অর্থনীতিতে সুদের থাবা প্রধানমন্ত্রী অন্ধকারে
ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের আগ্রাসী থাবায় আক্রান্ত দেশের সার্বিক অর্থনীতি। এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় অর্থনীতির বহুমুখী ক্ষতি হলেও প্রধানমন্ত্রীকে রাখা হয়েছে অন্ধকারে। এতে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও হুমকির মুখে পড়েছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে শিল্প খাতে বিনিয়োগ। অস্বাভাবিক চড়া সুদে বিনিয়োগকারীরা ঋণ নিতে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় ব্যাংকিং খাতও অচলপ্রায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের এই বন্ধ্যাত্বে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব দূর করার প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্র“তিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শিল্পায়ন ব্যাহত হলে তা ভবিষ্যৎ অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। অথচ একশ্রেণীর মন্ত্রী-আমলা উচ্চ সুদের এসব বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে গোপন করে অর্থনীতিকে উল্টো দিকে ঠেলে দেয়ার প্রয়াস চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া মাত্রাতিরিক্ত সুদের কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়। যার প্রভাবে বেড়ে যায় পণ্যমূল্য। আর এই সুযোগে নিুমানের ও কম মূল্যের পণ্য আমদানি করে দেশের বাজারে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। মার খাচ্ছে উঁচু মানের দেশীয় পণ্য।
সূত্র জানায়, ঋণের সুদের হার কমানোর বিষয়ে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি করা হলেও সরকারের নীতি-নির্ধারকরা এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। তাদের এই উদাসীনতায় ব্যাংকগুলো জেঁকে বসেছে উচ্চ সুদের নামে মহাজনি ব্যবসার জাল পেতে। একে একে সবকিছু গ্রাস করে নিচ্ছে উচ্চ সুদের এ কঠিন ও জটিল ফাঁদ। অথচ সরকারের নীতি-নির্ধারকরা অর্থনীতির এই ভয়াবহ সংকটের সব সতর্কবার্তাকে অবলীলায় উড়িয়ে দিচ্ছেন।
সূত্র জানায়, দীর্ঘ সময় ধরে চলা বিনিয়োগে ভয়াবহ মন্দার মধ্যেও ব্যাংকগুলো ঋণের উচ্চ সুদের নামে মহাজনি ব্যবসায় লিপ্ত। একদিকে চড়া সুদ, অন্যদিকে ৩ মাস পর পর ঋণের সঙ্গে সুদ যোগ করে মূল ঋণের পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে। ফলে বেড়ে যাচ্ছে ঋণের অংক। ঋণের বিপরীতে আবার নেয়া হচ্ছে নানা নামে সার্ভিস চার্জ ও কমিশন। এসব কিছু ঋণের সুদের হার আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর ঘোষিত সুদের হার ১৪ থেকে ১৭ শতাংশ বেড়ে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ২২ থেকে ২৪ শতাংশে। এছাড়া রয়েছে নানা ধরনের ‘উপরি’ খরচ। সবকিছু মিটিয়ে উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। এর বাইরে নিরবচ্ছিন্নভাবে মিলছে না গ্যাস ও বিদ্যুৎ। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান চালু হওয়ার পর বেশিদিন টিকে থাকতে পারছে না। আর্থিক সংকটে পড়ে নিয়মিত ঋণ শোধ করতে না পেরে হয়ে যাচ্ছেন ঋণ খেলাপি। যা ব্যাংকিং খাতে এখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
এদিকে দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে লুট করা হচ্ছে। ঋণ নিয়ে খেলাপি বনে পুরো টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অসৎ চক্র। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আমানতকারীদের সঞ্চয় লুটেপুটে খাচ্ছে কিছু রাঘব বোয়াল। ফলে ব্যাংকগুলো রীতিমতো ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এই ঝুঁকি কমাতে গিয়ে ব্যাংকগুলো এখন ঋণের বিপরীতে উচ্চ সুদ আরোপ করছে। এতে নাকাল হচ্ছেন শিল্প মালিকরা। ফলে তারা এখন হাত গুটিয়ে বসে আছেন। বিনিয়োগ করছেন না। বিনিয়োগ না হওয়ায় ঋণের চাহিদা বাড়ছে না। ফলে ব্যাংকগুলোতে জমেছে অলস অর্থের পাহাড়। এ অলস টাকার বোঝা নিয়ে ব্যাংকগুলো এখন আরও বেকায়দায়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক এমকে মুজেরি যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদ যদিও কমে আসছে, কিন্তু এখনও সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে আসেনি। সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিট হলে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে পারবে। এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, বিনিয়োগের পথে কয়েকটি বাধার মধ্যে ব্যাংক ঋণের সুদ একটি বাধা। তবে গুরুত্বপূর্ণ আরও বাধা রয়েছে। ব্যাংকের সুদের হার কমানোর প্রয়োজনীয়তা আছে। এজন্য ব্যাংক ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। বিভিন্ন স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে। এসবের মাধ্যমে সুদের হার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
অর্থনীতিবিদরা জানান, দেশের অর্থনীতিতে বিনিয়োগ রক্ত সঞ্চালনের মতো কাজ করে। কিন্তু সেই রক্ত সঞ্চালন দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাহত হওয়ায় এখন অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাবগুলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে। এই অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে অর্থনৈতিক সংকট ভয়াবহ রূপ নেবে। এসব বিবেচনায় নিয়ে এখনই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
এদিকে উদ্যোক্তারা জানান, ব্যাংকিং খাতের বিষয়ে সরকারের ভুল নীতি এবং চরম উদাসীনতার কারণে দেশের শিল্প খাত বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। যা ব্যাংক ও শিল্প খাতসহ দেশের গোটা অর্থনীতিকে নিয়ে একেবারে ধসে পড়ার মতো অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু এই আশংকা নিয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের কারও কোনো মাথাব্যথা নেই।
সূত্র জানায়, দেশের সিংহভাগ কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে বেসরকারি খাতে। কিন্তু ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের কারণে এ খাত সম্প্রসারিত হচ্ছে না। চড়া সুদের কারণে উদ্যোক্তারা ঋণ নিচ্ছেন না। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে না পাড়ায় অনেকে খেলাপি হয়ে পড়ছেন। ফলে গড়ে তোলা শিল্প প্রতিষ্ঠানও আর চালু রাখতে পারছেন না উদ্যোক্তারা। এ রকম পরিস্থিতিতে শিল্প খাত নাজুক হলেও সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিরা রহস্যজনক কারণে নীরব ভূমিকা পালন করছেন। তাদের এই ভূমিকায় পুরো শিল্প খাত আজ হুমকির মধ্যে পড়েছে।
জানা গেছে, ব্যাংক ঋণের সুদের ব্যাপারে এক শ্রেণীর পরামর্শদাতা প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে পরিস্থিতি পর্যালোচনায় এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এসব পরামর্শদাতা হয় ব্যাংকের বর্ধিত সুদের হারের অন্তর্নিহিত ভয়াবহ ক্ষতির বিষয়ে কিছুই জানেন না, অথবা জানলেও ভিন্ন উদ্দেশ্যে তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে গোপন করে চলেছেন। তারা আসলে ভুল পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ধোঁকা দিচ্ছেন। এটি দেশের শিল্পায়নের বিরুদ্ধে একটি গভীর ষড়যন্ত্র। কিন্তু এতে করে দেশ ও দেশের অর্থনীতির ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে। গোটা ব্যাংক ব্যবস্থা ধাবিত হচ্ছে ধ্বংসের দিকে।
এদিকে বিনিয়োগ না হওয়ায় দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ৩ বছরে দেশে বিনিয়োগ না হওয়ায় প্রতি বছর গড়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ হারে। বিনিয়োগ না হলে এই হার আরও কমে যাবে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা।
সম্প্রতি বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার কমে যাবে বলে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ রয়েছে সরল হারে অর্থাৎ ঋণের মূল টাকার ওপর বছর হিসাবে সুদ আরোপ করার। কিন্তু ব্যাংকগুলো সাম্প্রতিক সময়ে এই নির্দেশ মানছে না। তারা হিসাবের মারপ্যাঁচের মাধ্যমে ঋণের বিপরীতে চক্রবৃদ্ধি হারে বা সুদের ওপর সুদ আরোপ করছে। ৩ মাস পর পর ঋণের সুদ মূল ঋণের সঙ্গে যোগ করে ঋণের অংক বাড়িয়ে তুলছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে সুদের হার। ফলে ঋণ আর পরিশোধ হয় না। সুদ ও মূল টাকার অংক বাড়তেই থাকে।
