এমন পৈশাচিকতা কি খুব বিরল by আলী রীয়াজ
অত্যাচার
মাত্রই অমানবিক, হত্যাকাণ্ড মাত্রই বর্বরোচিত। কিন্তু এসব বর্বরতার
সাক্ষ্য-প্রমাণ যখন আমাদের সামনে আসে, তখন বুঝতে পারি আমরা কত নির্লিপ্ত
জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। সিলেটের শহরতলি কুমারগাঁও এলাকায় চোর
সন্দেহে সামিউল আলম রাজনকে (১৩) পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনার ভিডিও সামাজিক
যোগাযোগের মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর দুই দিন ধরে (১১ ও ১২ জুলাই) এই
নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। এই ভিডিওর সূত্রে আমরা জানতে পারি, কতটা
বর্বরোচিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এ-ও জানতে পারি, ঠান্ডা মাথায় এই
নির্যাতন চালানো হয়েছে। অমানবিক নির্যাতনের মুখে শিশুটি যখন তার শেষ আশ্রয়
হিসেবে পুলিশের হাতে সোপর্দ করার জন্য অনুনয় করেছে, তখন নিপীড়নকারীদের
একজন নিজেকে পুলিশ বলে দাবি করেছে। তারা যে রাজনকে হত্যা করতে চেয়েছে, সে
বিষয়ে সন্দেহের কারণ নেই। কেননা, ভিডিওতে তার সাক্ষ্য রয়েছে—শেষ দিকে
নির্যাতনকারীদের একজন সঙ্গীদের কাছে জানতে চায়, ‘কিতা করতাম?’ আরেকজনকে তখন
বলতে শোনা যায়, ‘মামায় যে কইছন, ওই কাম করি ছাড়ি দে!’ এই ‘মামা’ যে
নির্দেশদাতা, তা আমরা বুঝতে পারি। শুধু তা-ই নয়, এই হত্যাকারীরা লাশ গুমের
চেষ্টা চালিয়েছিল।
শেখপাড়ার মুহিত আলমের মাইক্রোবাসে তুলে স্থানীয় কুমারগাঁও এলাকার ভেতরের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় লোকজন দেখে ফেললে মাইক্রোবাসটি সেখানে ফেলে এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট নির্যাতনকারীরা পালিয়ে যায়। মখলিছ মিয়া নামের এক যুবককে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে স্থানীয় জনতা। এ যাবৎ যে বর্ণনা পাওয়া গেছে, তাতে স্পষ্ট যে স্থানীয় কিছু লোক এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিল। কেউ কেউ লাশ গুমের কাজে সহযোগিতা করেছে। আবার স্থানীয় মানুষই এই অপরাধীদের ধরতে চেষ্টা করেছে।
রাজন হত্যার ঘটনার যে ভিডিওচিত্র আমরা দেখতে পাই, তা এতটাই অসহনীয় যে আমার জানামতে অনেকেই এক চেষ্টায় এর পুরোটা দেখতে পারেনি। কিন্তু যদি এই ভিডিও আমরা না দেখতাম, তাহলে কি আমরা জানতে পারতাম কতটা পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়েছে একটি শিশুকে? আমরা জানি অথবা না জানি, তাতে এই হত্যাকাণ্ডের যে নির্মমতা, তা বিন্দুমাত্র কম হতো না।
যত কষ্টকরই হোক না কেন, এখন আমাদের একবারের জন্য হলেও এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া দরকার—এ রকম পৈশাচিকতা কি খুব বিরল ঘটনা? ১২ জুলাই বাংলাদেশ সময় রাতে যারা এ খবর দেখেছে, তারা কি এটাই লক্ষ করেছে যে ওই দিন আরও তিনটি খবর গণমাধ্যমে ছিল, যেখানে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে? গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী সিদ্ধিরগঞ্জে একজন পোশাকশ্রমিককে, রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে এক যুবককে এবং কোম্পানীগঞ্জে তৃতীয় লিঙ্গের একজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই তিনটি হত্যাকাণ্ডের কারণ ভিন্ন।
