বাঙালির পরাজয়ে বাঙালিই বিজয়ী by জুয়েল রাজ
লন্ডনের
টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিলের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে কেউ কেউ খুব আপসোস
করছেন। টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিলের নেতৃত্ব বাঙালির হাতছাড়া হওয়া নিয়ে।
আসলেই কি বাঙালির হাতছাড়া টাওয়ার হ্যামলেট?
টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিলের মেয়র নির্বাচনে পরাজিত হলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত স্বতন্ত্র প্রার্থী রাবিনা খান। বিজয়ী হলেন লেবার প্রার্থী জন বিগস। জয় পরাজয়ের মূল নিয়ামক ছিলেন বাঙালি ভোটার। ৩৩ শতাংশ বাঙালি অধ্যুষিত নির্বাচনী এলাকা টাওয়ার হ্যামলেট। নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৩৭ শতাংশের সামান্য কিছু বেশি। সেখানে বাঙালি প্রার্থীর ভরাডুবির কারণ থাকার কথা না। কিন্তু প্রত্যাশিত ভরাডুবি রোধ করা যায় নি।
নির্বাচনে যতোটা না হেরেছেন রাবিনা খান, তাঁর চেয়ে বেশি হেরেছেন সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমান। কম বেশি সবাই জানেন, রাবিনা খান স্বতন্ত্র হিসাবে নির্বাচন করলেও মূলত তিনি ছিলেন লুৎফুর রহমানের প্রার্থী। নির্বাচনের পিছনে কলকাঠি নেড়েছেন সাবেক মেয়র। একজন কাউন্সিলর হিসাবে যে ২৬ হাজার ভোট তিনি পেয়েছেন তা আসলে লুৎফুর রহমানের ভোট। আর এই ভোটারদের সিংহভাগ বাঙালি ও আফ্রিকান ভোটার যারা ভোট করেছেন ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে।
লুৎফুর রহমান ও তাঁর রাজনীতি ঘিরে বাঙালি কমিউনিটি স্পষ্টত দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। প্রগতিশীল ধারাটি যারা এক সময় তাঁকে সমর্থন দিয়েছিল, তারা দিনদিন লুৎফুর রহমানের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। আর এর কারণ হিসাবে সবাই তাঁর জামায়াত প্রীতিকেই দায়ী করেন।
ব্যাক্তি লুৎফুরের কাছে হয়তো এর বিকল্পও ছিল না। বাঙালিদের লেবার প্রীতির বাইরে এসে স্বতন্ত্রপ্রার্থী রাজনীতির ফলাফল কি হতো সেটা অনুমেয়। তাই নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থেই হয়তো তিনি জোট বেঁধেছিলেন। কিন্তু অভিমূন্য চক্র ভেদ করে আর বের হয়ে আসতে পারেন নি তিনি। এটা একান্তই আমার ব্যাক্তিগত ধারণা।
সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো আদালতের রায়ে ভোট জালিয়াতি ও দূর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার পরেও ব্যাক্তি লুৎফুর রহমানকে অনেকেই ভালমানুষ হিসাবেই চিহ্নিত করেন। বাঙালিদের মনে আলাদা একটা জায়গা তৈরি হয়ে গেছে তাঁর জন্য। তাঁদের মতে ব্যাক্তি লুৎফুর রহমান অপরাধী নয়, যতোটা না অপরাধী মেয়র লুৎফুর রহমান। আর তাঁর অপরাধের জন্য সবাই দায়ী করেন তাঁর চারপাশে যারা ঘিরে ছিলেন সেই সব মানুষদের। যারা নিজেদের স্বার্থে ধর্মের লেবাসে আটকে রেখেছিলেন মেয়র লুৎফুর রহমানকে।
আড়ালে আবডালে টাওয়ার হ্যামলেটকে ইসলামী রিপাবলিক অব টাওয়ার হ্যামলেট বলে ডাকতেন। ভিন্ন সংস্কৃতির আধুনিক ব্রিটেনে অতিধর্মীয়তা অনেকে সহজ ভাবে নিতে পারেননি। পাশাপাশি ইসলামী সংগঠন ও এর নেতৃবৃন্দ কাউন্সিল থেকে বিশেষ সুবিধা আদায় করারও অভিযোগ ছিল।
মুসলমান আর বাঙালি মুসলমানের মধ্যে কিছু পার্থক্য বিদ্যমান। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা তাঁর মজ্জাগত। জোর করে বাঙালিত্ব বাদ দিয়ে শুধু মুসলামান বানানো সত্যিই কঠিন। আর যারা বাঙালিত্ব বাদ দিয়ে শুধু মুসলমান বানাতে চাইছেন, তারাই ঘিরে রেখেছিল চারপাশ। লুৎফুর রহমানের কাঁধে বন্দুক রেখে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন সবাই। সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতের সাথে তাঁর সখ্যতা।
