মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ছাড়পত্র by ওয়ালিউল হক
আওয়ামী লীগের নেতারা অনেক দিন ধরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমরনায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমানকে পাকিস্তানের চর হিসেবে আখ্যায়িত করে আসছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফের দায়িত্ব পালনকারী এ কে খন্দকারকেও এবার তারা পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার (আইএসআই) এজেন্ট হিসেবে চিত্রিত করা শুরু করেছেন। জিয়াউর রহমান যেহেতু একজন জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন এবং সেই সাথে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন, সে কারণে আওয়ামী লীগ তাকে যে দু’চোখে দেখতে পারে না সেটা খুব অস্বাভাবিক নয়; কিন্তু তার পরও দেশের বেশির ভাগ মানুষ ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাকারী মেজর জিয়াকে পাকিস্তানের চর বলে কোনোভাবেই মেনে নিতে রাজি নয়। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী সবচেয়ে সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তা এবং পরে আওয়ামী লীগের এমপি ও মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী এ কে খন্দকারকেও তারা আইএসআইয়ের এজেন্ট হিসেবে মেনে নিতে অপারগ। দেশের মানুষ মনে করে, মুক্তিযুদ্ধের এসব শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের যদি এভাবে পাকিস্তানের এজেন্ট বানানোর কাজ অব্যাহত থাকে, তাহলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গোটা ব্যাপারটিই একদিন খেলো হয়ে পড়বে। এবার দেখা যাক, মুক্তিযুদ্ধের সময় শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক কিংবা সামরিক নেতাদের পক্ষে পাকিস্তানি এজেন্ট হিসেবে কাজ করা সম্ভব ছিল কি না। যখন কোনো দেশ বা গেরিলা সংগঠন যুদ্ধে লিপ্ত থাকে তখন তারা বিপক্ষ দেশ বা শক্তির অন্তর্ঘাতমূলক চক্রান্তের ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ থাকেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী সরকার ও এম এ জি ওসমানীর নেতৃত্বাধীন সামরিক কমান্ডাররাও এ ব্যাপারে অনেক সতর্ক ছিলেন। উদাহরণ হিসেবে প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক ও তার সহযোগীদের ওপর প্রবাসী সরকারের নজরদারির বিষয়টি উল্লেখ করা যায়। ‘পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার জন্য’ কলকাতার মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা যখন খন্দকার মোশতাকের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন, তখন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাজউদ্দীন আহমদকে বিষয়টি অবহিত করে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দেয়। তাজউদ্দীন আহমদ তাদের পরামর্শ অনুযায়ী খন্দকার মোশতাকের নিউ ইয়র্ক সফর বাতিল করে দেন (যদিও তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা Henry Kissinger তার White House Years বইয়ে লিখেছেন, ভারত সরকারের পরামর্শক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সরকারের সাথে যোগাযোগের কাজ শুরু করেছিল। আবার ভারত সরকারই যুক্তরাষ্ট্রের সেই উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দেয়)।
এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের প্রখ্যাত সামরিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইকরাম সেহগালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারটিও উল্লেখ করা যায়। বাঙালি মা ও পাঞ্জাবি বাবার সন্তান ইকরাম সেহগাল ১৯৭১ সালে ছিলেন দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের তরুণ ক্যাপ্টেন। ৩১ মার্চ তিনি মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেও ৫ এপ্রিল মেজর খালেদ মোশাররফ তাকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে বিএসএফের হাতে তুলে দেন। Escape from Oblivion শীর্ষক গ্রন্থে ইকরাম সেহগাল তার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। মেজর সফিউল্লাহ তাকে বিশ্বাস করলেও খালেদ মোশাররফ তাকে সন্দেহের চোখে দেখতেন।
জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন বলে যারা এখন প্রচারণা চালান, তাদের অবগতির জন্য একটি তথ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। তথ্যটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : একাদশ খণ্ডের ৫৪১ পৃষ্ঠায় ছাপানো হয়েছে। সেখানে দেখা যায় ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম (যিনি পরে আওয়ামী লীগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন) ১৯৭১ সালের ২৭ মে তার ডায়েরিতে লিখেছেনÑ In the evening, interrogated two EPR soldiers who confessed they have been sent by Major Salman of Pakistan Army to kill Major Ziaur Rahman and me. Salman is my coursemate, But today? (সন্ধ্যায় ইপিআরের দু’জন সৈন্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করে যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর সালমান তাদের ভারতে পাঠিয়েছে মেজর জিয়াউর রহমান ও আমাকে হত্যা করার জন্য। সালমান ও আমি সেনাবাহিনীতে একই সাথে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছি। আর আজ?)। প্রশ্ন হলো : জিয়াউর রহমান যদি তাদের লোকই হয়ে থাকেন তাহলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে হত্যা করার জন্য ভারতে ঘাতক বাহিনী পাঠাবে কেন? ওপরের তথ্য থেকে এটাও বোঝা যায় যে, সামরিক কমান্ডাররা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার ব্যাপারে অনেক সতর্ক ছিলেন।
একই কথা প্রযোজ্য ভারত সরকার ও তাদের সেনাবাহিনীর ব্যাপারে। বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ভারত সরকার ও তাদের সেনাবাহিনীও পাকিস্তানি অনুচরদের ভারতে অনুপ্রবেশ ও অন্তর্ঘাতকমূলক তৎপরতার ব্যাপারে বেশ সজাগ ছিলেন। যেহেতু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভারত ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল, সে কারণে ভারতীয়দের নজরদারি এড়িয়ে কোনো সামরিক কমান্ডারের পক্ষে পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে কাজ করা কোনোভাবে সম্ভব ছিল বলে মনে হয় না। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক সামরিক কর্মকর্তাদের অনেক যাচাই বাছাই করার পরই ভারত তাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিত। এ ব্যাপারে এ কে খন্দকার তার লেখা ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ বইয়ে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন এভাবেÑ ‘কলকাতায় দু’দিন থাকার পর কর্নেল ওসমানী বলেন, ভারতীয় বিভিন্ন বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ-সম্পর্কিত কিছু বিষয়ে আলোচনা করতে আমাকে দিল্লি যেতে হবে। আমি কলকাতায় আসার পর সম্ভবত আমার উপস্থিতি সম্পর্কে দিল্লিতে খবর পাঠানো হয়। গ্রুপ ক্যাপ্টেন বাদামি আমাকে দিল্লি নিয়ে যেতে কলকাতায় আসেন। ২০ কিংবা ২১ মে বাদামির সঙ্গে আমাকে দিল্লি পাঠানো হয়। গ্রুপ ক্যাপ্টেন বাদামি ভারতের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি তখন আমাকে কিছু বলেননি, আর আমিও আগ বাড়িয়ে তার পরিচয় জানতে চাইনি। তার পদবিটা আমি পরে জানতে পারি। দিল্লিতে গিয়ে বাদামি একটি বিরাট বাংলোয় আমার থাকার ব্যবস্থা করেন। সেখানে আমি একটি কামরায় একাই থাকতাম।’
‘দিল্লিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর ইন্টেলিজেন্স বিভাগের কর্মকর্তারা আমাকে অনেক প্রশ্ন করেন। তারা পাকিস্তান বিমানবাহিনী সম্পর্কে জানতে চান। আমার অগোচরে আগরতলা থেকে উইং কমান্ডার বাশার, স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফাইট লেফটেন্যান্ট নুরুল কাদেরকেও দিল্লিতে আনা হয়। তাদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে প্রশ্ন করা হয়। সম্ভবত তারা আমার বিবৃতির সঙ্গে তাদের বিবৃতি মিলিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। আমাদের আনুগত্য, বিশ্বস্ততা ইত্যাদি পরীক্ষা এবং গোয়েন্দা-বিষয়ক সংবাদ গ্রহণের জন্য ভারতীয়রা এই কাজটি করে থাকতে পারে। তারা যখন দেখল, আমার বিবৃতির সঙ্গে তাদের বিবৃতির কোনো পার্থক্য নেই, তখন তারা আমাদের ওপর আস্থা আনতে পারল। আমি পাকিস্তান বিমানবাহিনী থেকে ভারতে এসেছি এবং তাদের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে কাজ করব, তাই আমাদের যাচাই-বাছাই করে নেয়াটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। মূলত এজন্যই আমাদের সবাইকে দিল্লি যেতে হয়েছিল’ (১৯৭১ : ভেতরে বাইরে, পৃষ্ঠা ৮২-৮৩)।
একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানা যায় মেজর রফিকুল ইসলামের লেখা থেকেও। মেজর রফিকুল ইসলামের বর্ণনা মতে, ‘২ এপ্রিল আমি আগরতলা পৌঁছালে সরাসরি আমাকে বিএসএফের সিনিয়র অফিসার কালিয়ার অফিসে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি তার কাছে আমাদের লড়াইয়ের অবস্থা বর্ণনা করে সামরিক সাহায্যের অনুরোধ জানালাম। কালিয়া অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন বিধায় আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন। অপেক্ষা করা ছাড়া আমার আর কোনো গত্যন্তর ছিল না। আমাকে আগরতলার এক অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হলো এবং সেখানেই এক কক্ষে আমি সারা দিন রইলাম। সেখানে সাদা পোশাক পরিহিত কয়েকজন ভারতীয় অফিসার পর্যায়ক্রমে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। তারা আমার কাছ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান, তাদের শক্তি, কোন ধরনের অস্ত্র তারা ব্যবহার করছে ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করলেন। তারা আমার অতীত জীবন এবং কি কারণে আমি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিলাম সেসব বিষয়েও প্রশ্ন করলেন, ঘটনাবলি সম্পর্কে আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, পাকবাহিনীর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং স্বাধীনতা অর্জনে আমরা কী কী উদ্যোগ নিয়েছি তা-ও জানতে চাইলেন। এদের সঙ্গে আমার আলোচনা অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ এবং আন্তরিকতার মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তারা খুবই সহানুভূতিশীল ছিলেন। তবে এদের আলোচনার ধারা থেকে আমি বুঝতে পারি, এরা সবাই ভারতীয় সামরিক বাহিনী ও বিএসএফের গোয়েন্দা বিভাগের লোক’ (বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড, পৃষ্ঠা৭৭)।
‘মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতীয় গোয়েন্দাদের ছাড়পত্রের বিষয়টি যে শুধুমাত্র সেনা কর্মকর্তাদের ব্যাপারে প্রযোজ্য ছিল তা নয়, এটা রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য ছিল। যে কারণে চীনপন্থী বাম রাজনীতিকরা ভারতে গেলেও তাদের মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে দেয়া হয়নি। ভাসানী ন্যাপের নেতা কাজী জাফর আহমদ ১৯৭১ সালের ১ জুন এ ব্যাপারে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাথে সাক্ষাৎ করলে তিনি (তাজউদ্দীন) তাকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন যে, বামপন্থীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে তাকে গোয়েন্দা রিপোর্ট নিতে হবে এবং সে গোয়েন্দা রিপোর্ট দেবে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা’ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : পঞ্চদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩৬)।
কাজী জাফর আহমদের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় মওলানা ভাসানীকে কাগজ-কলমে না হলেও পরোক্ষভাবে সুকৌশলে আটক রাখা হয়েছিল এবং জুনের মাঝামাঝি ভারতীয় গোয়েন্দা ‘র’ তাকেও (কাজী জাফর) আগরতলা থেকে আটক করে শিলং নিয়ে যায়। সেখানকার একটি ডাকবাংলোয় তাকে সাত দিন আটক রেখে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করেন ‘র’-এর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান সুব্রামনিয়াম।
ওপরের সব তথ্য পাঠ করলে বোঝা যায়, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা ছাড়পত্রের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং ভারতীয় গোয়েন্দাদের নজরদারি এড়িয়ে পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে কাজ করাও কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না।
এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের প্রখ্যাত সামরিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইকরাম সেহগালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারটিও উল্লেখ করা যায়। বাঙালি মা ও পাঞ্জাবি বাবার সন্তান ইকরাম সেহগাল ১৯৭১ সালে ছিলেন দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের তরুণ ক্যাপ্টেন। ৩১ মার্চ তিনি মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেও ৫ এপ্রিল মেজর খালেদ মোশাররফ তাকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে বিএসএফের হাতে তুলে দেন। Escape from Oblivion শীর্ষক গ্রন্থে ইকরাম সেহগাল তার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। মেজর সফিউল্লাহ তাকে বিশ্বাস করলেও খালেদ মোশাররফ তাকে সন্দেহের চোখে দেখতেন।
জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন বলে যারা এখন প্রচারণা চালান, তাদের অবগতির জন্য একটি তথ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। তথ্যটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : একাদশ খণ্ডের ৫৪১ পৃষ্ঠায় ছাপানো হয়েছে। সেখানে দেখা যায় ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম (যিনি পরে আওয়ামী লীগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন) ১৯৭১ সালের ২৭ মে তার ডায়েরিতে লিখেছেনÑ In the evening, interrogated two EPR soldiers who confessed they have been sent by Major Salman of Pakistan Army to kill Major Ziaur Rahman and me. Salman is my coursemate, But today? (সন্ধ্যায় ইপিআরের দু’জন সৈন্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করে যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর সালমান তাদের ভারতে পাঠিয়েছে মেজর জিয়াউর রহমান ও আমাকে হত্যা করার জন্য। সালমান ও আমি সেনাবাহিনীতে একই সাথে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছি। আর আজ?)। প্রশ্ন হলো : জিয়াউর রহমান যদি তাদের লোকই হয়ে থাকেন তাহলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে হত্যা করার জন্য ভারতে ঘাতক বাহিনী পাঠাবে কেন? ওপরের তথ্য থেকে এটাও বোঝা যায় যে, সামরিক কমান্ডাররা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার ব্যাপারে অনেক সতর্ক ছিলেন।
একই কথা প্রযোজ্য ভারত সরকার ও তাদের সেনাবাহিনীর ব্যাপারে। বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ভারত সরকার ও তাদের সেনাবাহিনীও পাকিস্তানি অনুচরদের ভারতে অনুপ্রবেশ ও অন্তর্ঘাতকমূলক তৎপরতার ব্যাপারে বেশ সজাগ ছিলেন। যেহেতু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভারত ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল, সে কারণে ভারতীয়দের নজরদারি এড়িয়ে কোনো সামরিক কমান্ডারের পক্ষে পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে কাজ করা কোনোভাবে সম্ভব ছিল বলে মনে হয় না। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক সামরিক কর্মকর্তাদের অনেক যাচাই বাছাই করার পরই ভারত তাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিত। এ ব্যাপারে এ কে খন্দকার তার লেখা ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ বইয়ে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন এভাবেÑ ‘কলকাতায় দু’দিন থাকার পর কর্নেল ওসমানী বলেন, ভারতীয় বিভিন্ন বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ-সম্পর্কিত কিছু বিষয়ে আলোচনা করতে আমাকে দিল্লি যেতে হবে। আমি কলকাতায় আসার পর সম্ভবত আমার উপস্থিতি সম্পর্কে দিল্লিতে খবর পাঠানো হয়। গ্রুপ ক্যাপ্টেন বাদামি আমাকে দিল্লি নিয়ে যেতে কলকাতায় আসেন। ২০ কিংবা ২১ মে বাদামির সঙ্গে আমাকে দিল্লি পাঠানো হয়। গ্রুপ ক্যাপ্টেন বাদামি ভারতের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি তখন আমাকে কিছু বলেননি, আর আমিও আগ বাড়িয়ে তার পরিচয় জানতে চাইনি। তার পদবিটা আমি পরে জানতে পারি। দিল্লিতে গিয়ে বাদামি একটি বিরাট বাংলোয় আমার থাকার ব্যবস্থা করেন। সেখানে আমি একটি কামরায় একাই থাকতাম।’
‘দিল্লিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর ইন্টেলিজেন্স বিভাগের কর্মকর্তারা আমাকে অনেক প্রশ্ন করেন। তারা পাকিস্তান বিমানবাহিনী সম্পর্কে জানতে চান। আমার অগোচরে আগরতলা থেকে উইং কমান্ডার বাশার, স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফাইট লেফটেন্যান্ট নুরুল কাদেরকেও দিল্লিতে আনা হয়। তাদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে প্রশ্ন করা হয়। সম্ভবত তারা আমার বিবৃতির সঙ্গে তাদের বিবৃতি মিলিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। আমাদের আনুগত্য, বিশ্বস্ততা ইত্যাদি পরীক্ষা এবং গোয়েন্দা-বিষয়ক সংবাদ গ্রহণের জন্য ভারতীয়রা এই কাজটি করে থাকতে পারে। তারা যখন দেখল, আমার বিবৃতির সঙ্গে তাদের বিবৃতির কোনো পার্থক্য নেই, তখন তারা আমাদের ওপর আস্থা আনতে পারল। আমি পাকিস্তান বিমানবাহিনী থেকে ভারতে এসেছি এবং তাদের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে কাজ করব, তাই আমাদের যাচাই-বাছাই করে নেয়াটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। মূলত এজন্যই আমাদের সবাইকে দিল্লি যেতে হয়েছিল’ (১৯৭১ : ভেতরে বাইরে, পৃষ্ঠা ৮২-৮৩)।
একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানা যায় মেজর রফিকুল ইসলামের লেখা থেকেও। মেজর রফিকুল ইসলামের বর্ণনা মতে, ‘২ এপ্রিল আমি আগরতলা পৌঁছালে সরাসরি আমাকে বিএসএফের সিনিয়র অফিসার কালিয়ার অফিসে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি তার কাছে আমাদের লড়াইয়ের অবস্থা বর্ণনা করে সামরিক সাহায্যের অনুরোধ জানালাম। কালিয়া অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন বিধায় আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন। অপেক্ষা করা ছাড়া আমার আর কোনো গত্যন্তর ছিল না। আমাকে আগরতলার এক অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হলো এবং সেখানেই এক কক্ষে আমি সারা দিন রইলাম। সেখানে সাদা পোশাক পরিহিত কয়েকজন ভারতীয় অফিসার পর্যায়ক্রমে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। তারা আমার কাছ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান, তাদের শক্তি, কোন ধরনের অস্ত্র তারা ব্যবহার করছে ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করলেন। তারা আমার অতীত জীবন এবং কি কারণে আমি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিলাম সেসব বিষয়েও প্রশ্ন করলেন, ঘটনাবলি সম্পর্কে আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, পাকবাহিনীর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং স্বাধীনতা অর্জনে আমরা কী কী উদ্যোগ নিয়েছি তা-ও জানতে চাইলেন। এদের সঙ্গে আমার আলোচনা অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ এবং আন্তরিকতার মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তারা খুবই সহানুভূতিশীল ছিলেন। তবে এদের আলোচনার ধারা থেকে আমি বুঝতে পারি, এরা সবাই ভারতীয় সামরিক বাহিনী ও বিএসএফের গোয়েন্দা বিভাগের লোক’ (বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড, পৃষ্ঠা৭৭)।
‘মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতীয় গোয়েন্দাদের ছাড়পত্রের বিষয়টি যে শুধুমাত্র সেনা কর্মকর্তাদের ব্যাপারে প্রযোজ্য ছিল তা নয়, এটা রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য ছিল। যে কারণে চীনপন্থী বাম রাজনীতিকরা ভারতে গেলেও তাদের মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে দেয়া হয়নি। ভাসানী ন্যাপের নেতা কাজী জাফর আহমদ ১৯৭১ সালের ১ জুন এ ব্যাপারে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাথে সাক্ষাৎ করলে তিনি (তাজউদ্দীন) তাকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন যে, বামপন্থীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে তাকে গোয়েন্দা রিপোর্ট নিতে হবে এবং সে গোয়েন্দা রিপোর্ট দেবে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা’ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : পঞ্চদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩৬)।
কাজী জাফর আহমদের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় মওলানা ভাসানীকে কাগজ-কলমে না হলেও পরোক্ষভাবে সুকৌশলে আটক রাখা হয়েছিল এবং জুনের মাঝামাঝি ভারতীয় গোয়েন্দা ‘র’ তাকেও (কাজী জাফর) আগরতলা থেকে আটক করে শিলং নিয়ে যায়। সেখানকার একটি ডাকবাংলোয় তাকে সাত দিন আটক রেখে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করেন ‘র’-এর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান সুব্রামনিয়াম।
ওপরের সব তথ্য পাঠ করলে বোঝা যায়, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা ছাড়পত্রের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং ভারতীয় গোয়েন্দাদের নজরদারি এড়িয়ে পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে কাজ করাও কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না।
No comments