জাতির স্বপ্ন ও প্রেস কাবের দায়- প্রেস কাবের হীরক জয়ন্তী by শওকত মাহমুদ
“সাংবাদিকতা যেন এক অপ্রশম্য অনুরাগ যা কেবলমাত্র বাস্তবের মুখোমুখি হওয়ার মধ্য দিয়েই ধারণ ও আত্মস্থ করা সম্ভব। যার ধমনীতে এর শোণিত প্রবাহ নেই, যা শুধু অনিশ্চয়তায় জীবনকে তাড়িত করে, তার দ্বারা সাংবাদিকতার চুম্বকীয় আকর্ষণ উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। যার অভিজ্ঞানে সাংবাদিকতার পরিচিতি নেই, তার পক্ষে সংবাদকর্মের টানটান উত্তেজনা, প্রথম সফল প্রচেষ্টার শিহরিত আনন্দ কিংবা ব্যর্থ প্রয়াসের মানসিক বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব নয়। যে সাংবাদিকতার জন্য জন্মায়নি অথবা এর জন্য জীবনপাত করতে প্রস্তুত নয়, সে এই বোধাতীত ও নিমগ্ন কাজে লেগে থাকতে পারে না Ñ যেখানে দিনান্তের সংবাদের পদযাত্রা এক্ষণ শেষ হতে না হতেই পরক্ষণে ঊর্ধ্বশ্বাস। এমনকি এক মুহূর্তের স্বস্তির অবকাশটুকুও নেই।”
কলাম্বিয়ার সাংবাদিক ও নোবেলবিজয়ী ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর সাংবাদিক সম্বন্ধীয় এই নিখুঁত পর্যবেক্ষণকে উল্লেখপূর্বক বাংলাদেশের অগ্রগণ্য সাংবাদিক জাতীয় প্রেস কাবের ডাকসাইটে সাবেক সভাপতি মরহুম এ জেড এম এনায়েতুল্লাহ খান (মিন্টু ভাই) আরও এগিয়ে বলেছিলেনÑ “চার দশকেরও বেশি সময় ধরে মার্কেসের মূর্ত ভাষাশৈলীর বিস্তারের মতো অনুপম রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন হয়েছি, বেগবান অশ্বের মতো ধাবিত হয়েছি, যুধ্যমান সৈনিকের মতো শব্দের হাতিয়ার দিয়ে বৈরী শক্তিকে বিদ্ধ করেছি। আবার পরম মমত্ব দিয়ে তৈরি শব্দাবলীর ঝাঁপি দিয়ে অনুরাগের মিনার সোপানে অর্পণ করেছি।” মিন্টু ভাইয়ের অনুপম রোমান্টিকতার অর্থ সাংবাদিক নিজে স্বপ্ন দেখে, পাঠক-দর্শককে স্বপ্ন দেখায়। এর বাইরেও আরেক দায়িত্ব, সমাজে হস্তক্ষেপের। বিদ্ধ করা বৈরী শক্তিই অন্যায় অবিচার পরাধীনতা অগণতান্ত্রিকতা।
জন্ম থেকেই সাংবাদিকতা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার প্রতিস্পর্ধী ভূমিকায়। এ সত্যটা আরও বেশি করে বাঙময় বঙ্গ-পাক-ভারত উপমহাদেশে তথা বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এবং ধারাবাহিকভাবেই তাদের দিনলিপি নির্মিত হয়েছে শুধু সত্য-তথ্যের জ্ঞাপনে নয়, বরঞ্চ দ্রোহে এবং জাতি গঠনে, ভাষা-সংস্কৃতির সুস্থ বিকাশের বুনিয়াদে। বিশ্বের আর কোনো অঞ্চলে বা জাতিতে সাংবাদিকতা এমন প্রবলভাবে স্বাধীনতা-দেশমুখী, ফ্যাসিবাদবিরোধী, গণতন্ত্রকেন্দ্রিক, সত্য-ন্যায়ের নিশান-বরদার কি না জানি না। নইলে পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই কেন সাংবাদিকেরা স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য আওয়াজ দেবেন, চিন্তার রাজ্যের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য রেনেসাঁর উদ্যোগ নেবেন, বাংলাকে মাতৃভাষা করার জন্য ১৯৪২ থেকেই আন্দোলন শুরু করবেন এবং ’৪৭ সালে ‘পূর্ববঙ্গ সাংবাদিক সংঘ’ সরকারের কাছে স্মারকলিপি দেবে। কেন বায়ান্নর একুশেতে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ‘আজাদ’ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রাদেশিক পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন? ২৬ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারের উদ্বোধক তিনি। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১ ফেব্রুয়ারি’-অমর এই গানটির রচয়িতা সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী এবং একুশের প্রথম এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী সঙ্কলনটির সম্পাদক একজন সাংবাদিক হাসান হাফিজুর রহমান। ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সম্মুখ-সৈনিক হয়েছেন এই সাংবাদিক সমাজ এবং বাংলাদেশের সকল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে অনাপোস আন্দোলন করবেন এবং এসব আবর্তিত হয়েছে ‘জাতীয় প্রেস কাব’ নামক নিরন্তর সংগ্রামে অমলিন প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে।
১৯৫৪ সালে প্রেস কাবের আনুষ্ঠানিক জন্ম এবং এর গঠনতন্ত্রে ‘জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম’ শব্দত্রয়ের সন্নিবেশন কোনো রোমান্টিকতা ছিল না বরং গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্য জাতীয় আত্মার আকুতি ধারণেরই পরিচয়। এক সংগ্রামী প্রয়াস ছিল সে পর্বটি। জীবনের নানাক্ষেত্রে কৃতী পুরুষ এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম উদযোগী পুরুষ এবং সংবাদ-এর সাবেক সম্পাদক মরহুম খায়রুল কবীর কী আবেগেই না বলেছিলেন Ñ “আমার জীবনের বড় সাফল্য ‘জাতীয় প্রেস কাব’ প্রতিষ্ঠা।” তারুণ্যে টগবগ খায়রুল কবীরের বয়স তখন সাতাশ-আটাশ। আরেক প্রবীণ সদস্য ও এক সময়ের চোস্ত রিপোর্টার আবদুর রহিমের মতে ‘প্রেস কাব বাংলাদেশের রাজনীতির সূতিকাগার’। দৈনিক বাংলার বরেণ্য রিপোর্টার, পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণে তীè মরহুম মাশির হোসেন এই সত্যই উচ্চারণ করেছিলেন Ñ ‘প্রেস কাব শুধু ভবনগত অবকাঠামোই নয়। এর মানসবিহার অনেক বিস্তৃত। বর্তমানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে টের পাই অতীত ও ভাবীকালের করমর্দন। প্রেস কাবের ব্যাপ্তি ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়েই।”
আমাদের সাংবাদিকতার ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রাজনীতির ইতিহাস। ‘বাংলাদেশের দেড় শ’ বছরের সংবাদপত্র বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস, (সৈয়দ আবুল মকসুদ) ইতিহাসের এক পর্বে প্রাধান্য পেয়েছে কলকাতাকেন্দ্রিক স্বাধিকারমুখী সাংবাদিকতা। ’৪৭ সালের পর থেকে স্বকীয়তা নির্মাণের ও স্বাধীনতার সংগ্রামের অভিনিবেশে আরেক অধ্যায়। আর বাংলাদেশ আমলে গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের লড়াইয়ে ঠাসা আরেক চলমান ইতিহাস। সংবাদচর্চার মূলে রয়েছে সামাজিক চর্চা। সময় ও সমাজ যেমন তার পশ্চাৎপট, তেমনই ইতিহাসসচেতনতা হলো তার অস্তিত্বের গুরুত্ব নিয়ামক (বিংশ শতাব্দীর সংবাদপত্র : বাংলা দৈনিক পত্রিকা : কৃষ্ণ ধর)। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে শ্রীরামপুরের মিশনারিদের উদ্যোগে ‘সমাচার দর্পণ’ (১৮১৮) ও দিগদর্শন (১৮১৮) এবং একই বছরের গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের ‘বঙ্গাল গেজেটি’ পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষায় মুদ্রণমাধ্যমের সূত্রপাত। ১৮৩১ সালের ৭ মার্চ বেরোয় মুসলমান সম্পাদিত প্রথম বাংলা পত্রিকা ‘সমাচার সভা রাজেন্দ্র’। খ্রিষ্টধর্ম বাংলাসহ স্থানীয় ভাষাগুলোতে প্রচারের জন্য শ্রীরামপুরে ছাপাখানা আমদানি এবং বাংলা গদ্যের প্রচলন করেন পাদ্রি উইলিয়াম কেরি। এর আগে সুলতান কুতুবউদ্দিনের আমল (১২০১) থেকে ইংরেজ গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিংক (১৮৩৬) পর্যন্ত সাড়ে ৬ শ’ বছর ফার্সি ভাষা উপমহাদেশে লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা, অফিস-আদালত ও শিক্ষার মাধ্যম ছিল। আর পল্লী অঞ্চলে পুঁথির ভাষা ছিল বহুলভাবে প্রচলিত। মধ্যযুগে গৌড়ের সুলতানি আমলে পুঁথিসাহিত্য অনুবাদ সাহিত্য এবং পরে গদ্যের মাধ্যমে বাংলা ভাষার বিবর্তনে যে বৈপ্লবিক বিকাশ সাধিত হয় তাতে কবি শাহ মুহম্মদ সগীর, সৈয়দ হামজা, সৈয়দ সুলতান, সৈয়দ আলাউদ্দিন আর সপ্তদশ শতকে কাব্য ও পুঁথিতে বাংলা ভাষা-বিরোধী চক্রের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনি উচ্চারণকারী কবি আবদুল হাকিম রাখেন অসামান্য অবদান। আজও আবদুল হাকিমের এই পঙ্ক্তিগুলি রাষ্ট্রভাষা দিবসে আমরা স্মরণ করি : “যে জন বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি” (সানাউল্লাহ নূরী, সভ্যতার বিবর্তন এবং বাংলা সংবাদপত্র বিকাশের যুগ)। ‘যদি পলাশী ক্ষেত্রে বাংলার মুসলমানদের ভাগ্য বিপর্যয় না ঘটিত, তবে হয়ত এই পুঁথির ভাষাই বাংলার হিন্দু মুসলমানদের পুস্তকের ভাষা হইত।” (ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সংবর্ধনা গ্রন্থ) বাংলাক্রমে সংস্কৃতপ্রধান হয়ে ওঠে।
বাঙালি মুসলমান কর্তৃক সংবাদপত্র প্রকাশের চেষ্টা সম্ভবত ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে। তখন কয়েকজন উদ্যমশীল মুসলমান সাহিত্যিকের আবির্ভাব হয় Ñ যাঁদের সমাজ হিতৈষণা মুসলিম বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই সমাজপ্রাণ সাহিত্যিক গোষ্ঠী হচ্ছে : মুন্সী মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন আহমদ, পণ্ডিত রেয়াজউদ্দিন মাশহাদী, মৌলভী সেরাজুদ্দীন, মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ, মীর্জা মোহাম্মদ ইউসুফ আলী, শেখ আবদুর রহীম, শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হক, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, শেখ ফজলুল করিম, এয়াকুব আলী চৌধুরী, ডা. লুৎফর রহমান প্রমুখ। বাংলার মুসলমানের দুঃখ-দৈন্য, অভাব-অভিযোগ এদের প্রাণে তীব্র জ্বালার সৃষ্টি করেছিল। এঁরা বুঝতে পারেন বাংলার মুসলমানের অভাব-অভিযোগ দুঃখ-বেদনা ব্যক্ত করার জন্য চাই তার একটা বাংলা ভাষার সাপ্তাহিক মুখপত্র। ১৮৮৯ সালে বের হয় ‘সুধাকর’, বিষাদ সিন্ধু খ্যাত মীর মশাররফ হোসেন সে যুগের শুধু আদি সাহিত্যিকই নন, তিনি আমাদের আদি সাংবাদিকও। ‘হিতকরী’ নামে একটি বাংলা সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের তিনি সম্পাদক ও প্রতিষ্ঠাতা। (মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতা ও আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্)।
