মোড়ে পৌঁছেছি, এবার টার্ন নিতে হবে by মেজর (অব.) সুধীর সাহা
একটি দেশের অগ্রগতির জন্য, সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ৪০-৫০ বছর খুব বেশি সময় নয়। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উন্নতি নয়, একটি দেশের সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে অনেক শর্ত থাকে। যেসব দেশ সামনে এগিয়ে গেছে, সেগুলোর প্রতিটিরই সময় লেগেছে। তবে কোনো কোনো দেশের কথা আলাদা। সেগুলোর কোনো কোনোটি সোনার চামচ কিংবা তেলের ঝাঁপা মাথায় করে জন্ম নিয়েছে। তাই তাদের প্রাকৃতিক সম্পদই তাদের সামনের দিকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের কপাল তত ভালো ছিল না। অন্যদিকে, পুরো পাকিস্তানের সময়টুকুতে বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানকে দাবিয়ে রাখার সব চেষ্টাই করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকচক্র। ফলে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার প্রাক্কালে আমাদের খালি হাতেই একটি নতুন রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য যখন উঁকি দিচ্ছিল আমাদের জানালায়, ঠিক সেই সময়ে পাকিস্তানের পিশাচের দল আমাদের অনেক সূর্যসন্তানকে হত্যা করেছিল। নতুন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার চক্রান্তের একটি নীল নকশা ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। যেহেতু স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত, রাশিয়া আমাদের পাশে ছিল, তাই যুক্তরাষ্ট্র আর পাকিস্তান বৈরী মনোভাব নিয়েই দেখছিল আমাদের স্বাধীনতার পর থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব পরবর্তী সময়ে কিছুটা পরিবর্তিত হলেও বাংলাদেশের প্রতি পাকিস্তানের মনোভাবের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি আজ অবধি। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ নিয়ে কৌতুক করে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সেই সময়ের বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে একটি জটিল ও নাজুক উন্নয়ন সমস্যার দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল।
বিশ্বের নানা দেশে ভ্রমণের সময় যাত্রীরা যদি লাইনের বাইরে দাঁড় করানো কোনো হতভাগ্য যাত্রীকে দেখতে পেয়ে করুণার দৃষ্টিতে তাকাত, তবে সে যে বাংলাদেশের কোনো যাত্রী হবে এমনটা অনুমান করা যেত। বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী লোকটি অস্পৃশ্য, তাকে লাইনের বাইরে নিয়ে ম্যাগনিফায়িং গ্লাসে পরীক্ষা করতে হবে। কঠিন ও তীর্যক প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া যেন বাংলাদেশীদের ভাগ্যের লিখন। কখনও তারা ছাড়া পেত, প্লেন ধরতে পারত। আবার কখনও কখনও প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতেই প্লেনটি তার নাকের ডগা দিয়ে চলে যেত। পরবর্তী প্লেনের জন্য তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। ইংরেজিতে বোঝাতে না পেরে বাংলাদেশের কত যাত্রী যে ভোগান্তিতে পড়েছে তা হিসাব করে বলার উপায় নেই।
মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো শহর থেকে প্লেনে উঠলেই শত শত বাঙালি শ্রমজীবী কর্মী পাবেন। বিমানে বসা থেকে শুরু করে খাওয়া- সর্বত্রই তাদের ব্যবহারিক সমস্যা আছে। তারা চিৎকার করে কথা বলে। অযথাই হাঁটাহাঁটি করে। তাদের ব্যবহার নিয়ে বিমানবালাদেরও বিরক্তির শেষ নেই। এয়ারপোর্ট সংক্রান্ত কোনো ফরম পূরণ করতে হলে তারা সমস্যায় পড়ে। পাশের কোনো শিক্ষিত লোককে অনুরোধ করে তার ফরমটি পূরণ করে দিতে। এসব সমস্যা আমাদের আছে দীর্ঘদিন ধরে। শ্রীলংকা, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন থেকেও বিদেশে যায় প্রচুর শ্রমিক। তবে তাদের জানার পরিধি আমাদের শ্রমিকদের থেকে বেশি হওয়ায় তারা রাস্তায় কোনো সমস্যায় পড়ে না। শ্রমিকদের শিক্ষা, কারিগরি জ্ঞান, ব্যবহার, কোনো কিছুর প্রশিক্ষণেই আমাদের রাষ্ট্র খুব বেশি মনোযোগী ছিল না কখনও। তাই তো গ্রামবাংলার অশিক্ষিত শ্রমিক যখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশে যাচ্ছে, তাদের কাঁচা স্বভাব পরিবর্তন করার সুযোগ সে পাচ্ছে না। এমন অপরিপক্ব জ্ঞানের জন্য কাকে দায়ী করা যায় সে প্রশ্ন রয়েই যাবে। তবে পাশাপাশি সাফিয়ার মতো আমাদের বীর গৃহকর্মীও আছেন, যাকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। আমিরাতে গৃহকর্মীর কাজ করতেন সাফিয়া। সাফিয়া নিজের জীবন দিয়ে আবুধাবির সমুদ্র সৈকতে ডুবন্ত চার শিশুকে প্রাণে বাঁচান। মনিবের সন্তানকে বাঁচাতে গিয়ে সাফিয়া নিজের জীবন দান করে গেছেন। এই সাফিয়া আর আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। কিন্তু তিনি হাজার সাফিয়াকে উদ্বুদ্ধ করে গেলেন নিজের জীবন দিয়ে।
ভদ্রলোক বাংলাদেশের। অনেক বছর বিশ্ব সংস্থার বিভিন্ন দেশে চাকরি করে বিশ বছর ধরে কানাডায় থাকেন। গ্রীষ্মে কানাডা এবং শীতে বাংলাদেশে থাকবেন এই আশায় তিনি ঢাকার বনানীতে একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয় করেন। তিন বছর কাটে এভাবে। কিন্তু তিন বছর পর গত বছর থেকে ভদ্রলোক বনানীর অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করে মালয়েশিয়ায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয় করে শীতের সময় বাংলাদেশের পরিবর্তে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে বসবাস শুরু করেন। কেন বাংলাদেশ ছাড়তে হল এমন একটি প্রশ্ন করে, আমার মনে হল, আমি যেন মৌচাকে ঢিল দিয়ে বসেছি। ভদ্রলোক ঢাকা, বাংলাদেশ এবং তার পরিচিত ঢাকাবাসীকে নিয়ে যত নেগেটিভ কথা বলা যায় সবই বলে গেলেন একদমে। তার কাছে তার মাতৃভূমি একেবারেই বসবাসের অনুপযোগী মনে হয়েছে। রাস্তার যানজট, প্রতিবেশীর মন্দ ব্যবহার, সরকারি অফিসের দুর্নীতি, চলাচলের পরাধীনতা, খাবার জিনিসে ভেজাল, রাজনৈতিক সহিংসতাসহ অনেক বিষয়ই তার বিরাগের কারণ হিসেবে কাজ করেছে। ভদ্রলোক বেশ কয়েকটি বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে নিজ দেশের প্রতি এমন বিরাগভাজন হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করছিলেন।
এসব বাস্তবতা স্বীকার করেও বলতে ইচ্ছা হয়, বাংলাদেশ সামনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নেই, দুর্নীতি একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা, প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়ম আর অব্যবস্থা বিদ্যমান। তারপরও বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের দিকে ধাবিত হচ্ছে দ্রুতগতিতে। গ্রস ন্যাশনাল ইনকাম (জিএনআই) হল মধ্যম আয় মাপার মাধ্যম। নিু আয় ধরা হয় ১,০২৫ ডলার পর্যন্ত। নিু মধ্যম আয় ১,০২৬ থেকে ৪,০৩৫ ডলার। বাংলাদেশের বর্তমান মাথাপিছু জিএনআই ৮৫১ ডলার। এই জিএনআই অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশের ৫০তম স্বাধীনতাবার্ষিকীতে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে ঘোষণা দেয়া সম্ভব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ বন্যা, দুর্যোগ মোকাবেলা করছে প্রতিনিয়ত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এর অবস্থা নাজুক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর নিত্যসঙ্গী। বাংলাদেশের রাজনীতি সংঘাতময়। শাসন ব্যবস্থা এখানে দুর্বল। এরপর আছে বিশ্ব সমাজের প্রভাবশালীদের চাপ। সবকিছু সত্ত্বেও বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। স্বাধীনতার পর যেসব দেশ বিরূপ মন্তব্য করেছিল, বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই তাদের ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে। ঘনবসতিপূর্ণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ বাংলাদেশও টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব করেছে; সুলভ শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে রফতানিনির্ভর অর্থনীতি রেখেছে সমুন্নত। অনেক সামাজিক সূচকে প্রতিবেশী জায়েন্ট
ভারতকে বৃদ্ধাঙুলি দেখাতে পেরেছে বাংলাদেশ। প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল যেখানে ভারতে ৬৬, সেখানে বাংলাদেশে ৬৯। শিশু মৃত্যুর হার ভারতে ৪৪ এবং বাংলাদেশে ৩৭। জন্মহার ভারতে ২ দশমিক ৫ আর বাংলাদেশে ২ দশমিক ২। নারীশিক্ষার হার ভারতে ৭৪ আর বাংলাদেশে ৮০। অপুষ্টির হার ভারতে ১৮ আর বাংলাদেশে ১৭। বাংলাদেশে সামাজিক সূচকের উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পরিবার পরিকল্পনা এবং নারী-পুরুষের সমতা বিষয়ে বাংলাদেশের সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে। সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংকসহ অন্যান্য এনজিও এবং নারী উদ্যোক্তারা। বিশেষ করে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী খুব বড় করে ধন্যবাদ পেতে পারেন। প্রথমবারের জন্য নারী জাগরণের বাঁশিটি প্রকৃতপক্ষে তিনিই অফিসিয়ালি বাজিয়েছেন।
আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় আছি, যেদিন আর পৃথিবীর রাস্তাঘাটে বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীদের অযথা নাজেহাল হতে হবে না। বাংলাদেশের শ্রমিকরা আর দৌড়াবে না বিদেশের মাটিতে। বরং নিজের দেশে তারা শ্রম দেবে নিরলসভাবে। সাফিয়ারা আর দুবাই-আবুধাবিতে মনিবের শিশুকে উদ্ধার করতে গিয়ে সাগরে প্রাণ দিবে না। কানাডার বাঙালি ভদ্রলোকের মনের ক্ষোভ আর অন্য কোনো প্রবাসীর মনে জেগে উঠবে না। বাংলাদেশ জেগে উঠবেই একদিন। আর সেদিন এখন আর কল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া আগামী দিনের বাস্তবতা। এটা আরও ত্বরান্বিত হবে যদি আমরা রাজনীতিকে কিছুটা সংঘাতহীন করতে পারি, দুর্নীতির রশিকে কিছুটা টেনে রাখতে পারি এবং সুশাসনের বলয় উপহার দিতে পারি। ১৯৭১-এর বাংলাদেশ ২০১৪-তে দাঁড়িয়ে সত্যি সত্যি একটি শক্ত অবস্থানের ঘোষণা দিচ্ছে।
মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক
বিশ্বের নানা দেশে ভ্রমণের সময় যাত্রীরা যদি লাইনের বাইরে দাঁড় করানো কোনো হতভাগ্য যাত্রীকে দেখতে পেয়ে করুণার দৃষ্টিতে তাকাত, তবে সে যে বাংলাদেশের কোনো যাত্রী হবে এমনটা অনুমান করা যেত। বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী লোকটি অস্পৃশ্য, তাকে লাইনের বাইরে নিয়ে ম্যাগনিফায়িং গ্লাসে পরীক্ষা করতে হবে। কঠিন ও তীর্যক প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া যেন বাংলাদেশীদের ভাগ্যের লিখন। কখনও তারা ছাড়া পেত, প্লেন ধরতে পারত। আবার কখনও কখনও প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতেই প্লেনটি তার নাকের ডগা দিয়ে চলে যেত। পরবর্তী প্লেনের জন্য তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। ইংরেজিতে বোঝাতে না পেরে বাংলাদেশের কত যাত্রী যে ভোগান্তিতে পড়েছে তা হিসাব করে বলার উপায় নেই।
মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো শহর থেকে প্লেনে উঠলেই শত শত বাঙালি শ্রমজীবী কর্মী পাবেন। বিমানে বসা থেকে শুরু করে খাওয়া- সর্বত্রই তাদের ব্যবহারিক সমস্যা আছে। তারা চিৎকার করে কথা বলে। অযথাই হাঁটাহাঁটি করে। তাদের ব্যবহার নিয়ে বিমানবালাদেরও বিরক্তির শেষ নেই। এয়ারপোর্ট সংক্রান্ত কোনো ফরম পূরণ করতে হলে তারা সমস্যায় পড়ে। পাশের কোনো শিক্ষিত লোককে অনুরোধ করে তার ফরমটি পূরণ করে দিতে। এসব সমস্যা আমাদের আছে দীর্ঘদিন ধরে। শ্রীলংকা, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন থেকেও বিদেশে যায় প্রচুর শ্রমিক। তবে তাদের জানার পরিধি আমাদের শ্রমিকদের থেকে বেশি হওয়ায় তারা রাস্তায় কোনো সমস্যায় পড়ে না। শ্রমিকদের শিক্ষা, কারিগরি জ্ঞান, ব্যবহার, কোনো কিছুর প্রশিক্ষণেই আমাদের রাষ্ট্র খুব বেশি মনোযোগী ছিল না কখনও। তাই তো গ্রামবাংলার অশিক্ষিত শ্রমিক যখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশে যাচ্ছে, তাদের কাঁচা স্বভাব পরিবর্তন করার সুযোগ সে পাচ্ছে না। এমন অপরিপক্ব জ্ঞানের জন্য কাকে দায়ী করা যায় সে প্রশ্ন রয়েই যাবে। তবে পাশাপাশি সাফিয়ার মতো আমাদের বীর গৃহকর্মীও আছেন, যাকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। আমিরাতে গৃহকর্মীর কাজ করতেন সাফিয়া। সাফিয়া নিজের জীবন দিয়ে আবুধাবির সমুদ্র সৈকতে ডুবন্ত চার শিশুকে প্রাণে বাঁচান। মনিবের সন্তানকে বাঁচাতে গিয়ে সাফিয়া নিজের জীবন দান করে গেছেন। এই সাফিয়া আর আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। কিন্তু তিনি হাজার সাফিয়াকে উদ্বুদ্ধ করে গেলেন নিজের জীবন দিয়ে।
ভদ্রলোক বাংলাদেশের। অনেক বছর বিশ্ব সংস্থার বিভিন্ন দেশে চাকরি করে বিশ বছর ধরে কানাডায় থাকেন। গ্রীষ্মে কানাডা এবং শীতে বাংলাদেশে থাকবেন এই আশায় তিনি ঢাকার বনানীতে একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয় করেন। তিন বছর কাটে এভাবে। কিন্তু তিন বছর পর গত বছর থেকে ভদ্রলোক বনানীর অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করে মালয়েশিয়ায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয় করে শীতের সময় বাংলাদেশের পরিবর্তে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে বসবাস শুরু করেন। কেন বাংলাদেশ ছাড়তে হল এমন একটি প্রশ্ন করে, আমার মনে হল, আমি যেন মৌচাকে ঢিল দিয়ে বসেছি। ভদ্রলোক ঢাকা, বাংলাদেশ এবং তার পরিচিত ঢাকাবাসীকে নিয়ে যত নেগেটিভ কথা বলা যায় সবই বলে গেলেন একদমে। তার কাছে তার মাতৃভূমি একেবারেই বসবাসের অনুপযোগী মনে হয়েছে। রাস্তার যানজট, প্রতিবেশীর মন্দ ব্যবহার, সরকারি অফিসের দুর্নীতি, চলাচলের পরাধীনতা, খাবার জিনিসে ভেজাল, রাজনৈতিক সহিংসতাসহ অনেক বিষয়ই তার বিরাগের কারণ হিসেবে কাজ করেছে। ভদ্রলোক বেশ কয়েকটি বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে নিজ দেশের প্রতি এমন বিরাগভাজন হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করছিলেন।