সিদ্ধিরগঞ্জের ঘটনায় অভিযোগ, নাইম (১৯) নামের যুবক মুঠোফোন চুরি করেছেন। নাইম ও তাঁর মা ঝর্ণা বেগমকে পিটিয়ে ফেলে রাখার পর স্থানীয় লোকজন তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যায়। চিকিৎসকেরা নাঈমকে মৃত ঘোষণা করেন। রাজশাহীতে জাহাঙ্গীর হোসেন নামে যে যুবককে হত্যা করা হয়েছে, তার কারণ জমি নিয়ে বিরোধ। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরকাঁকড়া ইউনিয়নে লাকি আক্তার ওরফে জাহাঙ্গীর নামের তৃতীয় লিঙ্গের যে মানুষটিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তার অপরাধ হলো সে এবং তার সঙ্গীরা চাঁদা দাবি করেছিল; অভিযোগ রয়েছে যে এক বিয়ের অনুষ্ঠানের পারিশ্রমিক নিয়ে এই বচসার শুরু।
আমরা জানি যে সারা দেশে যত ঘটনা ঘটে, তার কিয়দংশ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ফলে আমরা অনুমান করতে পারি, এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটেছে এবং তার সংবাদ আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়নি। দুই দিনের এসব সংবাদ স্মরণ করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য এই নয় যে রাজন হত্যার গুরুত্ব বা তার অমানবিক দিকটি ছোট করা; বরং এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া যে সমাজে এ রকম ঘটনা কেন ঘটছে? আমরা প্রতিদিন পিটিয়ে মারার যেসব খবর পাই, সেগুলো একদিক থেকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা; কিন্তু অন্য বিবেচনায় সেগুলো বিচ্ছিন্ন বলে ভাবার অবকাশ নেই।
বাংলাদেশের সমাজে যে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার লক্ষণ দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়, এ ধরনের নির্মমতা কি তারই প্রকাশ? এ বিষয়ে সাময়িক ক্ষোভের বাইরে সমাজে একধরনের নির্লিপ্ততাও কি একই সূত্রে বাঁধা?
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সর্বসাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬৮ জন মানুষকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০১০ সালে ১৬৭ জন, ২০১১ সালে ১৪৫ জন, ২০১২ সালে ৯৯ জন এবং ২০১৩ সালে ১২৩ জন পিটিয়ে হত্যার শিকার হয়েছ। প্রায়ই আমরা এ ধরনের ঘটনাকে ‘গণপিটুনি’ বলে বর্ণনা করতে শুনি। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য, ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ঢাকা ও এর আশপাশে বিভিন্ন ঘটনায় ১৫০ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিল। এই সংখ্যাগুলো নিঃসন্দেহে স্বস্তিদায়ক নয়।
আমার জানামতে, এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিচার হওয়ার কোনো নজির নেই। অনেকের মনে থাকবে যে ২০১১ সালে শবে বরাতের রাতে আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামে ছয় ছাত্রকে ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করে গ্রামবাসী। এ ঘটনার পর পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। প্রথমে পুলিশকে ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হলেও আদালতের নির্দেশে পরে এ দায়িত্ব পায় র্যাব। প্রায় দেড় বছর পর ৬০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়, মামলার কাজ এখন চলছে।
