বিচারপতি নিয়োগের আইন দ্রুত প্রণয়ন করা হোক by আবদুল লতিফ মন্ডল
আইন হয়নি ৪২ বছর শিরোনামে যুগান্তরের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল গত ২৫ সেপ্টেম্বর। এতে বলা হয়েছিল, উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে গত ৪২ বছরে আইন প্রণয়ন হয়নি। অতীতের সব সরকার আইন ছাড়াই বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথমদিকে কনভেনশন অনুসরণ করা হলেও পরবর্তী সময়ে সরকার ইচ্ছামতো বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আইনের মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগের বিষয় সংবিধানে উল্লেখ থাকলেও কোনো সরকার সেদিকে যায়নি। এছাড়া বিচারপতি নিয়োগের স্বচ্ছতার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরির প্রশ্নে হাইকোর্টের রুল, আইন কমিশনের সুপারিশ কিছুই আমলে নেয়নি সরকার।
সংবিধানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট নামে বাংলাদেশের একটি সর্বোচ্চ আদালত থাকবে এবং আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ নিয়ে তা গঠিত হবে। এ আদালতে নিযুক্ত প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারক বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন। সংবিধানের ৯৫(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হলে এবং সুপ্রিমকোর্টে অন্যূন দশ বছরকাল অ্যাডভোকেট না থেকে থাকলে, অথবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন দশ বছর কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করে থাকলে, অথবা সুপ্রিমকোর্টের বিচারক পদে নিয়োগলাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থেকে থাকলে তিনি বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না।
সংবিধানে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য আইন প্রণয়নের মাধ্যমে যোগ্যতা নির্ধারণের নির্দেশনা থাকলেও স্বাধীনতা-পরবর্তী দীর্ঘ সময়ে আইনটি প্রণীত হয়নি। ফলে বিভিন্ন সরকার, বিশেষ করে বিগত দুই দশকের বেশি সময় প্রায় পালাক্রমে দেশ শাসনের দায়িত্বে থেকে বিএনপি সরকার ও আওয়ামী লীগ সরকার উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগকে দলীয়করণ করেছে। সুপ্রিমকোর্টের সব পর্যায়ে বিচারক নিয়োগ দলীয়করণ করার সুযোগ থাকলেও এ সুযোগটির সর্বোচ্চ ব্যবহার হয় বিচারক হিসেবে নিয়োগের প্রবেশদ্বার হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক পদে নিয়োগে। সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি অনধিক দুই বছরের জন্য হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করতে পারেন। এভাবে নিযুক্ত কোনো অতিরিক্ত বিচারককে দুই বছর বা বর্ধিত সময়ের মধ্যে স্থায়ী না করা হলে তিনি ওই পদে বহাল থাকেন না। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৪ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ১৯ ব্যক্তিকে হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করা হয়। তৎকালীন সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন (এসসিবিএ) এ নিয়োগকে দলীয়করণ হিসেবে আখ্যায়িত করে তা বাতিলের জন্য আন্দোলন শুরু করে। কোন বিবেচনায় এ নিয়োগ প্রদান করা হয় তা জানাতে এসসিবিএ তৎকালীন আইনমন্ত্রীকে নোটিশ প্রদানের এবং মন্ত্রীর জবাব সন্তোষজনক না হলে হাইকোর্ট বিভাগে রিট করার সিদ্ধান্ত নেয়। অনুরূপভাবে ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে ১৭ ব্যক্তিকে হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করা হয়। এসসিবিএ এ নিয়োগের বিরুদ্ধে দলীয়করণের অভিযোগ আনে। বিশেষ করে তাদের মধ্যে দুজন সর্বজনাব রুহুল কুদ্দুস ও মো. খসরুজ্জামানের নিযুক্তির বিরুদ্ধে ঘোর আপত্তি জানায় এসসিবিএ। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিযুক্তি পাওয়া ১৭ জনের মধ্যে ১৫ জনকে শপথবাক্য পাঠ করালেও ওই দুজনকে শপথবাক্য পাঠ করাতে অস্বীকৃতি জানান। পরবর্তী প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তাদের শপথ বাক্য পাঠ করান। উচ্চ আদালতের অন্যান্য স্তরে নিয়োগেও দলীয়করণের অভিযোগ রয়েছে। নিবন্ধের আকার বিবেচনায় নিয়ে উদাহরণ দেয়া থেকে বিরত থাকা হল।
উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির ভূমিকা নিয়েও রাজনীতি করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত এবং ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া বাংলাদেশের সংবিধানের (অতঃপর মূল সংবিধান বলে অভিহিত) ৯৫(১) অনুচ্ছেদে বিধান করা হয়, প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করবেন। সংবিধান গৃহীত ও কার্যকর হওয়ার দুই বছর পার হতে না হতেই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর (২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫) মাধ্যমে অন্যান্য বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির পরামর্শ করা সংক্রান্ত বিধানটুকু বিলোপ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি এএসএম সায়েম ১৯৭৬ সালের ২৩ জানুয়ারি এক আদেশের (Proclamation Order No. IV) মাধ্যমে মূল সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদটি পুনর্বহাল করেন। অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্টে অন্যান্য বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির পরামর্শ করা সংক্রান্ত বিধান পুনর্বহাল করা হয়। সায়েমকে হটিয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ক্ষমতা গ্রহণকারী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের এক আদেশে (Second Proclamation Order No.I of 1977) ৪র্থ সংশোধনীর ফলে ৯৫(১) অনুচ্ছেদটি যে অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল সেটিকে ঠিক ওই অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন। অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্টে অন্যান্য বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির পরামর্শ করা সংক্রান্ত বিধান রহিত করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মূল সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদটি পুনর্বহাল করা হয়।
সুপ্রিমকোর্টে বিচারক নিয়োগে দলীয়করণ রোধে উদ্যোগ গ্রহণ করে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন অর্ডিন্যান্স ২০০৮ জারি করেন। এতে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন গঠনের বিধান করা হয়। আইনমন্ত্রী, আপিল বিভাগে কর্মরত বিচারকদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে তিনজন প্রবীণতম বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগে কর্মরত বিচারকদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে দুজন প্রবীণতম বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিকে এ কমিশনের সদস্য করা হয়। আপিল বিভাগে বিচারক পদে এবং হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক পদে নিয়োগের জন্য নাম সুপারিশ করার জন্য এ কমিশনকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
সুপ্রিমকোর্টের জনৈক অ্যাডভোকেট সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন গঠনকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন (রিট পিটিশন নং ৩২২৮/২০০৮) দাখিল করেন। ২০০৮ সালের ২৮ এপ্রিলে হাইকোর্ট ব্যাখ্যা চেয়ে সরকারের ওপর রুলনিশি জারি করেন এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশনের কার্যকারিতা তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন। রিট পিটিশনটি চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হওয়ার আগে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ওই নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠন করে। ওই সরকার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন অর্ডিন্যান্স ২০০৮ অনুমোদনের জন্য সংসদে উপস্থাপন করা থেকে বিরত থাকে।
এখন দেখা যাক আমাদের পাশের দেশগুলোতে এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত গ্রেট ব্রিটেনে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে কী পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ভারতের সংবিধানের ১২৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি ভারতের প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের যেসব বিচারকের সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন মনে করবেন, তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি সুপ্রিমকোর্টে বিচারক নিয়োগ দেবেন। অনুরূপভাবে কোনো হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগে রাষ্ট্রপতি