এসব বাস্তবতা স্বীকার করেও বলতে ইচ্ছা হয়, বাংলাদেশ সামনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নেই, দুর্নীতি একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা, প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়ম আর অব্যবস্থা বিদ্যমান। তারপরও বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের দিকে ধাবিত হচ্ছে দ্রুতগতিতে। গ্রস ন্যাশনাল ইনকাম (জিএনআই) হল মধ্যম আয় মাপার মাধ্যম। নিু আয় ধরা হয় ১,০২৫ ডলার পর্যন্ত। নিু মধ্যম আয় ১,০২৬ থেকে ৪,০৩৫ ডলার। বাংলাদেশের বর্তমান মাথাপিছু জিএনআই ৮৫১ ডলার। এই জিএনআই অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশের ৫০তম স্বাধীনতাবার্ষিকীতে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে ঘোষণা দেয়া সম্ভব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ বন্যা, দুর্যোগ মোকাবেলা করছে প্রতিনিয়ত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এর অবস্থা নাজুক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর নিত্যসঙ্গী। বাংলাদেশের রাজনীতি সংঘাতময়। শাসন ব্যবস্থা এখানে দুর্বল। এরপর আছে বিশ্ব সমাজের প্রভাবশালীদের চাপ। সবকিছু সত্ত্বেও বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। স্বাধীনতার পর যেসব দেশ বিরূপ মন্তব্য করেছিল, বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই তাদের ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে। ঘনবসতিপূর্ণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ বাংলাদেশও টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব করেছে; সুলভ শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে রফতানিনির্ভর অর্থনীতি রেখেছে সমুন্নত। অনেক সামাজিক সূচকে প্রতিবেশী জায়েন্ট
ভারতকে বৃদ্ধাঙুলি দেখাতে পেরেছে বাংলাদেশ। প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল যেখানে ভারতে ৬৬, সেখানে বাংলাদেশে ৬৯। শিশু মৃত্যুর হার ভারতে ৪৪ এবং বাংলাদেশে ৩৭। জন্মহার ভারতে ২ দশমিক ৫ আর বাংলাদেশে ২ দশমিক ২। নারীশিক্ষার হার ভারতে ৭৪ আর বাংলাদেশে ৮০। অপুষ্টির হার ভারতে ১৮ আর বাংলাদেশে ১৭। বাংলাদেশে সামাজিক সূচকের উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পরিবার পরিকল্পনা এবং নারী-পুরুষের সমতা বিষয়ে বাংলাদেশের সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে। সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংকসহ অন্যান্য এনজিও এবং নারী উদ্যোক্তারা। বিশেষ করে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী খুব বড় করে ধন্যবাদ পেতে পারেন। প্রথমবারের জন্য নারী জাগরণের বাঁশিটি প্রকৃতপক্ষে তিনিই অফিসিয়ালি বাজিয়েছেন।
আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় আছি, যেদিন আর পৃথিবীর রাস্তাঘাটে বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীদের অযথা নাজেহাল হতে হবে না। বাংলাদেশের শ্রমিকরা আর দৌড়াবে না বিদেশের মাটিতে। বরং নিজের দেশে তারা শ্রম দেবে নিরলসভাবে। সাফিয়ারা আর দুবাই-আবুধাবিতে মনিবের শিশুকে উদ্ধার করতে গিয়ে সাগরে প্রাণ দিবে না। কানাডার বাঙালি ভদ্রলোকের মনের ক্ষোভ আর অন্য কোনো প্রবাসীর মনে জেগে উঠবে না। বাংলাদেশ জেগে উঠবেই একদিন। আর সেদিন এখন আর কল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া আগামী দিনের বাস্তবতা। এটা আরও ত্বরান্বিত হবে যদি আমরা রাজনীতিকে কিছুটা সংঘাতহীন করতে পারি, দুর্নীতির রশিকে কিছুটা টেনে রাখতে পারি এবং সুশাসনের বলয় উপহার দিতে পারি। ১৯৭১-এর বাংলাদেশ ২০১৪-তে দাঁড়িয়ে সত্যি সত্যি একটি শক্ত অবস্থানের ঘোষণা দিচ্ছে।
মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক
No comments