সুদের হারের এই ধরনের হিসাব পদ্ধতির জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংককে দোষারোপ করছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালার আওতায় ৩ মাস পর পর ঋণ শ্রেণীকরণ, প্রভিশনিং, স্থগিত সুদ, আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করতে বাধ্য করায় ব্যাংকগুলোও তা করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী সুদ আদায় করতে না পারলে তা আয় খাতে নেয়া যায় না। আর তা নিতে না পারলে আয় বাড়ে না। ফলে ব্যাংকারদের পর্ষদ থেকে চাপে থাকতে হয়। এ কারণে তারা যেভাবেই হোক সুদ আদায়ের দিকে নজর রাখে বেশি। এতে গড়ে সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে।
প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে সুদের হার অনেক বেশি। ব্যাংকগুলো যেমন ইচ্ছাকৃতভাবে সুদের হার বাড়াচ্ছে, তেমনি পদ্ধতিগত জটিলতায়ও সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে। ভারতে শিল্প ঋণের গড় সুদের হার ৯ শতাংশ। ভারি শিল্প স্থাপন করলে সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্যোক্তাদের ৭ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে। নিয়মিত ঋণ শোধ করলে সুদের ওপর বিশেষ ছাড় দিচ্ছে। এতে করে নিট সুদের হার কমে যাচ্ছে।
শ্রীলংকায় পরিবেশবান্ধব ও উৎপাদনমুখী খাতে শিল্প ঋণের সুদের হার ৮ থেকে ১২ শতাংশ। পাকিস্তানে ওইসব খাতে ৯ থেকে ১২ শতাংশ। এসব দেশে নিয়মিত ঋণ শোধ করলে বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা রয়েছে। রফতানিমুখী শিল্প স্থাপন করলে এ হার আরও কম।
লিবিয়ায় শিল্প স্থাপন করলে সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনোরকম সুদ ছাড়াই ঋণ দেয়া হয়। ইউরোপের দেশগুলোতে ঋণের সুদের হার আরও কম। ওইসব দেশে আড়াই থেকে ৬ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে বর্তমানে উদ্যোক্তারা দেশী ব্যাংকের পরিবর্তে বিদেশ থেকে কম সুদে ঋণ নিচ্ছেন। এতে দেশী ব্যাংকে অলস টাকার পাহাড় জমেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রফতানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (ইএবি) প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম মুর্শেদী বুধবার যুগান্তরকে বলেন, আমি মনে করি সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেয়ার। সরকারি ব্যাংকগুলো সুদের হার কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো সরকারের একটি অংশ। তাদেরও এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে হলে টার্ম লোনের পরে সুদের ওপর ক্যাপিং করে দিতে হবে। সুদের হারের ওপর এই ক্যাপিং করে দিলে বিনিয়োগের খরা কেটে যাবে। এখন ট্যাক্স হলিডে আছে, সঙ্গে ঋণের সুদের হার কমলে বিনিয়োগে অনেকে উৎসাহিত হবে। কর্মসংস্থান বাড়বে। আমি মনে করি, মেয়াদি ঋণের পর সুদের হারের ওপর একটি ক্যাপিং করার উপযুক্ত সময় এখন।
সূত্র জানায়, ঋণের সুদের হার কমানোর বিষয়ে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি করা হলেও সরকারের নীতি-নির্ধারকরা এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। তাদের এই উদাসীনতায় ব্যাংকগুলো জেঁকে বসেছে উচ্চ সুদের নামে মহাজনি ব্যবসার জাল পেতে। একে একে সবকিছু গ্রাস করে নিচ্ছে উচ্চ সুদের এ কঠিন ও জটিল ফাঁদ। অথচ সরকারের নীতি-নির্ধারকরা অর্থনীতির এই ভয়াবহ সংকটের সব সতর্কবার্তাকে অবলীলায় উড়িয়ে দিচ্ছেন।
সূত্র জানায়, দীর্ঘ সময় ধরে চলা বিনিয়োগে ভয়াবহ মন্দার মধ্যেও ব্যাংকগুলো ঋণের উচ্চ সুদের নামে মহাজনি ব্যবসায় লিপ্ত। একদিকে চড়া সুদ, অন্যদিকে ৩ মাস পর পর ঋণের সঙ্গে সুদ যোগ করে মূল ঋণের পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে। ফলে বেড়ে যাচ্ছে ঋণের অংক। ঋণের বিপরীতে আবার নেয়া হচ্ছে নানা নামে সার্ভিস চার্জ ও কমিশন। এসব কিছু ঋণের সুদের হার আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর ঘোষিত সুদের হার ১৪ থেকে ১৭ শতাংশ বেড়ে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ২২ থেকে ২৪ শতাংশে। এছাড়া রয়েছে নানা ধরনের ‘উপরি’ খরচ। সবকিছু মিটিয়ে উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। এর বাইরে নিরবচ্ছিন্নভাবে মিলছে না গ্যাস ও বিদ্যুৎ। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান চালু হওয়ার পর বেশিদিন টিকে থাকতে পারছে না। আর্থিক সংকটে পড়ে নিয়মিত ঋণ শোধ করতে না পেরে হয়ে যাচ্ছেন ঋণ খেলাপি। যা ব্যাংকিং খাতে এখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
