স্যার, আমরা ওদের ক্ষমা করব না by সাজেদুল হক
কথাটি
সত্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বারান্দায় তার
কথা খুব শোনা যেত। আনিসুর রহমান। তিনি আমাদের শিক্ষক ছিলেন না, আবার
ছিলেনও। আমরা হয়তো তাকে দেখিনি। কিন্তু আমাদের ছাত্র মানসে তার ছবি আঁকা
ছিল। অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিনের ফেসবুক দেয়ালে যখন আনিসুর রহমানের মৃত্যু
সংবাদ পেলাম, হৃদয়টা হাহাকার করে উঠল। অদ্ভুত এক শূন্যতা আঁকড়ে ধরল আমাকে,
আমাদের আরও অনেককে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ যেমনটা লিখেছেন- আরো এক বন্ধুর বিদায়; আনিসুর রহমান- সহপাঠী, সহকর্মী, বন্ধু। ‘পাতা ঝরার শব্দ শুনতে পাই; মনে হয় জীবনের কোলাহলকে ছাপিয়ে পাতা ঝরছে, নিষ্পত্র হচ্ছে বৃক্ষরা- অথচ এখনো তো অনেক সময় বাকি থাকার কথা, এখন তো গ্রীষ্ম, এখন তো ঝরা পাতা কুড়াবার সময় আসবার কথা নয়; কিন্তু আমি পাতা কুড়াই, আমি শুনি ঝরাপাতার গান, জীবনের কোলাহলকে ছাপিয়ে কেবল সেই বাণী- ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।’ আমি সান্ত¡না খুঁজি ‘তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,/ কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফোটে।’ কোথাও কি তরঙ্গ উঠছে? কোথাও কি কুসুম ফুটছে? চারপাশের জীবনের এত আয়োজনের মধ্যে কুসুম ঝরার শব্দই সত্য হয়ে থাকে কেন?
গ্রাম্য এক সহজ-সরল বালক। তবে কীর্তিতে ছাড়িয়ে যান অন্যদের। এসএসসি আর এইচএসসিতে মেধা তালিকায় স্থান নেন কুমিল্লা বোর্ডে। এরপর আসেন ঢাকায়। শহুরে, এলিটদের মেধার লড়াইয়ে পরাজিত করার বাসনা ছিল হয়তোবা তার মনে। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। সাংবাদিকতা বিভাগের অনার্সের প্রথম ব্যাচ। চারপাশে অনেক কীর্তিমান মেধাবী। এরই মধ্যে অনার্স-মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। খুব অল্প বয়সে হয়ে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিন্তু এলিট শিক্ষকরা এ সহজ-সরল-শিক্ষার্থী অন্তঃপ্রাণ মানুষটিকে মেনে নিতে পারেননি। পাগলাটে অপবাদ দেয়া হয় তার ওপর। শিক্ষক রাজনীতির শিকার হয়ে তাকে ত্যাগ করতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি ফিরে যান কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের তৈয়াসার গ্রামে। মাঝে শারীরিক অসুস্থতা গ্রাস করে তাকে। সবার থেকে বিচ্ছিন্ন আনিস স্যারকে অবশ্য তার শিক্ষার্থীরা ভোলেনি। অনেক চেষ্টা করে তাকে চিকিৎসার জন্য ভারত যেতে রাজি করান। চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার পরও শিক্ষার্থীরা চেষ্টা করেছিলেন তাকে কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় ফেরাতে। আনিস স্যার রাজি হননি। তিনি ফিরে যান গ্রামে। শুনেছি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন তিনি। রোববার দিবাগত রাতে সেই গ্রামেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন আনিসুর রহমান।
