গুঞ্জনই সত্য হলো
সৈয়দ আশরাফ দপ্তরবিহীন মন্ত্রী, স্থানীয় সরকারের দায়িত্বে খন্দকার মোশাররফ
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গত মঙ্গলবার তাঁর
অব্যাহতি পাওয়ার গুঞ্জনকে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এর প্রায় ৪৮ ঘণ্টার
ব্যবধানে গতকাল বৃহস্পতিবার তাঁকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়
মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো।
ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন, যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয় এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। এখন পুরোনো মন্ত্রণালয়টি থাকছে তাঁর অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে।
সৈয়দ আশরাফকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করায় দলের মধ্যে যাঁরা খুশি, তাঁদের অনেকেই আবার নাখোশ ওই মন্ত্রণালয়ে তুলনামূলক কম রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়ায়। নব্বই-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দলের সাধারণ সম্পাদকই আর্থিক বা দলীয় বিবেচনায় এই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন।
এদিকে মন্ত্রিসভা থেকে আরও অন্তত তিনজন বিতর্কিত মন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে গুঞ্জন রয়েছে। শিগগিরই এই রদবদল হতে পারে বলে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে আভাস পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন কোনো তথ্য আমার জানা নেই।’
গত মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুপস্থিত থাকায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার আভাস দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এ নিয়ে ওই দিন ব্যাপক আলোচনা হলেও সন্ধ্যার দিকে সৈয়দ আশরাফ বিষয়টিকে গুজব বলে এতে কান না দেওয়ার পরামর্শ দেন।
গতকাল দুপুরে সৈয়দ আশরাফকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কার্যালয়ে ডেকে পাঠান। তাঁরা প্রায় এক ঘণ্টা একান্তে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, এ সময় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রস্তাব তিনি মেনে নেন। দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে তিনি থাকছেন। দলের ত্রিবার্ষিক কাউন্সিল হওয়ার আগ পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বেও তিনি থাকবেন। আগামী ডিসেম্বরে ওই কাউন্সিল হওয়ার কথা।
গতকাল দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হওয়ার পরও সৈয়দ আশরাফ স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখেন। বিকেলে তিনি বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর দলীয় কার্যালয়ে যুবলীগের ইফতার অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এ সময় সাংবাদিকেরা অনেক চেষ্টা করলেও তিনি এ বিষয়ে কিছু বলেননি।
মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির বিষয়ে জানতে চাইলে একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, এটা তাঁর প্রাপ্য ছিল। তাঁর নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে অনেক দিন ধরেই দল ও সরকারে আলোচনা-সমালোচনা ছিল।
সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, মঙ্গলবার একনেকের সভায় অনুপস্থিত থাকায় সৈয়দ আশরাফকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, বিষয়টি এমন নয়। বেশ কিছুদিন ধরেই প্রধানমন্ত্রী তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। মন্ত্রণালয়ে না যাওয়া, সরকার ও দলের অনুষ্ঠানে মাঝেমধ্যে যোগ দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে সরকার ও দলের ভেতর সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তিনি। এ ছাড়া সরকার ও দলের নিচু থেকে উঁচু স্তরের নেতাদের অনেকেই তাঁর সমালোচনা করতেন।
আপাতদৃষ্টিতে তাঁর বিরুদ্ধে প্রচলিত অভিযোগ ছিল, তিনি মন্ত্রণালয়ে যান না। কিন্তু ওই মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ সময়মতো হয়নি কিংবা কাজে দুর্নীতি বা অনিয়ম হয়েছে—এমন ব্যক্তিগত অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে শোনা যায়নি। তবে দল থেকে নেওয়া তাঁর একজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও আর্থিক অনিয়ম-সংক্রান্ত বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে।