মূলত সাহিত্যিক-সাংবাদিক এবং সাংবাদিক-সাহিত্যিক এ দু’টি পরিচয় প্রায় অভিন্ন হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশবিরোধী সাংবাদিকতায়। আমাদের সাংবাদিকতার ইতিহাসে সাহিত্য সেবক ও সংবাদজীবীর যুগ্মসত্তাকে ধারণ করা গুণীজনের সংখ্যা অনেক বেশি। এখনও এবং তালিকাটা ঈর্ষণীয়ভাবেই দীর্ঘ। “তথ্যকে ন্যায্যভাবে যুক্তি দিয়ে বিন্যস্ত করাই সাংবাদিকতার ধর্ম। ভাষা তার কাঠকাঠ। সংবাদপত্র হচ্ছে এক সম্মিলিত স্বপ্ন, যা আমরা দেখি দিনের পর দিন। রচিত হয় Literature in hurry সাহিত্যও এক ধরনের স্বপ্ন। রোজ দিনজুড়ে রাতজুড়ে তৈরি হচ্ছে না বা প্রাতঃরাশের টেবিল থেকে সংক্রামকভাবে বিস্তারিত হচ্ছে না, তবে এক ব্যাপক বিস্তীর্ণ সূক্ষ্ম, অলক্ষ্য, চোরাগোপ্তা ধারায় ছেয়ে থাকছে আমাদের জীবনে। সংবাদপত্রের সাড়াজাগানো শিরোনামের তুলনায় সাহিত্যের এই প্রচার অনেক সীমিত, অনেক নির্জন, কিন্তু এর দ্বারা অঙ্কুরিত স্বপ্নের চরিত্র অনেক বেশি। সাহিত্যের জন্মই এক অদৃশ্য কিন্তু অপ্রতর্ক্য হস্তক্ষেপে, জীবন, সমাজ, ঘটনা ও ইতিহাসকে একেবারে নিজের মতো করে ভেঙে-গড়ে, ভেঙে-গড়ে, ভেঙে-গড়ে, ভেঙে-গড়ে, গড়ে-গড়ে, গড়ে একেবারে এক সমান্তরাল, বিকল্প সত্যে নির্মিত করায় (সাহিত্য ও সাংবাদিকতা : শংকরলাল ভট্টাচার্য)।”
আমাদের কিংবদন্তির পূর্বসূরিরা সংবাদ ও সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে জাতির মনোরাজ্যে এক বিপ্লব সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম একাধিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৮৮৯ সালের নবজাগ্রত স্বাধীনতাকে দমন করার লক্ষ্যে ইংরেজ সরকার কুখ্যাত সিডিশন বিল পাস করে। বিল পাস হওয়ার আগের দিনে কলকাতার টাউন হলে আহূত প্রতিবাদ সভায় ‘কণ্ঠরোধ’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদ প্রকাশের অধিকারকে ‘একটি পরশাসিত জাতির আত্মসম্মান প্রতিষ্ঠার একটি অপরিহার্য অবলম্বন’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। ইংরেজ শাসকদের উদ্দেশে বলেছিলেন “সিপাহী বিদ্রোহের পূর্বে হাতে হাতে যে রুটি বিলি হইয়াছিল তাহাতে একটি অক্ষরও লেখা ছিল না Ñ সেই নির্বাক নিরক্ষর সংবাদপত্র কি যথার্থ ভয়ঙ্কর নহে? সর্পের গতি গোপন এবং দংশন নিঃশব্দ। সেই জন্যই কি তাহা নিদারুণ নহে? সংবাদপত্র যতই অধিক এবং যতই অবাধ হইবে, স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে দেশ ততই আত্মগোপন করিতে পারিবে না।”
ষাট দশকে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধে প্রেস অর্ডিন্যান্স জারির প্রতিবাদে বরেণ্য জাতীয় সন্তান সাংবাদিক-সাহিত্যিক মওলানা আকরম খাঁর নেতৃত্বে আবদুস সালাম, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী প্রমুখের অংশগ্রহণে জাতীয় প্রেস কাব থেকে এক ঐতিহাসিক মিছিল বেরিয়েছিল। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীর ভাষায় : আমার তো মনে হয় এত বড় মিছিল বোধহয় পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশে আমলে আর বেরোয়নি (পঞ্চাশ বছরের সাংবাদিকতা : জাতীয় প্রেস কাব)।
যা হোক, ওই কুখ্যাত সিডিশন বা রাজদ্রোহ আইনে কারানির্যাতিত প্রথম সাংবাদিক ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর সম্পাদিত ‘ধূমকেত’ু পত্রিকায় প্রকাশিত আনন্দময়ীর আগমনে (আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল) কবিতার জন্য এক বছরের কারাদণ্ড পান। নজরুলের সম্পাদকীয় রচনার ভাষা ছিল তেজোদৃপ্ত। উদ্ধৃতি দিচ্ছি একটি সম্পাদকীয় (নিশান-বরদার) থেকে : “আমাদের বিজয় পতাকা তুলে ধরবার জন্য এসো সৈনিক। পতাকার রং হবে লাল তাকে রং করতে হবে খুন দিয়ে। বল আমরা পেছোব না। বল আমরা সিংহ শাবক আমরা খুন দেখে ভয় করি না। আমরা খুন নিয়ে খেলা করি, খুন দিয়ে কাপড় ছোপাই, খুন নিয়ে নিশান রাঙাই। বল আমি আছি আমি পুরুষোত্তম জয়। বল মাভৈঃ জয় সত্যের জয়। আমি আছি বলে নিশান হাতে তুলে নাও। এসো দলে দলে নিশানধারী বীর সৈনিক ভাইরা আমরা। নিজেকে সৈনিক বলে প্রচার করি এসো। এসো শয়তানকে অর্ধেক পুঁতে ফেলে তার মাথার উপর তাদেরি মাথার মগজের চর্বি দিয়ে চেরাগ জ্বালাই। শয়তানকে দগ্ধ করে মারতে হবে। এই কথা বলে বেরিয়ে এসো Ñ আমি আছি আমাতে আমিত্ব আছে, আমি পশু নই, আমি মনুষ্য, আমি পুরুষ সিংহ। আমাদের বিজয়ী হতে হবে। বিজয় পতাকা ওড়াতে হলে খুন খোসরোজ খেলতে হবে। ধর ধর এক হাতে ভীম খড়গ সর্বনাশের ঝাণ্ডা Ñ আর এক হাতে ধর রক্তমাখা পতাকা। আমাদের এই বিজয় মঙ্গলের সময় যদি কেউ বাধা দিতে আসে তবে তাকে বড় থেকে অর্ধেক ছাড়িয়ে নিয়ে অর্ধেক সাগর জলে ভাসিয়ে দাঁড় আর অর্ধেক খানা সেখানে পড়ে দুপায়ের গিঁটে যেন ঠোকাঠুকি করে।”
সে সময় ইউরোপীয় বণিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য যেমন ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশিত হতো তেমনি ভারতীয় হিন্দুরাও দ্য হিন্দু প্যাট্রিয়ট, দ্য বেঙ্গলি, ইন্ডিয়ান মিরর, অমৃতবাজার পত্রিকা, দ্য ট্রিবিউন, দ্য মারাঠা প্রকাশ করে। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, অরবিন্দ ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ তাদের সংবাদপত্র দ্বারা স্বদেশী আন্দোলন চাঙ্গা ও বঙ্গভঙ্গ রোধে উত্তপ্ত ভূমিকা রাখেন। প্রথম মহাযুদ্ধের শেষ (১৯১৯) এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরুর (১৯৩৯) মধ্যবর্তী দুই দশকে বাংলার সংবাদপত্রের চেহারা বদলে যায়। রাজনৈতিক দিক দিয়ে তিন ধরনের পত্রিকা ছিল। এক পক্ষ কংগ্রেসের সমর্থক, অন্যপক্ষ নবজাগ্রত মুসলিম লীগের অনুসারী (আজাদ, মোহাম্মদী, স্টার অব ইন্ডিয়া, মর্নিং নিউজ) আর তৃতীয় পথ বামধারার। সংবাদপত্র, সাময়িকপত্রের সম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করে প্রেস কাবের সদস্য, পরিশ্রমী গবেষক মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া ‘হিস্টরি অব দ্য প্রেস ইন বাংলাদেশ’ প্রকাশ করে জাতির সশ্রদ্ধ সমীহা অর্জন করেছেন।
“১৯৩৫ এর ভারত শাসন আইন অনুযায়ী সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারার ভিত্তিতে ১৯৩৭ এর জানুয়ারিতে প্রাদেশিক আইনসভার প্রথম ভোট থেকে বাংলা কাগজগুলোর ভেতরের এসব রাজনীতির সূক্ষ্ম ভাগাভাগি মুছে গেল। সব কাগজই তারস্বরে সাম্প্রদায়িক হয়ে গেল। সাম্প্রদায়িকতার জিভ ছিল সাপের জিভের মতো কাটা। তার এক ডগা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষ ছড়াত, আর এক ডগা তপশিলি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। এই দুই শত্রুর কাছে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদ এত তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল যে আগস্ট আন্দোলনের খবরও এসব কাগজে যথেষ্ট কম বেরোয়। হিন্দু কাগজগুলোর এই সাম্প্রদায়িকতার প্রতিক্রিয়া ও মুসলমান সমাজের রাজনৈতিক স্বাধিকারের আন্দোলনের প্রয়োজনে আজাদ ও ইত্তেফাক দুইটি মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার পোষকতা শুরু করে। বাংলা খবরের কাগজে বাঙালির যে বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়েছিল, তার জায়গায় নতুন এই বাঙালি বৈশিষ্ট্য এল চিৎকৃত সাম্প্রদায়িকতা। ১৯৪০ থেকে প্রায় ১৯৭০ পর্যন্ত এই বিদ্বিষ্ট, চিৎকৃত, বিকারগ্রস্ত ও অপ্রমাণিত সংবাদনির্ভর সাংবাদিকতা বাংলার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল (ঔপন্যাসিক দেবেশ রায় : খবর বলছি ..... সম্প্রচারের ভাষা ও ভঙ্গি)। “মুসলিম লীগ সমর্থক পত্রিকাগুলি” ৪৭-এর পর ঢাকায় চলে যায়। রাজনীতির প্রশ্নে এই পত্রিকাগুলির সঙ্গে কলকাতার অন্যান্য সংবাদপত্রগুলির নিয়মিত চাপান উতোর চলত। এমনকি আজাদ পত্রিকার আরবি ফারসি শব্দ মেশানো বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে নানা রকম ব্যঙ্গবিদ্রƒপও করা হতো। কিন্তু ইতিহাসের এমনই অনির্দেশ্য কুটিল গতি যে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু চাপাবার ষড়যন্ত্র হলে আজাদ ও ইত্তেফাক তার বিরোধিতা করে। (কৃষ্ণ ধর : বিংশ শতাব্দীর সংবাদপত্র : বাংলা দৈনিক পত্রিকা, বাংলা আকাদেমী পত্রিকা)।
মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্র বয়ানে জানা যায়, মুসলিম বাংলার সাহিত্য-সাংবাদিকতার অগ্রনায়কদের উদ্যোগে এবং অকান্ত প্রচেষ্টায় প্রকাশিত পরিচালিত ও সম্পাদিত মাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকার মাধ্যমেই বাংলার মুসলমানের সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতা ব্যাপকতা লাভ করে.... বিভাগপূর্বকালে যেমনি বিভাগ পরবর্তীকালেও তেমনি আমাদের অনেক সাংবাদিক-সাহিত্যিকের রচনাই সাংবাদিকতার প্রয়োজনে সৃষ্ট হলেও স্থানীয় আবেদনের অধিকার অর্জন করেছে।
স্বতন্ত্র জাতীয়তা
ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জাতীয় মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবির পটভূমি সম্পর্কে বলেছেন, কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা ১৮৮৫ সালে, মুসলমানরা কংগ্রেসের পাল্টা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকায়, ১৯০৬ সালে। শুরুতে কংগ্রেস ও লীগের ভেতর উদ্দেশ্যগতভাবে এক বিষয়ে মিলন ছিল উভয় প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য, ছিল ভারতীয়দের ভেতর শাসকদের প্রতি আনুগত্য গড়ে তোলা। বিচিত্র অভিজ্ঞতা সমাকীর্ণ পতন বন্ধুর যাত্রাপথে সংগঠন দু’টি ক্রমান্বয়ে শাসকদের পরিবর্তে দেশের স্বাধীনতার নিকটবর্তী হতে চেয়েছে, কিন্তু কখনো সম্পূর্ণভাবে এক হয়ে যেতে পারেনি। তাদের প্রবাহ ছিল সময়েই কম-বেশি সমান্তরাল। তার কারণ স্পষ্টতই এই যে, মুসলিম সংখ্যালঘুরা হিন্দু সংখ্যাগুরুকে ভয় না করে পারেননি। কংগ্রেস যে স্বাধীনতার কথা বলতেন সেখানে ভারতীয় মুসলিম নিজের জন্য নতুন এক পরাধীনতার নিগড় দেখে শিউরে উঠেছেন। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনেও এই ভীতির কারণগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট ও বাস্তব (সাহিত্যে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবি : পাকিস্তান আন্দোলন ও মুসলিম সাহিত্য)।
রেনেসাঁ আন্দোলন
মুসলিম মানসে স্বকীয়তার উত্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কলকাতায় ১৯৪২ সালে সাংবাদিক-সাহিত্যিকেরা রেনেসাঁ আন্দোলনের সূচনা ঘটান। ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব পাসের পরবর্তী পর্যায়ে এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই আন্দোলন সূচিত হলেও রাজনৈতিক স্বাধীনতা তথা মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে নবজাগরণ তথা রেনেসাঁ আনয়নই ছিল এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান কথাটি ছিল না বটে, তবে তাতে ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে দু’টি স্বতন্ত্র স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। এ সূত্রেই রেনেসাঁ আন্দোলনের নায়করা ধরে নিয়েছিলেন যে, পাকিস্তান পরিকল্পনা অনুসারে ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে গঠিত পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তান হবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, কিন্তু পরবর্তীকালে বাস্তবে তা ঘটেনি এবং ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ ও (সাবেক) পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় লাহোর প্রস্তাবের মর্মবাণীকে অগ্রাহ্য করে; ১৯৪৬ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের কনভেনশনে অনুমোদিত দুই রাষ্ট্রের বদলে এক রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব অনুসারে। কিন্তু দেশ ভাগের আগেই ১৯৪২ এরও আগে, পূর্ব পাকিস্তান কথাটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও প্রতীক হিসেবে চালু হয়ে গিয়েছিল এবং বুদ্ধিজীবীদের মনোরাজ্যেও ঠাঁই করে নিয়েছিল। এ কারণেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে ১৯৪২ সালে কলকাতায় ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’ এবং ঢাকায় ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’ প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল। দু’টি সংস্থা গঠনেই ‘আজাদ’ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীনের অনুপ্রেরণা এবং মুজীবুর রহমান খাঁর উদ্যোগী ভূমিকা ছিল। বস্তুত দু’টি সংস্থাই মূলত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উদ্দেশ্যে গঠিত এবং পরিচালিত হলেও রাজনৈতিক লক্ষ্যও এতে অন্তরিত ছিল’। (মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতা ও আবুল কালাম শামসুদ্দীন : মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্)
রাষ্ট্রভাষা বাংলা
রেনেসাঁর নায়কেরা ১৯৪২-৪৩ সাল থেকেই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চিন্তা করেছেন। ‘পাকিস্তানের আন্দোলনকালে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধই প্রবল হয়। কিন্তু এ দেশের মুসলমান সমাজ যে বাঙালি পরিচয়কে গৌণ করে দেখেনি, তারও নানা প্রমাণ আছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই বাংলাভাষাকে নতুন রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের দাবি উঠেছিল (জাতীয়তাবিষয়ক ভাবনা, ডক্টর আনিসুজ্জামান, এপিটাফ ১৯৮০)।
মওলানা আকরম খাঁ, মুজীবুর রহমান খাঁ, হবীবুল্লাহ বাহার, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, তালেবুর রহমান, আবদুল হক, ফররুখ আহমদ তাঁদের নানা রচনায় এ বিষয়টি তুলে ধরেন।
সে সময় আরও তিনটি জাতীয় দৈনিকের উল্লেখ না করলে সাংবাদিকতা ও বাংলাদেশের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। পাকিস্তান অবজার্ভার, ইত্তেফাক ও সংবাদ আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে উচ্চশিখরে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। এই তিনটি পত্রিকাকে বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক বক্তব্যের জন্য সরকার কয়েকবার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। মানিক মিয়া, আবদুস সালাম ও জহুর হোসেন চৌধুরী Ñ এই তিন সম্পাদক আইয়ুব-মোনেমের জন্য ছিলেন মস্ত শিরঃপীড়া। তাঁরা প্রেস কাবকে তরুণ সাংবাদিকদের মতো সম্পৃক্ত করে নিতে চেষ্টা করতেন। তখন থেকেই প্রেস কাবের ‘কাব চরিত্রের’ বুনিয়াদ (আমাদের পৃথিবী, সেলবিদ্ধ প্রেস কাব : ফয়েজ আহমদ)। পাকিস্তান অবজার্ভার বেরুল ১৯৪৯-এ। মালিক স্মরণীয় আইনজীবী ও মুসলিম লীগ নেতা হামিদুল হক চৌধুরী। পত্রিকাটি প্রথম রোটারি মেশিনে ছাপা উপলক্ষে সগর্বে ঘোষণা দিয়েছিল Ñ এখন থেকে অবজারভার ইংল্যান্ড থেকে আনা রোটারি মেশিনে, রাশিয়ান নিউজপ্রিন্টে ভারত থেকে আনা কালিতে ছাপা হয়ে পাঠকদের হাতে পৌঁছবে। কিংবদন্তি সাংবাদিক আবদুস সালাম পরের বছর এর সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন। মাহবুব জামাল জাহেদী, এসএম আলী, ওবায়দুল হক, এবিএম মূসা, এজেডএম এনায়েতুল্লাহ খান, শহীদুল হক, আবদুল মতিন, বদরুল হক, আসাদুজ্জামান বাচ্চু, আবদুর রহিম, আতাউস সামাদ প্রমুখ উজ্জ্বল সাংবাদিকগণ পাকিস্তান অবজারভারকে বাঙালি জাতির অন্যতম দিশারিতে পরিণত করেন। মওলানা ভাসানীর তত্ত্বাবধানে ইয়ার মোহাম্মদ খানের অর্থানুকূল্যে ও সম্পাদনায় ১৯৪৯ সালে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক বেরোয়। আবু জাফর শামসুদ্দীন পরে সম্পাদক হন। ১৯৫১ তে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া (কলকাতার ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকা, যার সম্পাদক ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ) তার সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে তিনি ইত্তেফাক হাতে নেন। এমআর আখতার মুকুল, ফয়েজ ভাই। ১৯৫৩-তে তিনি এটিকে দৈনিকে রূপান্তরিত করেন। মানিক মিয়ার লেখনী আওয়ামী লীগের পক্ষে দেশবাসীকে উদ্বোধনী মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। ১৯৬৯-এ তিনি মারা গেলে জ্যেষ্ঠপুত্র ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন দায়িত্ব নেন। প্রথিতযশা সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেন হন নির্বাহী সম্পাদক। মুসলিম লীগের মুখপত্র হয়ে বের হলেও পরে সংবাদ বামধারার শক্তিশালী দৈনিকে পরিণত হয়। সংবাদ-এ ছিলেন আহমদুল কবির, সৈয়দ নূরুদ্দীন, সরদার ফজলুল করিম, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, কাজী মোহাম্মদ ইদরিস, মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ, মন্টু লোহানী, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, সাদেক খান, আবু তাহের আওয়াল খান, শহীদুল্লাহ কায়সার, সন্তোষ গুপ্ত, বজলুর রহমান, ফয়েজ আহমদ, কে জি মুস্তফা, মোহাম্মদ তোহা খান, শহীদ সাবের, তোয়াব খান, আলী আকসাদ। অন্য দিকে মর্নিং নিউজে ছিলেন এসজিএম বদরুদ্দীন, ওয়াহিদুল হক, হাসানুজ্জামান খান।
সাংবাদিকদের সেই স্বাধিকার আন্দোলনে ফটো সাংবাদিকদের স্মরণে না আনলে গুনাহ হবে। মোজাম্মেল হোসেন, লাল ভাই, মোয়াজ্জেম হোসেন বুলু, রশীদ তালুকদার, আফতাব আহমেদ, গোলাম মাওলা, জহিরুল হক, কামরুজ্জামান, ওয়াসে আনসারী, মোকাদ্দাস ভাই, মানু মুন্সী, মোহাম্মদ আলম, আকিল খান, জালালউদ্দিন হায়দার, রফিকুর রহমান প্রমুখ আন্দোলনের এক ফটোগ্রাফিক কাব্য রচনা করে পাঠকদের উজ্জীবিত করেছেন।