ভারতের প্রধান বিচারপতি, সংশ্লিষ্ট রাজ্যের গভর্নর এবং সংশ্লিষ্ট হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে ওই হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগ দেবেন (অনুচ্ছেদ ২১৭)। গণমাধ্যমে প্রচারিত খবরে জানা যায়, ভারতের উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে প্রচলিত পদ্ধতির পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিয়েছে সে দেশের সরকার। আগস্টে লোকসভায় পেশ করা হয়েছে ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশন (এনজেএসি) বিল। এতে ভারতের প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিমকোর্টের অন্যান্য বিচারক এবং হাইকোর্টে প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারক নিয়োগে সুপারিশ প্রদানে এনজেএসি যে পদ্ধতি অনুসরণ করবে তার বর্ণনা রয়েছে।
২০১০ সালে সংবিধানের অষ্টাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পাকিস্তানের উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আমূল পরিবর্তন আনা হয়। এতে সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট এবং ফেডারেল শরিয়াহ কোর্টে বিচারক নিয়োগে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি জুডিশিয়াল কমিশন গঠনের বিধান করা হয়।
উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে গ্রেট ব্রিটেন সাতশ বছরের ঐতিহ্য ভঙ্গ করে ২০০৬ সালে নতুন পদ্ধতি চালু করে। বিচারক নিয়োগে সুপারিশ প্রদানে ওই বছরের এপ্রিলে গঠন করা হয় জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশন। এর আগে লর্ড চ্যান্সেলর (যিনি মন্ত্রিসভার একজন সদস্য) সুপারিশক্রমে রাজা বা রানী উচ্চ আদালতে (সুপ্রিমকোর্ট অব জুডিকেচার এবং কোর্ট অব ক্রিমিনাল আপিল) বিচারক নিয়োগ দিতেন।
সবশেষে যা বলা দরকার তা হল, বাংলাদেশে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে দলীয়করণ রোধে সংবিধান নির্দেশিত আইনটি প্রণয়নে আর দেরি নয়। সংবিধানে উচ্চ আদালতে কোনো ব্যক্তির বিচারক পদে নিয়োগ পেতে যে তিনটি যোগ্যতার কথা বলা আছে, সেগুলোসহ আইনে বিচারক নিয়োগে সুপারিশ প্রদানে জুডিশিয়াল কমিশন গঠন, প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ, কোনো রাজনৈতিক দল বা অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, ফৌজদারি অপরাধ এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে রেকর্ড যাচাইয়ের বিধান থাকতে হবে। বিচার বিভাগ ও জনগণের স্বার্থে আইনটি যত তাড়াতাড়ি প্রণীত হয়, ততই মঙ্গল।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
সংবিধানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট নামে বাংলাদেশের একটি সর্বোচ্চ আদালত থাকবে এবং আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ নিয়ে তা গঠিত হবে। এ আদালতে নিযুক্ত প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারক বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন। সংবিধানের ৯৫(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হলে এবং সুপ্রিমকোর্টে অন্যূন দশ বছরকাল অ্যাডভোকেট না থেকে থাকলে, অথবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন দশ বছর কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করে থাকলে, অথবা সুপ্রিমকোর্টের বিচারক পদে নিয়োগলাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থেকে থাকলে তিনি বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না।
সংবিধানে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য আইন প্রণয়নের মাধ্যমে যোগ্যতা নির্ধারণের নির্দেশনা থাকলেও স্বাধীনতা-পরবর্তী দীর্ঘ সময়ে আইনটি প্রণীত হয়নি। ফলে বিভিন্ন সরকার, বিশেষ করে বিগত দুই দশকের বেশি সময় প্রায় পালাক্রমে দেশ শাসনের দায়িত্বে থেকে বিএনপি সরকার ও আওয়ামী লীগ সরকার উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগকে দলীয়করণ করেছে। সুপ্রিমকোর্টের সব পর্যায়ে বিচারক নিয়োগ দলীয়করণ করার সুযোগ থাকলেও এ সুযোগটির সর্বোচ্চ ব্যবহার হয় বিচারক হিসেবে নিয়োগের প্রবেশদ্বার হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক পদে নিয়োগে। সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি অনধিক দুই বছরের জন্য হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করতে পারেন। এভাবে নিযুক্ত কোনো অতিরিক্ত বিচারককে দুই বছর বা বর্ধিত সময়ের মধ্যে স্থায়ী না করা হলে তিনি ওই পদে বহাল থাকেন না। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৪ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ১৯ ব্যক্তিকে হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করা হয়। তৎকালীন সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন (এসসিবিএ) এ নিয়োগকে দলীয়করণ হিসেবে আখ্যায়িত করে তা বাতিলের জন্য আন্দোলন শুরু করে। কোন বিবেচনায় এ নিয়োগ প্রদান করা হয় তা জানাতে এসসিবিএ তৎকালীন আইনমন্ত্রীকে নোটিশ প্রদানের এবং মন্ত্রীর জবাব সন্তোষজনক না হলে হাইকোর্ট বিভাগে রিট করার সিদ্ধান্ত নেয়। অনুরূপভাবে ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে ১৭ ব্যক্তিকে হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করা হয়। এসসিবিএ এ নিয়োগের বিরুদ্ধে দলীয়করণের অভিযোগ আনে। বিশেষ করে তাদের মধ্যে দুজন সর্বজনাব রুহুল কুদ্দুস ও মো. খসরুজ্জামানের নিযুক্তির বিরুদ্ধে ঘোর আপত্তি জানায় এসসিবিএ। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিযুক্তি পাওয়া ১৭ জনের মধ্যে ১৫ জনকে শপথবাক্য পাঠ করালেও ওই দুজনকে শপথবাক্য পাঠ করাতে অস্বীকৃতি জানান। পরবর্তী প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তাদের শপথ বাক্য পাঠ করান। উচ্চ আদালতের অন্যান্য স্তরে নিয়োগেও দলীয়করণের অভিযোগ রয়েছে। নিবন্ধের আকার বিবেচনায় নিয়ে উদাহরণ দেয়া থেকে বিরত থাকা হল।
উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির ভূমিকা নিয়েও রাজনীতি করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত এবং ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া বাংলাদেশের সংবিধানের (অতঃপর মূল সংবিধান বলে অভিহিত) ৯৫(১) অনুচ্ছেদে বিধান করা হয়, প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করবেন। সংবিধান গৃহীত ও কার্যকর হওয়ার দুই বছর পার হতে না হতেই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর (২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫) মাধ্যমে অন্যান্য বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির পরামর্শ করা সংক্রান্ত বিধানটুকু বিলোপ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি এএসএম সায়েম ১৯৭৬ সালের ২৩ জানুয়ারি এক আদেশের (Proclamation Order No. IV) মাধ্যমে মূল সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদটি পুনর্বহাল করেন। অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্টে অন্যান্য বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির পরামর্শ করা সংক্রান্ত বিধান পুনর্বহাল করা হয়। সায়েমকে হটিয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ক্ষমতা গ্রহণকারী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের এক আদেশে (Second Proclamation Order No.I of 1977) ৪র্থ সংশোধনীর ফলে ৯৫(১) অনুচ্ছেদটি যে অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল সেটিকে ঠিক ওই অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন। অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্টে অন্যান্য বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির পরামর্শ করা সংক্রান্ত বিধান রহিত করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মূল সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদটি পুনর্বহাল করা হয়।
সুপ্রিমকোর্টে বিচারক নিয়োগে দলীয়করণ রোধে উদ্যোগ গ্রহণ করে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন অর্ডিন্যান্স ২০০৮ জারি করেন। এতে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন গঠনের বিধান করা হয়। আইনমন্ত্রী, আপিল বিভাগে কর্মরত বিচারকদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে তিনজন প্রবীণতম বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগে কর্মরত বিচারকদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে দুজন প্রবীণতম বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিকে এ কমিশনের সদস্য করা হয়। আপিল বিভাগে বিচারক পদে এবং হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক পদে নিয়োগের জন্য নাম সুপারিশ করার জন্য এ কমিশনকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