এদিকে দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে লুট করা হচ্ছে। ঋণ নিয়ে খেলাপি বনে পুরো টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অসৎ চক্র। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আমানতকারীদের সঞ্চয় লুটেপুটে খাচ্ছে কিছু রাঘব বোয়াল। ফলে ব্যাংকগুলো রীতিমতো ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এই ঝুঁকি কমাতে গিয়ে ব্যাংকগুলো এখন ঋণের বিপরীতে উচ্চ সুদ আরোপ করছে। এতে নাকাল হচ্ছেন শিল্প মালিকরা। ফলে তারা এখন হাত গুটিয়ে বসে আছেন। বিনিয়োগ করছেন না। বিনিয়োগ না হওয়ায় ঋণের চাহিদা বাড়ছে না। ফলে ব্যাংকগুলোতে জমেছে অলস অর্থের পাহাড়। এ অলস টাকার বোঝা নিয়ে ব্যাংকগুলো এখন আরও বেকায়দায়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক এমকে মুজেরি যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদ যদিও কমে আসছে, কিন্তু এখনও সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে আসেনি। সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিট হলে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে পারবে। এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, বিনিয়োগের পথে কয়েকটি বাধার মধ্যে ব্যাংক ঋণের সুদ একটি বাধা। তবে গুরুত্বপূর্ণ আরও বাধা রয়েছে। ব্যাংকের সুদের হার কমানোর প্রয়োজনীয়তা আছে। এজন্য ব্যাংক ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। বিভিন্ন স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে। এসবের মাধ্যমে সুদের হার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
অর্থনীতিবিদরা জানান, দেশের অর্থনীতিতে বিনিয়োগ রক্ত সঞ্চালনের মতো কাজ করে। কিন্তু সেই রক্ত সঞ্চালন দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাহত হওয়ায় এখন অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাবগুলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে। এই অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে অর্থনৈতিক সংকট ভয়াবহ রূপ নেবে। এসব বিবেচনায় নিয়ে এখনই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
এদিকে উদ্যোক্তারা জানান, ব্যাংকিং খাতের বিষয়ে সরকারের ভুল নীতি এবং চরম উদাসীনতার কারণে দেশের শিল্প খাত বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। যা ব্যাংক ও শিল্প খাতসহ দেশের গোটা অর্থনীতিকে নিয়ে একেবারে ধসে পড়ার মতো অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু এই আশংকা নিয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের কারও কোনো মাথাব্যথা নেই।
সূত্র জানায়, দেশের সিংহভাগ কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে বেসরকারি খাতে। কিন্তু ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের কারণে এ খাত সম্প্রসারিত হচ্ছে না। চড়া সুদের কারণে উদ্যোক্তারা ঋণ নিচ্ছেন না। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে না পাড়ায় অনেকে খেলাপি হয়ে পড়ছেন। ফলে গড়ে তোলা শিল্প প্রতিষ্ঠানও আর চালু রাখতে পারছেন না উদ্যোক্তারা। এ রকম পরিস্থিতিতে শিল্প খাত নাজুক হলেও সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিরা রহস্যজনক কারণে নীরব ভূমিকা পালন করছেন। তাদের এই ভূমিকায় পুরো শিল্প খাত আজ হুমকির মধ্যে পড়েছে।
জানা গেছে, ব্যাংক ঋণের সুদের ব্যাপারে এক শ্রেণীর পরামর্শদাতা প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে পরিস্থিতি পর্যালোচনায় এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এসব পরামর্শদাতা হয় ব্যাংকের বর্ধিত সুদের হারের অন্তর্নিহিত ভয়াবহ ক্ষতির বিষয়ে কিছুই জানেন না, অথবা জানলেও ভিন্ন উদ্দেশ্যে তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে গোপন করে চলেছেন। তারা আসলে ভুল পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ধোঁকা দিচ্ছেন। এটি দেশের শিল্পায়নের বিরুদ্ধে একটি গভীর ষড়যন্ত্র। কিন্তু এতে করে দেশ ও দেশের অর্থনীতির ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে। গোটা ব্যাংক ব্যবস্থা ধাবিত হচ্ছে ধ্বংসের দিকে।
