একজন অদ্ভুত মেয়রের গল্প by হাসান ফেরদৌস

বিশেষ ভঙ্গিমায় মেয়র আন্তানাস মকুস
বাংলাদেশের দুই প্রধান শহরের তিন মেয়রের নির্বাচন শেষ হয়েছে। এই নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বিস্তর বিতণ্ডা হয়েছে, কিন্তু মোদ্দাকথা হচ্ছে, আগামী পাঁচ বছর এই তিন মেয়র নিয়েই আমাদের কাজ করতে হবে। চাই বা না-চাই, তাঁরাই এখন আমাদের নগরপিতা। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই আমরা চাইব তাঁদের সাফল্য।
অন্তত একটি ব্যাপারে এই নির্বাচন থেকে আমরা আশার কারণ খুঁজে পাই। যাঁরা নির্বাচিত হলেন, তাঁদের অপেক্ষাকৃত তারুণ্য ও আপাতস্বচ্ছ ইমেজ। অন্য আরেকটি গুণ যা আমাকে উৎসাহিত করেছে তা হলো, তাঁদের অন্তত দুজন চমৎকার বাংলা বলেন। আমাদের সাংসদদের বাংলা জ্ঞানের সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে, তাঁরা নিশ্চয় এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানাবেন।
এই তিনজনের উদ্দেশে আজ আমি একজন মেয়রের গল্প বলতে চাই। কোনো পণ্ডিতি গল্প নয়, একদম সাদাসিধা একটি গল্প, তা থেকে দু-চারটে বুদ্ধি যদি তাঁরা ধার নেন, আমার ধারণা, তাহলে তাঁরা নিজেরাও উপকৃত হবেন, নগরবাসীও।
যাঁর কথা বলছি, তিনি কলম্বিয়ার রাজধানী বগোতার সাবেক মেয়র, আন্তানাস মকুস। পেশায় দার্শনিক—দর্শনশাস্ত্রে তাঁর পিএইচডি রয়েছে—একসময় বগোতার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি রাজনীতি করবেন, এ কথা মাথায় আনেননি কখনো। ১৯৯৩ সালে এক মহা হুলুস্থুল কাণ্ডের পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করে ঠিক করলেন বগোতার মেয়র পদে নির্বাচন করবেন। কাণ্ডটা কী, সে কথায় পরে আসছি।
মকুস জাত শিক্ষক, মেয়র হিসেবে তিনি বগোতার ৫০ লাখ নগরবাসীকে নিজের ক্লাসরুমের ছাত্র বিবেচনা করে তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার উদ্যোগ নিলেন। রাজনীতিবিদেরা যেমন তাঁদের ক্ষমতার শীর্ষ থেকে হুকুম চালাতে ভালোবাসেন, মকুস ছিলেন তার উল্টো। নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকার ও তার পাশাপাশি দায়িত্ব কী, সে কথা হাতে-কলমে দেখাতে বদ্ধপরিকর হলেন তিনি। ওপর থেকে নিচ—টপ ডাউন—এই পদ্ধতির বদলে তাঁর পথ ছিল নাগরিকদের সঙ্গে সরাসরি কথোপকথন। প্রত্যেকে যদি প্রত্যেকের দায়িত্বটুকু পালন করে, তাহলে আমরা সবাই লাভবান হব, এই ছিল তাঁর প্রধান স্লোগান। কথাটা সোজা, কিন্তু তার পরও আমাদের মাথায় ঢোকে না, কারণ নিজের স্বার্থের বাইরে অন্যের কথা ভাবার অভ্যাস আমাদের নেই। মকুস সে অভ্যাসটা বদলিয়ে অংশগ্রহণের এক নাগরিক সংস্কৃতি নির্মাণের উদ্যোগ নিলেন। যেখানে কথায় কাজ হতো না, সেখানে তিনি হাতে-কলমে দেখিয়ে দিতেন। এই কাজটা করতে তিনি একদিকে যেমন সহজবোধ্য নানা প্রতীক ব্যবহার করেছেন, তেমনি মাইম, ক্লাউন ও থিয়েটারের নানা উপকরণ কাজে লাগিয়েছেন।
ব্যাপারটা উদাহরণ বুঝিয়ে বলা যাক।
মকুস যখন বগোতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন এই শহরের একটি প্রধান সমস্যা ছিল সড়ক দুর্ঘটনা, যার মূল কারণ সড়ক চলাচলের আইন না মেনে চলা। যারা আইন মানে না, মকুস তাদের চিহ্নিত করে লজ্জা দেওয়ার জন্য একদল মূকাভিনেতার সাহায্য নিলেন। সং সেজে এসব মূকাভিনেতা যারাই ট্রাফিক আইন ভাঙত, তাদের দিকে রঙিন বড় বড় কাগজ তুলে ধরতেন, যাতে লেখা থাকত, ‘ভুল ভুল’। তা দেখে রাস্তার সবাই হেসে খুন। প্রায় রাতারাতি বগোতার সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেক হয়ে