কিন্তু এ ধরনের ঘটনার পৌনঃপুনিকতা এবং সমাজে এ নিয়ে উদ্বেগের অনুপস্থিতি কিসের ইঙ্গিত বহন করে? প্রথমত, এটি বিরাজমান বিচারহীনতার সংস্কৃতির লক্ষণ; ক্ষমতা, বিত্ত ও প্রভাবের কারণে অপরাধীরা বিচারের বাইরে থেকে যাওয়ায় এ ধরনের আচরণ করে পার পেয়ে যাওয়া যাবে বলে অপরাধীরা মনে করে। তারা যে ধরা–ছোঁয়ার বাইরে থাকবে, সেটা তারা ধরেই নেয় এ কারণে যে এ ধরনের ঘটনায় আগে কেউ বিচারের মুখোমুখি হয়নি। শুধু তা-ই নয়, তাঁরা এ-ও জানে যে সমাজে এ নিয়ে যে ক্ষোভ, তা অনেকটাই সাময়িক।
গুটি কয়েক মানুষ মিলে এ ধরনের ঘটনা সংঘটনের সময় অন্যদের মধ্য থেকে আমরা প্রতিরোধ দেখতে পাই না কেন? তার দুটি কারণ চিহ্নিত করা যায়—প্রথমটি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আস্থার অভাব। দ্বিতীয়ত, বিচার বিভাগ নিয়ে, বিশেষত নিম্ন আদালতগুলোয় সুবিচারের সম্ভাবনা বিষয়ে সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা। তাঁরা মনে করেন না, এসব অপরাধীকে পুলিশের হাতে তুলে দিলে এরা শাস্তি পাবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আস্থাহীনতা যে কতটা প্রবল, সেটা বোঝার জন্য একটি তথ্য উল্লেখ করা যায়। ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট প্রতিবছর সারা পৃথিবীর দেশগুলোর আইনের শাসনবিষয়ক, অর্থাৎ আইন ও বিচার বিভাগের বিভিন্ন দিক নিয়ে যে সূচক তৈরি করে, তাতে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১০২টি দেশের মধ্যে ৯৩; একই ধরনের অর্থনৈতিক অবস্থানের ১৫টি দেশের মধ্যে ১১ এবং আঞ্চলিক ৬টি দেশের মধ্যে চতুর্থ—কেবল আফগানিস্তান আর পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে।
শুধু তা-ই নয়, পুলিশের জবাবদিহিবিষয়ক যে তালিকা, যা তৈরি করা হয় আইনজীবী ও আইনজ্ঞদের দেওয়া মতামতের ওপর ভিত্তি করে, তাতে দেখা যায় যে উত্তরদাতাদের মাত্র ২৫ শতাংশ মনে করেন পুলিশ আইন অনুযায়ী কাজ করে, ২৬ শতাংশ মনে করেন যে পুলিশ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং ১৮ শতাংশ মনে করেন যে আইন ভঙ্গের জন্য পুলিশ শাস্তি ভোগ করে।
এ প্রশ্নও তোলা দরকার, কেন একটি দেশে মানুষ পিটিয়ে হত্যার ঘটনাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া হচ্ছে? এ প্রশ্ন নিয়ে বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানীদের যে ভাবনা-চিন্তা আমরা জানতে পারি, তা বিভিন্ন ঘটনার প্রতিক্রিয়া মাত্র। এ বিষয়ে গবেষণা যা হয়েছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা চোখে পড়ে না। কিন্তু বিভিন্ন ঘটনায় বাংলাদেশের সমাজে যে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার লক্ষণ দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়, এ ধরনের নির্মমতা কি তারই প্রকাশ? এ বিষয়ে সাময়িক ক্ষোভের বাইরে সমাজে একধরনের নির্লিপ্ততাও কি একই সূত্রে বাঁধা?