সুপ্রিমকোর্টের জনৈক অ্যাডভোকেট সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন গঠনকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন (রিট পিটিশন নং ৩২২৮/২০০৮) দাখিল করেন। ২০০৮ সালের ২৮ এপ্রিলে হাইকোর্ট ব্যাখ্যা চেয়ে সরকারের ওপর রুলনিশি জারি করেন এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশনের কার্যকারিতা তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন। রিট পিটিশনটি চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হওয়ার আগে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ওই নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠন করে। ওই সরকার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন অর্ডিন্যান্স ২০০৮ অনুমোদনের জন্য সংসদে উপস্থাপন করা থেকে বিরত থাকে।
এখন দেখা যাক আমাদের পাশের দেশগুলোতে এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত গ্রেট ব্রিটেনে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে কী পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ভারতের সংবিধানের ১২৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি ভারতের প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের যেসব বিচারকের সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন মনে করবেন, তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি সুপ্রিমকোর্টে বিচারক নিয়োগ দেবেন। অনুরূপভাবে কোনো হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগে রাষ্ট্রপতি ভারতের প্রধান বিচারপতি, সংশ্লিষ্ট রাজ্যের গভর্নর এবং সংশ্লিষ্ট হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে ওই হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগ দেবেন (অনুচ্ছেদ ২১৭)। গণমাধ্যমে প্রচারিত খবরে জানা যায়, ভারতের উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে প্রচলিত পদ্ধতির পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিয়েছে সে দেশের সরকার। আগস্টে লোকসভায় পেশ করা হয়েছে ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশন (এনজেএসি) বিল। এতে ভারতের প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিমকোর্টের অন্যান্য বিচারক এবং হাইকোর্টে প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারক নিয়োগে সুপারিশ প্রদানে এনজেএসি যে পদ্ধতি অনুসরণ করবে তার বর্ণনা রয়েছে।
২০১০ সালে সংবিধানের অষ্টাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পাকিস্তানের উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আমূল পরিবর্তন আনা হয়। এতে সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট এবং ফেডারেল শরিয়াহ কোর্টে বিচারক নিয়োগে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি জুডিশিয়াল কমিশন গঠনের বিধান করা হয়।
উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে গ্রেট ব্রিটেন সাতশ বছরের ঐতিহ্য ভঙ্গ করে ২০০৬ সালে নতুন পদ্ধতি চালু করে। বিচারক নিয়োগে সুপারিশ প্রদানে ওই বছরের এপ্রিলে গঠন করা হয় জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশন। এর আগে লর্ড চ্যান্সেলর (যিনি মন্ত্রিসভার একজন সদস্য) সুপারিশক্রমে রাজা বা রানী উচ্চ আদালতে (সুপ্রিমকোর্ট অব জুডিকেচার এবং কোর্ট অব ক্রিমিনাল আপিল) বিচারক নিয়োগ দিতেন।
সবশেষে যা বলা দরকার তা হল, বাংলাদেশে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে দলীয়করণ রোধে সংবিধান নির্দেশিত আইনটি প্রণয়নে আর দেরি নয়। সংবিধানে উচ্চ আদালতে কোনো ব্যক্তির বিচারক পদে নিয়োগ পেতে যে তিনটি যোগ্যতার কথা বলা আছে, সেগুলোসহ আইনে বিচারক নিয়োগে সুপারিশ প্রদানে জুডিশিয়াল কমিশন গঠন, প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ, কোনো রাজনৈতিক দল বা অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, ফৌজদারি অপরাধ এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে রেকর্ড যাচাইয়ের বিধান থাকতে হবে। বিচার বিভাগ ও জনগণের স্বার্থে আইনটি যত তাড়াতাড়ি প্রণীত হয়, ততই মঙ্গল।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
No comments