জাতীয় প্রেস কাব গঠন ও বিকাশ আজকের জাতীয় প্রেস কাবের প্রতিষ্ঠার পেছনে মূল উদ্যোগী পুরুষ ছিলেন সংবাদ সম্পাদক খায়রুল কবীর। স্বাধীন রাষ্ট্রে সাংবাদিকদের একটা প্রতিষ্ঠান চাই। খায়রুল কবীরের টিকাটুলিস্থ নাহা ম্যানসনের বাড়িতে তখন সাংবাদিকদের আড্ডা হতো। ঢাকাস্থ ভারতীয় সাংবাদিক বালান (অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব ইন্ডিয়া), বিলাতের ডেইলি মেইল প্রতিনিধি উইলিয়াম ননী, ‘সংবাদ’-এর সৈয়দ নূরুদ্দীন, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ডাইরেক্টর (ইনফরমশন) সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন, পাকিস্তান অবজারভার সম্পাদক আবদুল সালাম। সেস্টসম্যান পত্রিকা প্রতিনিধি এমএ ওহাব, এস জি এম বদরুদ্দীন আলোচনায় অংশ নিতেন। তাদের সঙ্গে নাজির আহমদ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দিন আহমেদ, কামরুল হাসান, সুরশিল্পী আবদুল আহাদ প্রেস কাব গঠনে উৎসাহী ছিলেন। বিবিসি খ্যাত যশস্বী সাংবাদিক, তৎকালীন দৈনিক মিল্লাত-এর বার্তা সম্পাদক সিরাজুর রহমান বলেছেন, ১৯৫২-এর গোড়ার দিকে সংবাদ-এর বার্তা সম্পাদক সৈয়দ নূরুদ্দীন, যুগ্ম সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী ও আমাকে নিয়ে প্রেস কাব গঠনার্থে একটি কমিটি গঠিত হয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে সার্থক করার প্রক্রিয়ায় অগ্রসেনানি সাংবাদিক সমাজ একুশে ফেব্রুয়ারির পর নাব উদ্দীপনায় আরো সোৎসাহী হয়ে ওঠেন। নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সম্মেলন হল কার্জন হলে ৭ ডিসেম্বর ১৯৫২-তে। সেখানেই আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব গৃহীত হলো প্রেস কাব প্রতিষ্ঠার। বাড়ি খোঁজাখুঁজিও শুরু হলো। কিন্তু তদানীন্তন চিফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদ রাজি নন। জনাব খায়রুল কবীর ১৯৫৪ সালে তথ্য মন্ত্রণালয়ে স্পেশাল অফিসার হিসেবে যোগ দেয়ার পর তাঁর তদবির বেড়ে যায়।
তিনি জানাচ্ছেন, ১৯৫৪ সালে ৯২ ধারার অধীনে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে যায়। প্রায় সামরিক শাসন। সব সামরিক শাসন বা গোত্রছাড়া কঠোর শাসন যখন প্রবর্তিত হয়, তার শুরুর দিকটাতে দুই রকম আধিক্য দেখা যায় Ñ কঠোরতার আধিক্য এবং উদারতার আধিক্য। প্রেস কাবের জন্য শহরের কেন্দ্রস্থলে অনেকখানি জায়গাজুড়ে একটি মনোরম বাড়ি বরাদ্দ করা হয় সম্ভবত শেষোক্ত কারণে। কারণ যা-ই হোক, ১৯৫৪ সালে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম প্রেস কাব আনুষ্ঠানিকভাবে স্থাপিত হয়ে গেল ঢাকাতে।
জাতীয় প্রেস কাবকে ঘিরে জাতির অগ্রগণ্য সব সাংবাদিক, যাঁদেরকে জাতীয় সত্তা বললে অত্যুক্তি হবে না, তাঁদের সাংবাদিকতা ও জাতীয় দায়িত্বে আবর্তিত হয়েছেন। পুরনো সেই লাল বাড়িটার স্মৃতি মুছে ফেলা কঠিন। মরহুম ফয়েজ আহমদ তাঁর মূল্যবান গ্রন্থ ‘সত্যবাবু মারা গেছেন’ জাতীয় প্রেস কাবকে উৎসর্গ করে লিখেছেন, যাকে কেন্দ্র করে সমস্ত সংবাদের উৎস সন্ধান ও পরিসমাপ্তি।
বাংলাদেশের সাংবাদিক-সাহিত্যিক ’৪৭-এর আগে ও পরে দু’টি ধারায় জাতির সেবায় নিয়োজিত থাকলেও (পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি ও পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ) ভাষা আন্দোলনে এক সুরে বাংলাভাষার পক্ষে থেকেছেন। একই সঙ্গে মিলেমিশে সাংবাদিক ইউনিয়ন গঠন করেছেন। আবার প্রেস কাবের প্রথম ব্যবস্থাপনা কমিটিতে রেনেসাঁর সভাপতি মুজীবুর রহমান খাঁকে সভাপতি এবং ‘সংবাদ’ এর যুগ্ম-সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরীকে সম্পাদক করেছেন। দু’ধারার অপূর্ব সম্মিলন। ফয়েজ ভাই লিখেছেন, কাব সদস্যগণ যে কোনো রাজনৈতিক মতের সাংবাদিক হতে পারেন, যে কোনো প্রতিক্রিয়াশীল বা বিপ্লবী পত্রিকার সাংবাদিক হলেও আপত্তি নেই। সহ-অবস্থানের এক আদর্শ বিচরণ ভূমি। সহাবস্থানের ভারসাম্য রক্ষা করার ঐতিহ্য প্রেস কাব প্রতিষ্ঠার সময় থেকে এবং সিনিয়র মেম্বার বা কয়েকজন সম্পাদকই এই পরিবেশ সৃষ্টির পথপ্রদর্শক। আর একই সঙ্গে সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের অন্তঃজ বন্ধনকে ক্রমাগত পুষ্ট করেছেন। দেশের কোন একটি সংঘে এতো সাহিত্যিক, যাঁদের অনেকেই জাতীয়ভাবে সম্মানিত, আছে কি না জানা নেই। আমাদের পূর্বসূরিরা বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠায় পর্যন্ত উদযোগী ছিলেন। এর মধ্যে সেই আমলে সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রেস কাবের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল। ষাটের দশকে গোটা পাকিস্তানে ১৭ দিনের ধর্মঘট করেছিল সাংবাদিক ইউনিয়ন।
জাতীয় প্রেস কাব নিয়ে এর সদস্যরা পর্বতপ্রমাণ গৌরব বোধ করেন। পাকিস্তান আমলে স্বৈরশাসক আইয়ুবের বশংবদ গভর্নর মোনায়েম খাঁকে প্রেস কাবে ঢুকতে দেয়া হয়নি। আমন্ত্রণ জানানো তো দূরের কথা, আরেক স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকেও কখনও দাওয়াত দেয়া হয়নি। এ নিয়ে তার যথেষ্ট আক্ষেপ। এরশাদবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনে প্রেস কাব ছিল রাজনীতিকদের তীর্থকেন্দ্র, আশ্রয়স্থল।
এই প্রেস কাবের সঙ্গে প্রতিজন সদস্যের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। প্রেস কাব সবার কাছে সেকেন্ড হোম। কারো কারো ‘ফার্স্ট হোম’। জনাব ননী, খতিব সাহেব এই কাবেই থাকতেন। একবার বন্যার সময় আবদুস সালাম পরিবার অর্থাৎ জামাতা এবিএম মূসাসহ কাবেই আশ্রয় নেন। মূসা ভাইয়ের এক সন্তানের প্রজন্ম প্রেস কাবে এবং দুই মেয়ের বিয়ে সেখানেই। আর ব্যাচেলর সদস্যরা একে শ্বশুরালয়ের মতোই ব্যবহার করেছেন ও করছেন। মরহুম হুমায়ুন কবীর চৌধুরীর দুনিয়াটা ছিল প্রেস কাবেই।
প্রায় তিন একর জমির ওপর সেই ছোট্ট লাল দালানটুকু একবার হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। রমনা পার্কের বিপরীতে শিল্পকলা একাডেমি সংলগ্ন স্থান কাবকে সরিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর ছিল মুজিব সরকার। এ সংক্রান্ত ফাইলেও সরকারপ্রধান সই করেন ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি। কিন্তু এর মধ্যে পটপরিবর্তন হয়ে গেলে কাব কর্তৃপক্ষ ও শিল্পকলা একাডেমির যৌথ সম্মতিতে জিয়াউর রহমানের সরকার কাবের বর্তমান স্থানে জমি বরাদ্দ, পুরাতন বিল্ডিংয়ের মূল্য পরিশোধ এবং নতুন কাব ভবন নির্মাণে সম্পূর্ণ খরচ বহনের সহযোগিতা প্রদান করেন। কাবের ৫ বার নির্বাচিত সম্পাদক এ এস এম হাবিবুল্লাহ জানিয়েছেন : “বর্তমান স্থানে নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়ার নাম কার্যনির্বাহী পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় (৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী স্মরণিকা)”। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কাবের অবরাদ্দকৃত আরো প্রায় ২ একর জমি বরাদ্দ দেন এবং পশ্চিম পাশে নতুন বহুতল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। জমি রেজিস্ট্রির ওই দলিলে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমার স্বাক্ষর থাকায় আমি অহঙ্কার বোধ করি।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র হওয়ার পর সংবাদপত্রকে অসভ্যতার আক্রোশে পড়তে হয়েছে বেশি। তাই সাংবাদিক ইউনিয়ন ও প্রেস কাবের পথ চলায় অনিশ্চয়তা ছিল বরাবরের মতোই। বাংলাভাষার অন্যতম প্রধান কবি ও গণকণ্ঠ সম্পাদক আল মাহমুদ, হলিডে সম্পাদক এ জেড এম এনায়েতুল্লাহ খান, রয়টার্স-এর আতিকুল আলম গ্রেফতার হন, অসংখ্য পত্রিকা বন্ধ ও সাংবাদিকের কর্মচ্যুত করা হয়। বিবিসির আতাউস সামাদ ও আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে নিক্ষেপ, চ্যানেল ওয়ান ও দিগন্ত টিভি বন্ধ, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড, আইসিটি অ্যাক্ট এবং গণবিরোধী জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা প্রভৃতি নিয়ে এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন প্রেস কাব এখনো সাহসের জায়গা। এরশাদের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানটা প্রেস কাবকে সামনে রেখেই হয়েছে।
‘কিছু করার দায়িত্ব’ সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও প্রেস কাবকে জন্মদিন থেকেই ব্যস্ত রেখেছে। স্বপ্ন দেখা ও দেখানো ছাড়া সাংবাদিকতার লক্ষ্যে তৃতীয় ও শেষ স্বপ্ন যদি কিছু থেকে থাকে তবে সেটা সমাজ ও জীবনের প্রবাহে এক ধরনের হস্তক্ষেপের। জাতীয় জীবনে কালো মেঘের সঞ্চার হলেই আলোর জন্য মানুষ ধাবিত হয় তোপখানা রোডে প্রেস কাবের দিকে। এর পরও অন্তরঙ্গে কাব আমাদের জন্য এমন যে, দার্শনিক পাস্কালের সেই উচ্চারণেই আমরা আশ্রয় নিই Ñ ‘হৃদয়েরও কিছু যুক্তি আছে, যুক্তি যার কিছুই জানে না।’ ফয়েজ ভাইয়ের কথাটা এখনো কানে বাজে, “বুঝলা শওকত, প্রেস কাবটা সাংবাদিকদের কাছে একটা ছোটখাটো পৃথিবী। এই ধর আনন্দ উল্লাস, হাসি-কান্না, মিষ্টি-ঝাল খাবার, তাস-দাবা, বন্ধুতা-শত্রুতা, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, রাজনৈতিক চেতনা, চিত্রকলা প্রদর্শনী, সুসময়-দুঃসময়, জ্ঞান বিকাশ, জ্ঞান প্রকাশ, স্ফূর্তিতে হাসাহাসি, বৈরিতায় হাতাহাতি, এমনকি গ্রেফতার, মুক্তি ঘোষণা এবং বুলেট-শেল পর্যন্ত।”
শওকত মাহমুদ : সাবেক সভাপতি
জাতীয় প্রেস কাব
সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন
কলাম্বিয়ার সাংবাদিক ও নোবেলবিজয়ী ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর সাংবাদিক সম্বন্ধীয় এই নিখুঁত পর্যবেক্ষণকে উল্লেখপূর্বক বাংলাদেশের অগ্রগণ্য সাংবাদিক জাতীয় প্রেস কাবের ডাকসাইটে সাবেক সভাপতি মরহুম এ জেড এম এনায়েতুল্লাহ খান (মিন্টু ভাই) আরও এগিয়ে বলেছিলেনÑ “চার দশকেরও বেশি সময় ধরে মার্কেসের মূর্ত ভাষাশৈলীর বিস্তারের মতো অনুপম রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন হয়েছি, বেগবান অশ্বের মতো ধাবিত হয়েছি, যুধ্যমান সৈনিকের মতো শব্দের হাতিয়ার দিয়ে বৈরী শক্তিকে বিদ্ধ করেছি। আবার পরম মমত্ব দিয়ে তৈরি শব্দাবলীর ঝাঁপি দিয়ে অনুরাগের মিনার সোপানে অর্পণ করেছি।” মিন্টু ভাইয়ের অনুপম রোমান্টিকতার অর্থ সাংবাদিক নিজে স্বপ্ন দেখে, পাঠক-দর্শককে স্বপ্ন দেখায়। এর বাইরেও আরেক দায়িত্ব, সমাজে হস্তক্ষেপের। বিদ্ধ করা বৈরী শক্তিই অন্যায় অবিচার পরাধীনতা অগণতান্ত্রিকতা।
জন্ম থেকেই সাংবাদিকতা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার প্রতিস্পর্ধী ভূমিকায়। এ সত্যটা আরও বেশি করে বাঙময় বঙ্গ-পাক-ভারত উপমহাদেশে তথা বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এবং ধারাবাহিকভাবেই তাদের দিনলিপি নির্মিত হয়েছে শুধু সত্য-তথ্যের জ্ঞাপনে নয়, বরঞ্চ দ্রোহে এবং জাতি গঠনে, ভাষা-সংস্কৃতির সুস্থ বিকাশের বুনিয়াদে। বিশ্বের আর কোনো অঞ্চলে বা জাতিতে সাংবাদিকতা এমন প্রবলভাবে স্বাধীনতা-দেশমুখী, ফ্যাসিবাদবিরোধী, গণতন্ত্রকেন্দ্রিক, সত্য-ন্যায়ের নিশান-বরদার কি না জানি না। নইলে পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই কেন সাংবাদিকেরা স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য আওয়াজ দেবেন, চিন্তার রাজ্যের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য রেনেসাঁর উদ্যোগ নেবেন, বাংলাকে মাতৃভাষা করার জন্য ১৯৪২ থেকেই আন্দোলন শুরু করবেন এবং ’৪৭ সালে ‘পূর্ববঙ্গ সাংবাদিক সংঘ’ সরকারের কাছে স্মারকলিপি দেবে। কেন বায়ান্নর একুশেতে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ‘আজাদ’ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রাদেশিক পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন? ২৬ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারের উদ্বোধক তিনি। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১ ফেব্রুয়ারি’-অমর এই গানটির রচয়িতা সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী এবং একুশের প্রথম এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী সঙ্কলনটির সম্পাদক একজন সাংবাদিক হাসান হাফিজুর রহমান। ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সম্মুখ-সৈনিক হয়েছেন এই সাংবাদিক সমাজ এবং বাংলাদেশের সকল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে অনাপোস আন্দোলন করবেন এবং এসব আবর্তিত হয়েছে ‘জাতীয় প্রেস কাব’ নামক নিরন্তর সংগ্রামে অমলিন প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে।
১৯৫৪ সালে প্রেস কাবের আনুষ্ঠানিক জন্ম এবং এর গঠনতন্ত্রে ‘জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম’ শব্দত্রয়ের সন্নিবেশন কোনো রোমান্টিকতা ছিল না বরং গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্য জাতীয় আত্মার আকুতি ধারণেরই পরিচয়। এক সংগ্রামী প্রয়াস ছিল সে পর্বটি। জীবনের নানাক্ষেত্রে কৃতী পুরুষ এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম উদযোগী পুরুষ এবং সংবাদ-এর সাবেক সম্পাদক মরহুম খায়রুল কবীর কী আবেগেই না বলেছিলেন Ñ “আমার জীবনের বড় সাফল্য ‘জাতীয় প্রেস কাব’ প্রতিষ্ঠা।” তারুণ্যে টগবগ খায়রুল কবীরের বয়স তখন সাতাশ-আটাশ। আরেক প্রবীণ সদস্য ও এক সময়ের চোস্ত রিপোর্টার আবদুর রহিমের মতে ‘প্রেস কাব বাংলাদেশের রাজনীতির সূতিকাগার’। দৈনিক বাংলার বরেণ্য রিপোর্টার, পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণে তীè মরহুম মাশির হোসেন এই সত্যই উচ্চারণ করেছিলেন Ñ ‘প্রেস কাব শুধু ভবনগত অবকাঠামোই নয়। এর মানসবিহার অনেক বিস্তৃত। বর্তমানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে টের পাই অতীত ও ভাবীকালের করমর্দন। প্রেস কাবের ব্যাপ্তি ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়েই।”
আমাদের সাংবাদিকতার ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রাজনীতির ইতিহাস। ‘বাংলাদেশের দেড় শ’ বছরের সংবাদপত্র বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস, (সৈয়দ আবুল মকসুদ) ইতিহাসের এক পর্বে প্রাধান্য পেয়েছে কলকাতাকেন্দ্রিক স্বাধিকারমুখী সাংবাদিকতা। ’৪৭ সালের পর থেকে স্বকীয়তা নির্মাণের ও স্বাধীনতার সংগ্রামের অভিনিবেশে আরেক অধ্যায়। আর বাংলাদেশ আমলে গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের লড়াইয়ে ঠাসা আরেক চলমান ইতিহাস। সংবাদচর্চার মূলে রয়েছে সামাজিক চর্চা। সময় ও সমাজ যেমন তার পশ্চাৎপট, তেমনই ইতিহাসসচেতনতা হলো তার অস্তিত্বের গুরুত্ব নিয়ামক (বিংশ শতাব্দীর সংবাদপত্র : বাংলা দৈনিক পত্রিকা : কৃষ্ণ ধর)। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে শ্রীরামপুরের মিশনারিদের উদ্যোগে ‘সমাচার দর্পণ’ (১৮১৮) ও দিগদর্শন (১৮১৮) এবং একই বছরের গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের ‘বঙ্গাল গেজেটি’ পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষায় মুদ্রণমাধ্যমের সূত্রপাত। ১৮৩১ সালের ৭ মার্চ বেরোয় মুসলমান সম্পাদিত প্রথম বাংলা পত্রিকা ‘সমাচার সভা রাজেন্দ্র’। খ্রিষ্টধর্ম বাংলাসহ স্থানীয় ভাষাগুলোতে প্রচারের জন্য শ্রীরামপুরে ছাপাখানা আমদানি এবং বাংলা গদ্যের প্রচলন করেন পাদ্রি উইলিয়াম কেরি। এর আগে সুলতান কুতুবউদ্দিনের আমল (১২০১) থেকে ইংরেজ গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিংক (১৮৩৬) পর্যন্ত সাড়ে ৬ শ’ বছর ফার্সি ভাষা উপমহাদেশে লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা, অফিস-আদালত ও শিক্ষার মাধ্যম ছিল। আর পল্লী অঞ্চলে পুঁথির ভাষা ছিল বহুলভাবে প্রচলিত। মধ্যযুগে গৌড়ের সুলতানি আমলে পুঁথিসাহিত্য অনুবাদ সাহিত্য এবং পরে গদ্যের মাধ্যমে বাংলা ভাষার বিবর্তনে যে বৈপ্লবিক বিকাশ সাধিত হয় তাতে কবি শাহ মুহম্মদ সগীর, সৈয়দ হামজা, সৈয়দ সুলতান, সৈয়দ আলাউদ্দিন আর সপ্তদশ শতকে কাব্য ও পুঁথিতে বাংলা ভাষা-বিরোধী চক্রের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনি উচ্চারণকারী কবি আবদুল হাকিম রাখেন অসামান্য অবদান। আজও আবদুল হাকিমের এই পঙ্ক্তিগুলি রাষ্ট্রভাষা দিবসে আমরা স্মরণ করি : “যে জন বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি” (সানাউল্লাহ নূরী, সভ্যতার বিবর্তন এবং বাংলা সংবাদপত্র বিকাশের যুগ)। ‘যদি পলাশী ক্ষেত্রে বাংলার মুসলমানদের ভাগ্য বিপর্যয় না ঘটিত, তবে হয়ত এই পুঁথির ভাষাই বাংলার হিন্দু মুসলমানদের পুস্তকের ভাষা হইত।” (ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সংবর্ধনা গ্রন্থ) বাংলাক্রমে সংস্কৃতপ্রধান হয়ে ওঠে।
বাঙালি মুসলমান কর্তৃক সংবাদপত্র প্রকাশের চেষ্টা সম্ভবত ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে। তখন কয়েকজন উদ্যমশীল মুসলমান সাহিত্যিকের আবির্ভাব হয় Ñ যাঁদের সমাজ হিতৈষণা মুসলিম বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই সমাজপ্রাণ সাহিত্যিক গোষ্ঠী হচ্ছে : মুন্সী মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন আহমদ, পণ্ডিত রেয়াজউদ্দিন মাশহাদী, মৌলভী সেরাজুদ্দীন, মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ, মীর্জা মোহাম্মদ ইউসুফ আলী, শেখ আবদুর রহীম, শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হক, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, শেখ ফজলুল করিম, এয়াকুব আলী চৌধুরী, ডা. লুৎফর রহমান প্রমুখ। বাংলার মুসলমানের দুঃখ-দৈন্য, অভাব-অভিযোগ এদের প্রাণে তীব্র জ্বালার সৃষ্টি করেছিল। এঁরা বুঝতে পারেন বাংলার মুসলমানের অভাব-অভিযোগ দুঃখ-বেদনা ব্যক্ত করার জন্য চাই তার একটা বাংলা ভাষার সাপ্তাহিক মুখপত্র। ১৮৮৯ সালে বের হয় ‘সুধাকর’, বিষাদ সিন্ধু খ্যাত মীর মশাররফ হোসেন সে যুগের শুধু আদি সাহিত্যিকই নন, তিনি আমাদের আদি সাংবাদিকও। ‘হিতকরী’ নামে একটি বাংলা সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের তিনি সম্পাদক ও প্রতিষ্ঠাতা। (মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতা ও আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্)।
