ইয়ানূর, রেহানা আর লতিফা। তিন
পরিবারের তিনটি মেয়ে। তিনজনের মধ্যে মিল হচ্ছে রানা প্লাজা ধস এঁদের জীবন
অনেকখানি বদলে দিয়েছে। পঙ্গু বানিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে স্বজনকে। স্বজনের
নির্মমতাও দেখতে হয়েছে এঁদের কাউকে। তবে এই তিন কন্যা জীবনকে জীবনের হাতে
ছেড়ে দেননি। ঘুরে দাঁড়িয়ে যুদ্ধে নেমেছেন। পড়াশোনা ছেড়ে মাত্র ১৪ বছর
বয়সে ইয়ানূর পোশাক কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন। মা আনোয়ারা বেগম আর তিনি
একই সঙ্গে রানা প্লাজায় কাজ করতেন। ভবনধসের ১৪ দিন পরে আনোয়ারার গলিত লাশ
পাওয়া যায় সাভারের অধর চন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠে। কোমরে, পায়ে, মাথায়
আঘাত নিয়ে ইয়ানূর তখন হাসপাতালে। ইয়ানূর এখনো ভালোভাবে হাঁটতে পারেন না।
বাঁ পা টেনেহিঁচড়ে আর শরীরটাকে বাঁকিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে ইয়ানূরকে
হাঁটতে হয়। মায়ের মৃত্যু, নিজের শারীরিক সীমাবদ্ধতা ইয়ানূরকে বদলে
দিয়েছে অনেকখানি। তবে হাল ছাড়েননি তিনি। এখন ইয়ানূর আবারও ষষ্ঠ শ্রেণিতে
পড়ছেন।
 |
ইয়ানূর |
ইয়ানূরের
বাবা ঝালমুড়িবিক্রেতা ইউনুস আলী মুন্সীর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। ইউনুস
আলী বলেন, ভবনধসের ১৪ দিন পরে তিনি স্ত্রীর গলিত লাশ পান। তখন ইয়ানূর
হাসপাতালে। তাঁর ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে ইয়ানূরই বড়। ছোটগুলোকেও দেখার কেউ
নেই। একটা ঝড় গেছে সবার জীবনের ওপর দিয়ে। তবে এখন পর্যন্ত ইয়ানূরের
মায়ের জন্য ছয় লাখ টাকা ও ইয়ানূরের জন্য আড়াই লাখ টাকা পেয়েছেন।
ইয়ানূরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সিআরপি। সম্প্রতি বিয়েও করেছেন ইউনুস। বললেন,
‘ছোট বাচ্চাদের দেখাশোনার কেউ নাই, সেই জন্য আবার সংসার করলাম।’
পা
হারিয়েও থেমে নেই রেহানা: রানা প্লাজায় দুই পা হারানো শ্রমিক রেহানা
আক্তারেরও দেখা মিলল এই গণকবাড়ির প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। রানা প্লাজা ধসের
পরে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল ও সিআরপিতে দীর্ঘ চিকিৎসা
নিতে হয়েছে রেহানাকে। চিকিৎসা নিতে এসে জীবনসঙ্গীও খুঁজে পেয়েছেন রেহানা।
তাঁর স্বামী মো. খোকন সিআরপির কর্মী। এই দম্পতি এখন সিআরপির গণকবাড়ি
কেন্দ্রে কর্মীদের জন্য নির্ধারিত আবাসস্থলে থাকেন।
মার্চ মাসের
দুপুরবেলা যখন রেহানার সঙ্গে দেখা হলো তখন তিনি সিআরপির প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে
সেলাইয়ের (দরজি কাজ) প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। বললেন অপেক্ষা করতে। প্রশিক্ষণ
শেষে নিজেই হুইলচেয়ার চালিয়ে বাসায় এলেন। বাসায় তাঁর স্বামী খোকন
মিয়া ছিলেন। খোকনের চোখের চিকিৎসা চলছে, সম্প্রতি অস্ত্রোপচার হয়েছে। ঘরে
আগে থেকেই ভাত রান্না করা ছিল। রেহানা ঘর থেকে ডিম ও আনুষঙ্গিক জিনিস
নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ভেজে আনলেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে দুপুরের আহার সেরে
স্বামীর চোখে ড্রপ দিয়ে দিলেন তিনি। এরপর আলাপ করতে বসলেন।
 |
রেহানা |
পাবনার
মেয়ে রেহানা জানান, হাঁটুর ওপর থেকে পা কাটা পড়ার পরে তাঁর মা বিয়ে
নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলেন। কিন্তু সিআরপিতে কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন কেন্দ্রে
গিয়ে পরিচয় হয় খোকন মিয়ার সঙ্গে। খোকন রোগীদের কৃত্রিম অঙ্গ পরিয়ে
দেন। সেখান থেকে জানাশোনা, মন দেওয়া-নেওয়া। এরপর দুই পরিবারের উপস্থিতিতে
সিআরপিতেই বিয়ে হয়। কয়েক মাস আগে সিআরপির সাভার কেন্দ্র থেকে গণকবাড়ি
কেন্দ্রে বদলি হয়ে আসেন খোকন মিয়া। এখন এখানেই রয়েছেন এই দম্পতি। এখনো
অনেক শারীরিক জটিলতা রয়েছে রেহানার। পায়ে আরও একটি অস্ত্রোপচার হওয়ার
কথা রয়েছে। তবু রেহানা জানালেন, এখন নিজের কাজগুলো নিজেই করার চেষ্টা
করেন। তিনি জানান, এ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রায় ১৫ লাখ টাকা
পেয়েছেন। সেই টাকা ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে রেখেছেন। স্বামী এখানে
চাকরি করছেন। এই দিয়ে বেশ ভালোই চলছে দুজনের সংসার।
 |
লতিফা |
ছোট্ট
লতিফা এখন সংসারী: রানা প্লাজা ধসের পরে অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছিল
আরিফা আর লতিফা নামে দুই বোনের সঙ্গে। আরিফার বয়স তখন ১০ আর লতিফার ১৪-১৫।
তাঁরা তাঁদের মা রীনা বেগমকে খুঁজছিলেন। ধসের ১৬তম দিনে আরিফাই মায়ের লাশ
শনাক্ত করে। এরপর দুই বোন গ্রামের বাড়িতে চলে যান। মায়ের মৃত্যুর পরে
পরিবারটি দুই লাখ টাকা পেয়েছিল। কিন্তু এক বছর পরেই তাঁদের বাবা লুৎফর
রহমান আবার বিয়ে করে নতুন সংসার করেন। আর দুই বোন যেন অথই জলে পড়েন। এরপর
ছোট বোনকে নিয়ে লতিফা আবারও সাভারের পুরোনো বাড়িতে চলে আসেন। তত দিনে
তাঁদের ভাড়া ঘরে অন্য লোক উঠে গেছে। পাশের বাড়িতে ঠাঁই হয় দুই বোনের। এই
বাড়ির সাইফুল ইসলামের স্ত্রী রাশিদা এক বছরের শিশু রেখে রানা প্লাজায়
মারা গেছেন। সাইফুলের বোন মাজেদাও রানা প্লাজায় গুরুতর আহত হন। চলতি বছর
প্রতিবেশীরা সাইফুলের সঙ্গে লতিফার বিয়ে দেন। বিয়ের পরে একটি বেসরকারি
সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে সেই সংস্থার আবাসিক স্কুলে বোন আরিফাকে ভর্তি
করিয়েছেন লতিফা ও তাঁর স্বামী সাইফুল।
No comments