থ্রিপিসের কাছে তাঁতশাড়ি পরাজিত
বাংলার
ঐতিহ্য বাঙালি রমণীদের দীর্ঘকালের অহংকার মনোমুগ্ধকর তাঁতের কাপড় এবার
ঢাকার তৈরি থ্রিপিসের কাছে হেরে গেল। উত্তরবঙ্গ তথা বাংলাদেশের একমাত্র
তাঁত কাপড় এলাকা বলে খ্যাত সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর। সপ্তাহে শাহজাদপুরে
চারদিন তাঁত কাপড়ের হাট বসে। এখানকার মানুষের একমাত্র উপার্জনের মাধ্যম এ
তাঁত কাপড় বুনন। কয়েক যুগ পর এবারই প্রথম পবিত্র ঈদ সামনে রেখে তাঁতের
শাড়ির ব্যবসা একেবারেই মন্দা। গত রোববার সরেজমিন শাহজাদপুর হাট ঘুরে দেখা
গেছে, চারপাশে তাঁতের শাড়ি থাকলেও ভিড় থ্রিপিসের দোকানে। হাটের কাপড়
ব্যবসায়ী মিলন খান, আব্দুল মজিদ, শাহাদাত হোসেনসহ শত শত তাঁত ব্যবসায়ীর
এবার একটাই কথা, ব্যবসায় চরম লোকসান হচ্ছে। থ্রিপিসের কাছে তাঁতশাড়ি হেরে
যাচ্ছে। শাহজাদপুরের তাঁত ব্যবসায়ী আলহাজ মামুন আনসারী, বিদ্যুৎ আলমাজী,
রওশন আলী, হযরত আলী, রজব আলী, জালাল উদ্দিন, আলহাজ বুুলবুল আলী জানান,
অন্যান্য বছরে ঈদের বাজারে কোটি কোটি টাকার শাড়ি বিক্রি হতো। এবার তার
উল্টো। বিশেষ করে শাড়ির জায়গা দখল করেছে ঢাকার তৈরি বিভিন্ন ডিজাইনের
থ্রিপিস। তাঁতীদের দুঃখ-দুর্দশার কারণ বিদেশি ক্রেতার অভাব, পুঁজির অভাব,
ঋণের অভাব, উচ্চ সুদ, পর্যাপ্ত শ্রমিকের অভাব, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির
মহিলাদের থ্রিপিসের দিকে ঝুঁকে পড়া। এছাড়া ধানের দাম কম, হরতাল-অবরোধসহ
নানা কারণে শাহজাদপুরে কাপড় বিক্রি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। বাঙালির ঐতিহ্য
বাহারি শাড়ির মধ্যে জামদানি, সুতি কাতান, সুতি জামদানি, সিল্ক শাড়ি, সেট,
বেনারশী, শেড শাড়ি, চোষা শাড়ি, সিল্ক চোষা, হাফসিসহ অসম্ভব সুন্দর শাড়ি
হাটে থাকলেও তা বিক্রি হচ্ছে না। এবার বেশি বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে ঢাকার
তৈরি থ্রিপিস কিরণমালা, ঝিলিক, টপটেন, ঝিনুক, চোরাবালি, স্টার জলসা,
কারিনা। দ্বিগুণ মূল্যে বিক্রি হলেও মহিলারা শাড়ি বাদ দিয়ে এবার থ্রিপিসের
দিকেই ঝুঁকে পড়েছেন। থ্রিপিস ব্যবসায়ী জয়দেব ঘোষ, আলহাজ আনোয়ার হোসেন,
পল্লব বসাক, প্রদীপ সাহা জানান, অন্যবারের তুলনায় এবারের ঈদে খুচরা ও
পাইকারি কয়েকগুণ বেশি থ্রিপিস বিক্রি হয়েছে। তারা খাবার সময় পর্যন্ত পাননি।
শাহজাদপুর উপজেলা তাঁত মালিক সমিতির সভাপতি আলমাছ আনছারী, সাধারণ সম্পাদক
হায়দার আলী জানান, সপ্তাহে শাহজাদপুর হাটে সারাদেশ থেকে লক্ষাধিক লোক আসেন।
এখানে প্রায় দুইশ পঞ্চাশটি আড়ৎ রয়েছে। এছাড়া শাহজাদপুরে দুই লক্ষ
হ্যান্ডলুম তাঁত রয়েছে। পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় দুই লক্ষ হ্যান্ডলুম,
পাওয়ার লুম রয়েছে এক লক্ষ দশ হাজার। এবার প্রত্যেক তাঁতীর অবস্থা খুবই
শোচনীয়। তারা জানান, এখান যদি তাঁতের শাড়ি ভারতে না যেত তাহলে তাঁত প্রায়
বন্ধই হয়ে যেত। এরই মধ্যে অনেকেই তাঁত বন্ধ করেও দিয়েছেন। ভারতে বাংলার
শাড়ি বিশাল বাজার আছে। তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তাঁতশাড়ি
স্বল্পমূল্যে ভারতে এলসির মাধ্যমে প্রেরণ করার। এখন ভারতই আমাদের অন্যতম
ভরসা। কারণ, ভারতের মহিলার বেশির ভাগই শাড়ি পরেন। এ কারণে সেখানে শাড়ির
চাহিদা ব্যাপক। তিনি আরও জানান, প্রতি সপ্তাহে ভারতের ত্রিশ থেকে চল্লিশজন
পাইকার দুই থেকে তিন কোটি টাকার শাড়ি সে দেশে নিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে
তাঁতীদের এবার ব্যবসা মন্দা থাকায় তারা বিশাল লোকসানের হিসাব কষছে। অন্য
বছর শাড়ির চাহিদা থাকলেও এবার ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। তাই বাঙালি রমণীদের
শাড়ির বদলে এবার থ্রিপিস জায়গা দখল করে নিয়েছে। এ কারণে সিরাজগঞ্জ ও পাবনা
জেলার তাঁতীরা খুবই হতাশায় দিন গুনছেন।
No comments