এক নেতা ৫ পদবি by কাফি কামাল
নির্বাচন
পূর্ববর্তী আন্দোলনে সবচেয়ে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছিল বিএনপির তৃণমূল। অথচ
নির্বাচনের পরপর প্রথম তৃণমূল পর্যায়ের কয়েকটি কমিটি ভেঙে দেয়া হয়।
মাঝেমধ্যেই এমন বিস্ময়কর সিদ্ধান্ত দেখা যায় বিএনপিতে। যেসব সিদ্ধান্ত
প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন দলটির কার্যালয়কেন্দ্রিক কর্মকর্তারা।
আন্দোলনের মাঠে না থাকলেও বিএনপিতে পদপদবির লড়াই তীব্র। অনেক নেতা একাই ভোগ
করেন ৩ থেকে ৫টি পদ। ‘বিএনপির ময়নাতদন্ত’ শীর্ষক ধারাবাহিক প্রতিবেদনের শেষ পর্বে এসব দিকেই দৃষ্টি ফেলেছেন আমাদের রাজনৈতিক সংবাদদাতা কাফি কামাল-
সাড়ে তিন দশকের রাজনৈতিক ইতিহাসে সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিএনপি। নেতৃত্ব নির্বাচনে বারবারই অদূরদর্শিতা ও ভুলনীতির প্রয়োগ দেখা গেছে দলটিতে। কমিটি গঠনে রাজনীতিকদের চেয়ে প্রাধান্য পেয়েছেন ব্যবসায়ী ও আমলারা। সুবিধামতো কেউ কেউ ভাগিয়ে নিয়েছেন ৩-৫টি পদ। এক সময় ছাত্রদল থেকে বিএনপিতে অনেক নেতা এলেও সে ধারাও এখন বন্ধ প্রায়। ছাত্র ও যুবদল থেকে প্রতিষ্ঠিত নেতারাও জাতীয় পর্যায়ে ঝুঁকে পড়েছেন ভোগবাদের দিকে। ফলে আদর্শবাদীদের ডিঙিয়ে অবস্থান সংহত করেছেন ভোগবাদীরা। সাংগঠনিক ক্ষেত্রে অরাজনৈতিক, নির্জীব ও নিষ্ক্রিয় ব্যক্তিরা ঢুকে পড়ায়; ক্রান্তিকালে কোন ভূমিকা রাখতে পারছেন না তারা।
সৌভাগ্যবানরা দলীয় মনোনয়নের পাশাপাশি পেয়েছেন সংগঠনের নিয়ন্ত্রণও। মনোনয়নের পাশাপাশি উপজেলা বিএনপির শীর্ষপদ, জেলা ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে তাদের স্থান দেয়া হয়েছে নির্বিচারে। জাতীয় নির্বাচনে যাকে যেখানে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল তৃণমূলের সাংগঠনিক ইউনিট কমিটি গঠনে তার হাতেই দেয়া হয়েছে ক্ষমতা। ফলে তারা যাকে ইচ্ছা নেতা বানিয়েছেন, যাকে ইচ্ছা বাদ দিয়েছেন। পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে কমিটি গঠনের কারণে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ও পদপদবিতে প্রতিযোগিতা নষ্ট হয়েছে তৃণমূলে। রাজনীতিক বিশ্লেষকদের মতে, তৃণমূল রাজনীতিতে কমপক্ষে এক যুগের অভিজ্ঞতা না থাকা লোককে উপজেলার দায়িত্ব দেয়া মানে তৃণমূল নষ্ট করে দেয়া। কিন্তু বারবার সেটাই করেছে বিএনপি।
বিএনপিতে এমন অনেক নেতা আছেন যারা একই সঙ্গে দলের শীর্ষস্থানীয় পদের পাশাপাশি অঙ্গ-সংগঠন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের পদে আসীন রয়েছেন। পাশাপাশি প্রভাব খাটিয়ে ভাগিয়ে নিয়েছেন পেশাজীবী সংগঠনের পদপদবিও। ফলে একেকজন সিনিয়র নেতার কব্জায় রয়েছে অন্তত ৩ থেকে ৫টি পদ। বর্তমান ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক রয়েছেন ৫ পদে। খোদ ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবই রয়েছেন ৪ পদে। অথচ দীর্ঘ ৫ বছরেও তার ‘ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব’ পদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি বিএনপি। একই রকম পরিস্থিতি যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দল, শ্রমিক দল, মহিলা দলসহ প্রতিটি অঙ্গসংগঠনে। নেতারা কেন্দ্রীয় কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদোন্নতি পেলেও অঙ্গসংগঠনের নেতৃত্ব ছাড়তে চান না।
রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্র হচ্ছে অঙ্গ-সংগঠন। কিন্তু বিএনপিতে পকেট কমিটি গঠনের মাধ্যমে বন্ধ্যা করে ফেলা হয়েছে প্রতিটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন। কমিটি গঠনে স্থবিরতা ও মাইনাস পলিসির কারণে ছাত্রদলকে করা হয়েছে দুর্বল। সময় মতো কোনবারই কমিটি হয়নি সংগঠনটিতে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এক দশক ধরে নতুন কমিটি গঠন হয়নি। ফলে বছরের বছর ছাত্ররাজনীতি করেও সদস্যপদ ছাড়াই ছাত্রজীবন শেষ করেছেন অনেক ছাত্রদল কর্মী। জট লেগে নিষ্ক্রিয় হয়েছে সংগঠনের