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
শেখপাড়ার মুহিত আলমের মাইক্রোবাসে তুলে স্থানীয় কুমারগাঁও এলাকার ভেতরের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় লোকজন দেখে ফেললে মাইক্রোবাসটি সেখানে ফেলে এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট নির্যাতনকারীরা পালিয়ে যায়। মখলিছ মিয়া নামের এক যুবককে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে স্থানীয় জনতা। এ যাবৎ যে বর্ণনা পাওয়া গেছে, তাতে স্পষ্ট যে স্থানীয় কিছু লোক এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিল। কেউ কেউ লাশ গুমের কাজে সহযোগিতা করেছে। আবার স্থানীয় মানুষই এই অপরাধীদের ধরতে চেষ্টা করেছে।
রাজন হত্যার ঘটনার যে ভিডিওচিত্র আমরা দেখতে পাই, তা এতটাই অসহনীয় যে আমার জানামতে অনেকেই এক চেষ্টায় এর পুরোটা দেখতে পারেনি। কিন্তু যদি এই ভিডিও আমরা না দেখতাম, তাহলে কি আমরা জানতে পারতাম কতটা পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়েছে একটি শিশুকে? আমরা জানি অথবা না জানি, তাতে এই হত্যাকাণ্ডের যে নির্মমতা, তা বিন্দুমাত্র কম হতো না।
যত কষ্টকরই হোক না কেন, এখন আমাদের একবারের জন্য হলেও এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া দরকার—এ রকম পৈশাচিকতা কি খুব বিরল ঘটনা? ১২ জুলাই বাংলাদেশ সময় রাতে যারা এ খবর দেখেছে, তারা কি এটাই লক্ষ করেছে যে ওই দিন আরও তিনটি খবর গণমাধ্যমে ছিল, যেখানে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে? গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী সিদ্ধিরগঞ্জে একজন পোশাকশ্রমিককে, রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে এক যুবককে এবং কোম্পানীগঞ্জে তৃতীয় লিঙ্গের একজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই তিনটি হত্যাকাণ্ডের কারণ ভিন্ন।
সিদ্ধিরগঞ্জের ঘটনায় অভিযোগ, নাইম (১৯) নামের যুবক মুঠোফোন চুরি করেছেন। নাইম ও তাঁর মা ঝর্ণা বেগমকে পিটিয়ে ফেলে রাখার পর স্থানীয় লোকজন তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যায়। চিকিৎসকেরা নাঈমকে মৃত ঘোষণা করেন। রাজশাহীতে জাহাঙ্গীর হোসেন নামে যে যুবককে হত্যা করা হয়েছে, তার কারণ জমি নিয়ে বিরোধ। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরকাঁকড়া ইউনিয়নে লাকি আক্তার ওরফে জাহাঙ্গীর নামের তৃতীয় লিঙ্গের যে মানুষটিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তার অপরাধ হলো সে এবং তার সঙ্গীরা চাঁদা দাবি করেছিল; অভিযোগ রয়েছে যে এক বিয়ের অনুষ্ঠানের পারিশ্রমিক নিয়ে এই বচসার শুরু।
আমরা জানি যে সারা দেশে যত ঘটনা ঘটে, তার কিয়দংশ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ফলে আমরা অনুমান করতে পারি, এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটেছে এবং তার সংবাদ আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়নি। দুই দিনের এসব সংবাদ স্মরণ করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য এই নয় যে রাজন হত্যার গুরুত্ব বা তার অমানবিক দিকটি ছোট করা; বরং এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া যে সমাজে এ রকম ঘটনা কেন ঘটছে? আমরা প্রতিদিন পিটিয়ে মারার যেসব খবর পাই, সেগুলো একদিক থেকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা; কিন্তু অন্য বিবেচনায় সেগুলো বিচ্ছিন্ন বলে ভাবার অবকাশ নেই।
বাংলাদেশের সমাজে যে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার লক্ষণ দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়, এ ধরনের নির্মমতা কি তারই প্রকাশ? এ বিষয়ে সাময়িক ক্ষোভের বাইরে সমাজে একধরনের নির্লিপ্ততাও কি একই সূত্রে বাঁধা?