সাংবাদিক প্রভাষ আমিন লিখেছেন, আজ দুপুরে ফেসবুক খুলতেই একটা শোক সংবাদ পেলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষক আনিসুর রহমান মারা গেছেন। কিছুক্ষণ পরই এই শোক সংবাদটি হাহাকার ছড়ালো ফেসবুকে। সেই হাহাকার ছুঁয়ে গেল আমাকেও। কারণ, এই একই হাহাকার আমি শুনেছি, ‘৯০-৯১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের বারান্দায়। মরে যাওয়া আনিস স্যারের জন্য যতটা হাহাকার, ততটাই যেন ছিল বেঁচে থাকা আনিস স্যারের জন্যও। আমি কখনও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়িনি। কিন্তু নিয়মিত অনেক ছাত্রের চেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছি আড্ডা মেরে। সেখানেই শুনতাম আনিস স্যারের জন্য শিক্ষক-ছাত্রছাত্রী সবার আক্ষেপ হাহাকার। আনিসুর রহমান গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অনার্সের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। কুমিল্লা বোর্ড থেকে এসএসসি, এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করা আনিসুর রহমান অনার্স-মাস্টার্সেও প্রথম শ্রেণী পেয়েছিলেন। আনিসুর রহমান স্বপ্ন দেখতেন, স্বপ্ন দেখাতেন। অসম্ভব মেধাবী এ মানুষটিকে তার বন্ধুরা ডাকতেন দার্শনিক হিসেবে, কেউ কেউ ডাকতেন পাগলা আনিস। শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন বিভাগেই। কিন্তু দুই বছর পরই শিক্ষক রাজনীতির শিকার হয়ে বিদায় নিতে হয় তাকে।
তারপরই শুরু আনিস স্যারের দ্বিতীয় জীবন। বাউন্ডুলেপনার চূড়ান্ত উদাহরণ হয়ে যান। স্বপ্নের চূড়াটা যেমন দেখিয়েছেন, দেখিয়েছেন হতাশার অতল গহ্বরও। রাস্তায়-পার্কে ঘুমানো থেকে শুরু করে খামখেয়ালিপনার সবই করতেন। কিছুদিন ঢাকায় থেকে চলে যান গ্রামে, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। সেখানে কিছুই না করে কাটতো তার সময়। মাঝে একবার সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হলে বন্ধুবান্ধব, শিক্ষার্থীরা চাঁদা তুলে তাকে ভারতের পাঠায় চিকিৎসার জন্য। কিন্তু শরীরের চিকিৎসা যত সহজ, মনেরটা তত নয়। তাই আপাত সুস্থ হলেও আসলে সুস্থ হননি আনিস স্যার। গ্রামের মানুষের কাছে সব রোগের এক চিকিৎসা- বিয়ে করিয়ে দাও। তাও করানো হলো। কিন্তু সময়ের অনেক আগেই জন্ম নেয়া আনিস স্যারকে এসব তুচ্ছ জাগতিক বাঁধনে জড়ানো যায়নি। আনিস স্যার আসলে মরে গিয়েছিলেন অনেক আগে, ’৮৯ সালেই। কিন্তু তার শারীরিক মৃত্যুর তারিখ লেখা থাকবে ১৮ই মে ২০১৫। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৫।