গেল। পরীক্ষা নিয়ে দেখা গেল, অধিকাংশ মানুষ দিনদুপুরে সবার হাসির পাত্র হওয়ার চেয়ে আইন মেনে চলা অনেক বুদ্ধিমানের কাজ মনে করে। আরও একটা কাজ করলেন মকুস। শহরের যেসব জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে, সেখানে তিনি রঙিন কালিতে নক্ষত্রের ছবি এঁকে দিলেন। উদ্দেশ্য, সে নকশার সামনে এলেই আপনার মনে পড়বে এখানে কোনো এক নিরীহ পথযাত্রী নিহত হয়েছে। বছর যেতে না যেতেই দেখা গেল বগোতার সড়ক দুর্ঘটনা থেকে মৃত্যু নাটকীয়ভাবে কমে এসেছে।
মেয়েদের ওপর যৌন অত্যাচার, সেটাও বগোতার দৈনন্দিন ঘটনা ছিল। রাত একটু বেশি গড়ালে মেয়েরা নিরাপদ বোধ করত না। মকুস প্রস্তাব করলেন, সপ্তাহের একটি রাতে নির্দিষ্ট সময়ের পর সব পুরুষেরা যাঁর যাঁর ঘরে থাকবেন। রাস্তায় থাকবে শুধু মেয়েরা। তাঁর সে প্রস্তাব শুনে নারী-পুরুষ সবাই হেসে খুন। অথচ প্রথম যেদিন ‘শুধু মেয়েদের জন্য রাত’ ঘোষিত হলো, প্রায় সাত লাখ মেয়ে মহা হুল্লোড় করে রাস্তায় নেমে আসে। সব পুরুষ না হলেও বগোতার অধিকাংশ পুরুষ ঘরে বসে ছিলেন। শুধু বসে নয়, ঘরকন্নার কাজ করে, ছেলেপুলের যত্ন নিয়ে তাঁরা রাত কাটান। বারান্দায় বা বাড়ির জানালা দিয়ে শিশুকে কোলে নিয়ে হাঁটছেন এমন কোনো পুরুষ দেখা গেলেই, সব মেয়েরা হইহই করে তাঁদের অভিনন্দন জানিয়েছে। হাসি-ঠাট্টার ব্যাপার, অথচ কী সহজে মকুস বুঝিয়ে দিলেন, রাজপথ শুধু একা পুরুষের নয়, ঘরকন্নার কাজও শুধু মেয়েদের মাথাব্যথা নয়।
বগোতার এক বড় সমস্যা হলো পানি। তার চেয়েও বড় সমস্যা পানির অপচয়। এই অপচয় কমাতে মকুস সবাইকে অনুরোধ করলেন যখন যেভাবে সম্ভব পানির ব্যবহার সীমিত করতে। প্রথম নির্দেশ গেল সরকারি অফিস-আদালতে, সব ধরনের কর্মকর্তাদের কাছে। প্রতি সপ্তাহ শেষে মকুস সাংবাদিকদের ডেকে হিসাব দেওয়া শুরু করলেন, গত সাত দিনে কতটুকু পানি সঞ্চয় সম্ভব হয়েছে। অপচয়ের বিরুদ্ধে নাগরিক আস্থা অর্জনের পর তিনি দৃষ্টি ফেরালেন সাধারণ নাগরিকদের ওপর। কীভাবে পানির অপচয় কমানো সম্ভব, তা বোঝানোর জন্য মকুস জাতীয় টেলিভিশনে নিজের স্নানঘরে গায়ে-গতরে সাবান মেখে গোসলের দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার করলেন। সাবান মাখার সময় ট্যাপের পানি ছেড়ে রাখার বদলে তা বন্ধ রাখলেন, মুখে বললেন, ‘অতি সামান্য এই কাজ যদি আমরা সবাই করি, তাহলে প্রতি সপ্তাহে কী বিপুল পরিমাণ পানি বাঁচানো সম্ভব।’
গার্হস্থ্য সহিংসতা কমাতে আরেক বুদ্ধি আঁটেন মকুস। যারা সহিংসতার শিকার, এমন নারীদের তিনি প্রকাশ্যে তাঁদের নিগ্রহের গল্প শোনাতে ডাকলেন। বললেন, ‘তোমাদের ওপর যারা হামলা করেছে, তাদের ছবি দিয়ে পুতুল বানাও। তারপর সে পুতুলকে মানুষ ভেবে যা খুশি বলো বা চাও তো দু-চার ঘা লাগিয়ে দাও।’ দর্শক ও মানসিক বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে এই ‘নাট্যাভিনয়ে’ প্রায় ৪০ হাজার মেয়ে অংশ নেয়।
মকুসকে নিয়ে আরও অসংখ্য গল্প রয়েছে, একাধিক বই লেখা হয়েছে তাঁর প্রশাসনিক পদ্ধতি নিয়ে। এমনকি এক ঘণ্টার চমৎকার এক ডকুমেন্টারি পর্যন্ত তৈরি হয়েছে, যা আপনারাও দেখে নিতে পারেন এই ঠিকানায়: https://youtu.be/bwgWM3h_l-4
