নতুন বাস নামাতে মূল বাধা মালিক সমিতির চাঁদাবাজি by আনোয়ার হোসেন
ঢাকাসহ সারা দেশে নতুন বাস-মিনিবাস নামানোর ক্ষেত্রে প্রধান বাধা মালিক সমিতিগুলোর চাঁদাবাজি। বাস নামানোর আগেই মালিক সমিতির সদস্যপদ সংগ্রহ করতে গিয়ে ২ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বাস-মিনিবাস না নামার এটি অন্যতম কারণ। এই সুযোগে রাস্তা দখল করে নিয়েছে নানা ধরনের তিন চাকার ছোট্ট যানবাহন।
সারা দেশে চলাচলরত বাস-মিনিবাসের অন্তত ৩০ শতাংশ ২০ বছরের বেশি পুরোনো, লক্কড়-ঝক্কড়। আর ৬১ শতাংশের বয়স ১০ বছরের ওপরে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) বাস নিবন্ধনসংক্রান্ত তথ্যভান্ডার থেকে জানা গেছে, সারা দেশে বাস-মিনিবাসের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে ৬১ হাজার ৫৮৯টি। এর মধ্যে ৪০ হাজার ৮২২টি বাস-মিনিবাস ১০ বছরের পুরোনো। ২০ বছরের পুরোনো বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ১৮ হাজার ৫৪টি।
বিআরটিএর আরেক হিসাবে দেখা যায়, ১৯৯৫ সালের পর থেকে সারা দেশে বাস-মিনিবাসের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে ৪৩ হাজার ৫৩৫টি। অথচ এই সময় অটোরিকশা ও টেম্পোর নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ১৩ হাজার ১৬২টি। কিন্তু সারা দেশে বৈধ-অবৈধ অটোরিকশা, নছিমন, করিমন, ভটভটি ও ইজিবাইক রয়েছে ১৩ লাখের বেশি। এগুলোকে জাতীয় মহাসড়ক থেকে উচ্ছেদ করতে গিয়ে এখন নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশে কত মানুষের জন্য কী পরিমাণ গণপরিবহন দরকার, এই বিষয়ে কোনো গবেষণা নেই। তবে বিদ্যমান গণপরিবহনব্যবস্থা যে মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না, এটা পরিষ্কার। তা না হলে তো ধীরগতির তিন চাকার যানের এত চাহিদা থাকত না। তিনি বলেন, মালিক-শ্রমিকদের সিন্ডিকেটের কারণে গণপরিবহনে বিনিয়োগ কমে গেছে। দূরপাল্লার কিছু পথ বাদ দিলে বিদ্যমান পরিবহনব্যবস্থা আরামদায়ক কিংবা আকর্ষণীয় নয়। ফলে মানুষ ধীরগতির যানের দিকে ঝুঁকছে।
পরিবহন খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী একাধিক ভুক্তভোগী জানান, বিআরটিএ এবং পরিবহন কমিটির অনুমোদনের আগেই মালিক সমিতির সদস্য হতে হয়। আর মালিক সমিতিগুলো নিয়ন্ত্রণ করে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের নেতা বা নেতাদের আত্মীয়স্বজন। এই চাঁদা আদায়ে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোরও সমর্থন থাকে।
কয়েকজন পরিবহনমালিক প্রথম আলোকে বলেন, মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে বাস নামানোর পর মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও পুলিশকে দিতে হয় দৈনিক বা মাসিক চাঁদা। এমনকি মালিক সমিতি না চাইলে সরকারের পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির বাসও চলতে পারে না। গত এক দশকে মালিক সমিতির চাপ, ধর্মঘট ও ভাঙচুরে শিকার হয়ে বিআরটিসিই অন্তত ৫০টি পথে বাস চলাচল গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছে।
অবশ্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, এখন আর চাঁদা নিয়ে সমিতির সদস্য করার বিষয় নেই। অতীতে ছিল। টুকটাক কোনো জেলায় চাঁদা নেওয়ার খবর পেলে তাঁরা প্রশাসনকে নিয়ে মোকাবিলা করে থাকেন।
বাসের দামের চেয়ে সমিতির চাঁদা বেশি: বছর তিনেক আগে ভোলা-চরফ্যাশন পথে চালানোর লক্ষ্যে ১১ লাখ টাকা দিয়ে একটি পাঁচ বছরের পুরোনো বাস কিনেছিলেন মেহেদী হাসান। কিন্তু বাস কেনার পর জানতে পারলেন, সরকারের অনুমোদনের আগে স্থানীয় মালিক সমিতির সদস্যপদ লাগবে। সদস্যপদের জন্য গেলে তাঁর কাছে দাবি করা হয় ১৮ লাখ টাকা। ব্যর্থ হয়ে পরে মেহেদী বাসটি বিক্রি করে দেন।
মেহেদী হাসান বলেন, ১৮ লাখ টাকায় সদস্যপদ নিয়ে একটি বাস চালিয়ে পোষাবে না ভেবে তিনি সরে আসেন। তবে সম্প্রতি ওই জেলায় একজন ২০ লাখ টাকায় মালিক সমিতির সদস্যপদ কিনে বাস নামিয়েছেন।
১৯৯৬ সালের পর ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ফজলুল কাদের মোল্লা মালিক সমিতিকে পাশ কাটিয়ে চারটি নতুন বাস নামিয়েছিলেন। কিন্তু তিন মাসের বেশি টিকতে পারেননি।
ফজলুল কাদের মোল্লা বর্তমানে ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই জেলার বেশির ভাগ বাসই ছিল কয়েকবার ইঞ্জিন-বডি পরিবর্তন করা লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা। তিনি চারটি নতুন বাস নামিয়েছিলেন। কিন্তু মালিক সমিতির সদস্যপদ না নেওয়ার কারণে তাঁর বাস ভাঙচুর করা হয়। পরে তিনি বাস বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন।
ভোলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সমিতির মালিকানায় বাস, জমিসহ অনেক স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আছে। সদস্য হওয়ার অর্থ হচ্ছে ১৩-১৪ লাখ টাকার সম্পদের মালিক হওয়া। এ জন্যই চাঁদার ব্যবস্থা।’ তিনি জানান, সমিতি থেকে প্রতি মাসে সদস্যদের ১০ হাজার টাকা করে বোনাস দেওয়া হয়।
ভোলার মালিক সমিতির এই চিত্র বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। কম-বেশি এটাই সারা দেশের চিত্র। সম্প্রতি সিলেট পথে চলাচলকারী একটি বাস কোম্পানির মালিক পিরোজপুরের মালিক সমিতিকে তিন লাখ টাকা দিয়ে সেই জেলায় বাস চালানোর অনুমতি পেয়েছেন। ঢাকায় দিশারী পরিবহনের অধীনে একটি বাস নামাতে মালিককে ব্যয় করতে হয় তিন লাখ টাকা। তবে ভুক্তভোগীদের কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি।
পিরোজপুর জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান ওরফে মহারাজ। কিন্তু তাঁর নিজের কোনো বাস নেই। তিনি স্থানীয় সাংসদ এ কে এম এ আউয়ালের (সাইদুর রহমান) ভাই।
ঢাকা থেকে পিরোজপুর পর্যন্ত বাস চালানোর অনুমতি দিতে একটি কোম্পানির কাছ থেকে তিন লাখ টাকা চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন মশিউর রহমান। তিনি গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাঁদা নেওয়ার বিষয়টি সত্য নয়। তবে জেলায় বাস চালানোর জন্য বিআরটিএর অনুমোদনের বাইরে আমাদের অনুমোদন নিতে হয়। নতুবা আমাদের মালিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ঢাকার পরিবহন কোম্পানিকে শর্ত দিয়েছি, যাতে ভোর ছয়টার আগে শহর ছাড়ে।’
সমিতির সদস্য হতে মোটা অঙ্কের চাঁদা লাগে কি না জানতে চাইলে মশিউর রহমান বলেন, পিরোজপুরে চার-পাঁচ বছর ধরে সদস্য নেওয়া বন্ধ আছে। কারণ, নতুন বাস নামলে পুরোনো মালিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তিনি দাবি করেন, আগে পিরোজপুরে দৈনিক ১৬৫ টাকা চাঁদা নেওয়া হতো। তিনি এসে কমিয়ে ১০ টাকা করেছেন। সমিতি চালানো কঠিন হয়ে গেলে চাঁদা ২৫ টাকা করা হয়।
নিজের বাস না থাকার বিষয়ে মশিউর বলেন, ‘আমার বাস নেই এটা সত্যি। তবে আগে ছিল। নেতা হওয়ার জন্য বাস থাকার চেয়ে সদস্যপদ থাকা বাধ্যতামূলক।’
ঢাকা-টাঙ্গাইল ও টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলার মধ্যে বাস যোগাযোগ বেশ জনপ্রিয়। সেখানকার মালিক সমিতি নতুন বাস নামানোর ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে আট লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেয় বলে মালিকদের সূত্রে জানা গেছে। ওই জেলায় ৮০০-৯০০ বাস-মিনিবাস চলাচল করত। এখন শ দেড়েক বাস কমে গেছে। টাঙ্গাইলে বাস মালিকদের দুটি সংগঠন একত্র করে এর সভাপতি হন স্থানীয় সাংসদ আমানুর রহমান খানের ভাই জাহিদুর রহমান। খুনের মামলায় খান পরিবারের সদস্যরা এখন পলাতক।
অবশ্য জেলার বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির বাস শাখার সাধারণ সম্পাদক তাবিবুর রহমান দাবি করেন, সমিতির কেউ বাস নামালে পাঁচ হাজার এবং বাইরের হলে ১০ হাজার টাকা নিয়ে সদস্যপদ দেওয়া হয়। এর বাইরে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এটা আমার জানা নেই।’
টাঙ্গাইলের নাগরিকেরা দীর্ঘদিন ধরে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) বাস নামানোর দাবি করে আসছিলেন। বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হন আগ্রহীরা। সর্বশেষ আক্তার হোসেন নামে এক ব্যবসায়ী জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে এই বিষয়টি তুললে প্রশাসন তৎপর হয়। সনি এন্টারপ্রাইজ নামে চারটি বাস নামেও। তবে জেলার ঢাকামুখী সব বাসের গন্তব্য মহাখালী টার্মিনাল হলেও সেই এসি বাস সার্ভিসকে মহাখালীতে থামতে দেওয়া হয় না। তাকে দাঁড়াতে হয় শ্যামলীতে।
লক্কড়-ঝক্কড় যান বাড়ছে: বিআরটিএ সূত্র জানায়, কাগজেপত্রে বর্তমানে সারা দেশে প্রতি মাসে গড়ে ২০০ বাস চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু এর অর্ধেককেই এক জেলা থেকে এনে অন্য জেলায় কিংবা এক রুট থেকে অন্য রুটে স্থানান্তরের অনুমতি দেওয়া হয়। নতুন বাসগুলো নামছে দূরপাল্লার পথে।
মোটরযান আইন অনুসারে, যত দিন ফিটনেস থাকবে, তত দিন একটি গাড়ি চলতে পারবে। তবে নির্বাহী আদেশে রাজধানীতে বাসের ২০ এবং ট্রাকের জন্য ২৫ বছরের বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু ২০ বছরের অধিক পুরোনো বাসও ঢাকার রাস্তায় চলছে।
বিআরটিএর হিসাবে, বর্তমানে সারা দেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ৩ লাখ ৩৫ হাজার। এর মধ্যে বাস-মিনিবাস ৪১ শতাংশ বা প্রায় ২৫ হাজার। অবশ্য ফিটনেস সনদ হালনাগাদ না করলেও তা ফিটনেসবিহীন গাড়ির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, ফিটনেসবিহীন যানের সংখ্যা পাঁচ হাজারের মধ্যে থাকলে বলতে হবে পরিবহনব্যবস্থা ঠিক আছে।
মহানগরগুলোতে বাস চলাচলের অনুমতি (রুট পারমিট) দেয় পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বাধীন পরিবহন কমিটি। জেলায় কমিটি হয় পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে। আন্তজেলা পরিবহনের চলাচলের অনুমোদন দেয় বিআরটিএর সদর কার্যালয়। সব কমিটিতেই মালিক-শ্রমিকের প্রতিনিধি থাকেন। বিআরটিএর প্রতিনিধি কমিটির সদস্যসচিব এবং সংস্থাটি নথিপত্র সংরক্ষণ করে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক বলেন, ছোট গাড়ির ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধির অর্থ হলো যানজটকে ডেকে আনা। আর সড়ক নিরাপত্তা তো বিপন্ন হবেই। এ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে তিনি বলেন, সবচেয়ে ভালো হয় রেল ও নৌপথব্যবস্থার উন্নয়ন। বিকল্প হিসেবে অবশ্যই বাসকে গুরুত্ব দিতে হবে। তবে এর জন্য সরকারকে সুস্থ প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে।
সারা দেশে চলাচলরত বাস-মিনিবাসের অন্তত ৩০ শতাংশ ২০ বছরের বেশি পুরোনো, লক্কড়-ঝক্কড়। আর ৬১ শতাংশের বয়স ১০ বছরের ওপরে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) বাস নিবন্ধনসংক্রান্ত তথ্যভান্ডার থেকে জানা গেছে, সারা দেশে বাস-মিনিবাসের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে ৬১ হাজার ৫৮৯টি। এর মধ্যে ৪০ হাজার ৮২২টি বাস-মিনিবাস ১০ বছরের পুরোনো। ২০ বছরের পুরোনো বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ১৮ হাজার ৫৪টি।
বিআরটিএর আরেক হিসাবে দেখা যায়, ১৯৯৫ সালের পর থেকে সারা দেশে বাস-মিনিবাসের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে ৪৩ হাজার ৫৩৫টি। অথচ এই সময় অটোরিকশা ও টেম্পোর নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ১৩ হাজার ১৬২টি। কিন্তু সারা দেশে বৈধ-অবৈধ অটোরিকশা, নছিমন, করিমন, ভটভটি ও ইজিবাইক রয়েছে ১৩ লাখের বেশি। এগুলোকে জাতীয় মহাসড়ক থেকে উচ্ছেদ করতে গিয়ে এখন নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশে কত মানুষের জন্য কী পরিমাণ গণপরিবহন দরকার, এই বিষয়ে কোনো গবেষণা নেই। তবে বিদ্যমান গণপরিবহনব্যবস্থা যে মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না, এটা পরিষ্কার। তা না হলে তো ধীরগতির তিন চাকার যানের এত চাহিদা থাকত না। তিনি বলেন, মালিক-শ্রমিকদের সিন্ডিকেটের কারণে গণপরিবহনে বিনিয়োগ কমে গেছে। দূরপাল্লার কিছু পথ বাদ দিলে বিদ্যমান পরিবহনব্যবস্থা আরামদায়ক কিংবা আকর্ষণীয় নয়। ফলে মানুষ ধীরগতির যানের দিকে ঝুঁকছে।
পরিবহন খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী একাধিক ভুক্তভোগী জানান, বিআরটিএ এবং পরিবহন কমিটির অনুমোদনের আগেই মালিক সমিতির সদস্য হতে হয়। আর মালিক সমিতিগুলো নিয়ন্ত্রণ করে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের নেতা বা নেতাদের আত্মীয়স্বজন। এই চাঁদা আদায়ে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোরও সমর্থন থাকে।
কয়েকজন পরিবহনমালিক প্রথম আলোকে বলেন, মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে বাস নামানোর পর মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও পুলিশকে দিতে হয় দৈনিক বা মাসিক চাঁদা। এমনকি মালিক সমিতি না চাইলে সরকারের পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির বাসও চলতে পারে না। গত এক দশকে মালিক সমিতির চাপ, ধর্মঘট ও ভাঙচুরে শিকার হয়ে বিআরটিসিই অন্তত ৫০টি পথে বাস চলাচল গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছে।
অবশ্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, এখন আর চাঁদা নিয়ে সমিতির সদস্য করার বিষয় নেই। অতীতে ছিল। টুকটাক কোনো জেলায় চাঁদা নেওয়ার খবর পেলে তাঁরা প্রশাসনকে নিয়ে মোকাবিলা করে থাকেন।
বাসের দামের চেয়ে সমিতির চাঁদা বেশি: বছর তিনেক আগে ভোলা-চরফ্যাশন পথে চালানোর লক্ষ্যে ১১ লাখ টাকা দিয়ে একটি পাঁচ বছরের পুরোনো বাস কিনেছিলেন মেহেদী হাসান। কিন্তু বাস কেনার পর জানতে পারলেন, সরকারের অনুমোদনের আগে স্থানীয় মালিক সমিতির সদস্যপদ লাগবে। সদস্যপদের জন্য গেলে তাঁর কাছে দাবি করা হয় ১৮ লাখ টাকা। ব্যর্থ হয়ে পরে মেহেদী বাসটি বিক্রি করে দেন।
মেহেদী হাসান বলেন, ১৮ লাখ টাকায় সদস্যপদ নিয়ে একটি বাস চালিয়ে পোষাবে না ভেবে তিনি সরে আসেন। তবে সম্প্রতি ওই জেলায় একজন ২০ লাখ টাকায় মালিক সমিতির সদস্যপদ কিনে বাস নামিয়েছেন।
১৯৯৬ সালের পর ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ফজলুল কাদের মোল্লা মালিক সমিতিকে পাশ কাটিয়ে চারটি নতুন বাস নামিয়েছিলেন। কিন্তু তিন মাসের বেশি টিকতে পারেননি।
ফজলুল কাদের মোল্লা বর্তমানে ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই জেলার বেশির ভাগ বাসই ছিল কয়েকবার ইঞ্জিন-বডি পরিবর্তন করা লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা। তিনি চারটি নতুন বাস নামিয়েছিলেন। কিন্তু মালিক সমিতির সদস্যপদ না নেওয়ার কারণে তাঁর বাস ভাঙচুর করা হয়। পরে তিনি বাস বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন।
ভোলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সমিতির মালিকানায় বাস, জমিসহ অনেক স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আছে। সদস্য হওয়ার অর্থ হচ্ছে ১৩-১৪ লাখ টাকার সম্পদের মালিক হওয়া। এ জন্যই চাঁদার ব্যবস্থা।’ তিনি জানান, সমিতি থেকে প্রতি মাসে সদস্যদের ১০ হাজার টাকা করে বোনাস দেওয়া হয়।
ভোলার মালিক সমিতির এই চিত্র বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। কম-বেশি এটাই সারা দেশের চিত্র। সম্প্রতি সিলেট পথে চলাচলকারী একটি বাস কোম্পানির মালিক পিরোজপুরের মালিক সমিতিকে তিন লাখ টাকা দিয়ে সেই জেলায় বাস চালানোর অনুমতি পেয়েছেন। ঢাকায় দিশারী পরিবহনের অধীনে একটি বাস নামাতে মালিককে ব্যয় করতে হয় তিন লাখ টাকা। তবে ভুক্তভোগীদের কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি।
পিরোজপুর জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান ওরফে মহারাজ। কিন্তু তাঁর নিজের কোনো বাস নেই। তিনি স্থানীয় সাংসদ এ কে এম এ আউয়ালের (সাইদুর রহমান) ভাই।
ঢাকা থেকে পিরোজপুর পর্যন্ত বাস চালানোর অনুমতি দিতে একটি কোম্পানির কাছ থেকে তিন লাখ টাকা চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন মশিউর রহমান। তিনি গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাঁদা নেওয়ার বিষয়টি সত্য নয়। তবে জেলায় বাস চালানোর জন্য বিআরটিএর অনুমোদনের বাইরে আমাদের অনুমোদন নিতে হয়। নতুবা আমাদের মালিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ঢাকার পরিবহন কোম্পানিকে শর্ত দিয়েছি, যাতে ভোর ছয়টার আগে শহর ছাড়ে।’
সমিতির সদস্য হতে মোটা অঙ্কের চাঁদা লাগে কি না জানতে চাইলে মশিউর রহমান বলেন, পিরোজপুরে চার-পাঁচ বছর ধরে সদস্য নেওয়া বন্ধ আছে। কারণ, নতুন বাস নামলে পুরোনো মালিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তিনি দাবি করেন, আগে পিরোজপুরে দৈনিক ১৬৫ টাকা চাঁদা নেওয়া হতো। তিনি এসে কমিয়ে ১০ টাকা করেছেন। সমিতি চালানো কঠিন হয়ে গেলে চাঁদা ২৫ টাকা করা হয়।
নিজের বাস না থাকার বিষয়ে মশিউর বলেন, ‘আমার বাস নেই এটা সত্যি। তবে আগে ছিল। নেতা হওয়ার জন্য বাস থাকার চেয়ে সদস্যপদ থাকা বাধ্যতামূলক।’
ঢাকা-টাঙ্গাইল ও টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলার মধ্যে বাস যোগাযোগ বেশ জনপ্রিয়। সেখানকার মালিক সমিতি নতুন বাস নামানোর ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে আট লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেয় বলে মালিকদের সূত্রে জানা গেছে। ওই জেলায় ৮০০-৯০০ বাস-মিনিবাস চলাচল করত। এখন শ দেড়েক বাস কমে গেছে। টাঙ্গাইলে বাস মালিকদের দুটি সংগঠন একত্র করে এর সভাপতি হন স্থানীয় সাংসদ আমানুর রহমান খানের ভাই জাহিদুর রহমান। খুনের মামলায় খান পরিবারের সদস্যরা এখন পলাতক।
অবশ্য জেলার বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির বাস শাখার সাধারণ সম্পাদক তাবিবুর রহমান দাবি করেন, সমিতির কেউ বাস নামালে পাঁচ হাজার এবং বাইরের হলে ১০ হাজার টাকা নিয়ে সদস্যপদ দেওয়া হয়। এর বাইরে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এটা আমার জানা নেই।’
টাঙ্গাইলের নাগরিকেরা দীর্ঘদিন ধরে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) বাস নামানোর দাবি করে আসছিলেন। বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হন আগ্রহীরা। সর্বশেষ আক্তার হোসেন নামে এক ব্যবসায়ী জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে এই বিষয়টি তুললে প্রশাসন তৎপর হয়। সনি এন্টারপ্রাইজ নামে চারটি বাস নামেও। তবে জেলার ঢাকামুখী সব বাসের গন্তব্য মহাখালী টার্মিনাল হলেও সেই এসি বাস সার্ভিসকে মহাখালীতে থামতে দেওয়া হয় না। তাকে দাঁড়াতে হয় শ্যামলীতে।
লক্কড়-ঝক্কড় যান বাড়ছে: বিআরটিএ সূত্র জানায়, কাগজেপত্রে বর্তমানে সারা দেশে প্রতি মাসে গড়ে ২০০ বাস চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু এর অর্ধেককেই এক জেলা থেকে এনে অন্য জেলায় কিংবা এক রুট থেকে অন্য রুটে স্থানান্তরের অনুমতি দেওয়া হয়। নতুন বাসগুলো নামছে দূরপাল্লার পথে।
মোটরযান আইন অনুসারে, যত দিন ফিটনেস থাকবে, তত দিন একটি গাড়ি চলতে পারবে। তবে নির্বাহী আদেশে রাজধানীতে বাসের ২০ এবং ট্রাকের জন্য ২৫ বছরের বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু ২০ বছরের অধিক পুরোনো বাসও ঢাকার রাস্তায় চলছে।
বিআরটিএর হিসাবে, বর্তমানে সারা দেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ৩ লাখ ৩৫ হাজার। এর মধ্যে বাস-মিনিবাস ৪১ শতাংশ বা প্রায় ২৫ হাজার। অবশ্য ফিটনেস সনদ হালনাগাদ না করলেও তা ফিটনেসবিহীন গাড়ির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, ফিটনেসবিহীন যানের সংখ্যা পাঁচ হাজারের মধ্যে থাকলে বলতে হবে পরিবহনব্যবস্থা ঠিক আছে।
মহানগরগুলোতে বাস চলাচলের অনুমতি (রুট পারমিট) দেয় পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বাধীন পরিবহন কমিটি। জেলায় কমিটি হয় পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে। আন্তজেলা পরিবহনের চলাচলের অনুমোদন দেয় বিআরটিএর সদর কার্যালয়। সব কমিটিতেই মালিক-শ্রমিকের প্রতিনিধি থাকেন। বিআরটিএর প্রতিনিধি কমিটির সদস্যসচিব এবং সংস্থাটি নথিপত্র সংরক্ষণ করে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক বলেন, ছোট গাড়ির ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধির অর্থ হলো যানজটকে ডেকে আনা। আর সড়ক নিরাপত্তা তো বিপন্ন হবেই। এ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে তিনি বলেন, সবচেয়ে ভালো হয় রেল ও নৌপথব্যবস্থার উন্নয়ন। বিকল্প হিসেবে অবশ্যই বাসকে গুরুত্ব দিতে হবে। তবে এর জন্য সরকারকে সুস্থ প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে।
No comments