অনার্সের প্রথম ব্যাচটি সত্যিকারের তারকাখচিত। সুব্রত শংকর ধর বিশ্বব্যাংকের বড় কর্তা, আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী অধ্যাপক, শওকত মাহমুদ তারকা সাংবাদিক ও বিএনপি নেতা, কাজী রওনাক হোসেন মাসিক সরগম সম্পাদক, ফয়সল মোকাম্মেল ব্যাংকার, মির্জা তারেকুল কাদের বিজেম নামে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান। মোস্তফা তারেক-কামরুন্নাহার প্রেম করে, বিয়ে করে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। হারুনুর রশিদও প্রবাসী। ১৩ জনের এই ব্যাচের উজ্জ্বল তারকাদের একজন আনিসুর রহমান চলে গেলেন আজ নিভৃতে। এর আগে গেছেন মিশুক মুনীর, রাশিদা মহিউদ্দিন ও ব্যাংক কর্মকর্তা শেখ সাদেক। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা অধ্যয়নের অগ্রবাহিনী সম্মানিত এই ব্যাচ। শুধু বাংলাদেশ নয়, এ উপমহাদেশের সাংবাদিকতার প্রথম অনার্স ব্যাচ এটি।
শুনেছি সাংবাদিকতায় আমার গুরু মিনার মাহমুদের বন্ধু ছিলেন আনিসুর রহমান। বিচিন্তার প্রথম পর্বের নিয়মিত আড্ডার সঙ্গী ছিলেন। আমি সাংবাদিকতা শুরু করেছি বিচিন্তার দ্বিতীয় পর্বে। এইটুকু নৈকট্য ছাড়া আর কোন যোগাযোগ ছিল না তার সঙ্গে। কখনও দেখিওনি। মারা যাওয়ার পর আরেকটি নৈকট্য আবিষ্কৃত হলো, তার বাড়িও কুমিল্লায়। আনিসুর রহমানের মৃত্যু জীবনের একটা অদ্ভুত বৈপরীত্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। একই ব্যাচের দুটি ফার্স্টক্লাস পাওয়া একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, উন্নত জীবনযাপন করেন। আরেকজন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের গ্রামের বাড়িতে কিছু না করে, রোগে ভুগে, স্বজনহীন-বন্ধুবিহীন অসহায় মৃত্যুবরণ করেছেন। সৌন্দর্য বলেন, নিষ্ঠুরতা বলেন- এটাই জীবন। জীবন কম্পিউটারের প্রোগ্রাম নয়। এক লাইনে চলে না।
একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে কখনও না দেখা, অসম্ভব প্রতিভাবান, দার্শনিক, স্বাপ্নিক, খামখেয়ালিপনায় জীবন কাটিয়ে দেয়া গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার এই মেধাবী শিক্ষকের জন্য এই অনুজের দুই ফোঁটা অশ্রু থাকল ফেসবুকের ভার্চুয়াল জগতেই।
শেষ কথা: দরজার ওপাশে কেমন আছেন আনিস স্যার। পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা তিনি যেন ভাল থাকেন। আর স্যার আপনার প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজও বদলায়নি। নোংরা রাজনীতি আরও গ্রাস করেছে সবকিছুকে। আমরা আপনাকে ভুলব না স্যার। আমরা ওদের ক্ষমা করব না।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ যেমনটা লিখেছেন- আরো এক বন্ধুর বিদায়; আনিসুর রহমান- সহপাঠী, সহকর্মী, বন্ধু। ‘পাতা ঝরার শব্দ শুনতে পাই; মনে হয় জীবনের কোলাহলকে ছাপিয়ে পাতা ঝরছে, নিষ্পত্র হচ্ছে বৃক্ষরা- অথচ এখনো তো অনেক সময় বাকি থাকার কথা, এখন তো গ্রীষ্ম, এখন তো ঝরা পাতা কুড়াবার সময় আসবার কথা নয়; কিন্তু আমি পাতা কুড়াই, আমি শুনি ঝরাপাতার গান, জীবনের কোলাহলকে ছাপিয়ে কেবল সেই বাণী- ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।’ আমি সান্ত¡না খুঁজি ‘তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,/ কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফোটে।’ কোথাও কি তরঙ্গ উঠছে? কোথাও কি কুসুম ফুটছে? চারপাশের জীবনের এত আয়োজনের মধ্যে কুসুম ঝরার শব্দই সত্য হয়ে থাকে কেন?
গ্রাম্য এক সহজ-সরল বালক। তবে কীর্তিতে ছাড়িয়ে যান অন্যদের। এসএসসি আর এইচএসসিতে মেধা তালিকায় স্থান নেন কুমিল্লা বোর্ডে। এরপর আসেন ঢাকায়। শহুরে, এলিটদের মেধার লড়াইয়ে পরাজিত করার বাসনা ছিল হয়তোবা তার মনে। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। সাংবাদিকতা বিভাগের অনার্সের প্রথম ব্যাচ। চারপাশে অনেক কীর্তিমান মেধাবী। এরই মধ্যে অনার্স-মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। খুব অল্প বয়সে হয়ে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিন্তু এলিট শিক্ষকরা এ সহজ-সরল-শিক্ষার্থী অন্তঃপ্রাণ মানুষটিকে মেনে নিতে পারেননি। পাগলাটে অপবাদ দেয়া হয় তার ওপর। শিক্ষক রাজনীতির শিকার হয়ে তাকে ত্যাগ করতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি ফিরে যান কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের তৈয়াসার গ্রামে। মাঝে শারীরিক অসুস্থতা গ্রাস করে তাকে। সবার থেকে বিচ্ছিন্ন আনিস স্যারকে অবশ্য তার শিক্ষার্থীরা ভোলেনি। অনেক চেষ্টা করে তাকে চিকিৎসার জন্য ভারত যেতে রাজি করান। চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার পরও শিক্ষার্থীরা চেষ্টা করেছিলেন তাকে কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় ফেরাতে। আনিস স্যার রাজি হননি। তিনি ফিরে যান গ্রামে। শুনেছি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন তিনি। রোববার দিবাগত রাতে সেই গ্রামেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন আনিসুর রহমান।
সাংবাদিক প্রভাষ আমিন লিখেছেন, আজ দুপুরে ফেসবুক খুলতেই একটা শোক সংবাদ পেলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষক আনিসুর রহমান মারা গেছেন। কিছুক্ষণ পরই এই শোক সংবাদটি হাহাকার ছড়ালো ফেসবুকে। সেই হাহাকার ছুঁয়ে গেল আমাকেও। কারণ, এই একই হাহাকার আমি শুনেছি, ‘৯০-৯১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের বারান্দায়। মরে যাওয়া আনিস স্যারের জন্য যতটা হাহাকার, ততটাই যেন ছিল বেঁচে থাকা আনিস স্যারের জন্যও। আমি কখনও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়িনি। কিন্তু নিয়মিত অনেক ছাত্রের চেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছি আড্ডা মেরে। সেখানেই শুনতাম আনিস স্যারের জন্য শিক্ষক-ছাত্রছাত্রী সবার আক্ষেপ হাহাকার। আনিসুর রহমান গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অনার্সের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। কুমিল্লা বোর্ড থেকে এসএসসি, এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করা আনিসুর রহমান অনার্স-মাস্টার্সেও প্রথম শ্রেণী পেয়েছিলেন। আনিসুর রহমান স্বপ্ন দেখতেন, স্বপ্ন দেখাতেন। অসম্ভব মেধাবী এ মানুষটিকে তার বন্ধুরা ডাকতেন দার্শনিক হিসেবে, কেউ কেউ ডাকতেন পাগলা আনিস। শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন বিভাগেই। কিন্তু দুই বছর পরই শিক্ষক রাজনীতির শিকার হয়ে বিদায় নিতে হয় তাকে।