তাই নির্বাচনে বাঙালির কাছেই হেরে গেছেন লুৎফুর রহমান। বাঙালি ভোটাররা চেয়েছেন মেয়রের অভিযোগের অপবাদ থেকে মুক্তি। তাই বাঙালি প্রার্থী রাবিনা খানের পরিবর্তে বেছে নিয়েছেন নন বাঙালি জন বিগসকে। সংসদ নির্বাচনে লেবারের জয়জয়কার পূর্ব লন্ডনে দীর্ঘ দিনের। বিপুল ভোটে দুই দুইবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন বাঙালি প্রার্থী রুশনারা আলী ও লাইম হাউজ পপলার আসনে জেমস ফিজফেট্রিক ৫ বার লেবার থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু মেয়র নির্বাচনে বাঙ্গালিয়ানার কাছে হেরে গিয়েছিল লেবার। যদিও প্রথমবার হেরেছিল ব্যাক্তি লুৎফুর রহমানের কাছে। রাবিনা খান বিজয়ী হলে লুৎফুর রহমানের চক্রভেদ করা খুব কঠিন ছিল। টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিল সেই তিমিরেই থাকত। তাই টাওয়ার হ্যামলেট নির্বাচনে জন বিগসের বিজয় জরুরি ছিল।
ব্যাক্তি লুৎফুর রহমানের জন্য অন্য অনেকের মতোই আমারও ব্যাক্তিগত আপসোস আছে। অপার সম্ভাবনার মৃত্যুর জন্য। যার ব্যাক্তি ক্যারিশমা কমিউনিটির অর্জনের পাল্লাকে আরো ভারী করতে পারতো। অঙ্কুরেই যা বিনিষ্ট হল।
জন বিগসের বিজয়ও বাঙালির জরুরি ছিল। বাঙালি তিন লেবার দলীয় এমপি যেভাবে জন বিগসের জন্য নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছিলেন তাঁদের আত্মসম্মান রক্ষার্থে ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই মোটা দাগে বলা যায় এবারের টাওয়ার হ্যামলেট নির্বাচন বাঙালির সঙ্গে বাঙালির প্রতিযোগিতা ছিল। বাঙালির কাছেই হেরেছে বাঙালি, আবার বাঙালির কাছেই বিজয়ী হয়েছে বাঙালি। জন বিগস, রাবিনা সেখানে উপলক্ষ্য মাত্র। এবার অপেক্ষার পালা। জন বিগস টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিলের বাঙালিকে কী উপহার দেন।
(লেখকঃ ব্রিকলেনের বার্তা সম্পাদক ও দৈনিক মানবকণ্ঠের যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি)
টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিলের মেয়র নির্বাচনে পরাজিত হলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত স্বতন্ত্র প্রার্থী রাবিনা খান। বিজয়ী হলেন লেবার প্রার্থী জন বিগস। জয় পরাজয়ের মূল নিয়ামক ছিলেন বাঙালি ভোটার। ৩৩ শতাংশ বাঙালি অধ্যুষিত নির্বাচনী এলাকা টাওয়ার হ্যামলেট। নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৩৭ শতাংশের সামান্য কিছু বেশি। সেখানে বাঙালি প্রার্থীর ভরাডুবির কারণ থাকার কথা না। কিন্তু প্রত্যাশিত ভরাডুবি রোধ করা যায় নি।
নির্বাচনে যতোটা না হেরেছেন রাবিনা খান, তাঁর চেয়ে বেশি হেরেছেন সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমান। কম বেশি সবাই জানেন, রাবিনা খান স্বতন্ত্র হিসাবে নির্বাচন করলেও মূলত তিনি ছিলেন লুৎফুর রহমানের প্রার্থী। নির্বাচনের পিছনে কলকাঠি নেড়েছেন সাবেক মেয়র। একজন কাউন্সিলর হিসাবে যে ২৬ হাজার ভোট তিনি পেয়েছেন তা আসলে লুৎফুর রহমানের ভোট। আর এই ভোটারদের সিংহভাগ বাঙালি ও আফ্রিকান ভোটার যারা ভোট করেছেন ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে।
লুৎফুর রহমান ও তাঁর রাজনীতি ঘিরে বাঙালি কমিউনিটি স্পষ্টত দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। প্রগতিশীল ধারাটি যারা এক সময় তাঁকে সমর্থন দিয়েছিল, তারা দিনদিন লুৎফুর রহমানের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। আর এর কারণ হিসাবে সবাই তাঁর জামায়াত প্রীতিকেই দায়ী করেন।