মূলত সাহিত্যিক-সাংবাদিক এবং সাংবাদিক-সাহিত্যিক এ দু’টি পরিচয় প্রায় অভিন্ন হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশবিরোধী সাংবাদিকতায়। আমাদের সাংবাদিকতার ইতিহাসে সাহিত্য সেবক ও সংবাদজীবীর যুগ্মসত্তাকে ধারণ করা গুণীজনের সংখ্যা অনেক বেশি। এখনও এবং তালিকাটা ঈর্ষণীয়ভাবেই দীর্ঘ। “তথ্যকে ন্যায্যভাবে যুক্তি দিয়ে বিন্যস্ত করাই সাংবাদিকতার ধর্ম। ভাষা তার কাঠকাঠ। সংবাদপত্র হচ্ছে এক সম্মিলিত স্বপ্ন, যা আমরা দেখি দিনের পর দিন। রচিত হয় Literature in hurry সাহিত্যও এক ধরনের স্বপ্ন। রোজ দিনজুড়ে রাতজুড়ে তৈরি হচ্ছে না বা প্রাতঃরাশের টেবিল থেকে সংক্রামকভাবে বিস্তারিত হচ্ছে না, তবে এক ব্যাপক বিস্তীর্ণ সূক্ষ্ম, অলক্ষ্য, চোরাগোপ্তা ধারায় ছেয়ে থাকছে আমাদের জীবনে। সংবাদপত্রের সাড়াজাগানো শিরোনামের তুলনায় সাহিত্যের এই প্রচার অনেক সীমিত, অনেক নির্জন, কিন্তু এর দ্বারা অঙ্কুরিত স্বপ্নের চরিত্র অনেক বেশি। সাহিত্যের জন্মই এক অদৃশ্য কিন্তু অপ্রতর্ক্য হস্তক্ষেপে, জীবন, সমাজ, ঘটনা ও ইতিহাসকে একেবারে নিজের মতো করে ভেঙে-গড়ে, ভেঙে-গড়ে, ভেঙে-গড়ে, ভেঙে-গড়ে, গড়ে-গড়ে, গড়ে একেবারে এক সমান্তরাল, বিকল্প সত্যে নির্মিত করায় (সাহিত্য ও সাংবাদিকতা : শংকরলাল ভট্টাচার্য)।”
আমাদের কিংবদন্তির পূর্বসূরিরা সংবাদ ও সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে জাতির মনোরাজ্যে এক বিপ্লব সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম একাধিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৮৮৯ সালের নবজাগ্রত স্বাধীনতাকে দমন করার লক্ষ্যে ইংরেজ সরকার কুখ্যাত সিডিশন বিল পাস করে। বিল পাস হওয়ার আগের দিনে কলকাতার টাউন হলে আহূত প্রতিবাদ সভায় ‘কণ্ঠরোধ’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদ প্রকাশের অধিকারকে ‘একটি পরশাসিত জাতির আত্মসম্মান প্রতিষ্ঠার একটি অপরিহার্য অবলম্বন’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। ইংরেজ শাসকদের উদ্দেশে বলেছিলেন “সিপাহী বিদ্রোহের পূর্বে হাতে হাতে যে রুটি বিলি হইয়াছিল তাহাতে একটি অক্ষরও লেখা ছিল না Ñ সেই নির্বাক নিরক্ষর সংবাদপত্র কি যথার্থ ভয়ঙ্কর নহে? সর্পের গতি গোপন এবং দংশন নিঃশব্দ। সেই জন্যই কি তাহা নিদারুণ নহে? সংবাদপত্র যতই অধিক এবং যতই অবাধ হইবে, স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে দেশ ততই আত্মগোপন করিতে পারিবে না।”
ষাট দশকে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধে প্রেস অর্ডিন্যান্স জারির প্রতিবাদে বরেণ্য জাতীয় সন্তান সাংবাদিক-সাহিত্যিক মওলানা আকরম খাঁর নেতৃত্বে আবদুস সালাম, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী প্রমুখের অংশগ্রহণে জাতীয় প্রেস কাব থেকে এক ঐতিহাসিক মিছিল বেরিয়েছিল। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীর ভাষায় : আমার তো মনে হয় এত বড় মিছিল বোধহয় পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশে আমলে আর বেরোয়নি (পঞ্চাশ বছরের সাংবাদিকতা : জাতীয় প্রেস কাব)।
যা হোক, ওই কুখ্যাত সিডিশন বা রাজদ্রোহ আইনে কারানির্যাতিত প্রথম সাংবাদিক ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর সম্পাদিত ‘ধূমকেত’ু পত্রিকায় প্রকাশিত আনন্দময়ীর আগমনে (আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল) কবিতার জন্য এক বছরের কারাদণ্ড পান। নজরুলের সম্পাদকীয় রচনার ভাষা ছিল তেজোদৃপ্ত। উদ্ধৃতি দিচ্ছি একটি সম্পাদকীয় (নিশান-বরদার) থেকে : “আমাদের বিজয় পতাকা তুলে ধরবার জন্য এসো সৈনিক। পতাকার রং হবে লাল তাকে রং করতে হবে খুন দিয়ে। বল আমরা পেছোব না। বল আমরা সিংহ শাবক আমরা খুন দেখে ভয় করি না। আমরা খুন নিয়ে খেলা করি, খুন দিয়ে কাপড় ছোপাই, খুন নিয়ে নিশান রাঙাই। বল আমি আছি আমি পুরুষোত্তম জয়। বল মাভৈঃ জয় সত্যের জয়। আমি আছি বলে নিশান হাতে তুলে নাও। এসো দলে দলে নিশানধারী বীর সৈনিক ভাইরা আমরা। নিজেকে সৈনিক বলে প্রচার করি এসো। এসো শয়তানকে অর্ধেক পুঁতে ফেলে তার মাথার উপর তাদেরি মাথার মগজের চর্বি দিয়ে চেরাগ জ্বালাই। শয়তানকে দগ্ধ করে মারতে হবে। এই কথা বলে বেরিয়ে এসো Ñ আমি আছি আমাতে আমিত্ব আছে, আমি পশু নই, আমি মনুষ্য, আমি পুরুষ সিংহ। আমাদের বিজয়ী হতে হবে। বিজয় পতাকা ওড়াতে হলে খুন খোসরোজ খেলতে হবে। ধর ধর এক হাতে ভীম খড়গ সর্বনাশের ঝাণ্ডা Ñ আর এক হাতে ধর রক্তমাখা পতাকা। আমাদের এই বিজয় মঙ্গলের সময় যদি কেউ বাধা দিতে আসে তবে তাকে বড় থেকে অর্ধেক ছাড়িয়ে নিয়ে অর্ধেক সাগর জলে ভাসিয়ে দাঁড় আর অর্ধেক খানা সেখানে পড়ে দুপায়ের গিঁটে যেন ঠোকাঠুকি করে।”
সে সময় ইউরোপীয় বণিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য যেমন ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশিত হতো তেমনি ভারতীয় হিন্দুরাও দ্য হিন্দু প্যাট্রিয়ট, দ্য বেঙ্গলি, ইন্ডিয়ান মিরর, অমৃতবাজার পত্রিকা, দ্য ট্রিবিউন, দ্য মারাঠা প্রকাশ করে। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, অরবিন্দ ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ তাদের সংবাদপত্র দ্বারা স্বদেশী আন্দোলন চাঙ্গা ও বঙ্গভঙ্গ রোধে উত্তপ্ত ভূমিকা রাখেন। প্রথম মহাযুদ্ধের শেষ (১৯১৯) এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরুর (১৯৩৯) মধ্যবর্তী দুই দশকে বাংলার সংবাদপত্রের চেহারা বদলে যায়। রাজনৈতিক দিক দিয়ে তিন ধরনের পত্রিকা ছিল। এক পক্ষ কংগ্রেসের সমর্থক, অন্যপক্ষ নবজাগ্রত মুসলিম লীগের অনুসারী (আজাদ, মোহাম্মদী, স্টার অব ইন্ডিয়া, মর্নিং নিউজ) আর তৃতীয় পথ বামধারার। সংবাদপত্র, সাময়িকপত্রের সম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করে প্রেস কাবের সদস্য, পরিশ্রমী গবেষক মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া ‘হিস্টরি অব দ্য প্রেস ইন বাংলাদেশ’ প্রকাশ করে জাতির সশ্রদ্ধ সমীহা অর্জন করেছেন।
“১৯৩৫ এর ভারত শাসন আইন অনুযায়ী সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারার ভিত্তিতে ১৯৩৭ এর জানুয়ারিতে প্রাদেশিক আইনসভার প্রথম ভোট থেকে বাংলা কাগজগুলোর ভেতরের এসব রাজনীতির সূক্ষ্ম ভাগাভাগি মুছে গেল। সব কাগজই তারস্বরে সাম্প্রদায়িক হয়ে গেল। সাম্প্রদায়িকতার জিভ ছিল সাপের জিভের মতো কাটা। তার এক ডগা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষ ছড়াত, আর এক ডগা তপশিলি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। এই দুই শত্রুর কাছে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদ এত তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল যে আগস্ট আন্দোলনের খবরও এসব কাগজে যথেষ্ট কম বেরোয়। হিন্দু কাগজগুলোর এই সাম্প্রদায়িকতার প্রতিক্রিয়া ও মুসলমান সমাজের রাজনৈতিক স্বাধিকারের আন্দোলনের প্রয়োজনে আজাদ ও ইত্তেফাক দুইটি মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার পোষকতা শুরু করে। বাংলা খবরের কাগজে বাঙালির যে বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়েছিল, তার জায়গায় নতুন এই বাঙালি বৈশিষ্ট্য এল চিৎকৃত সাম্প্রদায়িকতা। ১৯৪০ থেকে প্রায় ১৯৭০ পর্যন্ত এই বিদ্বিষ্ট, চিৎকৃত, বিকারগ্রস্ত ও অপ্রমাণিত সংবাদনির্ভর সাংবাদিকতা বাংলার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল (ঔপন্যাসিক দেবেশ রায় : খবর বলছি ..... সম্প্রচারের ভাষা ও ভঙ্গি)। “মুসলিম লীগ সমর্থক পত্রিকাগুলি” ৪৭-এর পর ঢাকায় চলে যায়। রাজনীতির প্রশ্নে এই পত্রিকাগুলির সঙ্গে কলকাতার অন্যান্য সংবাদপত্রগুলির নিয়মিত চাপান উতোর চলত। এমনকি আজাদ পত্রিকার আরবি ফারসি শব্দ মেশানো বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে নানা রকম ব্যঙ্গবিদ্রƒপও করা হতো। কিন্তু ইতিহাসের এমনই অনির্দেশ্য কুটিল গতি যে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু চাপাবার ষড়যন্ত্র হলে আজাদ ও ইত্তেফাক তার বিরোধিতা করে। (কৃষ্ণ ধর : বিংশ শতাব্দীর সংবাদপত্র : বাংলা দৈনিক পত্রিকা, বাংলা আকাদেমী পত্রিকা)।
মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্র বয়ানে জানা যায়, মুসলিম বাংলার সাহিত্য-সাংবাদিকতার অগ্রনায়কদের উদ্যোগে এবং অকান্ত প্রচেষ্টায় প্রকাশিত পরিচালিত ও সম্পাদিত মাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকার মাধ্যমেই বাংলার মুসলমানের সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতা ব্যাপকতা লাভ করে.... বিভাগপূর্বকালে যেমনি বিভাগ পরবর্তীকালেও তেমনি আমাদের অনেক সাংবাদিক-সাহিত্যিকের রচনাই সাংবাদিকতার প্রয়োজনে সৃষ্ট হলেও স্থানীয় আবেদনের অধিকার অর্জন করেছে।
স্বতন্ত্র জাতীয়তা
ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জাতীয় মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবির পটভূমি সম্পর্কে বলেছেন, কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা ১৮৮৫ সালে, মুসলমানরা কংগ্রেসের পাল্টা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকায়, ১৯০৬ সালে। শুরুতে কংগ্রেস ও লীগের ভেতর উদ্দেশ্যগতভাবে এক বিষয়ে মিলন ছিল উভয় প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য, ছিল ভারতীয়দের ভেতর শাসকদের প্রতি আনুগত্য গড়ে তোলা। বিচিত্র অভিজ্ঞতা সমাকীর্ণ পতন বন্ধুর যাত্রাপথে সংগঠন দু’টি ক্রমান্বয়ে শাসকদের পরিবর্তে দেশের স্বাধীনতার নিকটবর্তী হতে চেয়েছে, কিন্তু কখনো সম্পূর্ণভাবে এক হয়ে যেতে পারেনি। তাদের প্রবাহ ছিল সময়েই কম-বেশি সমান্তরাল। তার কারণ স্পষ্টতই এই যে, মুসলিম সংখ্যালঘুরা হিন্দু সংখ্যাগুরুকে ভয় না করে পারেননি। কংগ্রেস যে স্বাধীনতার কথা বলতেন সেখানে ভারতীয় মুসলিম নিজের জন্য নতুন এক পরাধীনতার নিগড় দেখে শিউরে উঠেছেন। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনেও এই ভীতির কারণগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট ও বাস্তব (সাহিত্যে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবি : পাকিস্তান আন্দোলন ও মুসলিম সাহিত্য)।
রেনেসাঁ আন্দোলন
মুসলিম মানসে স্বকীয়তার উত্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কলকাতায় ১৯৪২ সালে সাংবাদিক-সাহিত্যিকেরা রেনেসাঁ আন্দোলনের সূচনা ঘটান। ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব পাসের পরবর্তী পর্যায়ে এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই আন্দোলন সূচিত হলেও রাজনৈতিক স্বাধীনতা তথা মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে নবজাগরণ তথা রেনেসাঁ আনয়নই ছিল এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান কথাটি ছিল না বটে, তবে তাতে ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে দু’টি স্বতন্ত্র স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। এ সূত্রেই রেনেসাঁ আন্দোলনের নায়করা ধরে নিয়েছিলেন যে, পাকিস্তান পরিকল্পনা অনুসারে ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে গঠিত পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তান হবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, কিন্তু পরবর্তীকালে বাস্তবে তা ঘটেনি এবং ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ ও (সাবেক) পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় লাহোর প্রস্তাবের মর্মবাণীকে অগ্রাহ্য করে; ১৯৪৬ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের কনভেনশনে অনুমোদিত দুই রাষ্ট্রের বদলে এক রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব অনুসারে। কিন্তু দেশ ভাগের আগেই ১৯৪২ এরও আগে, পূর্ব পাকিস্তান কথাটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও প্রতীক হিসেবে চালু হয়ে গিয়েছিল এবং বুদ্ধিজীবীদের মনোরাজ্যেও ঠাঁই করে নিয়েছিল। এ কারণেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে ১৯৪২ সালে কলকাতায় ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’ এবং ঢাকায় ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’ প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল। দু’টি সংস্থা গঠনেই ‘আজাদ’ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীনের অনুপ্রেরণা এবং মুজীবুর রহমান খাঁর উদ্যোগী ভূমিকা ছিল। বস্তুত দু’টি সংস্থাই মূলত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উদ্দেশ্যে গঠিত এবং পরিচালিত হলেও রাজনৈতিক লক্ষ্যও এতে অন্তরিত ছিল’। (মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতা ও আবুল কালাম শামসুদ্দীন : মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ্)
রাষ্ট্রভাষা বাংলা
রেনেসাঁর নায়কেরা ১৯৪২-৪৩ সাল থেকেই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চিন্তা করেছেন। ‘পাকিস্তানের আন্দোলনকালে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধই প্রবল হয়। কিন্তু এ দেশের মুসলমান সমাজ যে বাঙালি পরিচয়কে গৌণ করে দেখেনি, তারও নানা প্রমাণ আছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই বাংলাভাষাকে নতুন রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের দাবি উঠেছিল (জাতীয়তাবিষয়ক ভাবনা, ডক্টর আনিসুজ্জামান, এপিটাফ ১৯৮০)।
মওলানা আকরম খাঁ, মুজীবুর রহমান খাঁ, হবীবুল্লাহ বাহার, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, তালেবুর রহমান, আবদুল হক, ফররুখ আহমদ তাঁদের নানা রচনায় এ বিষয়টি তুলে ধরেন।
সে সময় আরও তিনটি জাতীয় দৈনিকের উল্লেখ না করলে সাংবাদিকতা ও বাংলাদেশের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। পাকিস্তান অবজার্ভার, ইত্তেফাক ও সংবাদ আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে উচ্চশিখরে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। এই তিনটি পত্রিকাকে বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক বক্তব্যের জন্য সরকার কয়েকবার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। মানিক মিয়া, আবদুস সালাম ও জহুর হোসেন চৌধুরী Ñ এই তিন সম্পাদক আইয়ুব-মোনেমের জন্য ছিলেন মস্ত শিরঃপীড়া। তাঁরা প্রেস কাবকে তরুণ সাংবাদিকদের মতো সম্পৃক্ত করে নিতে চেষ্টা করতেন। তখন থেকেই প্রেস কাবের ‘কাব চরিত্রের’ বুনিয়াদ (আমাদের পৃথিবী, সেলবিদ্ধ প্রেস কাব : ফয়েজ আহমদ)। পাকিস্তান অবজার্ভার বেরুল ১৯৪৯-এ। মালিক স্মরণীয় আইনজীবী ও মুসলিম লীগ নেতা হামিদুল হক চৌধুরী। পত্রিকাটি প্রথম রোটারি মেশিনে ছাপা উপলক্ষে সগর্বে ঘোষণা দিয়েছিল Ñ এখন থেকে অবজারভার ইংল্যান্ড থেকে আনা রোটারি মেশিনে, রাশিয়ান নিউজপ্রিন্টে ভারত থেকে আনা কালিতে ছাপা হয়ে পাঠকদের হাতে পৌঁছবে। কিংবদন্তি সাংবাদিক আবদুস সালাম পরের বছর এর সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন। মাহবুব জামাল জাহেদী, এসএম আলী, ওবায়দুল হক, এবিএম মূসা, এজেডএম এনায়েতুল্লাহ খান, শহীদুল হক, আবদুল মতিন, বদরুল হক, আসাদুজ্জামান বাচ্চু, আবদুর রহিম, আতাউস সামাদ প্রমুখ উজ্জ্বল সাংবাদিকগণ পাকিস্তান অবজারভারকে বাঙালি জাতির অন্যতম দিশারিতে পরিণত করেন। মওলানা ভাসানীর তত্ত্বাবধানে ইয়ার মোহাম্মদ খানের অর্থানুকূল্যে ও সম্পাদনায় ১৯৪৯ সালে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক বেরোয়। আবু জাফর শামসুদ্দীন পরে সম্পাদক হন। ১৯৫১ তে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া (কলকাতার ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকা, যার সম্পাদক ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ) তার সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে তিনি ইত্তেফাক হাতে নেন। এমআর আখতার মুকুল, ফয়েজ ভাই। ১৯৫৩-তে তিনি এটিকে দৈনিকে রূপান্তরিত করেন। মানিক মিয়ার লেখনী আওয়ামী লীগের পক্ষে দেশবাসীকে উদ্বোধনী মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। ১৯৬৯-এ তিনি মারা গেলে জ্যেষ্ঠপুত্র ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন দায়িত্ব নেন। প্রথিতযশা সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেন হন নির্বাহী সম্পাদক। মুসলিম লীগের মুখপত্র হয়ে বের হলেও পরে সংবাদ বামধারার শক্তিশালী দৈনিকে পরিণত হয়। সংবাদ-এ ছিলেন আহমদুল কবির, সৈয়দ নূরুদ্দীন, সরদার ফজলুল করিম, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, কাজী মোহাম্মদ ইদরিস, মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ, মন্টু লোহানী, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, সাদেক খান, আবু তাহের আওয়াল খান, শহীদুল্লাহ কায়সার, সন্তোষ গুপ্ত, বজলুর রহমান, ফয়েজ আহমদ, কে জি মুস্তফা, মোহাম্মদ তোহা খান, শহীদ সাবের, তোয়াব খান, আলী আকসাদ। অন্য দিকে মর্নিং নিউজে ছিলেন এসজিএম বদরুদ্দীন, ওয়াহিদুল হক, হাসানুজ্জামান খান।
সাংবাদিকদের সেই স্বাধিকার আন্দোলনে ফটো সাংবাদিকদের স্মরণে না আনলে গুনাহ হবে। মোজাম্মেল হোসেন, লাল ভাই, মোয়াজ্জেম হোসেন বুলু, রশীদ তালুকদার, আফতাব আহমেদ, গোলাম মাওলা, জহিরুল হক, কামরুজ্জামান, ওয়াসে আনসারী, মোকাদ্দাস ভাই, মানু মুন্সী, মোহাম্মদ আলম, আকিল খান, জালালউদ্দিন হায়দার, রফিকুর রহমান প্রমুখ আন্দোলনের এক ফটোগ্রাফিক কাব্য রচনা করে পাঠকদের উজ্জীবিত করেছেন।