তারপরই শুরু আনিস স্যারের দ্বিতীয় জীবন। বাউন্ডুলেপনার চূড়ান্ত উদাহরণ হয়ে যান। স্বপ্নের চূড়াটা যেমন দেখিয়েছেন, দেখিয়েছেন হতাশার অতল গহ্বরও। রাস্তায়-পার্কে ঘুমানো থেকে শুরু করে খামখেয়ালিপনার সবই করতেন। কিছুদিন ঢাকায় থেকে চলে যান গ্রামে, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। সেখানে কিছুই না করে কাটতো তার সময়। মাঝে একবার সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হলে বন্ধুবান্ধব, শিক্ষার্থীরা চাঁদা তুলে তাকে ভারতের পাঠায় চিকিৎসার জন্য। কিন্তু শরীরের চিকিৎসা যত সহজ, মনেরটা তত নয়। তাই আপাত সুস্থ হলেও আসলে সুস্থ হননি আনিস স্যার। গ্রামের মানুষের কাছে সব রোগের এক চিকিৎসা- বিয়ে করিয়ে দাও। তাও করানো হলো। কিন্তু সময়ের অনেক আগেই জন্ম নেয়া আনিস স্যারকে এসব তুচ্ছ জাগতিক বাঁধনে জড়ানো যায়নি। আনিস স্যার আসলে মরে গিয়েছিলেন অনেক আগে, ’৮৯ সালেই। কিন্তু তার শারীরিক মৃত্যুর তারিখ লেখা থাকবে ১৮ই মে ২০১৫। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৫।
অনার্সের প্রথম ব্যাচটি সত্যিকারের তারকাখচিত। সুব্রত শংকর ধর বিশ্বব্যাংকের বড় কর্তা, আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী অধ্যাপক, শওকত মাহমুদ তারকা সাংবাদিক ও বিএনপি নেতা, কাজী রওনাক হোসেন মাসিক সরগম সম্পাদক, ফয়সল মোকাম্মেল ব্যাংকার, মির্জা তারেকুল কাদের বিজেম নামে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান। মোস্তফা তারেক-কামরুন্নাহার প্রেম করে, বিয়ে করে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। হারুনুর রশিদও প্রবাসী। ১৩ জনের এই ব্যাচের উজ্জ্বল তারকাদের একজন আনিসুর রহমান চলে গেলেন আজ নিভৃতে। এর আগে গেছেন মিশুক মুনীর, রাশিদা মহিউদ্দিন ও ব্যাংক কর্মকর্তা শেখ সাদেক। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা অধ্যয়নের অগ্রবাহিনী সম্মানিত এই ব্যাচ। শুধু বাংলাদেশ নয়, এ উপমহাদেশের সাংবাদিকতার প্রথম অনার্স ব্যাচ এটি।
শুনেছি সাংবাদিকতায় আমার গুরু মিনার মাহমুদের বন্ধু ছিলেন আনিসুর রহমান। বিচিন্তার প্রথম পর্বের নিয়মিত আড্ডার সঙ্গী ছিলেন। আমি সাংবাদিকতা শুরু করেছি বিচিন্তার দ্বিতীয় পর্বে। এইটুকু নৈকট্য ছাড়া আর কোন যোগাযোগ ছিল না তার সঙ্গে। কখনও দেখিওনি। মারা যাওয়ার পর আরেকটি নৈকট্য আবিষ্কৃত হলো, তার বাড়িও কুমিল্লায়। আনিসুর রহমানের মৃত্যু জীবনের একটা অদ্ভুত বৈপরীত্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। একই ব্যাচের দুটি ফার্স্টক্লাস পাওয়া একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, উন্নত জীবনযাপন করেন। আরেকজন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের গ্রামের বাড়িতে কিছু না করে, রোগে ভুগে, স্বজনহীন-বন্ধুবিহীন অসহায় মৃত্যুবরণ করেছেন। সৌন্দর্য বলেন, নিষ্ঠুরতা বলেন- এটাই জীবন। জীবন কম্পিউটারের প্রোগ্রাম নয়। এক লাইনে চলে না।
একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে কখনও না দেখা, অসম্ভব প্রতিভাবান, দার্শনিক, স্বাপ্নিক, খামখেয়ালিপনায় জীবন কাটিয়ে দেয়া গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার এই মেধাবী শিক্ষকের জন্য এই অনুজের দুই ফোঁটা অশ্রু থাকল ফেসবুকের ভার্চুয়াল জগতেই।
শেষ কথা: দরজার ওপাশে কেমন আছেন আনিস স্যার। পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা তিনি যেন ভাল থাকেন। আর স্যার আপনার প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজও বদলায়নি। নোংরা রাজনীতি আরও গ্রাস করেছে সবকিছুকে। আমরা আপনাকে ভুলব না স্যার। আমরা ওদের ক্ষমা করব না।
No comments