এদিকে বিনিয়োগ না হওয়ায় দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ৩ বছরে দেশে বিনিয়োগ না হওয়ায় প্রতি বছর গড়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ হারে। বিনিয়োগ না হলে এই হার আরও কমে যাবে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা।
সম্প্রতি বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার কমে যাবে বলে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ রয়েছে সরল হারে অর্থাৎ ঋণের মূল টাকার ওপর বছর হিসাবে সুদ আরোপ করার। কিন্তু ব্যাংকগুলো সাম্প্রতিক সময়ে এই নির্দেশ মানছে না। তারা হিসাবের মারপ্যাঁচের মাধ্যমে ঋণের বিপরীতে চক্রবৃদ্ধি হারে বা সুদের ওপর সুদ আরোপ করছে। ৩ মাস পর পর ঋণের সুদ মূল ঋণের সঙ্গে যোগ করে ঋণের অংক বাড়িয়ে তুলছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে সুদের হার। ফলে ঋণ আর পরিশোধ হয় না। সুদ ও মূল টাকার অংক বাড়তেই থাকে।
সুদের হারের এই ধরনের হিসাব পদ্ধতির জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংককে দোষারোপ করছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালার আওতায় ৩ মাস পর পর ঋণ শ্রেণীকরণ, প্রভিশনিং, স্থগিত সুদ, আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করতে বাধ্য করায় ব্যাংকগুলোও তা করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী সুদ আদায় করতে না পারলে তা আয় খাতে নেয়া যায় না। আর তা নিতে না পারলে আয় বাড়ে না। ফলে ব্যাংকারদের পর্ষদ থেকে চাপে থাকতে হয়। এ কারণে তারা যেভাবেই হোক সুদ আদায়ের দিকে নজর রাখে বেশি। এতে গড়ে সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে।
প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে সুদের হার অনেক বেশি। ব্যাংকগুলো যেমন ইচ্ছাকৃতভাবে সুদের হার বাড়াচ্ছে, তেমনি পদ্ধতিগত জটিলতায়ও সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে। ভারতে শিল্প ঋণের গড় সুদের হার ৯ শতাংশ। ভারি শিল্প স্থাপন করলে সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্যোক্তাদের ৭ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে। নিয়মিত ঋণ শোধ করলে সুদের ওপর বিশেষ ছাড় দিচ্ছে। এতে করে নিট সুদের হার কমে যাচ্ছে।
শ্রীলংকায় পরিবেশবান্ধব ও উৎপাদনমুখী খাতে শিল্প ঋণের সুদের হার ৮ থেকে ১২ শতাংশ। পাকিস্তানে ওইসব খাতে ৯ থেকে ১২ শতাংশ। এসব দেশে নিয়মিত ঋণ শোধ করলে বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা রয়েছে। রফতানিমুখী শিল্প স্থাপন করলে এ হার আরও কম।
লিবিয়ায় শিল্প স্থাপন করলে সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনোরকম সুদ ছাড়াই ঋণ দেয়া হয়। ইউরোপের দেশগুলোতে ঋণের সুদের হার আরও কম। ওইসব দেশে আড়াই থেকে ৬ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে বর্তমানে উদ্যোক্তারা দেশী ব্যাংকের পরিবর্তে বিদেশ থেকে কম সুদে ঋণ নিচ্ছেন। এতে দেশী ব্যাংকে অলস টাকার পাহাড় জমেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রফতানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (ইএবি) প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম মুর্শেদী বুধবার যুগান্তরকে বলেন, আমি মনে করি সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেয়ার। সরকারি ব্যাংকগুলো সুদের হার কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো সরকারের একটি অংশ। তাদেরও এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে হলে টার্ম লোনের পরে সুদের ওপর ক্যাপিং করে দিতে হবে। সুদের হারের ওপর এই ক্যাপিং করে দিলে বিনিয়োগের খরা কেটে যাবে। এখন ট্যাক্স হলিডে আছে, সঙ্গে ঋণের সুদের হার কমলে বিনিয়োগে অনেকে উৎসাহিত হবে। কর্মসংস্থান বাড়বে। আমি মনে করি, মেয়াদি ঋণের পর সুদের হারের ওপর একটি ক্যাপিং করার উপযুক্ত সময় এখন।
No comments