দরকার, মেয়র নির্বাচনকালে মকুস কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী ছিলেন না, টেবিলের নিচ থেকে হাতানো কোনো অর্থ তাঁর ছিল না। প্রথম নির্বাচনী প্রচারণার সময় তাঁর নিজের পকেটে ছিল সাকল্যে ১০ হাজার ডলার। তাঁর একমাত্র পুঁজি ছিল ব্যক্তিগত সততা। বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে তিন বছর আগে গ্রিন পার্টির প্রার্থী হিসেবে দেশের প্রেসিডেন্ট পদে পর্যন্ত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন মকুস। তাতে তিনি অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন, যদিও পরাজয়ের প্রধান কারণ ভোট গ্রহণের ঠিক আগে আগে ধরা পড়ে তিনি পারকিনসন্স রোগে ভুগছেন।
একদম হুট করে নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢোকার সিদ্ধান্ত নেন মকুস। সেটা ১৯৯৩ সালের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের এক সভায় হট্টগোল থামাতে ব্যর্থ হলে তিনি নিজের প্যান্ট খুলে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেন। তাঁর সে উদ্দেশ্য অর্জিত হয়েছিল, কিন্তু সমালোচনার মুখে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের পদ ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
মকুস বিশ্বাস করতেন আইন, নৈতিকতা ও সংস্কৃতি যদি একে অন্যের সম্পূরক হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে এক নতুন নাগরিক সংস্কৃতি নির্মাণ সম্ভব। প্রত্যেক নাগরিকের লক্ষ্য আইন ভাঙা বা সরকারকে ফাঁকি দেওয়া নয়। আইন ভাঙা হলে অথবা সরকারি ভান্ডার থেকে চুরি করলে সে নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এ কথাটা কোনো নাগরিককে যদি বোঝানো যায়, তাহলে সে নিজের ব্যবহার বদলাবে। আর এ কথাটা বোঝাতে মকুস বগোতার মেয়র হওয়ার বদলে তাঁর এক নম্বর ‘জোকার’ হিসেবে নিজের স্থান নির্ধারণ করেছিলেন। সুপারম্যানের কায়দায় পোশাক পরে রাস্তায় হাঁটতেন, নিজের নাম দিয়েছিলেন সুপার সিটিজেন। বস্তুত, তাঁর ব্যবহার ক্লাউনের মতো মনে হলেও তিনি আসলে ক্ষমতার সমীকরণ একদম পাল্টে দিয়েছিলেন। নগরপিতা হিসেবে তাঁর কোনো ক্ষমতাই নেই, অথচ প্রত্যেক নাগরিক নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সম্মত হলে তারা প্রত্যেকে নাগরিক হিসেবে ক্ষমতাবান হয়ে উঠবে, এই ছিল তাঁর মোদ্দা ফিলোসফি।
নগরকে যদি সচল ও বাসযোগ্য করতে হয়, তো সবার আগে দরকার নগরের বাসিন্দাদের সে কথায় বিশ্বাসী ও নিজ দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান হতে উৎসাহ জোগানো। মকুস এই কাজে নাগরিক শিক্ষা বা সিভিক এডুকেশনকে তাঁর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার করে তোলেন। আউগুস্তো বোয়ালের ‘থিয়েটার অব দি অপ্রেসড’ থেকে উপাদান ধার করে প্রত্যেক নাগরিককে একই সঙ্গে দর্শক ও অভিনেতার ভূমিকা প্রদান করেছিলেন। তিনি জানতেন, গল্পচ্ছলে নাগরিকদের যদি শিক্ষিত করা যায়, তাদের যদি জানানো হয় কোন ব্যবহার ঠিক, কোনটা বেঠিক, তাহলে অধিকাংশ নাগরিক তার ব্যবহার শুধরে নেবে। কিন্তু এমন কিছু করার আগে দরকার ব্যবহার শোধরানোর কথা যিনি বলবেন, তাঁর ব্যবহারটা যেন বিতর্কের ঊর্ধ্বে হয়। মকুস ছিলেন সেই রকম একজন বিতর্ক-ঊর্ধ্ব ব্যক্তি।
আমি বলি না আমাদের নতুন তিন মেয়র মকুসের মতো হবেন। মকুস একজন শিক্ষক, কলম্বিয়ার রাজধানীকে তিনি এক বিশাল ক্লাসরুম বিবেচনা করে সেখানে একের পর এক সামাজিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। আমাদের মেয়ররা কেউ শিক্ষক নন, তাঁরা ব্যবসায়ী। কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকেই আমাদের এই আশ্বাস দিয়েছেন যে শহরের দায়িত্বভার তাঁরা নিচ্ছেন, তার দেখভালের কাজটুকু সাধ্যমতো করবেন। এ কাজে মকুস তাঁদের এক উদাহরণ হতে পারেন।
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.