দলীয় কর্মকাণ্ডে নিয়মিত অংশ না নেওয়া এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সারা দেশে দলের নেতাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ, পরামর্শ ও দল পরিচালনায় তাঁর একধরনের অনাগ্রহ থাকার অভিযোগ নতুন নয়। এই অভিযোগের ভিত্তি থাকলেও দলের পদ থেকে তাঁকে সরানো হয়নি।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, সরকার যে প্রক্রিয়ায় বা পদ্ধতিতে চলে, তার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে তাঁর ভিন্নমত ছিল। সর্বশেষ একনেক সভায় তাঁর মন্ত্রণালয়ের ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকার যে বিশাল প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়, ওই প্রকল্প নেওয়ার বিষয়েও তাঁর সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি।
বিভিন্ন সময়ে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, ঢাকা ওয়াসাসহ বিভিন্ন সংস্থায় শীর্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ, ওই সব পদে চাকরির মেয়াদ বাড়ানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। এর অনেকগুলোই হয়েছে তাঁর অমতে। ঢাকার দুটি এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২৮ এপ্রিলের নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে সরকারের নির্দেশনাও গিয়েছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে। এটি পদ্ধতিগতভাবে সঠিক না হওয়ায় আগের প্রস্তাব ফেরত এনে নতুন করে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়। এ রকম আরও কিছু পদ্ধতিগত ও প্রক্রিয়াগত বিষয়ে সরকারের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব সৃষ্টি হয়। জেলা পরিষদে সরকারের মনোনীত প্রশাসক দেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন তিনি। তাঁর মত ছিল, জেলা পরিষদে নির্বাচন করা অথবা কিছুই না করা। এ ছাড়া গত আড়াই বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ১৪ জন প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে তাঁর মত নেওয়া হয়নি।
সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প’ নিয়ে বেপরোয়া অনিয়ম ও দুর্নীতি হলেও এর প্রকল্প পরিচালক প্রশান্ত কুমার কর্মকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেননি তিনি। প্রকল্প পরিচালক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে মন্ত্রী হিসেবে তাঁকে পাশ কাটিয়ে যান। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রশান্ত কুমারের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পরও বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। একপর্যায়ে মন্ত্রী হিসেবে ওই প্রকল্পের যেসব নথিতে তাঁর সইয়ের দরকার ছিল, তা দেওয়া থেকে বিরত থাকেন সৈয়দ আশরাফ। তিনি আগে দুর্নীতির তদন্ত করা এবং প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ার কারণ তদন্ত করতে বলেন, এরপর সই দেবেন বলেও জানান। কিন্তু পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ধীরগতিতে এগোয়।
এর আগে নবম সংসদের মেয়াদকালে যখন প্রথম সাংসদদের হাতে সরাসরি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব ওঠে, তখন তিনি এর বিরোধিতা করেন। তিনি বলেছিলেন, এই টাকা সাংসদদের হাতে সরাসরি দেওয়া হলে তা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠবে। এর পরিবর্তে তিনি সাংসদদের দেওয়া প্রকল্পের বিপরীতে টাকা বরাদ্দের পক্ষে অবস্থান নেন। ওই সংসদে বিএনপির সাংসদেরাও ছিলেন। কিন্তু সরকারের প্রস্তাব ছিল, শুধু সরকারদলীয় সাংসদদের ওই অর্থ দেওয়া। তিনি এরও বিরোধিতা করে সব সাংসদের জন্য বরাদ্দের পক্ষে অবস্থান নেন। এসব ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থানই কার্যকর হয়। তবে এ নিয়ে সরকারের ভেতরে তাঁর সম্পর্কে একধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী বলেন, মন্ত্রণালয় ও দলে সৈয়দ আশরাফের নিষ্ক্রিয়তা প্রধানমন্ত্রী এক প্রকার মেনেই নিয়েছিলেন। নইলে গত প্রায় সাড়ে ছয় বছর কীভাবে থাকলেন। তবে মন্ত্রণালয়ের আরেকটি সূত্র জানায়, গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সৈয়দ আশরাফের অবস্থান মন্ত্রণালয়ে দুর্বল হতে থাকে। এর আগের মেয়াদে স্থানীয় সরকারে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে জাহাঙ্গীর কবির নানক দায়িত্ব পালন করায় এবং তিনি দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় খুব একটা সমস্যা হয়নি। প্রতিমন্ত্রীই তখন মন্ত্রণালয় চালিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু ভিন্ন দলের একজন নেতাকে প্রতিমন্ত্রী করায় এবং সৈয়দ আশরাফ নিষ্ক্রিয় থাকায় মন্ত্রণালয়ে আমলাতন্ত্রের খবরদারি বেড়ে যায় এবং সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে এই মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া শুরু হয়।
সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে চলমান মতবিরোধ উসকানি পায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের একটি বক্তব্যে। একনেক সভায় তিনি বলেন, ছয় হাজার কোটি টাকার এত বড় প্রকল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দুজন মন্ত্রী রয়েছেন, একজনও আসেননি। তাই এ প্রকল্প একনেক সভা থেকে প্রত্যাহার করা হোক। তাঁদের মতামত নিয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন করা দরকার।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা বলেন, প্রকল্পটা প্রত্যাহার করবেন না। উনি যখন আসেন না, উনাকে সরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু ওই দিন পরিবর্তন না করলেও দুই দিন পর তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা: ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, নতুন দায়িত্ব পেয়ে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘আমার প্রথম ও প্রধান কাজ হবে প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারী কর্মসূচি “একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প” বাস্তবায়নের মাধ্যমে পল্লি উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা।’ গতকাল বিকেলে ফরিদপুর শহরতলির বদরপুর এলাকার নিজ বাড়িতে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়ায় মন্ত্রী এ কথা বলেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তাঁর বেয়াই খন্দকার মোশাররফ। বলেন, এ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রামের উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। এই কাজ করার সুবাদে গ্রামীণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নত জনপদ গড়ে তোলা হবে।
ক্ষুব্ধ কিশোরগঞ্জবাসী: নিজস্ব প্রতিবেদক, ভৈরব জানান, সৈয়দ আশরাফকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়ায় এলাকার লোকজন বেজায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন। চা দোকানি নাসির মিয়া বলেন, ‘হুনুইন, ভালা মানুষের ভাত নাই।’ শহরের নগুয়া মহল্লার অটোরিকশা গ্যারেজের মালিক তামিম মিয়ার মন্তব্য, ‘শুধু কি ভাত নাই, দামও নাই। তা না হইলে কি আর সৈয়দ আশরাফের মতো সৎ ও বিনয়ী এক নেতাকে মন্ত্রিত্ব হারাতে হয়?’
এর ফলে কিশোরগঞ্জের চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা অনেকের। তাঁর অব্যাহতির খবরে ভেঙে পড়েন দলীয় নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে তাঁর এলাকার সাধারণ মানুষও।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ আফজাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর তো হাত নেই। তবে আমাদের নেতা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নেই, ভাবতে খারাপ লাগছে।’
ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন, যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয় এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। এখন পুরোনো মন্ত্রণালয়টি থাকছে তাঁর অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে।
সৈয়দ আশরাফকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করায় দলের মধ্যে যাঁরা খুশি, তাঁদের অনেকেই আবার নাখোশ ওই মন্ত্রণালয়ে তুলনামূলক কম রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়ায়। নব্বই-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দলের সাধারণ সম্পাদকই আর্থিক বা দলীয় বিবেচনায় এই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন।
এদিকে মন্ত্রিসভা থেকে আরও অন্তত তিনজন বিতর্কিত মন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে গুঞ্জন রয়েছে। শিগগিরই এই রদবদল হতে পারে বলে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে আভাস পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন কোনো তথ্য আমার জানা নেই।’
গত মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুপস্থিত থাকায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার আভাস দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এ নিয়ে ওই দিন ব্যাপক আলোচনা হলেও সন্ধ্যার দিকে সৈয়দ আশরাফ বিষয়টিকে গুজব বলে এতে কান না দেওয়ার পরামর্শ দেন।
গতকাল দুপুরে সৈয়দ আশরাফকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কার্যালয়ে ডেকে পাঠান। তাঁরা প্রায় এক ঘণ্টা একান্তে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, এ সময় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রস্তাব তিনি মেনে নেন। দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে তিনি থাকছেন। দলের ত্রিবার্ষিক কাউন্সিল হওয়ার আগ পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বেও তিনি থাকবেন। আগামী ডিসেম্বরে ওই কাউন্সিল হওয়ার কথা।