একাংশ। বর্তমানে কর্মী-সমর্থক না থাকলেও নেতৃত্বের দাবিদারের সংখ্যা বেশুমার। সংগঠনটিতে ২০০১ সালের পর থেকে ফলো করা হয়েছে মাইনাস পলিসি। এক গ্রুপ নেতৃত্ব পেলে আরেক গ্রুপকে বাদ দেয়ার পাশাপাশি দাপটের সঙ্গেই করেছে কোণঠাসা। এতে সংগঠন থেকে ছিটকে পড়েছে যোগ্য ও বিশ্বস্ত কর্মী-সমর্থকরা। কেন এমন হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তরে ওঠে আসে কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রুপিং ও প্রভাববলয় তৈরির অপকৌশল। নব্বইয়ের দশকের কয়েকজন প্রভাবশালী ছাত্রনেতা প্রতিবারই ভাগ-বাটোয়ারা করেছেন পদপদবি। সাংগঠনিক যোগ্যতার চেয়ে নিজেদের পছন্দ ও অনুসারীদের টেনে এনেছেন নেতৃত্বে। প্রতিবন্ধকতা তৈরি ও ল্যাং মেরে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন যোগ্যদের।
বিএনপিসহ প্রতিটি অঙ্গসংগঠনের কমিটি গঠনে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে সেটা হচ্ছে কোটা। দলীয় নেতৃত্ব ভাগ হয়েছে কোটাভিত্তিতে। কোটা প্রথায় বিএনপিতে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে বৃহত্তর নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, বরিশাল ও নরসিংদী। দলের ৬টি যুগ্ম মহাসচিব পদের ৩টিই দেয়া হয়েছে নোয়াখালী জেলা থেকে। অন্য জেলাগুলো থেকে কি যোগ্য নেতা ওঠে আসেননি? কয়েক বছর ধরে ছাত্রদলের শীর্ষ পদগুলো মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো ঘুরছে টাঙ্গাইল ও নরসিংদী জেলায়। দলটিতে বছরের পর বছর ‘লবিং’ ভিত্তিক নেতা সৃষ্টি হওয়ার কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছেন কর্মীবান্ধব নেতারা। অনেক ক্ষেত্রে পদবঞ্চিতরা আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা রাখতে গেলে পদপদবিধারীরা প্রশাসনকে ব্যবহার করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গ্রেপ্তার করিয়েছেন। বহু জেলায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের পদবঞ্চিতরা যেখানে মামলার ঘানি টানতে টানতে ন্যূব্জ হয়ে পড়েছেন, সেখানে পদপদবিধারীরা রয়েছেন নিরাপদ। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা এবং বছরের পর বছর আন্দোলন-সংগ্রামে থাকার পরও বহু জেলা-উপজেলার পদবিধারীদের নামে মামলা হয়নি। এমন নিরাপদ রাজনীতি করেছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি অংশও।
বিরোধী রাজনীতিতে এ দীর্ঘ সময়ে সাংগঠনিকভাবে অদ্ভুত সব সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গেছে দলটিকে। নানা বিতর্কের পরও ঢাকা মহানগর নেতৃত্ব দেয়া হয়েছে সমালোচিতদের হাতেই। সারা দেশে গড়ে ওঠা আন্দোলনের রেশ ঢাকা মহানগর নেতারা জোরালো করতে না পারলেও শাস্তি পেয়েছে তৃণমূল। কর্মসূচি শেষে ঢাকা মহানগর বিএনপি ঢেলে সাজানোর চেয়ে ভাঙা হয়েছে বিভিন্ন জেলা কমিটি। আবার মহানগরে নানা নাটকের পর ঘোষণা এসেছে আহ্বায়ক কমিটির। দীর্ঘ কয়েক বছর পেরিয়ে গেলেও তারা রাজধানীতে এক-দশমাংশ ওয়ার্ডেও কমিটি গঠন করতে পারেনি। এ ব্যর্থতার নেপথ্যে দেখা গেছে, শীর্ষ নেতৃত্বের নিস্পৃহ ভূমিকা ও সুবিধাবাদীদের অপতৎপরতা। জেলা কমিটি গঠনে দেখা গেছে, খালেদা জিয়ার অনুমোদন পাওয়া কমিটিকে চ্যালেঞ্জ করে গঠন করা হয়েছে পাল্টা কমিটি। অন্যদিকে জোটকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে দল দুর্বল করার বহু আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত দেখা গেছে বিএনপিতে। জোটের কারণে ক্ষমতায় থাকাকালে বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, গাইবান্ধাসহ বহু জেলায় সংগঠন গোছানোর কথা ভুলে থেকেছিল বিএনপি। যেখানে এখন সাংগঠনিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দলটি। যার পরিণতিতে জিয়াউর রহমানের জন্মভূমি বগুড়ায় স্থানীয় নির্বাচনগুলোয় অর্ধেকের বেশি প্রার্থিতা ছেড়ে দেয়া হয়েছে জামায়াতকে। স্থানীয় নির্বাচনে জোটের মনরক্ষা করতে গিয়ে কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতাকে বহিষ্কার করতেও দেখা গেছে।
দুই দফা আন্দোলনের সময় বেশিরভাগ মাঝারি সারি ও জেলা পর্যায়ের নেতারা কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে পারেননি। কিন্তু ‘নিরাপদে থাকা’ তৃণমূলের নেতারাই পেয়েছেন শীর্ষ নেতৃত্বের ফোন। অনেক ক্ষেত্রে খালেদা জিয়াকে ভুল বুঝিয়ে নির্বাচিত জেলা কমিটি ভেঙে গঠন করা হয়েছে পকেট কমিটি। এক্ষেত্রে গুলশান কার্যালয়ে দায়িত্বরত কর্মকর্তারাই শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে নির্ধারণ করেছেন মাঝারি সারি ও জেলা নেতাদের ভূমিকা। তৃণমূলে যারা নানামুখী বিপর্যয়ের শিকার হয়েছেন তাদের খোঁজ নেয়া হয়নি শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে। গুম-নিখোঁজ হওয়া নেতাকর্মীদের পরিবার পায়নি সান্ত্বনা। কারাবন্দি নেতাকর্মীরা পায়নি আইনি সহায়তা।
দলটির কেন্দ্রীয় ও চেয়ারপারসনের দুটি কার্যালয় থাকলেও নেতাকর্মীদের মামলা-হামলা, গ্রেপ্তার, গুমসহ সাংগঠনিক ও আইনগত তেমন কোন তথ্য মেলে না সেখানে। তাই বিএনপি এ পর্যন্ত তাদের অন্তরীণ বা নিখোঁজ থাকা নেতা-কর্মীদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে পারেনি। নেতারা সবসময় ‘হাজার হাজার বা লাখে লাখে গ্রেপ্তার’ শব্দ দিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন। কারণ রেকর্ড সংরক্ষণ ও তার হালনাগাদকরণ কঠিন কাজ। দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতার প্রধান দায়িত্ব হয়ে উঠেছে শুধুই ব্রিফিং। দলটির বিষয়ভিত্তিক শতাধিক সম্পাদক রয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের কোন তৎপরতা দেখা যায় না। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংবাদ সম্মেলনে প্রয়োজনীয় প্রাসঙ্গিক তথ্যও দিতে পারেননি বিএনপি চেয়ারপারসন।
গণমাধ্যমের ব্যাপারে আগাগোড়াই নিস্পৃহতা ও খামখেয়ালি দেখিয়েছে বিএনপি। সাড়ে নয়টার মধ্যেই জাতীয় দৈনিকগুলোর প্রথম সংস্কার প্রেসে যায়। কিন্তু বিএনপির বেশির ভাগ বৈঠক শেষ হয় এ সময়ের পর। এতে সারা দেশের মানুষ বিএনপির তথ্য বা সংবাদ থেকে বঞ্চিত হয়। একইভাবে টেলিভিশনগুলোতে সমস্যা হয়। এতে গণমাধ্যমকর্মীসহ সংশ্লিষ্টদের অনাকাঙ্ক্ষিত ভোগান্তি পোহাতে হয়। সেদিকে নজরই দেয়নি বিএনপি। দলের কোন তথ্য বা বক্তব্য সবাইকে জানানোর চেয়ে বিশেষ কয়েকটি মিডিয়াকে ডেকে কথা বলার একটি রেওয়াজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দলটিতে। অন্যদিকে সংবাদ সম্মেলনগুলোয় খালেদা জিয়াকে প্রশ্ন করার সুযোগ সীমিত করে দেয়া হয়। ২০১৪ সালে বর্তমান সরকার যেদিন শপথ গ্রহণ করে সেদিন কথা বলার জন্য বিএনপি বিটের সাংবাদিকদের ডেকেছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু বাসার সামনে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষায় রেখে তিনি শেষ পর্যন্ত সাক্ষাৎ দেননি। আবার সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিএনপি নেতারা ক্যামেরাপ্রিয় হয়ে পড়েছেন। নেতাদের এ ক্যামেরাপ্রীতি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে আন্দোলনে। হরতাল বা অন্যান্য কর্মসূচিতে রাজপথে নেতাদের উপস্থিতি চোখে না পড়লেও বিকালে কেতাদুরস্ত হয়ে তারা হাজির হন ব্রিফিংয়ে। বিএনপির সাংগঠনিক ও দাপ্তরিক কার্যক্রমে পদে পদে ফুটে ওঠে সমন্বয়হীনতা। সাংগঠনিক কোন বিষয়ে তথ্য বা মতামত জানতে চাইলে বেশির ভাগ সিনিয়র নেতাই দেখিয়ে দেন বিশেষ কয়েকজনকে। এমনও হয়েছে বারবার গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সিদ্ধান্ত হয়েছে কিন্তু তার ছিটেফোঁটাও জানতে পারেননি অনেক নীতিনির্ধারক।
দলটির সিনিয়র নেতারা ঘরোয়া আলাপে প্রায় বলেন, প্রেসিডেন্ট থাকাকালে জিয়াউর রহমানের গাড়ির দুপাশ খোলা থাকতো। দুদিক থেকে তাকে ফুল দিতো লোকজন। তিনি পাশে দাঁড়ানো লোকজনের সঙ্গে হাত মেলাতেন। কিন্তু নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ঘেরাটোপে বন্দি করা হয়েছে খালেদা জিয়াকে। নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে যোগাযোগ। চেয়ারপারসন কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ পেতে পার হতে হয় অন্তত ৫টি ধাপ। নানা সময়ে দেখা গেছে, দলের নীতিনির্ধারক ফোরামের সদস্য কিংবা সিনিয়র নেতাকে আটকে দেয়া হয়েছে স্রেফ হাত প্রসারিত করে। গুলশান কার্যালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের পছন্দ এবং মর্জিতেই নির্ধারণ হয় কারা খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ পাবেন। ফলে কোন কোন জেলার শীর্ষ নেতার প্রবেশাধিকার সীমিত থাকলেও সুবিধাবাদী ও একই জেলার থানা বা ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের রয়েছে অবাধ যাতায়াত। আবার যখন আনুষ্ঠানিকভাবে মতবিনিময়ের জন্য ডাকা হয়, তখনও কে কে কথা বলবেন আগেই তা নির্ধারণ করে সে প্রভাব বলয়। এর মাধ্যমে দলের দৈনন্দিন ও সার্বিক তথ্য থেকে দূরে রাখা হয় খালেদা জিয়াকে। গুলশান কার্যালয়ে কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতা, রহস্যজনক আচরণ এবং দৌরাত্ম্যই এখন স্বাভাবিকতার অংশ হয়ে উঠেছে। নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয় সুবিধাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে। জেলা ও থানা পর্যায়ের নেতাদের বহিষ্কার, বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার ও তদবিরের তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে কেন্দ্রীয় কার্যালয়। বিএনপি ক্ষমতার বাইরে রয়েছে প্রায় নয় বছর। একবার জাতীয় কাউন্সিল ছাড়া সংগঠন গোছানোর কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি। একবার সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু করলেও গতিহীন হয়ে পড়ে সে উদ্যোগ। অভিযানে কি পরিমাণ লোকজন বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন, তার কোন পরিসংখ্যান নেই দলটির দপ্তরে। দীর্ঘ সময়েও প্রতিষ্ঠিত হয়নি দলের একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক শাখা।
বিএনপিতে নেতাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের একটি আত্মঘাতী ধারা চালু রয়েছে প্রথম থেকেই। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর এ রেওয়াজ রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত হয়েছে দলটির। বিভিন্ন সময়ে কেবল অবিশ্বাসের শিকার হয়েই কপাল পুড়েছে অনেক রাজনীতিকের। বর্তমানে সেই অবিশ্বাসের ধারাটিই ব্যবহারের সুযোগ নিচ্ছে সরকার। দলের কেউ কাউকে বিশ্বাস করেন না। উল্টো পরস্পরকে ‘সরকারের দালাল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যস্ত থাকেন সময়ে সময়ে। ঘরোয়া আলাপে বেশির ভাগ নেতাই অন্য নেতাদের নিয়ে খোলাখুলি অভিযোগের তীর ছুড়েন। বিএনপিতে একটি প্রবাদ রয়েছে, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কাউকে একবার বিশ্বাস করলে দলে অটুট হয় তাঁর অবস্থান। কাউকে একবার অবিশ্বাস করলে তিনি হয়ে পড়েন কোনঠাসা। দলের স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান ও যুগ্ম মহাসচিব মিলিয়ে তার আস্থাচক্রে আছেন তেমন কিছু নেতা। তারা একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব সৃষ্টি, দলকে ভুল পথে পরিচালনা, দলের নীতি-আদর্শবিরোধী বক্তব্য প্রদান করলেও তাদের ব্যাপারে কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি। বরং তথাকথিত বিশ্বাসীদের প্রভাবকে প্রাধান্য দিয়েই তিনি দলের তৃণমূলের মতামত ও সিনিয়র নেতাদের পরামর্শকে গৌণ বিবেচনা করেছেন বারবার। বড় বড় পদে বসানো এবং নির্বাচন ও বিভিন্ন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে তাদের হাতেই দেয়া হয়েছে দায়িত্ব। পদপদবি বিক্রি ও অনুসারীদের সামনে নিয়ে আসার সুবর্ণ সুযোগ। বিএনপির রাজনীতি নিয়ে গবেষণার দরকার পড়ে না, একটু নজর দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একাংশ সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে চলেছেন, আরেক অংশ জেল-জুলুম-নির্যাতনে ধুঁকে মরছে। কারণ বিএনপি নজরদারি চালাতে পারেনি নেতৃত্বের গতিবিধিতে। দলের পদ ও দায়িত্ব নিয়ে বিরোধী দলে থাকা সত্ত্বেও কেউ কেউ বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন চুটিয়ে। রাজনীতির ইতিহাসে দেখা গেছে, কোন দলের প্রকৃত সংগঠকরা কোনঠাসা হলে সে দলের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
সাড়ে তিন দশকের রাজনৈতিক ইতিহাসে সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিএনপি। নেতৃত্ব নির্বাচনে বারবারই অদূরদর্শিতা ও ভুলনীতির প্রয়োগ দেখা গেছে দলটিতে। কমিটি গঠনে রাজনীতিকদের চেয়ে প্রাধান্য পেয়েছেন ব্যবসায়ী ও আমলারা। সুবিধামতো কেউ কেউ ভাগিয়ে নিয়েছেন ৩-৫টি পদ। এক সময় ছাত্রদল থেকে বিএনপিতে অনেক নেতা এলেও সে ধারাও এখন বন্ধ প্রায়। ছাত্র ও যুবদল থেকে প্রতিষ্ঠিত নেতারাও জাতীয় পর্যায়ে ঝুঁকে পড়েছেন ভোগবাদের দিকে। ফলে আদর্শবাদীদের ডিঙিয়ে অবস্থান সংহত করেছেন ভোগবাদীরা। সাংগঠনিক ক্ষেত্রে অরাজনৈতিক, নির্জীব ও নিষ্ক্রিয় ব্যক্তিরা ঢুকে পড়ায়; ক্রান্তিকালে কোন ভূমিকা রাখতে পারছেন না তারা।
সৌভাগ্যবানরা দলীয় মনোনয়নের পাশাপাশি পেয়েছেন সংগঠনের নিয়ন্ত্রণও। মনোনয়নের পাশাপাশি উপজেলা বিএনপির শীর্ষপদ, জেলা ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে তাদের স্থান দেয়া হয়েছে নির্বিচারে। জাতীয় নির্বাচনে যাকে যেখানে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল তৃণমূলের সাংগঠনিক ইউনিট কমিটি গঠনে তার হাতেই দেয়া হয়েছে ক্ষমতা। ফলে তারা যাকে ইচ্ছা নেতা বানিয়েছেন, যাকে ইচ্ছা বাদ দিয়েছেন। পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে কমিটি গঠনের কারণে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ও পদপদবিতে প্রতিযোগিতা নষ্ট হয়েছে তৃণমূলে। রাজনীতিক বিশ্লেষকদের মতে, তৃণমূল রাজনীতিতে কমপক্ষে এক যুগের অভিজ্ঞতা না থাকা লোককে উপজেলার দায়িত্ব দেয়া মানে তৃণমূল নষ্ট করে দেয়া। কিন্তু বারবার সেটাই করেছে বিএনপি।
বিএনপিতে এমন অনেক নেতা আছেন যারা একই সঙ্গে দলের শীর্ষস্থানীয় পদের পাশাপাশি অঙ্গ-সংগঠন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের পদে আসীন রয়েছেন। পাশাপাশি প্রভাব খাটিয়ে ভাগিয়ে নিয়েছেন পেশাজীবী সংগঠনের পদপদবিও। ফলে একেকজন সিনিয়র নেতার কব্জায় রয়েছে অন্তত ৩ থেকে ৫টি পদ। বর্তমান ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক রয়েছেন ৫ পদে। খোদ ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবই রয়েছেন ৪ পদে। অথচ দীর্ঘ ৫ বছরেও তার ‘ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব’ পদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি বিএনপি। একই রকম পরিস্থিতি যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দল, শ্রমিক দল, মহিলা দলসহ প্রতিটি অঙ্গসংগঠনে। নেতারা কেন্দ্রীয় কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদোন্নতি পেলেও অঙ্গসংগঠনের নেতৃত্ব ছাড়তে চান না।
রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্র হচ্ছে অঙ্গ-সংগঠন। কিন্তু বিএনপিতে পকেট কমিটি গঠনের মাধ্যমে বন্ধ্যা করে ফেলা হয়েছে প্রতিটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন। কমিটি গঠনে স্থবিরতা ও মাইনাস পলিসির কারণে ছাত্রদলকে করা হয়েছে দুর্বল। সময় মতো কোনবারই কমিটি হয়নি সংগঠনটিতে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এক দশক ধরে নতুন কমিটি গঠন হয়নি। ফলে বছরের বছর ছাত্ররাজনীতি করেও সদস্যপদ ছাড়াই ছাত্রজীবন শেষ করেছেন অনেক ছাত্রদল কর্মী। জট লেগে নিষ্ক্রিয় হয়েছে সংগঠনের একাংশ। বর্তমানে কর্মী-সমর্থক না থাকলেও নেতৃত্বের দাবিদারের সংখ্যা বেশুমার। সংগঠনটিতে ২০০১ সালের পর থেকে ফলো করা হয়েছে মাইনাস পলিসি। এক গ্রুপ নেতৃত্ব পেলে আরেক গ্রুপকে বাদ দেয়ার পাশাপাশি দাপটের সঙ্গেই করেছে কোণঠাসা। এতে সংগঠন থেকে ছিটকে পড়েছে যোগ্য ও বিশ্বস্ত কর্মী-সমর্থকরা। কেন এমন হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তরে ওঠে আসে কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রুপিং ও প্রভাববলয় তৈরির অপকৌশল। নব্বইয়ের দশকের কয়েকজন প্রভাবশালী ছাত্রনেতা প্রতিবারই ভাগ-বাটোয়ারা করেছেন পদপদবি। সাংগঠনিক যোগ্যতার চেয়ে নিজেদের পছন্দ ও অনুসারীদের টেনে এনেছেন নেতৃত্বে। প্রতিবন্ধকতা তৈরি ও ল্যাং মেরে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন যোগ্যদের।
বিএনপিসহ প্রতিটি অঙ্গসংগঠনের কমিটি গঠনে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে সেটা হচ্ছে কোটা। দলীয় নেতৃত্ব ভাগ হয়েছে কোটাভিত্তিতে। কোটা প্রথায় বিএনপিতে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে বৃহত্তর নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, বরিশাল ও নরসিংদী। দলের ৬টি যুগ্ম মহাসচিব পদের ৩টিই দেয়া হয়েছে নোয়াখালী জেলা থেকে। অন্য জেলাগুলো থেকে কি যোগ্য নেতা ওঠে আসেননি? কয়েক বছর ধরে ছাত্রদলের শীর্ষ পদগুলো মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো ঘুরছে টাঙ্গাইল ও নরসিংদী জেলায়। দলটিতে বছরের পর বছর ‘লবিং’ ভিত্তিক নেতা সৃষ্টি হওয়ার কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছেন কর্মীবান্ধব নেতারা। অনেক ক্ষেত্রে পদবঞ্চিতরা আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা রাখতে গেলে পদপদবিধারীরা প্রশাসনকে ব্যবহার করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গ্রেপ্তার করিয়েছেন। বহু জেলায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের পদবঞ্চিতরা যেখানে মামলার ঘানি টানতে টানতে ন্যূব্জ হয়ে পড়েছেন, সেখানে পদপদবিধারীরা রয়েছেন নিরাপদ। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা এবং বছরের পর বছর আন্দোলন-সংগ্রামে থাকার পরও বহু জেলা-উপজেলার পদবিধারীদের নামে মামলা হয়নি। এমন নিরাপদ রাজনীতি করেছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি অংশও।
বিরোধী রাজনীতিতে এ দীর্ঘ সময়ে সাংগঠনিকভাবে অদ্ভুত সব সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গেছে দলটিকে। নানা বিতর্কের পরও ঢাকা মহানগর নেতৃত্ব দেয়া হয়েছে সমালোচিতদের হাতেই। সারা দেশে গড়ে ওঠা আন্দোলনের রেশ ঢাকা মহানগর নেতারা জোরালো করতে না পারলেও শাস্তি পেয়েছে তৃণমূল। কর্মসূচি শেষে ঢাকা মহানগর বিএনপি ঢেলে সাজানোর চেয়ে ভাঙা হয়েছে বিভিন্ন জেলা কমিটি। আবার মহানগরে নানা নাটকের পর ঘোষণা এসেছে আহ্বায়ক কমিটির। দীর্ঘ কয়েক বছর পেরিয়ে গেলেও তারা রাজধানীতে এক-দশমাংশ ওয়ার্ডেও কমিটি গঠন করতে পারেনি। এ ব্যর্থতার নেপথ্যে দেখা গেছে, শীর্ষ নেতৃত্বের নিস্পৃহ ভূমিকা ও সুবিধাবাদীদের অপতৎপরতা। জেলা কমিটি গঠনে দেখা গেছে, খালেদা জিয়ার অনুমোদন পাওয়া কমিটিকে চ্যালেঞ্জ করে গঠন করা হয়েছে পাল্টা কমিটি। অন্যদিকে জোটকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে দল দুর্বল করার বহু আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত দেখা গেছে বিএনপিতে। জোটের কারণে ক্ষমতায় থাকাকালে বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, গাইবান্ধাসহ বহু জেলায় সংগঠন গোছানোর কথা ভুলে থেকেছিল বিএনপি। যেখানে এখন সাংগঠনিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দলটি। যার পরিণতিতে জিয়াউর রহমানের জন্মভূমি বগুড়ায় স্থানীয় নির্বাচনগুলোয় অর্ধেকের বেশি প্রার্থিতা ছেড়ে দেয়া হয়েছে জামায়াতকে। স্থানীয় নির্বাচনে জোটের মনরক্ষা করতে গিয়ে কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতাকে বহিষ্কার করতেও দেখা গেছে।
দুই দফা আন্দোলনের সময় বেশিরভাগ মাঝারি সারি ও জেলা পর্যায়ের নেতারা কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে পারেননি। কিন্তু ‘নিরাপদে থাকা’ তৃণমূলের নেতারাই পেয়েছেন শীর্ষ নেতৃত্বের ফোন। অনেক ক্ষেত্রে খালেদা জিয়াকে ভুল বুঝিয়ে নির্বাচিত জেলা কমিটি ভেঙে গঠন করা হয়েছে পকেট কমিটি। এক্ষেত্রে গুলশান কার্যালয়ে দায়িত্বরত কর্মকর্তারাই শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে নির্ধারণ করেছেন মাঝারি সারি ও জেলা নেতাদের ভূমিকা। তৃণমূলে যারা নানামুখী বিপর্যয়ের শিকার হয়েছেন তাদের খোঁজ নেয়া হয়নি শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে। গুম-নিখোঁজ হওয়া নেতাকর্মীদের পরিবার পায়নি সান্ত্বনা। কারাবন্দি নেতাকর্মীরা পায়নি আইনি সহায়তা।
দলটির কেন্দ্রীয় ও চেয়ারপারসনের দুটি কার্যালয় থাকলেও নেতাকর্মীদের মামলা-হামলা, গ্রেপ্তার, গুমসহ সাংগঠনিক ও আইনগত তেমন কোন তথ্য মেলে না সেখানে। তাই বিএনপি এ পর্যন্ত তাদের অন্তরীণ বা নিখোঁজ থাকা নেতা-কর্মীদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে পারেনি। নেতারা সবসময় ‘হাজার হাজার বা লাখে লাখে গ্রেপ্তার’ শব্দ দিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন। কারণ রেকর্ড সংরক্ষণ ও তার হালনাগাদকরণ কঠিন কাজ। দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতার প্রধান দায়িত্ব হয়ে উঠেছে শুধুই ব্রিফিং। দলটির বিষয়ভিত্তিক শতাধিক সম্পাদক রয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের কোন তৎপরতা দেখা যায় না। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংবাদ সম্মেলনে প্রয়োজনীয় প্রাসঙ্গিক তথ্যও দিতে পারেননি বিএনপি চেয়ারপারসন।
গণমাধ্যমের ব্যাপারে আগাগোড়াই নিস্পৃহতা ও খামখেয়ালি দেখিয়েছে বিএনপি। সাড়ে নয়টার মধ্যেই জাতীয় দৈনিকগুলোর প্রথম সংস্কার প্রেসে যায়। কিন্তু বিএনপির বেশির ভাগ বৈঠক শেষ হয় এ সময়ের পর। এতে সারা দেশের মানুষ বিএনপির তথ্য বা সংবাদ থেকে বঞ্চিত হয়। একইভাবে টেলিভিশনগুলোতে সমস্যা হয়। এতে গণমাধ্যমকর্মীসহ সংশ্লিষ্টদের অনাকাঙ্ক্ষিত ভোগান্তি পোহাতে হয়। সেদিকে নজরই দেয়নি বিএনপি। দলের কোন তথ্য বা বক্তব্য সবাইকে জানানোর চেয়ে বিশেষ কয়েকটি মিডিয়াকে ডেকে কথা বলার একটি রেওয়াজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দলটিতে। অন্যদিকে সংবাদ সম্মেলনগুলোয় খালেদা জিয়াকে প্রশ্ন করার সুযোগ সীমিত করে দেয়া হয়। ২০১৪ সালে বর্তমান সরকার যেদিন শপথ গ্রহণ করে সেদিন কথা বলার জন্য বিএনপি বিটের সাংবাদিকদের ডেকেছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু বাসার সামনে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষায় রেখে তিনি শেষ পর্যন্ত সাক্ষাৎ দেননি। আবার সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিএনপি নেতারা ক্যামেরাপ্রিয় হয়ে পড়েছেন। নেতাদের এ ক্যামেরাপ্রীতি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে আন্দোলনে। হরতাল বা অন্যান্য কর্মসূচিতে রাজপথে নেতাদের উপস্থিতি চোখে না পড়লেও বিকালে কেতাদুরস্ত হয়ে তারা হাজির হন ব্রিফিংয়ে। বিএনপির সাংগঠনিক ও দাপ্তরিক কার্যক্রমে পদে পদে ফুটে ওঠে সমন্বয়হীনতা। সাংগঠনিক কোন বিষয়ে তথ্য বা মতামত জানতে চাইলে বেশির ভাগ সিনিয়র নেতাই দেখিয়ে দেন বিশেষ কয়েকজনকে। এমনও হয়েছে বারবার গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সিদ্ধান্ত হয়েছে কিন্তু তার ছিটেফোঁটাও জানতে পারেননি অনেক নীতিনির্ধারক।
দলটির সিনিয়র নেতারা ঘরোয়া আলাপে প্রায় বলেন, প্রেসিডেন্ট থাকাকালে জিয়াউর রহমানের গাড়ির দুপাশ খোলা থাকতো। দুদিক থেকে তাকে ফুল দিতো লোকজন। তিনি পাশে দাঁড়ানো লোকজনের সঙ্গে হাত মেলাতেন। কিন্তু নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ঘেরাটোপে বন্দি করা হয়েছে খালেদা জিয়াকে। নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে যোগাযোগ। চেয়ারপারসন কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ পেতে পার হতে হয় অন্তত ৫টি ধাপ। নানা সময়ে দেখা গেছে, দলের নীতিনির্ধারক ফোরামের সদস্য কিংবা সিনিয়র নেতাকে আটকে দেয়া হয়েছে স্রেফ হাত প্রসারিত করে। গুলশান কার্যালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের পছন্দ এবং মর্জিতেই নির্ধারণ হয় কারা খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ পাবেন। ফলে কোন কোন জেলার শীর্ষ নেতার প্রবেশাধিকার সীমিত থাকলেও সুবিধাবাদী ও একই জেলার থানা বা ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের রয়েছে অবাধ যাতায়াত। আবার যখন আনুষ্ঠানিকভাবে মতবিনিময়ের জন্য ডাকা হয়, তখনও কে কে কথা বলবেন আগেই তা নির্ধারণ করে সে প্রভাব বলয়। এর মাধ্যমে দলের দৈনন্দিন ও সার্বিক তথ্য থেকে দূরে রাখা হয় খালেদা জিয়াকে। গুলশান কার্যালয়ে কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতা, রহস্যজনক আচরণ এবং দৌরাত্ম্যই এখন স্বাভাবিকতার অংশ হয়ে উঠেছে। নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয় সুবিধাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে। জেলা ও থানা পর্যায়ের নেতাদের বহিষ্কার, বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার ও তদবিরের তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে কেন্দ্রীয় কার্যালয়। বিএনপি ক্ষমতার বাইরে রয়েছে প্রায় নয় বছর। একবার জাতীয় কাউন্সিল ছাড়া সংগঠন গোছানোর কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি। একবার সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু করলেও গতিহীন হয়ে পড়ে সে উদ্যোগ। অভিযানে কি পরিমাণ লোকজন বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন, তার কোন পরিসংখ্যান নেই দলটির দপ্তরে। দীর্ঘ সময়েও প্রতিষ্ঠিত হয়নি দলের একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক শাখা।
বিএনপিতে নেতাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের একটি আত্মঘাতী ধারা চালু রয়েছে প্রথম থেকেই। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর এ রেওয়াজ রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত হয়েছে দলটির। বিভিন্ন সময়ে কেবল অবিশ্বাসের শিকার হয়েই কপাল পুড়েছে অনেক রাজনীতিকের। বর্তমানে সেই অবিশ্বাসের ধারাটিই ব্যবহারের সুযোগ নিচ্ছে সরকার। দলের কেউ কাউকে বিশ্বাস করেন না। উল্টো পরস্পরকে ‘সরকারের দালাল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যস্ত থাকেন সময়ে সময়ে। ঘরোয়া আলাপে বেশির ভাগ নেতাই অন্য নেতাদের নিয়ে খোলাখুলি অভিযোগের তীর ছুড়েন। বিএনপিতে একটি প্রবাদ রয়েছে, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কাউকে একবার বিশ্বাস করলে দলে অটুট হয় তাঁর অবস্থান। কাউকে একবার অবিশ্বাস করলে তিনি হয়ে পড়েন কোনঠাসা। দলের স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান ও যুগ্ম মহাসচিব মিলিয়ে তার আস্থাচক্রে আছেন তেমন কিছু নেতা। তারা একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব সৃষ্টি, দলকে ভুল পথে পরিচালনা, দলের নীতি-আদর্শবিরোধী বক্তব্য প্রদান করলেও তাদের ব্যাপারে কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি। বরং তথাকথিত বিশ্বাসীদের প্রভাবকে প্রাধান্য দিয়েই তিনি দলের তৃণমূলের মতামত ও সিনিয়র নেতাদের পরামর্শকে গৌণ বিবেচনা করেছেন বারবার। বড় বড় পদে বসানো এবং নির্বাচন ও বিভিন্ন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে তাদের হাতেই দেয়া হয়েছে দায়িত্ব। পদপদবি বিক্রি ও অনুসারীদের সামনে নিয়ে আসার সুবর্ণ সুযোগ। বিএনপির রাজনীতি নিয়ে গবেষণার দরকার পড়ে না, একটু নজর দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একাংশ সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে চলেছেন, আরেক অংশ জেল-জুলুম-নির্যাতনে ধুঁকে মরছে। কারণ বিএনপি নজরদারি চালাতে পারেনি নেতৃত্বের গতিবিধিতে। দলের পদ ও দায়িত্ব নিয়ে বিরোধী দলে থাকা সত্ত্বেও কেউ কেউ বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন চুটিয়ে। রাজনীতির ইতিহাসে দেখা গেছে, কোন দলের প্রকৃত সংগঠকরা কোনঠাসা হলে সে দলের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
No comments