ব্যাক্তি লুৎফুরের কাছে হয়তো এর বিকল্পও ছিল না। বাঙালিদের লেবার প্রীতির বাইরে এসে স্বতন্ত্রপ্রার্থী রাজনীতির ফলাফল কি হতো সেটা অনুমেয়। তাই নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থেই হয়তো তিনি জোট বেঁধেছিলেন। কিন্তু অভিমূন্য চক্র ভেদ করে আর বের হয়ে আসতে পারেন নি তিনি। এটা একান্তই আমার ব্যাক্তিগত ধারণা।
সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো আদালতের রায়ে ভোট জালিয়াতি ও দূর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার পরেও ব্যাক্তি লুৎফুর রহমানকে অনেকেই ভালমানুষ হিসাবেই চিহ্নিত করেন। বাঙালিদের মনে আলাদা একটা জায়গা তৈরি হয়ে গেছে তাঁর জন্য। তাঁদের মতে ব্যাক্তি লুৎফুর রহমান অপরাধী নয়, যতোটা না অপরাধী মেয়র লুৎফুর রহমান। আর তাঁর অপরাধের জন্য সবাই দায়ী করেন তাঁর চারপাশে যারা ঘিরে ছিলেন সেই সব মানুষদের। যারা নিজেদের স্বার্থে ধর্মের লেবাসে আটকে রেখেছিলেন মেয়র লুৎফুর রহমানকে।
আড়ালে আবডালে টাওয়ার হ্যামলেটকে ইসলামী রিপাবলিক অব টাওয়ার হ্যামলেট বলে ডাকতেন। ভিন্ন সংস্কৃতির আধুনিক ব্রিটেনে অতিধর্মীয়তা অনেকে সহজ ভাবে নিতে পারেননি। পাশাপাশি ইসলামী সংগঠন ও এর নেতৃবৃন্দ কাউন্সিল থেকে বিশেষ সুবিধা আদায় করারও অভিযোগ ছিল।
মুসলমান আর বাঙালি মুসলমানের মধ্যে কিছু পার্থক্য বিদ্যমান। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা তাঁর মজ্জাগত। জোর করে বাঙালিত্ব বাদ দিয়ে শুধু মুসলামান বানানো সত্যিই কঠিন। আর যারা বাঙালিত্ব বাদ দিয়ে শুধু মুসলমান বানাতে চাইছেন, তারাই ঘিরে রেখেছিল চারপাশ। লুৎফুর রহমানের কাঁধে বন্দুক রেখে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন সবাই। সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতের সাথে তাঁর সখ্যতা।
তাই নির্বাচনে বাঙালির কাছেই হেরে গেছেন লুৎফুর রহমান। বাঙালি ভোটাররা চেয়েছেন মেয়রের অভিযোগের অপবাদ থেকে মুক্তি। তাই বাঙালি প্রার্থী রাবিনা খানের পরিবর্তে বেছে নিয়েছেন নন বাঙালি জন বিগসকে। সংসদ নির্বাচনে লেবারের জয়জয়কার পূর্ব লন্ডনে দীর্ঘ দিনের। বিপুল ভোটে দুই দুইবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন বাঙালি প্রার্থী রুশনারা আলী ও লাইম হাউজ পপলার আসনে জেমস ফিজফেট্রিক ৫ বার লেবার থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু মেয়র নির্বাচনে বাঙ্গালিয়ানার কাছে হেরে গিয়েছিল লেবার। যদিও প্রথমবার হেরেছিল ব্যাক্তি লুৎফুর রহমানের কাছে। রাবিনা খান বিজয়ী হলে লুৎফুর রহমানের চক্রভেদ করা খুব কঠিন ছিল। টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিল সেই তিমিরেই থাকত। তাই টাওয়ার হ্যামলেট নির্বাচনে জন বিগসের বিজয় জরুরি ছিল।
ব্যাক্তি লুৎফুর রহমানের জন্য অন্য অনেকের মতোই আমারও ব্যাক্তিগত আপসোস আছে। অপার সম্ভাবনার মৃত্যুর জন্য। যার ব্যাক্তি ক্যারিশমা কমিউনিটির অর্জনের পাল্লাকে আরো ভারী করতে পারতো। অঙ্কুরেই যা বিনিষ্ট হল।
জন বিগসের বিজয়ও বাঙালির জরুরি ছিল। বাঙালি তিন লেবার দলীয় এমপি যেভাবে জন বিগসের জন্য নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছিলেন তাঁদের আত্মসম্মান রক্ষার্থে ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই মোটা দাগে বলা যায় এবারের টাওয়ার হ্যামলেট নির্বাচন বাঙালির সঙ্গে বাঙালির প্রতিযোগিতা ছিল। বাঙালির কাছেই হেরেছে বাঙালি, আবার বাঙালির কাছেই বিজয়ী হয়েছে বাঙালি। জন বিগস, রাবিনা সেখানে উপলক্ষ্য মাত্র। এবার অপেক্ষার পালা। জন বিগস টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিলের বাঙালিকে কী উপহার দেন।
(লেখকঃ ব্রিকলেনের বার্তা সম্পাদক ও দৈনিক মানবকণ্ঠের যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি)
No comments