মধ্যে আজ কোন আহমদ ছফা নেই, হুমায়ুন আজাদ নেই, এবিএম মূসাও নেই। যারা রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সব সময় নিজের মতো প্রকাশ করে গেছেন। আকুণ্ঠচিত্তে বলে গেছেন হক কথা। বাংলাদেশে আজ যেন হক বলে কিছু নেই। সিভিল সোসাইটির বিভক্তিকেই এর প্রধান কারণ মনে করেন বুদ্ধিভিত্তিক জগতের মানুষেরা। ‘বিভক্তির কবলে বিশ্বাস’ শীর্ষক ধারাবাহিক প্রতিবেদনে মানবজমিন দেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী-নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মতামত তুলে ধরেছে। তারা প্রায় সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন, এ বিভক্তির পেছনে প্রধান কারণ দুটি। ১. রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে বিভক্তি। ২. পাওয়া-না পাওয়ার হিসাবের ভিত্তিতে বিভক্তি। তবে এর বাইরেও নানা কারণের কথা বলেছেন তারা। সিভিল সোসাইটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে না পারার পেছনে ভয়ের সংস্কৃতির কথাও বলেছেন অনেকে। অতীতে যারা সাহসিকতার সঙ্গে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছেন, তাদের পরিণতির কথা স্মরণ করছেন অনেকে। নানা রকম গ্লানি সহ্য করতে হয়েছে তাদের। কেউ কেউ বলেছেন, বাংলাদেশে এখন আর সিভিল সোসাইটি বলতে কিছু নেই। সবাই পরিণত হয়েছেন রাজনৈতিক সোসাইটিতে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছাড়া সিভিল সোসাইটি যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে না বলেও মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। পর্যবেক্ষকরা, চীনের কথাও উল্লেখ করেছেন। অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের উদ্ভব হলেও সেখানে গণতন্ত্র নেই, নেই কোন সিভিল সোসাইটিও।
বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটির বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের সরল পথ অবশ্য কেউ বাতলাতে পারেননি। দলের দাসত্ব থেকে বেরিয়ে আসাই সম্ভবত সে পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। দুই বিভক্ত ধারার নেতৃত্বে থাকা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ও বহুমাত্রিক লেখক সৈয়দ শামসুল হক বিভক্তি নিয়ে মতামতের ক্ষেত্রেও বিভক্তই থেকেছেন-
আমি কোন বিভক্তি দেখি না: সৈয়দ হক
বিভক্তির রেখাটি এখন একেবারেই স্পষ্ট। ভেতর থেকেই যেন ভাগ হয়ে গেছে বাংলাদেশের সমাজ। সিভিল সোসাইটির বিভক্তিকে সবচেয়ে বড় ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অনেকে। যদিও এ বিভক্তির বিষয়টি মানতে রাজি নন সরকার সমর্থক সহস্র নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অগ্রগতির পেছনে সুশীলসমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের অবদান আগেও ছিল, এখনও আছে এবং তা বেশ বড় আকারেই আছে। আর যারা বাংলাদেশে বিশ্বাস করে না, কিছু পাওয়ার আশা করে কিন্তু পায়নি তারাই মূলত এ সমাজের বিভক্তি ও বিভাজনের কথা বলে। তবে আমি কোন বিভাজন ও বিভক্তি দেখি না। প্রশ্ন হলো আমি বাংলাদেশে বিশ্বাস করি কী করি না? মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করেন কী করেন না। যারা বাংলাদেশের মানুষ, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তবুদ্ধির চেতনায় বিশ্বাস করেন, তাদের মধ্যে কোন বিভাজন নেই। আর যারা এসবে বিশ্বাস করেন না তারাই মূলত বিভাজনের কথা বলেন। কিন্তু তারা খুব একটা শক্তিশালীও নন। কেউ কেউ আছেন, কিন্তু সেই ‘কেউ কেউরা’ সব সময়ই থাকেন। এদের ব্যাপারে সতর্ক থাকলেই হবে। বাংলাদেশ সঠিক পথেই এগোচ্ছে মন্তব্য করে প্রথিতযশা এই কবি বলেন, অনেকেই বলে দেশের সুশীলসমাজ ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় আরও একটু গতিশীল ভূমিকা রাখলে দেশের জন্য ভাল হতো। কিন্তু আমি বলি, কি হতো না হতো তার চেয়ে বেশি জরুরি কী হচ্ছে? ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বারুদ না ভিজলে ইতিহাস তো অন্য রকমও হতে পারতো। তবে, ইতিহাসের বড় শিক্ষা এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। তাই, কি হতো না হতো তা বাদ দিয়ে যা হচ্ছে তার ভিত্তিতেই আলোচনা করতে হবে, আমাদের এগোতে হবে।
গণতন্ত্র না থাকাতেই এ বিভক্তি: এমাজউদ্দীন
বিরোধী সমর্থক শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি গোটা সমাজের ঐক্য বিনষ্ট করে। যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু থাকে তখন সবকিছুই উন্মুক্ত থাকে। আর গণতন্ত্র যখন থাকে না, তখনই সুশীল সমাজসহ সামাজিক শক্তিগুলো বিভক্ত হয়ে যায়। তিনি বলেন, যেখানে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও সুশাসন থাকে না সেখানে বিভক্তি ও বিভাজন থাকবেই। তিনি বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যখন থাকে, তখন সেই গণতন্ত্রের কাজই হলো সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখা। সমস্যার সমাধান করা। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে সেই পরিবেশ নেই। আর পরিবেশ না থাকলে সামাজিক শক্তি যেমন বিভাজিত হয়ে যায়, তেমনি গোটা সমাজটাই বিভক্ত হয়ে যায়। যে জন্য বুদ্ধিজীবী ও সুশীলসমাজও এখন বিভক্ত হয়ে গেছে। তিনি বলেন, একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে দেশের সবাই মিলেমিশে ছিল। কিন্তু পরাধীন ছিল। আবার তখন পরাধীন থাকার ফলেই সবাই ঐক্যবদ্ধ ছিল। গণতন্ত্রের জন্য নয়। যখন স্বাধীনতা পেলাম তখনও আমরা ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। কিন্তু যখনই নতুন সরকার গঠিত হলো তখনই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি শুরু হলো। ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পথও রুদ্ধ হয়ে গেল। পরবর্তীকালে শাসকদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির ধারাবাহিকতা বজায় থাকায় সুশীলসমাজের মধ্যেও বিভক্তি তৈরি হলো। সেই ধারাবাহিকতা চলছে এখনও। তিনি বলেন, ধীরে ধীরে আমাদের সামাজিক বন্ধনটা ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক প্রবণতার কারণে সামাজিক ঐক্যবোধও নষ্ট হয়ে গেছে। সব পেশাতেই এখন কে কতটুকু ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির প্রতি অনুগত এটাই দেখা হয়। এটাই যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দ্বিধা, লজ্জা, শরম বলে কিছুই নেই এখন। তিনি বলেন, একে একে রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান বিনষ্ট হয়ে গেছে। শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী এমনকি মানুষ বাঁচানোর চিকিৎসক ও পুলিশ পর্যন্ত বিভাজিত হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন মেধার কোন মূল্য নেই। আছে রাজনৈতিক পরিচয়ের মূল্য। এ কারণে বিভাজনও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিভাজন দূর করার জন্য গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের কোন বিকল্প নেই উল্লেখ করে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, কোন সরকার যদি সুশাসন বাদ দিয়ে নিজের, পরিবারের বা রাজনৈতিক দলকে সামনে আনার চেষ্টা করে, তখনই ঐক্য বিনষ্ট হয়। আর ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে মানুষ ঐক্যবদ্ধ থাকে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই মানুষ ঐক্যবদ্ধ থকে। এজন্য আইনের শাসন ও গণতন্ত্র বজায় রাখা একান্ত জরুরি।
আহমদ ছফার মতো মানুষ অবশ্য সে সময়ও বুদ্ধিজীবীরা যে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন তা মানতে রাজি ছিলেন না। ১৯৭২ সালে তিনি লিখেছেন, বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন তা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, এখন যা বলছেন তা শুনলে বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তন হবে না। বুদ্ধিজীবী আর সিভিল সোসাইটি এক কি-না তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে। যদিও রাষ্ট্রচিন্তক আবুল কাসেম ফজলুল হক লিখেছেন, আগে বলা হতো বুদ্ধিজীবী, এখন বলা হয় বিশিষ্ট নাগরিক। বুদ্ধিজীবীই বলি, আর বিশিষ্ট নাগরিকই বলি রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা গুরুতর বিবেচনার দাবি করে।
বুদ্ধিজীবী বা সিভিল সোসাইটির ওপর মানুষের বিশ্বাস যে আজ ভেঙে পড়েছে তা অনস্বীকার্য। এ সত্য কেউ অস্বীকার করেন না যে, আমাদের মধ্যে আজ কোন আহমদ ছফা নেই, হুমায়ুন আজাদ নেই, এবিএম মূসাও নেই। যারা রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সব সময় নিজের মতো প্রকাশ করে গেছেন। আকুণ্ঠচিত্তে বলে গেছেন হক কথা। বাংলাদেশে আজ যেন হক বলে কিছু নেই। সিভিল সোসাইটির বিভক্তিকেই এর প্রধান কারণ মনে করেন বুদ্ধিভিত্তিক জগতের মানুষেরা। ‘বিভক্তির কবলে বিশ্বাস’ শীর্ষক ধারাবাহিক প্রতিবেদনে মানবজমিন দেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী-নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মতামত তুলে ধরেছে। তারা প্রায় সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন, এ বিভক্তির পেছনে প্রধান কারণ দুটি। ১. রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে বিভক্তি। ২. পাওয়া-না পাওয়ার হিসাবের ভিত্তিতে বিভক্তি। তবে এর বাইরেও নানা কারণের কথা বলেছেন তারা। সিভিল সোসাইটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে না পারার পেছনে ভয়ের সংস্কৃতির কথাও বলেছেন অনেকে। অতীতে যারা সাহসিকতার সঙ্গে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছেন, তাদের পরিণতির কথা স্মরণ করছেন অনেকে। নানা রকম গ্লানি সহ্য করতে হয়েছে তাদের। কেউ কেউ বলেছেন, বাংলাদেশে এখন আর সিভিল সোসাইটি বলতে কিছু নেই। সবাই পরিণত হয়েছেন রাজনৈতিক সোসাইটিতে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছাড়া সিভিল সোসাইটি যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে না বলেও মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। পর্যবেক্ষকরা, চীনের কথাও উল্লেখ করেছেন। অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের উদ্ভব হলেও সেখানে গণতন্ত্র নেই, নেই কোন সিভিল সোসাইটিও।
বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটির বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের সরল পথ অবশ্য কেউ বাতলাতে পারেননি। দলের দাসত্ব থেকে বেরিয়ে আসাই সম্ভবত সে পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। দুই বিভক্ত ধারার নেতৃত্বে থাকা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ও বহুমাত্রিক লেখক সৈয়দ শামসুল হক বিভক্তি নিয়ে মতামতের ক্ষেত্রেও বিভক্তই থেকেছেন-
আমি কোন বিভক্তি দেখি না: সৈয়দ হক
বিভক্তির রেখাটি এখন একেবারেই স্পষ্ট। ভেতর থেকেই যেন ভাগ হয়ে গেছে বাংলাদেশের সমাজ। সিভিল সোসাইটির বিভক্তিকে সবচেয়ে বড় ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অনেকে। যদিও এ বিভক্তির বিষয়টি মানতে রাজি নন সরকার সমর্থক সহস্র নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অগ্রগতির পেছনে সুশীলসমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের অবদান আগেও ছিল, এখনও আছে এবং তা বেশ বড় আকারেই আছে। আর যারা বাংলাদেশে বিশ্বাস করে না, কিছু পাওয়ার আশা করে কিন্তু পায়নি তারাই মূলত এ সমাজের বিভক্তি ও বিভাজনের কথা বলে। তবে আমি কোন বিভাজন ও বিভক্তি দেখি না। প্রশ্ন হলো আমি বাংলাদেশে বিশ্বাস করি কী করি না? মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করেন কী করেন না। যারা বাংলাদেশের মানুষ, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তবুদ্ধির চেতনায় বিশ্বাস করেন, তাদের মধ্যে কোন বিভাজন নেই। আর যারা এসবে বিশ্বাস করেন না তারাই মূলত বিভাজনের কথা বলেন। কিন্তু তারা খুব একটা শক্তিশালীও নন। কেউ কেউ আছেন, কিন্তু সেই ‘কেউ কেউরা’ সব সময়ই থাকেন। এদের ব্যাপারে সতর্ক থাকলেই হবে। বাংলাদেশ সঠিক পথেই এগোচ্ছে মন্তব্য করে প্রথিতযশা এই কবি বলেন, অনেকেই বলে দেশের সুশীলসমাজ ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় আরও একটু গতিশীল ভূমিকা রাখলে দেশের জন্য ভাল হতো। কিন্তু আমি বলি, কি হতো না হতো তার চেয়ে বেশি জরুরি কী হচ্ছে? ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বারুদ না ভিজলে ইতিহাস তো অন্য রকমও হতে পারতো। তবে, ইতিহাসের বড় শিক্ষা এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। তাই, কি হতো না হতো তা বাদ দিয়ে যা হচ্ছে তার ভিত্তিতেই আলোচনা করতে হবে, আমাদের এগোতে হবে।
গণতন্ত্র না থাকাতেই এ বিভক্তি: এমাজউদ্দীন
বিরোধী সমর্থক শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি গোটা সমাজের ঐক্য বিনষ্ট করে। যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু থাকে তখন সবকিছুই উন্মুক্ত থাকে। আর গণতন্ত্র যখন থাকে না, তখনই সুশীল সমাজসহ সামাজিক শক্তিগুলো বিভক্ত হয়ে যায়। তিনি বলেন, যেখানে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও সুশাসন থাকে না সেখানে বিভক্তি ও বিভাজন থাকবেই। তিনি বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যখন থাকে, তখন সেই গণতন্ত্রের কাজই হলো সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখা। সমস্যার সমাধান করা। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে সেই পরিবেশ নেই। আর পরিবেশ না থাকলে সামাজিক শক্তি যেমন বিভাজিত হয়ে যায়, তেমনি গোটা সমাজটাই বিভক্ত হয়ে যায়। যে জন্য বুদ্ধিজীবী ও সুশীলসমাজও এখন বিভক্ত হয়ে গেছে। তিনি বলেন, একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে দেশের সবাই মিলেমিশে ছিল। কিন্তু পরাধীন ছিল। আবার তখন পরাধীন থাকার ফলেই সবাই ঐক্যবদ্ধ ছিল। গণতন্ত্রের জন্য নয়। যখন স্বাধীনতা পেলাম তখনও আমরা ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। কিন্তু যখনই নতুন সরকার গঠিত হলো তখনই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি শুরু হলো। ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পথও রুদ্ধ হয়ে গেল। পরবর্তীকালে শাসকদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির ধারাবাহিকতা বজায় থাকায় সুশীলসমাজের মধ্যেও বিভক্তি তৈরি হলো। সেই ধারাবাহিকতা চলছে এখনও। তিনি বলেন, ধীরে ধীরে আমাদের সামাজিক বন্ধনটা ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক প্রবণতার কারণে সামাজিক ঐক্যবোধও নষ্ট হয়ে গেছে। সব পেশাতেই এখন কে কতটুকু ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির প্রতি অনুগত এটাই দেখা হয়। এটাই যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দ্বিধা, লজ্জা, শরম বলে কিছুই নেই এখন। তিনি বলেন, একে একে রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান বিনষ্ট হয়ে গেছে। শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী এমনকি মানুষ বাঁচানোর চিকিৎসক ও পুলিশ পর্যন্ত বিভাজিত হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন মেধার কোন মূল্য নেই। আছে রাজনৈতিক পরিচয়ের মূল্য। এ কারণে বিভাজনও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিভাজন দূর করার জন্য গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের কোন বিকল্প নেই উল্লেখ করে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, কোন সরকার যদি সুশাসন বাদ দিয়ে নিজের, পরিবারের বা রাজনৈতিক দলকে সামনে আনার চেষ্টা করে, তখনই ঐক্য বিনষ্ট হয়। আর ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে মানুষ ঐক্যবদ্ধ থাকে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই মানুষ ঐক্যবদ্ধ থকে। এজন্য আইনের শাসন ও গণতন্ত্র বজায় রাখা একান্ত জরুরি।
No comments