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সর্বসাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬৮ জন মানুষকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০১০ সালে ১৬৭ জন, ২০১১ সালে ১৪৫ জন, ২০১২ সালে ৯৯ জন এবং ২০১৩ সালে ১২৩ জন পিটিয়ে হত্যার শিকার হয়েছ। প্রায়ই আমরা এ ধরনের ঘটনাকে ‘গণপিটুনি’ বলে বর্ণনা করতে শুনি। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য, ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ঢাকা ও এর আশপাশে বিভিন্ন ঘটনায় ১৫০ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিল। এই সংখ্যাগুলো নিঃসন্দেহে স্বস্তিদায়ক নয়।
আমার জানামতে, এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিচার হওয়ার কোনো নজির নেই। অনেকের মনে থাকবে যে ২০১১ সালে শবে বরাতের রাতে আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামে ছয় ছাত্রকে ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করে গ্রামবাসী। এ ঘটনার পর পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। প্রথমে পুলিশকে ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হলেও আদালতের নির্দেশে পরে এ দায়িত্ব পায় র্যাব। প্রায় দেড় বছর পর ৬০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়, মামলার কাজ এখন চলছে।
কিন্তু এ ধরনের ঘটনার পৌনঃপুনিকতা এবং সমাজে এ নিয়ে উদ্বেগের অনুপস্থিতি কিসের ইঙ্গিত বহন করে? প্রথমত, এটি বিরাজমান বিচারহীনতার সংস্কৃতির লক্ষণ; ক্ষমতা, বিত্ত ও প্রভাবের কারণে অপরাধীরা বিচারের বাইরে থেকে যাওয়ায় এ ধরনের আচরণ করে পার পেয়ে যাওয়া যাবে বলে অপরাধীরা মনে করে। তারা যে ধরা–ছোঁয়ার বাইরে থাকবে, সেটা তারা ধরেই নেয় এ কারণে যে এ ধরনের ঘটনায় আগে কেউ বিচারের মুখোমুখি হয়নি। শুধু তা-ই নয়, তাঁরা এ-ও জানে যে সমাজে এ নিয়ে যে ক্ষোভ, তা অনেকটাই সাময়িক।
গুটি কয়েক মানুষ মিলে এ ধরনের ঘটনা সংঘটনের সময় অন্যদের মধ্য থেকে আমরা প্রতিরোধ দেখতে পাই না কেন? তার দুটি কারণ চিহ্নিত করা যায়—প্রথমটি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আস্থার অভাব। দ্বিতীয়ত, বিচার বিভাগ নিয়ে, বিশেষত নিম্ন আদালতগুলোয় সুবিচারের সম্ভাবনা বিষয়ে সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা। তাঁরা মনে করেন না, এসব অপরাধীকে পুলিশের হাতে তুলে দিলে এরা শাস্তি পাবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আস্থাহীনতা যে কতটা প্রবল, সেটা বোঝার জন্য একটি তথ্য উল্লেখ করা যায়। ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট প্রতিবছর সারা পৃথিবীর দেশগুলোর আইনের শাসনবিষয়ক, অর্থাৎ আইন ও বিচার বিভাগের বিভিন্ন দিক নিয়ে যে সূচক তৈরি করে, তাতে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১০২টি দেশের মধ্যে ৯৩; একই ধরনের অর্থনৈতিক অবস্থানের ১৫টি দেশের মধ্যে ১১ এবং আঞ্চলিক ৬টি দেশের মধ্যে চতুর্থ—কেবল আফগানিস্তান আর পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে।
শুধু তা-ই নয়, পুলিশের জবাবদিহিবিষয়ক যে তালিকা, যা তৈরি করা হয় আইনজীবী ও আইনজ্ঞদের দেওয়া মতামতের ওপর ভিত্তি করে, তাতে দেখা যায় যে উত্তরদাতাদের মাত্র ২৫ শতাংশ মনে করেন পুলিশ আইন অনুযায়ী কাজ করে, ২৬ শতাংশ মনে করেন যে পুলিশ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং ১৮ শতাংশ মনে করেন যে আইন ভঙ্গের জন্য পুলিশ শাস্তি ভোগ করে।
এ প্রশ্নও তোলা দরকার, কেন একটি দেশে মানুষ পিটিয়ে হত্যার ঘটনাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া হচ্ছে? এ প্রশ্ন নিয়ে বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানীদের যে ভাবনা-চিন্তা আমরা জানতে পারি, তা বিভিন্ন ঘটনার প্রতিক্রিয়া মাত্র। এ বিষয়ে গবেষণা যা হয়েছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা চোখে পড়ে না। কিন্তু বিভিন্ন ঘটনায় বাংলাদেশের সমাজে যে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার লক্ষণ দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়, এ ধরনের নির্মমতা কি তারই প্রকাশ? এ বিষয়ে সাময়িক ক্ষোভের বাইরে সমাজে একধরনের নির্লিপ্ততাও কি একই সূত্রে বাঁধা?
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments