‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি কৌশল’ নয় কেন? by মইনুল ইসলাম
৪ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত
জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করার পর গত ২৪ দিনে পত্রপত্রিকায় বাজেটের ওপর নানা
ধরনের সমীক্ষা ও মূল্যায়ন উপস্থাপিত হয়ে চলেছে। বাজেটের সমালোচনার মূল
সুরটাই হলো এটা বাস্তবায়ন-অযোগ্য রকমের উচ্চাভিলাষী বাজেট, যার
রাজস্ব-টার্গেট এবং ঘাটতি-অর্থায়ন টার্গেট দুটোই অর্জনের যৌক্তিক ভিত্তি
নেই। এগুলো যেহেতু প্রাক্কলন, তাই বছরের শেষে শতভাগ ঘোষিত লক্ষ্য পূরণের
তেমন দায় থাকে না অর্থমন্ত্রীর কিংবা সরকারি রাজস্ব-আহরণকারী বিভাগগুলোর,
আর সেটারই সুযোগ নিয়ে বাজেট বক্তৃতায় অতি উচ্চাভিলাষী টার্গেট ঘোষণার
অভ্যাসটা ছাড়েন না আমাদের অর্থমন্ত্রীরা। আলোচনার খোরাক জোগায় এ ধরনের
বাগাড়ম্বরপূর্ণ বাজেট বক্তৃতা। এখনকার সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি
যেহেতু সরকারের অংশীদার, সেহেতু এবারের বাজেট অধিবেশন অতিশয় নিষ্প্রাণ
হচ্ছে। আজকের কলামে আমি বাজেটের ব্যয়-বরাদ্দ, ঘাটতি অর্থায়ন বা রাজস্বের
উৎসের খঁুটিনাটি নিয়ে আলোচনা করব না, বাজেটের মাধ্যমে প্রতিফলিত ক্ষমতাসীন
সরকারের অর্থনৈতিক দর্শনের মূল গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ উপস্থাপন করব।
বাংলাদেশ বেশ কয়েক বছর ধরে ৬ শতাংশের বেশি হারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শেষ বছর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ৮ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলা হলেও তা অর্জিত হয়নি, এমনকি ৭ শতাংশেও পৌঁছানো যায়নি। বিএনপি এটাকে সরকারের ব্যর্থতা বলে গলাবাজি করলেও এ জন্য তাদের কৃতিত্বটাও (?) কম নয়। ২০১৩ সালে ও ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাসে বিএনপি-জামায়াতের যে প্রাণঘাতী তাণ্ডব পুরো দেশকে একটি ভয়ংকর পরিস্থিতিতে নিক্ষেপ করেছিল, তার মূল শিকার ছিল সাধারণ জনমানুষের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি। সরকারকে তারা হটাতে ব্যর্থ হলেও অর্থনীতিতে গতিসঞ্চারের পথে ওই জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর ও অবরোধ-হরতালের অভূতপূর্ব সন্ত্রাসী তাণ্ডব নিঃসন্দেহে বড়সড় বাধা সৃষ্টি করেছে। এতত্সত্ত্বেও দেশে যে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, তাকে মোটেও খাটো করে দেখা যাবে না। তবে যে কথাটি জোর দিয়ে বলা প্রয়োজন তাহলো দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের তাণ্ডব যদি কমানো যেত তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমপক্ষে আরও ১ শতাংশ বেশি হতো। ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগটা অনায়াসে করা যায় তাহলো দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন কমানোর ব্যাপারে তাঁদের কোনো সদিচ্ছা কিংবা কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘তাঁকে কেনা যায় না।’ কিন্তু তাঁর দলের মন্ত্রী, সাংসদ, অন্যান্য নেতা-কর্মী বা তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত আমলা ও ঠিকাদার-ব্যবসায়ীদের দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের দায়ও তিনি এড়াতে পারেন না। অতএব, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে তাঁকেই।
কিন্তু আজকের কলামে আমি আলোকপাত করতে চাই দেশে আয়বৈষম্য নিরসনের বিষয়টা যথাযোগ্য গুরুত্বের সঙ্গে বাজেটে উপস্থাপিত না হওয়ার ওপর। বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উন্নয়ন-দর্শন ঘোষিত হয়েছিল ‘দরিদ্রবান্ধব প্রবৃদ্ধি কৌশল’ অবলম্বনে। ওই পরিকল্পনা প্রণয়নে দিকনির্দেশনা প্রদানের জন্য গঠিত ‘প্যানেল অব ইকোনমিস্টস’-এর অন্যতম সদস্য ছিলাম আমি। আমার অবস্থান ছিল, ওই কৌশল ফাঁকিবাজির নামান্তর, ওতে হবে না। সরাসরি বৈষম্য নিরসনকে উন্নয়নের দর্শন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, কারণ ১৯৭৫ সাল থেকে এ দেশের সরকারগুলো ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির’ ডামাডোলে শরিক হয়ে ব্যক্তি খাত ও বাজারীকরণকে আঁকড়ে ধরার ফলে এ দেশে আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য বেড়ে বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে গেছে। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা থাকার কথা নয় যে হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিসার সার্ভে বা খানা আয় ও ব্যয় জরিপ মোতাবেক এ দেশের আয়বৈষম্য পরিমাপক গিনি সহগ (কো–ইফিশিয়েন্ট) ২০০৫ সালে ০.৪৬৭ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল, এবং ২০১০ সালের একই জরিপে ওই সহগ ০.৪৬৫-এ রয়ে গেছে। তার মানে, ওই পাঁচ বছরে আয়বৈষম্য আর না বাড়লেও কমানো যায়নি। কোনো দেশের গিনি সহগ ০.৫ অতিক্রম করলে ওই দেশকে ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আমরা তার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।
১৯৭০ সালের পাকিস্তানে ২২টি কোটিপতি পরিবারের কথা বলা হতো, যারা রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তানের শিল্প-বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। ওই ২২ পরিবারের মধ্যে দুটো পরিবার ছিল পূর্ব পাকিস্তানের, তা-ও একটি অবাঙালি। এই বাংলাদেশেই ২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মোতাবেক ২৩,২১২ জন কোটিপতি ছিল। ২০১৪ সালে ওই সংখ্যা ৫০ হাজার অতিক্রম করেছে বলে দাবি করা হয়েছে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোটিপতির এ ধরনের নাটকীয় প্রবৃদ্ধির হারকে কৃতিত্বপূর্ণ সাফল্য মনে করতে পারে, কিন্তু এর মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল যে এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে গিয়ে পুঞ্জীভূত হয়ে যাওয়ার বিপৎসংকেত পাওয়া যাচ্ছে, সে ব্যাপারে ক্ষমতাসীন সরকারের কি কোনো করণীয় নেই?
জনগণের কাছে বোধগম্য যেসব বিষয় এই বিপদটার জানান দিচ্ছে সেগুলো হলো: ১. ব্যাংকের ঋণ সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশে কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে এবং ঋণখেলাপি বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে; ২. দেশের জায়গা-জমি, অ্যাপার্টমেন্ট, প্লট, ফ্ল্যাট, মানে রিয়াল এস্টেটের দাম প্রচণ্ডভাবে বেড়েছে; ৩. বিদেশে পঁুজি পাচার ব্যাপক হারে বাড়ছে; ৪. দেশে গাড়ি, বিশেষত বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে; ৫. বিদেশে বাড়িঘর কেনা ও ব্যবসা–বাণিজ্য করার হিড়িক পড়েছে; ৬. ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশ ভ্রমণ বাড়ছে; ৭. উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার খায়েশ বাড়ছে; ৮. উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঘন ঘন বিদেশে যাওয়ার অভ্যাস বাড়ছে; ৯. প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিলাসবহুল ক্লিনিক দ্রুত বাড়ছে; ১০. প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়েছে; এবং ১১. প্রধানত প্রাইভেট কারের কারণে সৃষ্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক জ্যাম নাগরিক জীবনকে বিপর্যস্ত করছে।
বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে একটি ‘গণপ্রজাতন্ত্র’, এবং ২০১০ সালের সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রসহ রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অতএব, ২০১০-১৫ মেয়াদের জন্য প্রণীত ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আমি বৈষম্য নিরসনকে উন্নয়ন কৌশলের প্রধান ফোকাস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানিয়েছিলাম আমি। ‘প্যানেল অব ইকোনমিস্ট’-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদসহ প্রায় সব সদস্য আমাকে সমর্থন দিলেন। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, প্যানেলের আর কোনো সভা না ডেকেই পরিকল্পনার খসড়া মন্ত্রিসভায় পেশ করে পাস করে ফেলা হলো। ওখানে ‘দরিদ্রবান্ধব প্রবৃদ্ধি’ কৌশল ঠিকই বহাল রয়ে গেল। (যেটা খুবই অবাক কাণ্ড তাহলো, পরিকল্পনা দলিলের একটা কপি পর্যন্ত আমাকে পৌঁছানোর সৌজন্যটুকুও দেখানো হলো না)। অবশ্য, এ দেশের নীতিপ্রণেতারা আদতে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় পরিকল্পনা অনুসরণের রেওয়াজ কখনো মেনে চলেন না।
কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় মাননীয় অর্থমন্ত্রী যখন দাবি করলেন যে বর্তমান সরকার আয়বৈষম্যকে আর বাড়তে দেয়নি তখন ইস্যুটাকে আবার ফোকাসে নিয়ে আসা সমীচীন মনে করেছি আমি: বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধিকেই এ দেশের উন্নয়নের মূল দর্শন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, এবং প্রতিটি উন্নয়ন পরিকল্পনায় এবং বাজেটে সুস্পষ্ট নীতি ও কর্ম-কৌশল ঘোষণা করতে হবে প্রতিবছর গিনি সহগকে কতখানি কমিয়ে আনা হবে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও চিলি এখন এ পথেই এগোচ্ছে। সাধারণ পাঠকেরা যেহেতু গিনি সহগের ব্যাপারটা ভালো বুঝবেন না, তাই তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, সরকারকে ওই সব দেশে আয় পুনর্বণ্টনের মূল এজেন্টের ভূমিকা পালনে এখন বাধ্য করা হচ্ছে। ২০১৪ সালে ব্রাজিল ফুটবল বিশ্বকাপ চলার সময় ব্রাজিলের বিভিন্ন বড় বড় শহরে লাখ লাখ মানুষের বিক্ষোভ মিছিল প্রশমিত করার জন্য সে দেশের সরকারকে ঘোষণা দিতে হয়েছিল, পেট্রোলিয়াম রপ্তানি থেকে অর্জিত সমুদয় আয় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা হবে। কারণ, বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য খাতের বাজারীকরণ হলো আয়বৈষম্য বৃদ্ধির সবচেয়ে ক্ষতিকর ব্যবস্থা। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের পর এই দুটো ব্যবস্থাকেই এগিয়ে নিয়ে গেছে সরকারগুলো। তৃতীয় ডাইমেনশনটি হলো ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং চতুর্থটি হলো সরকারি রাজস্ব ও ব্যয় ব্যবস্থা। এবারের বাজেটে শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয়কে জিডিপির ২ শতাংশেরও নিচে নামানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। স্বাস্থ্য খাতের সরকারি ব্যয়ও জিডিপির শতাংশ হিসাবে কমে যাবে। আর এ দেশের দারিদ্র্য সৃষ্টির সবচেয়ে বড় যে কারখানা সে কৃষি খাতেও সরকারি ব্যয় বরাদ্দ কমানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী ব্যস্ত মানুষ। জানি না, তাঁর সময় হয়েছে কি না, সম্প্রতি বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটির বেস্ট সেলার ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি–ফার্স্ট সেঞ্চুরি বইটি পড়ার। ওই বইয়ে যে হাইপোথিসিসটি বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তাহলো, রাষ্ট্র যদি অত্যন্ত কঠোরভাবে আয় ও সম্পদ পুনর্বণ্টনকারীর ভূমিকা পালন না করে তাহলে উন্নত-অনুন্নতনির্বিশেষে বিশ্বের সব দেশে আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য বাড়তে বাড়তে অতি দ্রুত বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে যাবে। সাইমন কুজনেৎস যে একপর্যায়ে উন্নত দেশগুলোতে বৈষম্য আর বাড়বে না বলে তত্ত্ব দিয়েছিলেন, সেটাকে পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে পিকেটির বইয়ে। তিনি মনে করেন, অত্যন্ত প্রগতিশীল আয়কর ব্যবস্থা, সম্পত্তি কর ব্যবস্থা এবং বিশ্বব্যাপী পুঁজির ওপর ‘গ্লোবাল ট্যাক্স’ বসানোর মাধ্যমে এই আসন্ন মহাবিপদকে ঠেকানোর প্রয়োজনকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। পিকেটি অবশ্য ইউরোপীয় কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোকে এ ব্যাপারে তাঁর আদর্শ মনে করেন। টমাস পিকেটি তাঁর বইয়ে কার্ল মার্ক্সের কঠোর সমালোচনা করেছেন, কিন্তু তৎসত্ত্বেও বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি কৌশল অবলম্বনের জন্য তাঁর আকুতি ফুটে উঠেছে বইয়ের উপসংহারে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে ‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি কৌশল’ কেন আমরা গ্রহণযোগ্য মনে করছি না, তার ব্যাখ্যা কী?
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ বেশ কয়েক বছর ধরে ৬ শতাংশের বেশি হারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শেষ বছর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ৮ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলা হলেও তা অর্জিত হয়নি, এমনকি ৭ শতাংশেও পৌঁছানো যায়নি। বিএনপি এটাকে সরকারের ব্যর্থতা বলে গলাবাজি করলেও এ জন্য তাদের কৃতিত্বটাও (?) কম নয়। ২০১৩ সালে ও ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাসে বিএনপি-জামায়াতের যে প্রাণঘাতী তাণ্ডব পুরো দেশকে একটি ভয়ংকর পরিস্থিতিতে নিক্ষেপ করেছিল, তার মূল শিকার ছিল সাধারণ জনমানুষের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি। সরকারকে তারা হটাতে ব্যর্থ হলেও অর্থনীতিতে গতিসঞ্চারের পথে ওই জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর ও অবরোধ-হরতালের অভূতপূর্ব সন্ত্রাসী তাণ্ডব নিঃসন্দেহে বড়সড় বাধা সৃষ্টি করেছে। এতত্সত্ত্বেও দেশে যে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, তাকে মোটেও খাটো করে দেখা যাবে না। তবে যে কথাটি জোর দিয়ে বলা প্রয়োজন তাহলো দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের তাণ্ডব যদি কমানো যেত তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমপক্ষে আরও ১ শতাংশ বেশি হতো। ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগটা অনায়াসে করা যায় তাহলো দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন কমানোর ব্যাপারে তাঁদের কোনো সদিচ্ছা কিংবা কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘তাঁকে কেনা যায় না।’ কিন্তু তাঁর দলের মন্ত্রী, সাংসদ, অন্যান্য নেতা-কর্মী বা তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত আমলা ও ঠিকাদার-ব্যবসায়ীদের দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের দায়ও তিনি এড়াতে পারেন না। অতএব, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে তাঁকেই।
কিন্তু আজকের কলামে আমি আলোকপাত করতে চাই দেশে আয়বৈষম্য নিরসনের বিষয়টা যথাযোগ্য গুরুত্বের সঙ্গে বাজেটে উপস্থাপিত না হওয়ার ওপর। বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উন্নয়ন-দর্শন ঘোষিত হয়েছিল ‘দরিদ্রবান্ধব প্রবৃদ্ধি কৌশল’ অবলম্বনে। ওই পরিকল্পনা প্রণয়নে দিকনির্দেশনা প্রদানের জন্য গঠিত ‘প্যানেল অব ইকোনমিস্টস’-এর অন্যতম সদস্য ছিলাম আমি। আমার অবস্থান ছিল, ওই কৌশল ফাঁকিবাজির নামান্তর, ওতে হবে না। সরাসরি বৈষম্য নিরসনকে উন্নয়নের দর্শন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, কারণ ১৯৭৫ সাল থেকে এ দেশের সরকারগুলো ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির’ ডামাডোলে শরিক হয়ে ব্যক্তি খাত ও বাজারীকরণকে আঁকড়ে ধরার ফলে এ দেশে আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য বেড়ে বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে গেছে। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা থাকার কথা নয় যে হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিসার সার্ভে বা খানা আয় ও ব্যয় জরিপ মোতাবেক এ দেশের আয়বৈষম্য পরিমাপক গিনি সহগ (কো–ইফিশিয়েন্ট) ২০০৫ সালে ০.৪৬৭ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল, এবং ২০১০ সালের একই জরিপে ওই সহগ ০.৪৬৫-এ রয়ে গেছে। তার মানে, ওই পাঁচ বছরে আয়বৈষম্য আর না বাড়লেও কমানো যায়নি। কোনো দেশের গিনি সহগ ০.৫ অতিক্রম করলে ওই দেশকে ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আমরা তার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।
১৯৭০ সালের পাকিস্তানে ২২টি কোটিপতি পরিবারের কথা বলা হতো, যারা রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তানের শিল্প-বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। ওই ২২ পরিবারের মধ্যে দুটো পরিবার ছিল পূর্ব পাকিস্তানের, তা-ও একটি অবাঙালি। এই বাংলাদেশেই ২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মোতাবেক ২৩,২১২ জন কোটিপতি ছিল। ২০১৪ সালে ওই সংখ্যা ৫০ হাজার অতিক্রম করেছে বলে দাবি করা হয়েছে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোটিপতির এ ধরনের নাটকীয় প্রবৃদ্ধির হারকে কৃতিত্বপূর্ণ সাফল্য মনে করতে পারে, কিন্তু এর মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল যে এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে গিয়ে পুঞ্জীভূত হয়ে যাওয়ার বিপৎসংকেত পাওয়া যাচ্ছে, সে ব্যাপারে ক্ষমতাসীন সরকারের কি কোনো করণীয় নেই?
জনগণের কাছে বোধগম্য যেসব বিষয় এই বিপদটার জানান দিচ্ছে সেগুলো হলো: ১. ব্যাংকের ঋণ সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশে কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে এবং ঋণখেলাপি বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে; ২. দেশের জায়গা-জমি, অ্যাপার্টমেন্ট, প্লট, ফ্ল্যাট, মানে রিয়াল এস্টেটের দাম প্রচণ্ডভাবে বেড়েছে; ৩. বিদেশে পঁুজি পাচার ব্যাপক হারে বাড়ছে; ৪. দেশে গাড়ি, বিশেষত বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে; ৫. বিদেশে বাড়িঘর কেনা ও ব্যবসা–বাণিজ্য করার হিড়িক পড়েছে; ৬. ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশ ভ্রমণ বাড়ছে; ৭. উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার খায়েশ বাড়ছে; ৮. উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঘন ঘন বিদেশে যাওয়ার অভ্যাস বাড়ছে; ৯. প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিলাসবহুল ক্লিনিক দ্রুত বাড়ছে; ১০. প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়েছে; এবং ১১. প্রধানত প্রাইভেট কারের কারণে সৃষ্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক জ্যাম নাগরিক জীবনকে বিপর্যস্ত করছে।
বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে একটি ‘গণপ্রজাতন্ত্র’, এবং ২০১০ সালের সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রসহ রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অতএব, ২০১০-১৫ মেয়াদের জন্য প্রণীত ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আমি বৈষম্য নিরসনকে উন্নয়ন কৌশলের প্রধান ফোকাস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানিয়েছিলাম আমি। ‘প্যানেল অব ইকোনমিস্ট’-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদসহ প্রায় সব সদস্য আমাকে সমর্থন দিলেন। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, প্যানেলের আর কোনো সভা না ডেকেই পরিকল্পনার খসড়া মন্ত্রিসভায় পেশ করে পাস করে ফেলা হলো। ওখানে ‘দরিদ্রবান্ধব প্রবৃদ্ধি’ কৌশল ঠিকই বহাল রয়ে গেল। (যেটা খুবই অবাক কাণ্ড তাহলো, পরিকল্পনা দলিলের একটা কপি পর্যন্ত আমাকে পৌঁছানোর সৌজন্যটুকুও দেখানো হলো না)। অবশ্য, এ দেশের নীতিপ্রণেতারা আদতে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় পরিকল্পনা অনুসরণের রেওয়াজ কখনো মেনে চলেন না।
কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় মাননীয় অর্থমন্ত্রী যখন দাবি করলেন যে বর্তমান সরকার আয়বৈষম্যকে আর বাড়তে দেয়নি তখন ইস্যুটাকে আবার ফোকাসে নিয়ে আসা সমীচীন মনে করেছি আমি: বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধিকেই এ দেশের উন্নয়নের মূল দর্শন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, এবং প্রতিটি উন্নয়ন পরিকল্পনায় এবং বাজেটে সুস্পষ্ট নীতি ও কর্ম-কৌশল ঘোষণা করতে হবে প্রতিবছর গিনি সহগকে কতখানি কমিয়ে আনা হবে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও চিলি এখন এ পথেই এগোচ্ছে। সাধারণ পাঠকেরা যেহেতু গিনি সহগের ব্যাপারটা ভালো বুঝবেন না, তাই তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, সরকারকে ওই সব দেশে আয় পুনর্বণ্টনের মূল এজেন্টের ভূমিকা পালনে এখন বাধ্য করা হচ্ছে। ২০১৪ সালে ব্রাজিল ফুটবল বিশ্বকাপ চলার সময় ব্রাজিলের বিভিন্ন বড় বড় শহরে লাখ লাখ মানুষের বিক্ষোভ মিছিল প্রশমিত করার জন্য সে দেশের সরকারকে ঘোষণা দিতে হয়েছিল, পেট্রোলিয়াম রপ্তানি থেকে অর্জিত সমুদয় আয় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা হবে। কারণ, বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য খাতের বাজারীকরণ হলো আয়বৈষম্য বৃদ্ধির সবচেয়ে ক্ষতিকর ব্যবস্থা। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের পর এই দুটো ব্যবস্থাকেই এগিয়ে নিয়ে গেছে সরকারগুলো। তৃতীয় ডাইমেনশনটি হলো ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং চতুর্থটি হলো সরকারি রাজস্ব ও ব্যয় ব্যবস্থা। এবারের বাজেটে শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয়কে জিডিপির ২ শতাংশেরও নিচে নামানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। স্বাস্থ্য খাতের সরকারি ব্যয়ও জিডিপির শতাংশ হিসাবে কমে যাবে। আর এ দেশের দারিদ্র্য সৃষ্টির সবচেয়ে বড় যে কারখানা সে কৃষি খাতেও সরকারি ব্যয় বরাদ্দ কমানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী ব্যস্ত মানুষ। জানি না, তাঁর সময় হয়েছে কি না, সম্প্রতি বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটির বেস্ট সেলার ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি–ফার্স্ট সেঞ্চুরি বইটি পড়ার। ওই বইয়ে যে হাইপোথিসিসটি বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তাহলো, রাষ্ট্র যদি অত্যন্ত কঠোরভাবে আয় ও সম্পদ পুনর্বণ্টনকারীর ভূমিকা পালন না করে তাহলে উন্নত-অনুন্নতনির্বিশেষে বিশ্বের সব দেশে আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য বাড়তে বাড়তে অতি দ্রুত বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে যাবে। সাইমন কুজনেৎস যে একপর্যায়ে উন্নত দেশগুলোতে বৈষম্য আর বাড়বে না বলে তত্ত্ব দিয়েছিলেন, সেটাকে পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে পিকেটির বইয়ে। তিনি মনে করেন, অত্যন্ত প্রগতিশীল আয়কর ব্যবস্থা, সম্পত্তি কর ব্যবস্থা এবং বিশ্বব্যাপী পুঁজির ওপর ‘গ্লোবাল ট্যাক্স’ বসানোর মাধ্যমে এই আসন্ন মহাবিপদকে ঠেকানোর প্রয়োজনকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। পিকেটি অবশ্য ইউরোপীয় কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোকে এ ব্যাপারে তাঁর আদর্শ মনে করেন। টমাস পিকেটি তাঁর বইয়ে কার্ল মার্ক্সের কঠোর সমালোচনা করেছেন, কিন্তু তৎসত্ত্বেও বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি কৌশল অবলম্বনের জন্য তাঁর আকুতি ফুটে উঠেছে বইয়ের উপসংহারে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে ‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি কৌশল’ কেন আমরা গ্রহণযোগ্য মনে করছি না, তার ব্যাখ্যা কী?
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments