ছাত্রলীগে অচল হাবিপ্রবি
কৃষি প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের প্রথম সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষা চলছিল। রবি ও বুধবার দুটি কোর্সের পরীক্ষা ছিল। হয়নি। ১৬ নভেম্বর রয়েছে পরেরটি। হবে কিনা কেউ জানে না।
একে তো পরীক্ষা হওয়া না হওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা, তার ওপর পড়ালেখা করারও উপায় নেই শিক্ষার্থীদের। তাদের দিন কাটছে ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিং-ঘেরাওয়ে অংশ নিয়ে। তাতে অংশ নিতে বাধ্য করছে ছাত্রলীগ।
শুধু কৃষি প্রকৌশল বিভাগ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের দশটিরও বেশি বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের সেমিস্টার ফাইনাল, ব্যবহারিক ও মিডটার্ম পরীক্ষাও বন্ধ। যেসব বিভাগে পরীক্ষা নেই, ক্লাস হচ্ছে না সেগুলোরও। বিশ্ববিদ্যালয়ের দাফতরিক কাজও চলছে না। আর শিক্ষকরা হিমশিম খাচ্ছেন ছাত্রলীগের একের পর এক হামলা, অবরোধ, মামলা আর পলিটিক্স মোকাবেলা করতে। সবমিলিয়ে নয় দিন ধরে কার্যত অচল হয়ে আছে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষা চলাকালে ৪ নভেম্বর ভর্তি জালিয়াতির দায়ে ছাত্রলীগের দুই নেতা হাবিপ্রবি শাখার সাধারণ সম্পাদক অরুণ কান্তি রায় ও জাহিদ হাসানকে সাময়িক বহিষ্কার করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে হামলা, ভাংচুর, প্রতিপক্ষকে মারধর ও হাত-পা ভেঙে দেয়া, শিক্ষকদের লাঞ্ছনা ও গুলি করে হত্যার হুমকি প্রদান, টেন্ডারবাজি হুমকি এবং চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে ছাত্রলীগের এ আন্দোলন।
ছাত্রলীগ নেতা অরুণ কান্তি রায় বুধবার যুগান্তরকে বলেন, বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার আর ভিসি প্রফেসর রুহুল আমিনের অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে।
এ আন্দোলনে বুধবার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা বিভাগের পরিচালক প্রফেসর শাহাদত হোসেন খান লিখনসহ ৪ শিক্ষককে তার কক্ষে তালা মেরে অবরুদ্ধ করে রাখে। বাইরে বিক্ষোভও করে তারা। পরে শিক্ষক-কর্মচারীরা একত্রিত হয়ে তালা ভেঙে শিক্ষকদের উদ্ধার করেন। কদিন ধরে চলমান শিক্ষক-ছাত্রলীগ উত্তেজনা এ নিয়ে আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
শিক্ষকরা বলছেন, মাত্র ১০ জন কথিত ছাত্রনেতার কাছে জিম্মি হাবিপ্রবির শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অবরোধ, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ভর্তি বাণিজ্য, শিক্ষক-কর্মচারী-শিক্ষার্থীদের মারধর, পিস্তল দেখিয়ে শিক্ষককে গুলি করে হত্যার হুমকি এবং ছাত্রীদের যৌন হয়রানিসহ এমন কোনো কাজ নেই যা তারা করছে না। এদের কারণে প্রাণও হারিয়েছেন কয়েকজন, অনেকেই বরণ করেছেন পঙ্গু জীবন। লেখাপড়ার পরিবেশই নষ্ট হয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথচ এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিলেই কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়।
কথা হচ্ছিল কৃষি প্রকৌশল বিভাগের লেভেল ফোরের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। ছাত্রলীগের ভয়ে নাম জানাতে অপারগতা জানান তারা। বলেন, শিক্ষক সংকটসহ নানা কারণে এমনিতেই প্রায় দুবছর শেসনজটে পড়ে আছি আমরা। এরপর একের পর এক পরীক্ষা বাতিল হচ্ছেই। পড়ালেখাও করতে পারছি না, আবার বাড়িতেও যেতে পারছি না। ছাত্রলীগের নেতারা হলে হলে গিয়ে কে কে আছে তার তালিকা নিয়েছে। নির্দেশ দিয়েছে মিছিল-মিটিংয়ে থাকার। অন্যথা হলে সিট বাতিলের হুমকি দিয়ে গেছে তারা। অভিজ্ঞতার কারণে এ হুমকি তুচ্ছজ্ঞান করার সাহস নেই কারও। এ শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ছাত্রলীগের কোনো কর্মসূচি থাকলেই ক্লাস-পরীক্ষা বাদ দিয়ে তাদের কর্মসূচিতে যেতে হয়। না গেলে সিট বাতিল, মারধরসহ নানা হয়রানির শিকার হতে হয়।
দীর্ঘ ১২ বছর ধরে হাবিপ্রবিতে লেখাপড়া করছেন ছাত্রলীগের সভাপতি ইফতেখারুল ইসলাম রিয়েল ও সাধারণ সম্পাদক অরুণ কান্ত রায় সিটন। এ সুযোগে ১০ সদস্যের একটি অভ্যন্তরীণ দল গঠন করে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। তাদের মতের বাইরে কেউ গেলে বা কথা না শুনলে নেমে আসে অন্ধকার। কদিন আগে তারা সহযোগী অধ্যাপক নওশের ওয়ান (ইংরেজি), ফুড প্রসেসিং অ্যান্ড প্রিজারভেশন বিভাগের প্রভাষক মো. রায়হানুল হক ও ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. কুতুব উদ্দীনকে লাঞ্ছিত করে এবং অধ্যাপক কুতুবউদ্দীনের কাছে তারা মোটা অংকের চাঁদাও দাবি করে।
নিয়োগ ও ভর্তি বাণিজ্য : বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী হিসাবে প্রায় অর্ধশত নিয়োগে বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে ওই ১০ জনের বিরুদ্ধে। নতুন কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ পেলেই প্রকারভেদে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয় তাদের। না দিলে ওই শিক্ষক-কর্মচারীকে জামায়াত-শিবিরের সমর্থক বানিয়ে হেনস্থা করা হয়। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগত শিক্ষার্থীদের ১ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত টাকা দিতে হয় তাদের।
চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি : ইফতেখারুল ইসলাম রিয়েল, অরুণ কান্তি রায়, জাহিদ হাসান ও সিফাতসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজির অভিযোগ মুখে মুখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ভবন নির্মাণের সব কাজে ২ থেকে ৫% হারে আগাম দিয়ে করতে হচ্ছে ঠিকাদারি। চাঁদাবাজির টাকা ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ভেটেরিনারি অনুষদের শেষ বর্ষের মেধাবী ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ শাখার সহসভাপতি ফাহিম মাহফুজ বিপুল হত্যার শিকার হন। প্রতি মাসে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও দিবসের নাম করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চাঁদা নেয়াটা প্রকাশ্য।
পাল্টা অভিযোগ : উল্টো শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ করে ক্যাম্পাসে পোস্টার সাঁটিয়েছে ছাত্রলীগ। তাদের কথিত আন্দোলনে বাধা দেয়ায় শিক্ষককে দিয়ে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। এ নিয়ে মামলা হলে উল্টো শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও মামলা করেছে তারা। অভিযোগ করেছে, তাদের শিক্ষাজীবন নষ্ট করে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন শিক্ষকরা!
তালাবাজি : হাবিপ্রবি আবাসিক হলে থাকতে হলে কথিত ওইসব ছাত্রনেতার হুকুমেই চলতে হবে, না চললে কক্ষে তালা ঝুলবে। এ কারণে দুশ তালা কিনেছে ছাত্রলীগ। মিছিল, মিটিংয়ে অংশ না নিলে কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হচ্ছে। তালা ঝোলানো হচ্ছে শিক্ষকদের কক্ষেও। সাধারণ ছাত্ররা জানায়, ছাত্রনেতাদের এ তালাবাজির সংস্কার ছাত্র রাজনীতিতে নতুন।
বিক্ষোভ : ছাত্রনেতাদের বহিষ্কারাদেশ ও থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ প্রত্যাহার দাবিতে বুধবার বেলা ১১টার দিকে ইফতেখারুল ইসলাম রিয়েলের নেতৃত্বে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সম্মুখে প্রতিবাদ সভায় বক্তারা বলেন, অবিলম্বে দুর্নীতিপরায়ণ ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর রুহুল আমিনকে অপসারণ ও তার সহযোগী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের ডিন প্রফেসর মো. আনিস খান, ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা বিভাগের পরিচালক প্রফেসর শাহাদত হোসেন খান লিখন, সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ফজলুল হক, পদার্থ বিভাগের চেয়ারম্যান মো. মোমিনুল ইসলাম, সাবেক রেজিস্ট্রার ও প্রগতিশীল শিক্ষক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ডা. বলরাম রায়ের বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতি তদন্ত করে অবিলম্বে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। সভায় বক্তব্য দেন অরুণ কান্তি রায় সিটন, প্রত্যুষ রায়, আতিকুর রহমান, আমিনুল হক, ছাত্রলীগ নেত্রী মারুফা শারমিন, মাসুমা পারভেজ, ভিয়েনা প্রমুখ।
শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : প্রগতিশীল শিক্ষক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ডা. বলরাম রায় যুগান্তরকে বলেন, তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই সবাই দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে যায়। দায়িত্বে থাকাকালে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি, এখন কেন উঠছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক রুহুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। ছাত্রলীগ যা করছে তা সম্পূর্ণ অনৈতিক। তাদের অপরাধ ঢাকতে এখন নানা অপবাদ দিয়ে আমার অপসারণ চাইছে তারা। তিনি বলেন, তদন্ত কমিটি ওই দুজনের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। কমিটির প্রতিবেদন পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। দিনাজপুর কোতোয়ালি থানার ওসি আলতাফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষক ও ছাত্র দুজনের দায়ের করা মামলারই তদন্ত চলছে।
একে তো পরীক্ষা হওয়া না হওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা, তার ওপর পড়ালেখা করারও উপায় নেই শিক্ষার্থীদের। তাদের দিন কাটছে ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিং-ঘেরাওয়ে অংশ নিয়ে। তাতে অংশ নিতে বাধ্য করছে ছাত্রলীগ।
শুধু কৃষি প্রকৌশল বিভাগ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের দশটিরও বেশি বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের সেমিস্টার ফাইনাল, ব্যবহারিক ও মিডটার্ম পরীক্ষাও বন্ধ। যেসব বিভাগে পরীক্ষা নেই, ক্লাস হচ্ছে না সেগুলোরও। বিশ্ববিদ্যালয়ের দাফতরিক কাজও চলছে না। আর শিক্ষকরা হিমশিম খাচ্ছেন ছাত্রলীগের একের পর এক হামলা, অবরোধ, মামলা আর পলিটিক্স মোকাবেলা করতে। সবমিলিয়ে নয় দিন ধরে কার্যত অচল হয়ে আছে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষা চলাকালে ৪ নভেম্বর ভর্তি জালিয়াতির দায়ে ছাত্রলীগের দুই নেতা হাবিপ্রবি শাখার সাধারণ সম্পাদক অরুণ কান্তি রায় ও জাহিদ হাসানকে সাময়িক বহিষ্কার করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে হামলা, ভাংচুর, প্রতিপক্ষকে মারধর ও হাত-পা ভেঙে দেয়া, শিক্ষকদের লাঞ্ছনা ও গুলি করে হত্যার হুমকি প্রদান, টেন্ডারবাজি হুমকি এবং চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে ছাত্রলীগের এ আন্দোলন।
ছাত্রলীগ নেতা অরুণ কান্তি রায় বুধবার যুগান্তরকে বলেন, বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার আর ভিসি প্রফেসর রুহুল আমিনের অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে।
এ আন্দোলনে বুধবার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা বিভাগের পরিচালক প্রফেসর শাহাদত হোসেন খান লিখনসহ ৪ শিক্ষককে তার কক্ষে তালা মেরে অবরুদ্ধ করে রাখে। বাইরে বিক্ষোভও করে তারা। পরে শিক্ষক-কর্মচারীরা একত্রিত হয়ে তালা ভেঙে শিক্ষকদের উদ্ধার করেন। কদিন ধরে চলমান শিক্ষক-ছাত্রলীগ উত্তেজনা এ নিয়ে আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
শিক্ষকরা বলছেন, মাত্র ১০ জন কথিত ছাত্রনেতার কাছে জিম্মি হাবিপ্রবির শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অবরোধ, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ভর্তি বাণিজ্য, শিক্ষক-কর্মচারী-শিক্ষার্থীদের মারধর, পিস্তল দেখিয়ে শিক্ষককে গুলি করে হত্যার হুমকি এবং ছাত্রীদের যৌন হয়রানিসহ এমন কোনো কাজ নেই যা তারা করছে না। এদের কারণে প্রাণও হারিয়েছেন কয়েকজন, অনেকেই বরণ করেছেন পঙ্গু জীবন। লেখাপড়ার পরিবেশই নষ্ট হয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথচ এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিলেই কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়।
কথা হচ্ছিল কৃষি প্রকৌশল বিভাগের লেভেল ফোরের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। ছাত্রলীগের ভয়ে নাম জানাতে অপারগতা জানান তারা। বলেন, শিক্ষক সংকটসহ নানা কারণে এমনিতেই প্রায় দুবছর শেসনজটে পড়ে আছি আমরা। এরপর একের পর এক পরীক্ষা বাতিল হচ্ছেই। পড়ালেখাও করতে পারছি না, আবার বাড়িতেও যেতে পারছি না। ছাত্রলীগের নেতারা হলে হলে গিয়ে কে কে আছে তার তালিকা নিয়েছে। নির্দেশ দিয়েছে মিছিল-মিটিংয়ে থাকার। অন্যথা হলে সিট বাতিলের হুমকি দিয়ে গেছে তারা। অভিজ্ঞতার কারণে এ হুমকি তুচ্ছজ্ঞান করার সাহস নেই কারও। এ শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ছাত্রলীগের কোনো কর্মসূচি থাকলেই ক্লাস-পরীক্ষা বাদ দিয়ে তাদের কর্মসূচিতে যেতে হয়। না গেলে সিট বাতিল, মারধরসহ নানা হয়রানির শিকার হতে হয়।
দীর্ঘ ১২ বছর ধরে হাবিপ্রবিতে লেখাপড়া করছেন ছাত্রলীগের সভাপতি ইফতেখারুল ইসলাম রিয়েল ও সাধারণ সম্পাদক অরুণ কান্ত রায় সিটন। এ সুযোগে ১০ সদস্যের একটি অভ্যন্তরীণ দল গঠন করে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। তাদের মতের বাইরে কেউ গেলে বা কথা না শুনলে নেমে আসে অন্ধকার। কদিন আগে তারা সহযোগী অধ্যাপক নওশের ওয়ান (ইংরেজি), ফুড প্রসেসিং অ্যান্ড প্রিজারভেশন বিভাগের প্রভাষক মো. রায়হানুল হক ও ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. কুতুব উদ্দীনকে লাঞ্ছিত করে এবং অধ্যাপক কুতুবউদ্দীনের কাছে তারা মোটা অংকের চাঁদাও দাবি করে।
নিয়োগ ও ভর্তি বাণিজ্য : বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী হিসাবে প্রায় অর্ধশত নিয়োগে বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে ওই ১০ জনের বিরুদ্ধে। নতুন কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ পেলেই প্রকারভেদে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয় তাদের। না দিলে ওই শিক্ষক-কর্মচারীকে জামায়াত-শিবিরের সমর্থক বানিয়ে হেনস্থা করা হয়। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগত শিক্ষার্থীদের ১ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত টাকা দিতে হয় তাদের।
চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি : ইফতেখারুল ইসলাম রিয়েল, অরুণ কান্তি রায়, জাহিদ হাসান ও সিফাতসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজির অভিযোগ মুখে মুখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ভবন নির্মাণের সব কাজে ২ থেকে ৫% হারে আগাম দিয়ে করতে হচ্ছে ঠিকাদারি। চাঁদাবাজির টাকা ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ভেটেরিনারি অনুষদের শেষ বর্ষের মেধাবী ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ শাখার সহসভাপতি ফাহিম মাহফুজ বিপুল হত্যার শিকার হন। প্রতি মাসে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও দিবসের নাম করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চাঁদা নেয়াটা প্রকাশ্য।
পাল্টা অভিযোগ : উল্টো শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ করে ক্যাম্পাসে পোস্টার সাঁটিয়েছে ছাত্রলীগ। তাদের কথিত আন্দোলনে বাধা দেয়ায় শিক্ষককে দিয়ে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। এ নিয়ে মামলা হলে উল্টো শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও মামলা করেছে তারা। অভিযোগ করেছে, তাদের শিক্ষাজীবন নষ্ট করে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন শিক্ষকরা!
তালাবাজি : হাবিপ্রবি আবাসিক হলে থাকতে হলে কথিত ওইসব ছাত্রনেতার হুকুমেই চলতে হবে, না চললে কক্ষে তালা ঝুলবে। এ কারণে দুশ তালা কিনেছে ছাত্রলীগ। মিছিল, মিটিংয়ে অংশ না নিলে কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হচ্ছে। তালা ঝোলানো হচ্ছে শিক্ষকদের কক্ষেও। সাধারণ ছাত্ররা জানায়, ছাত্রনেতাদের এ তালাবাজির সংস্কার ছাত্র রাজনীতিতে নতুন।
বিক্ষোভ : ছাত্রনেতাদের বহিষ্কারাদেশ ও থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ প্রত্যাহার দাবিতে বুধবার বেলা ১১টার দিকে ইফতেখারুল ইসলাম রিয়েলের নেতৃত্বে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সম্মুখে প্রতিবাদ সভায় বক্তারা বলেন, অবিলম্বে দুর্নীতিপরায়ণ ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর রুহুল আমিনকে অপসারণ ও তার সহযোগী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের ডিন প্রফেসর মো. আনিস খান, ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা বিভাগের পরিচালক প্রফেসর শাহাদত হোসেন খান লিখন, সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ফজলুল হক, পদার্থ বিভাগের চেয়ারম্যান মো. মোমিনুল ইসলাম, সাবেক রেজিস্ট্রার ও প্রগতিশীল শিক্ষক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ডা. বলরাম রায়ের বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতি তদন্ত করে অবিলম্বে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। সভায় বক্তব্য দেন অরুণ কান্তি রায় সিটন, প্রত্যুষ রায়, আতিকুর রহমান, আমিনুল হক, ছাত্রলীগ নেত্রী মারুফা শারমিন, মাসুমা পারভেজ, ভিয়েনা প্রমুখ।
শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : প্রগতিশীল শিক্ষক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ডা. বলরাম রায় যুগান্তরকে বলেন, তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই সবাই দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে যায়। দায়িত্বে থাকাকালে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি, এখন কেন উঠছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক রুহুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। ছাত্রলীগ যা করছে তা সম্পূর্ণ অনৈতিক। তাদের অপরাধ ঢাকতে এখন নানা অপবাদ দিয়ে আমার অপসারণ চাইছে তারা। তিনি বলেন, তদন্ত কমিটি ওই দুজনের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। কমিটির প্রতিবেদন পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। দিনাজপুর কোতোয়ালি থানার ওসি আলতাফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষক ও ছাত্র দুজনের দায়ের করা মামলারই তদন্ত চলছে।
No comments