জাতীয় প্রেস কাব গঠন ও বিকাশ আজকের জাতীয় প্রেস কাবের প্রতিষ্ঠার পেছনে মূল উদ্যোগী পুরুষ ছিলেন সংবাদ সম্পাদক খায়রুল কবীর। স্বাধীন রাষ্ট্রে সাংবাদিকদের একটা প্রতিষ্ঠান চাই। খায়রুল কবীরের টিকাটুলিস্থ নাহা ম্যানসনের বাড়িতে তখন সাংবাদিকদের আড্ডা হতো। ঢাকাস্থ ভারতীয় সাংবাদিক বালান (অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব ইন্ডিয়া), বিলাতের ডেইলি মেইল প্রতিনিধি উইলিয়াম ননী, ‘সংবাদ’-এর সৈয়দ নূরুদ্দীন, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ডাইরেক্টর (ইনফরমশন) সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন, পাকিস্তান অবজারভার সম্পাদক আবদুল সালাম। সেস্টসম্যান পত্রিকা প্রতিনিধি এমএ ওহাব, এস জি এম বদরুদ্দীন আলোচনায় অংশ নিতেন। তাদের সঙ্গে নাজির আহমদ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দিন আহমেদ, কামরুল হাসান, সুরশিল্পী আবদুল আহাদ প্রেস কাব গঠনে উৎসাহী ছিলেন। বিবিসি খ্যাত যশস্বী সাংবাদিক, তৎকালীন দৈনিক মিল্লাত-এর বার্তা সম্পাদক সিরাজুর রহমান বলেছেন, ১৯৫২-এর গোড়ার দিকে সংবাদ-এর বার্তা সম্পাদক সৈয়দ নূরুদ্দীন, যুগ্ম সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী ও আমাকে নিয়ে প্রেস কাব গঠনার্থে একটি কমিটি গঠিত হয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে সার্থক করার প্রক্রিয়ায় অগ্রসেনানি সাংবাদিক সমাজ একুশে ফেব্রুয়ারির পর নাব উদ্দীপনায় আরো সোৎসাহী হয়ে ওঠেন। নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সম্মেলন হল কার্জন হলে ৭ ডিসেম্বর ১৯৫২-তে। সেখানেই আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব গৃহীত হলো প্রেস কাব প্রতিষ্ঠার। বাড়ি খোঁজাখুঁজিও শুরু হলো। কিন্তু তদানীন্তন চিফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদ রাজি নন। জনাব খায়রুল কবীর ১৯৫৪ সালে তথ্য মন্ত্রণালয়ে স্পেশাল অফিসার হিসেবে যোগ দেয়ার পর তাঁর তদবির বেড়ে যায়।
তিনি জানাচ্ছেন, ১৯৫৪ সালে ৯২ ধারার অধীনে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে যায়। প্রায় সামরিক শাসন। সব সামরিক শাসন বা গোত্রছাড়া কঠোর শাসন যখন প্রবর্তিত হয়, তার শুরুর দিকটাতে দুই রকম আধিক্য দেখা যায় Ñ কঠোরতার আধিক্য এবং উদারতার আধিক্য। প্রেস কাবের জন্য শহরের কেন্দ্রস্থলে অনেকখানি জায়গাজুড়ে একটি মনোরম বাড়ি বরাদ্দ করা হয় সম্ভবত শেষোক্ত কারণে। কারণ যা-ই হোক, ১৯৫৪ সালে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম প্রেস কাব আনুষ্ঠানিকভাবে স্থাপিত হয়ে গেল ঢাকাতে।
জাতীয় প্রেস কাবকে ঘিরে জাতির অগ্রগণ্য সব সাংবাদিক, যাঁদেরকে জাতীয় সত্তা বললে অত্যুক্তি হবে না, তাঁদের সাংবাদিকতা ও জাতীয় দায়িত্বে আবর্তিত হয়েছেন। পুরনো সেই লাল বাড়িটার স্মৃতি মুছে ফেলা কঠিন। মরহুম ফয়েজ আহমদ তাঁর মূল্যবান গ্রন্থ ‘সত্যবাবু মারা গেছেন’ জাতীয় প্রেস কাবকে উৎসর্গ করে লিখেছেন, যাকে কেন্দ্র করে সমস্ত সংবাদের উৎস সন্ধান ও পরিসমাপ্তি।
বাংলাদেশের সাংবাদিক-সাহিত্যিক ’৪৭-এর আগে ও পরে দু’টি ধারায় জাতির সেবায় নিয়োজিত থাকলেও (পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি ও পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ) ভাষা আন্দোলনে এক সুরে বাংলাভাষার পক্ষে থেকেছেন। একই সঙ্গে মিলেমিশে সাংবাদিক ইউনিয়ন গঠন করেছেন। আবার প্রেস কাবের প্রথম ব্যবস্থাপনা কমিটিতে রেনেসাঁর সভাপতি মুজীবুর রহমান খাঁকে সভাপতি এবং ‘সংবাদ’ এর যুগ্ম-সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরীকে সম্পাদক করেছেন। দু’ধারার অপূর্ব সম্মিলন। ফয়েজ ভাই লিখেছেন, কাব সদস্যগণ যে কোনো রাজনৈতিক মতের সাংবাদিক হতে পারেন, যে কোনো প্রতিক্রিয়াশীল বা বিপ্লবী পত্রিকার সাংবাদিক হলেও আপত্তি নেই। সহ-অবস্থানের এক আদর্শ বিচরণ ভূমি। সহাবস্থানের ভারসাম্য রক্ষা করার ঐতিহ্য প্রেস কাব প্রতিষ্ঠার সময় থেকে এবং সিনিয়র মেম্বার বা কয়েকজন সম্পাদকই এই পরিবেশ সৃষ্টির পথপ্রদর্শক। আর একই সঙ্গে সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের অন্তঃজ বন্ধনকে ক্রমাগত পুষ্ট করেছেন। দেশের কোন একটি সংঘে এতো সাহিত্যিক, যাঁদের অনেকেই জাতীয়ভাবে সম্মানিত, আছে কি না জানা নেই। আমাদের পূর্বসূরিরা বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠায় পর্যন্ত উদযোগী ছিলেন। এর মধ্যে সেই আমলে সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রেস কাবের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল। ষাটের দশকে গোটা পাকিস্তানে ১৭ দিনের ধর্মঘট করেছিল সাংবাদিক ইউনিয়ন।
জাতীয় প্রেস কাব নিয়ে এর সদস্যরা পর্বতপ্রমাণ গৌরব বোধ করেন। পাকিস্তান আমলে স্বৈরশাসক আইয়ুবের বশংবদ গভর্নর মোনায়েম খাঁকে প্রেস কাবে ঢুকতে দেয়া হয়নি। আমন্ত্রণ জানানো তো দূরের কথা, আরেক স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকেও কখনও দাওয়াত দেয়া হয়নি। এ নিয়ে তার যথেষ্ট আক্ষেপ। এরশাদবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনে প্রেস কাব ছিল রাজনীতিকদের তীর্থকেন্দ্র, আশ্রয়স্থল।
এই প্রেস কাবের সঙ্গে প্রতিজন সদস্যের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। প্রেস কাব সবার কাছে সেকেন্ড হোম। কারো কারো ‘ফার্স্ট হোম’। জনাব ননী, খতিব সাহেব এই কাবেই থাকতেন। একবার বন্যার সময় আবদুস সালাম পরিবার অর্থাৎ জামাতা এবিএম মূসাসহ কাবেই আশ্রয় নেন। মূসা ভাইয়ের এক সন্তানের প্রজন্ম প্রেস কাবে এবং দুই মেয়ের বিয়ে সেখানেই। আর ব্যাচেলর সদস্যরা একে শ্বশুরালয়ের মতোই ব্যবহার করেছেন ও করছেন। মরহুম হুমায়ুন কবীর চৌধুরীর দুনিয়াটা ছিল প্রেস কাবেই।
প্রায় তিন একর জমির ওপর সেই ছোট্ট লাল দালানটুকু একবার হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। রমনা পার্কের বিপরীতে শিল্পকলা একাডেমি সংলগ্ন স্থান কাবকে সরিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর ছিল মুজিব সরকার। এ সংক্রান্ত ফাইলেও সরকারপ্রধান সই করেন ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি। কিন্তু এর মধ্যে পটপরিবর্তন হয়ে গেলে কাব কর্তৃপক্ষ ও শিল্পকলা একাডেমির যৌথ সম্মতিতে জিয়াউর রহমানের সরকার কাবের বর্তমান স্থানে জমি বরাদ্দ, পুরাতন বিল্ডিংয়ের মূল্য পরিশোধ এবং নতুন কাব ভবন নির্মাণে সম্পূর্ণ খরচ বহনের সহযোগিতা প্রদান করেন। কাবের ৫ বার নির্বাচিত সম্পাদক এ এস এম হাবিবুল্লাহ জানিয়েছেন : “বর্তমান স্থানে নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়ার নাম কার্যনির্বাহী পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় (৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী স্মরণিকা)”। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কাবের অবরাদ্দকৃত আরো প্রায় ২ একর জমি বরাদ্দ দেন এবং পশ্চিম পাশে নতুন বহুতল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। জমি রেজিস্ট্রির ওই দলিলে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমার স্বাক্ষর থাকায় আমি অহঙ্কার বোধ করি।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র হওয়ার পর সংবাদপত্রকে অসভ্যতার আক্রোশে পড়তে হয়েছে বেশি। তাই সাংবাদিক ইউনিয়ন ও প্রেস কাবের পথ চলায় অনিশ্চয়তা ছিল বরাবরের মতোই। বাংলাভাষার অন্যতম প্রধান কবি ও গণকণ্ঠ সম্পাদক আল মাহমুদ, হলিডে সম্পাদক এ জেড এম এনায়েতুল্লাহ খান, রয়টার্স-এর আতিকুল আলম গ্রেফতার হন, অসংখ্য পত্রিকা বন্ধ ও সাংবাদিকের কর্মচ্যুত করা হয়। বিবিসির আতাউস সামাদ ও আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে নিক্ষেপ, চ্যানেল ওয়ান ও দিগন্ত টিভি বন্ধ, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড, আইসিটি অ্যাক্ট এবং গণবিরোধী জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা প্রভৃতি নিয়ে এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন প্রেস কাব এখনো সাহসের জায়গা। এরশাদের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানটা প্রেস কাবকে সামনে রেখেই হয়েছে।
‘কিছু করার দায়িত্ব’ সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও প্রেস কাবকে জন্মদিন থেকেই ব্যস্ত রেখেছে। স্বপ্ন দেখা ও দেখানো ছাড়া সাংবাদিকতার লক্ষ্যে তৃতীয় ও শেষ স্বপ্ন যদি কিছু থেকে থাকে তবে সেটা সমাজ ও জীবনের প্রবাহে এক ধরনের হস্তক্ষেপের। জাতীয় জীবনে কালো মেঘের সঞ্চার হলেই আলোর জন্য মানুষ ধাবিত হয় তোপখানা রোডে প্রেস কাবের দিকে। এর পরও অন্তরঙ্গে কাব আমাদের জন্য এমন যে, দার্শনিক পাস্কালের সেই উচ্চারণেই আমরা আশ্রয় নিই Ñ ‘হৃদয়েরও কিছু যুক্তি আছে, যুক্তি যার কিছুই জানে না।’ ফয়েজ ভাইয়ের কথাটা এখনো কানে বাজে, “বুঝলা শওকত, প্রেস কাবটা সাংবাদিকদের কাছে একটা ছোটখাটো পৃথিবী। এই ধর আনন্দ উল্লাস, হাসি-কান্না, মিষ্টি-ঝাল খাবার, তাস-দাবা, বন্ধুতা-শত্রুতা, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, রাজনৈতিক চেতনা, চিত্রকলা প্রদর্শনী, সুসময়-দুঃসময়, জ্ঞান বিকাশ, জ্ঞান প্রকাশ, স্ফূর্তিতে হাসাহাসি, বৈরিতায় হাতাহাতি, এমনকি গ্রেফতার, মুক্তি ঘোষণা এবং বুলেট-শেল পর্যন্ত।”
শওকত মাহমুদ : সাবেক সভাপতি
জাতীয় প্রেস কাব
সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন
No comments