গতকাল দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হওয়ার পরও সৈয়দ আশরাফ স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখেন। বিকেলে তিনি বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর দলীয় কার্যালয়ে যুবলীগের ইফতার অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এ সময় সাংবাদিকেরা অনেক চেষ্টা করলেও তিনি এ বিষয়ে কিছু বলেননি।
মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির বিষয়ে জানতে চাইলে একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, এটা তাঁর প্রাপ্য ছিল। তাঁর নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে অনেক দিন ধরেই দল ও সরকারে আলোচনা-সমালোচনা ছিল।
সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, মঙ্গলবার একনেকের সভায় অনুপস্থিত থাকায় সৈয়দ আশরাফকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, বিষয়টি এমন নয়। বেশ কিছুদিন ধরেই প্রধানমন্ত্রী তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। মন্ত্রণালয়ে না যাওয়া, সরকার ও দলের অনুষ্ঠানে মাঝেমধ্যে যোগ দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে সরকার ও দলের ভেতর সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তিনি। এ ছাড়া সরকার ও দলের নিচু থেকে উঁচু স্তরের নেতাদের অনেকেই তাঁর সমালোচনা করতেন।
আপাতদৃষ্টিতে তাঁর বিরুদ্ধে প্রচলিত অভিযোগ ছিল, তিনি মন্ত্রণালয়ে যান না। কিন্তু ওই মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ সময়মতো হয়নি কিংবা কাজে দুর্নীতি বা অনিয়ম হয়েছে—এমন ব্যক্তিগত অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে শোনা যায়নি। তবে দল থেকে নেওয়া তাঁর একজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও আর্থিক অনিয়ম-সংক্রান্ত বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে।
দলীয় কর্মকাণ্ডে নিয়মিত অংশ না নেওয়া এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সারা দেশে দলের নেতাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ, পরামর্শ ও দল পরিচালনায় তাঁর একধরনের অনাগ্রহ থাকার অভিযোগ নতুন নয়। এই অভিযোগের ভিত্তি থাকলেও দলের পদ থেকে তাঁকে সরানো হয়নি।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, সরকার যে প্রক্রিয়ায় বা পদ্ধতিতে চলে, তার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে তাঁর ভিন্নমত ছিল। সর্বশেষ একনেক সভায় তাঁর মন্ত্রণালয়ের ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকার যে বিশাল প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়, ওই প্রকল্প নেওয়ার বিষয়েও তাঁর সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি।
বিভিন্ন সময়ে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, ঢাকা ওয়াসাসহ বিভিন্ন সংস্থায় শীর্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ, ওই সব পদে চাকরির মেয়াদ বাড়ানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। এর অনেকগুলোই হয়েছে তাঁর অমতে। ঢাকার দুটি এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২৮ এপ্রিলের নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে সরকারের নির্দেশনাও গিয়েছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে। এটি পদ্ধতিগতভাবে সঠিক না হওয়ায় আগের প্রস্তাব ফেরত এনে নতুন করে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়। এ রকম আরও কিছু পদ্ধতিগত ও প্রক্রিয়াগত বিষয়ে সরকারের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব সৃষ্টি হয়। জেলা পরিষদে সরকারের মনোনীত প্রশাসক দেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন তিনি। তাঁর মত ছিল, জেলা পরিষদে নির্বাচন করা অথবা কিছুই না করা। এ ছাড়া গত আড়াই বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ১৪ জন প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে তাঁর মত নেওয়া হয়নি।
সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প’ নিয়ে বেপরোয়া অনিয়ম ও দুর্নীতি হলেও এর প্রকল্প পরিচালক প্রশান্ত কুমার কর্মকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেননি তিনি। প্রকল্প পরিচালক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে মন্ত্রী হিসেবে তাঁকে পাশ কাটিয়ে যান। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রশান্ত কুমারের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পরও বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। একপর্যায়ে মন্ত্রী হিসেবে ওই প্রকল্পের যেসব নথিতে তাঁর সইয়ের দরকার ছিল, তা দেওয়া থেকে বিরত থাকেন সৈয়দ আশরাফ। তিনি আগে দুর্নীতির তদন্ত করা এবং প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ার কারণ তদন্ত করতে বলেন, এরপর সই দেবেন বলেও জানান। কিন্তু পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ধীরগতিতে এগোয়।
এর আগে নবম সংসদের মেয়াদকালে যখন প্রথম সাংসদদের হাতে সরাসরি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব ওঠে, তখন তিনি এর বিরোধিতা করেন। তিনি বলেছিলেন, এই টাকা সাংসদদের হাতে সরাসরি দেওয়া হলে তা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠবে। এর পরিবর্তে তিনি সাংসদদের দেওয়া প্রকল্পের বিপরীতে টাকা বরাদ্দের পক্ষে অবস্থান নেন। ওই সংসদে বিএনপির সাংসদেরাও ছিলেন। কিন্তু সরকারের প্রস্তাব ছিল, শুধু সরকারদলীয় সাংসদদের ওই অর্থ দেওয়া। তিনি এরও বিরোধিতা করে সব সাংসদের জন্য বরাদ্দের পক্ষে অবস্থান নেন। এসব ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থানই কার্যকর হয়। তবে এ নিয়ে সরকারের ভেতরে তাঁর সম্পর্কে একধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী বলেন, মন্ত্রণালয় ও দলে সৈয়দ আশরাফের নিষ্ক্রিয়তা প্রধানমন্ত্রী এক প্রকার মেনেই নিয়েছিলেন। নইলে গত প্রায় সাড়ে ছয় বছর কীভাবে থাকলেন। তবে মন্ত্রণালয়ের আরেকটি সূত্র জানায়, গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সৈয়দ আশরাফের অবস্থান মন্ত্রণালয়ে দুর্বল হতে থাকে। এর আগের মেয়াদে স্থানীয় সরকারে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে জাহাঙ্গীর কবির নানক দায়িত্ব পালন করায় এবং তিনি দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় খুব একটা সমস্যা হয়নি। প্রতিমন্ত্রীই তখন মন্ত্রণালয় চালিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু ভিন্ন দলের একজন নেতাকে প্রতিমন্ত্রী করায় এবং সৈয়দ আশরাফ নিষ্ক্রিয় থাকায় মন্ত্রণালয়ে আমলাতন্ত্রের খবরদারি বেড়ে যায় এবং সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে এই মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া শুরু হয়।
সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে চলমান মতবিরোধ উসকানি পায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের একটি বক্তব্যে। একনেক সভায় তিনি বলেন, ছয় হাজার কোটি টাকার এত বড় প্রকল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দুজন মন্ত্রী রয়েছেন, একজনও আসেননি। তাই এ প্রকল্প একনেক সভা থেকে প্রত্যাহার করা হোক। তাঁদের মতামত নিয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন করা দরকার।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা বলেন, প্রকল্পটা প্রত্যাহার করবেন না। উনি যখন আসেন না, উনাকে সরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু ওই দিন পরিবর্তন না করলেও দুই দিন পর তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা: ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, নতুন দায়িত্ব পেয়ে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘আমার প্রথম ও প্রধান কাজ হবে প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারী কর্মসূচি “একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প” বাস্তবায়নের মাধ্যমে পল্লি উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা।’ গতকাল বিকেলে ফরিদপুর শহরতলির বদরপুর এলাকার নিজ বাড়িতে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়ায় মন্ত্রী এ কথা বলেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তাঁর বেয়াই খন্দকার মোশাররফ। বলেন, এ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রামের উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। এই কাজ করার সুবাদে গ্রামীণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নত জনপদ গড়ে তোলা হবে।
ক্ষুব্ধ কিশোরগঞ্জবাসী: নিজস্ব প্রতিবেদক, ভৈরব জানান, সৈয়দ আশরাফকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়ায় এলাকার লোকজন বেজায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন। চা দোকানি নাসির মিয়া বলেন, ‘হুনুইন, ভালা মানুষের ভাত নাই।’ শহরের নগুয়া মহল্লার অটোরিকশা গ্যারেজের মালিক তামিম মিয়ার মন্তব্য, ‘শুধু কি ভাত নাই, দামও নাই। তা না হইলে কি আর সৈয়দ আশরাফের মতো সৎ ও বিনয়ী এক নেতাকে মন্ত্রিত্ব হারাতে হয়?’
এর ফলে কিশোরগঞ্জের চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা অনেকের। তাঁর অব্যাহতির খবরে ভেঙে পড়েন দলীয় নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে তাঁর এলাকার সাধারণ মানুষও।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ আফজাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর তো হাত নেই। তবে আমাদের নেতা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নেই, ভাবতে খারাপ লাগছে।’
No comments