গল্প- আমার একটা পোষা দৈত্য আছে by আনিসুল হক
দুপুরবেলা তপু একাই থাকে বাসায়। স্কুল
ছুটির পর স্কুল থেকে সে আসে রিকশাভ্যানে। একটা রিকশাভ্যানে আসে তারা আটজন।
ভ্যানচালকের নাম হবিবর, তারা ডাকে হবিবর মামা বলে।
রিকশাভ্যানটা
দেখতে খাঁচার মতো, লোহার জাল দিয়ে ঘেরা। তপুকে হবিবর মামা তাদের
বিল্ডিংয়ের গেটে নামিয়ে দেন। তপু তিনতলা পর্যন্ত হেঁটে ওঠে। কলবেল টেপে।
তখন মর্জিনা খালা গেট খুলে দেন।
তপু তার পায়ের কেডস-জোড়া প্রথমে এপাশে-ওপাশে ছুড়ে মারে। তারপর ছুড়তে থাকে মোজা। পিঠের ব্যাগ মেঝেতে লুটায়। তারপর সে প্রথমে ফোন করে মাকে, ‘মা, আমি বাসায় এসেছি।’ মা অফিসে থাকেন। তপুর ফোন না পাওয়া পর্যন্ত অস্থির থাকেন। তপু ফোন করলেই তিনি বলেন, ‘যাক, বাবা তপু, নাও, গোসল সেরে নাও। তারপর ভাত খাও। মর্জিনা খালাকে বলো, মুরগি বের করে দিতে।’
তপু পড়ে ক্লাস থ্রিতে, মিলেনিয়াম স্টারস স্কুলে। কলাবাগানে তাদের স্কুল। আর তারা থাকে কাঁঠালবাগানে। যদিও কলাবাগানে সে কোনো কলাগাছ দেখেনি, কাঁঠালবাগানে মাত্র একটা কাঁঠালগাছ দেখেছে।
দুপুরের খাওয়া হলে তপুর কাজ ঘুমানো। মর্জিনা খালা তখন বাথরুমে যান। পুরো বাড়িটা খাঁ খাঁ করে। পুরো পাড়াটাই কেমন ঝিমুতে থাকে। তিন্নি আপু আসবেন চারটায়। মা সাড়ে পাঁচটায়। বাবা ছয়টায়।
আজকে তপুর ঘুম আসছে না। স্কুলে বিজ্ঞানমেলা হবে। বন্ধুরা একেকজন একেকটা প্রজেক্ট করছে। তপু এখন কী প্রজেক্ট করে!
তপু বিছানা ছাড়ে। স্টোররুমে যায়। পুরোনো একটা রেডিও আছে। সেটা বের করে কী কিছু করা সম্ভব। একটা লাল বালতির ভেতরে কত কী! ভাঙা খেলনা গাড়ি, টর্চ লাইট। খেলনা গাড়ির ইঞ্জিনটা দিয়ে কি কিছু একটা বানানো যায়?
একটা নীল রঙের বোতল পাওয়া গেল বালতির গোড়ায়। বোতলটা দেখতে খুব সুন্দর। সে বোতলটা বের করে।
ভেতরে কিছু নেই। ছোট্ট বোতল। কী ছিল এই বোতলে? সুগন্ধি?
বোতলের ভেতরে একটা কী যেন নড়ছে। সে ভালো করে বোতলটা চোখের কাছে এনে দেখে। একটা ছোট্ট পুতুলের মতো দেখা যাচ্ছে ভেতরে। নড়াচড়া করছে।
ভারি অদ্ভুত তো!
তপু স্টোররুমের ভেতরেই বোতলের ছিপি খুলে ফেলে।
অমনি নীল আলো বেরোতে থাকে বোতল থেকে!
এত তীব্র নীল যে তার চোখ যায় ধাঁধিয়ে। সে চোখ বন্ধ করে। চোখ খুলতেই দেখে, তার সামনে ইয়া বড় একজন...না...ঠিক মানুষ নয়...সম্পূর্ণ নীল, মাথাটা ছাদে আটকে গেছে। মাথার চুল নীল, চামড়ার রং নীল, চোখ দুটো নীল।
‘কে তুমি?’ তপু জিজ্ঞেস করে। তার গলা কাঁপে। ‘তুমি কি আলাদিনের দৈত্য?’
‘ঠিক ধরেছ। আমি আলাদিনের দৈত্যর বংশধর। আমার নাম নীলাক্ষী।’
‘এখন আমি যা বলব, তুমি কি তা-ই শুনবে?’
‘হ্যাঁ, শুনব। আমি তোমার তিনটা আদেশ শুনব। কারণ, তুমি আমাকে এই বোতল থেকে উদ্ধার করেছ।’
তপু বলে, ‘তোমাদের দৈত্যদের এই নিয়মটা ভালো না একদম। তোমরা মাত্র তিনটা অর্ডার কেন শোনো। বেশি করে শুনতে পারো না।’
নীলাক্ষী বলে, ‘না, বেশি করে শোনার নিয়ম নেই। আমরা সবাই নিয়মের জালে বন্দী।’
‘তাহলে আর দৈত্য হয়ে কী লাভ। আমরাও তো নিয়মের জালেই বন্দী। দেখো না সকাল হলেই স্কুলে যেতে হয়। একটা বন্দীভ্যানে চড়ে। সেখানেও বন্দী। তারপর আবার বন্দীভ্যানে চড়ে বাসা। এখানেও আমি বন্দী।’
‘তবে আমার মতো বোতলে তো এক হাজার বছর থাকতে হয়নি। তুমি তো তবু আকাশ দেখো। আমি যে কত দিন আকাশ দেখি না।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। তোমার তিনটা হুকুম পালন করা হলেই আমি একটু বেরোব। আকাশ দেখব। বোতলের ভেতরে থাকতে থাকতে হাত-পায়ে খিল ধরে গেছে।’
‘না। আমি হুকুম করব না।’
‘তাহলে আমাকে ছেড়ে দাও। আমি যাই।’
‘না না, তা হয় না।’
‘ঠিক আছে। তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। ভেবে ভেবে তিনটা অর্ডার দিয়ে দাও।’
‘পাঁচ মিনিট পরে কী করবে?’
‘তোমার অর্ডার না পেলে চলে যাব।’
তপু বলল, ‘এখন একটা অর্ডার দিই। পরে আরও দুটো অর্ডার দেব। হবে?’
‘আচ্ছা দাও দেখি একটা হুকুম।’
তপু তার পায়ের কেডস-জোড়া প্রথমে এপাশে-ওপাশে ছুড়ে মারে। তারপর ছুড়তে থাকে মোজা। পিঠের ব্যাগ মেঝেতে লুটায়। তারপর সে প্রথমে ফোন করে মাকে, ‘মা, আমি বাসায় এসেছি।’ মা অফিসে থাকেন। তপুর ফোন না পাওয়া পর্যন্ত অস্থির থাকেন। তপু ফোন করলেই তিনি বলেন, ‘যাক, বাবা তপু, নাও, গোসল সেরে নাও। তারপর ভাত খাও। মর্জিনা খালাকে বলো, মুরগি বের করে দিতে।’
তপু পড়ে ক্লাস থ্রিতে, মিলেনিয়াম স্টারস স্কুলে। কলাবাগানে তাদের স্কুল। আর তারা থাকে কাঁঠালবাগানে। যদিও কলাবাগানে সে কোনো কলাগাছ দেখেনি, কাঁঠালবাগানে মাত্র একটা কাঁঠালগাছ দেখেছে।
দুপুরের খাওয়া হলে তপুর কাজ ঘুমানো। মর্জিনা খালা তখন বাথরুমে যান। পুরো বাড়িটা খাঁ খাঁ করে। পুরো পাড়াটাই কেমন ঝিমুতে থাকে। তিন্নি আপু আসবেন চারটায়। মা সাড়ে পাঁচটায়। বাবা ছয়টায়।
আজকে তপুর ঘুম আসছে না। স্কুলে বিজ্ঞানমেলা হবে। বন্ধুরা একেকজন একেকটা প্রজেক্ট করছে। তপু এখন কী প্রজেক্ট করে!
তপু বিছানা ছাড়ে। স্টোররুমে যায়। পুরোনো একটা রেডিও আছে। সেটা বের করে কী কিছু করা সম্ভব। একটা লাল বালতির ভেতরে কত কী! ভাঙা খেলনা গাড়ি, টর্চ লাইট। খেলনা গাড়ির ইঞ্জিনটা দিয়ে কি কিছু একটা বানানো যায়?
একটা নীল রঙের বোতল পাওয়া গেল বালতির গোড়ায়। বোতলটা দেখতে খুব সুন্দর। সে বোতলটা বের করে।
ভেতরে কিছু নেই। ছোট্ট বোতল। কী ছিল এই বোতলে? সুগন্ধি?
বোতলের ভেতরে একটা কী যেন নড়ছে। সে ভালো করে বোতলটা চোখের কাছে এনে দেখে। একটা ছোট্ট পুতুলের মতো দেখা যাচ্ছে ভেতরে। নড়াচড়া করছে।
ভারি অদ্ভুত তো!
তপু স্টোররুমের ভেতরেই বোতলের ছিপি খুলে ফেলে।
অমনি নীল আলো বেরোতে থাকে বোতল থেকে!
এত তীব্র নীল যে তার চোখ যায় ধাঁধিয়ে। সে চোখ বন্ধ করে। চোখ খুলতেই দেখে, তার সামনে ইয়া বড় একজন...না...ঠিক মানুষ নয়...সম্পূর্ণ নীল, মাথাটা ছাদে আটকে গেছে। মাথার চুল নীল, চামড়ার রং নীল, চোখ দুটো নীল।
‘কে তুমি?’ তপু জিজ্ঞেস করে। তার গলা কাঁপে। ‘তুমি কি আলাদিনের দৈত্য?’
‘ঠিক ধরেছ। আমি আলাদিনের দৈত্যর বংশধর। আমার নাম নীলাক্ষী।’
‘এখন আমি যা বলব, তুমি কি তা-ই শুনবে?’
‘হ্যাঁ, শুনব। আমি তোমার তিনটা আদেশ শুনব। কারণ, তুমি আমাকে এই বোতল থেকে উদ্ধার করেছ।’
তপু বলে, ‘তোমাদের দৈত্যদের এই নিয়মটা ভালো না একদম। তোমরা মাত্র তিনটা অর্ডার কেন শোনো। বেশি করে শুনতে পারো না।’
নীলাক্ষী বলে, ‘না, বেশি করে শোনার নিয়ম নেই। আমরা সবাই নিয়মের জালে বন্দী।’
‘তাহলে আর দৈত্য হয়ে কী লাভ। আমরাও তো নিয়মের জালেই বন্দী। দেখো না সকাল হলেই স্কুলে যেতে হয়। একটা বন্দীভ্যানে চড়ে। সেখানেও বন্দী। তারপর আবার বন্দীভ্যানে চড়ে বাসা। এখানেও আমি বন্দী।’
‘তবে আমার মতো বোতলে তো এক হাজার বছর থাকতে হয়নি। তুমি তো তবু আকাশ দেখো। আমি যে কত দিন আকাশ দেখি না।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। তোমার তিনটা হুকুম পালন করা হলেই আমি একটু বেরোব। আকাশ দেখব। বোতলের ভেতরে থাকতে থাকতে হাত-পায়ে খিল ধরে গেছে।’
‘না। আমি হুকুম করব না।’
‘তাহলে আমাকে ছেড়ে দাও। আমি যাই।’
‘না না, তা হয় না।’
‘ঠিক আছে। তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। ভেবে ভেবে তিনটা অর্ডার দিয়ে দাও।’
‘পাঁচ মিনিট পরে কী করবে?’
‘তোমার অর্ডার না পেলে চলে যাব।’
তপু বলল, ‘এখন একটা অর্ডার দিই। পরে আরও দুটো অর্ডার দেব। হবে?’
‘আচ্ছা দাও দেখি একটা হুকুম।’
তপু বলল, ‘চলো, আমাকে ছাদে নিয়ে চলো। আমাদের বিল্ডিংয়ের ছাদে যাওয়াও বারণ। তালা দেওয়া থাকে।’
‘চলো।’ নীলাক্ষী তপুর হাত ধরে। আর এক পলকেই তপু দেখতে পায়, তারা তাদের ছয়তলা বাড়ির ছাদে।
বিকেলবেলা। শরৎকালের বিকেল। আকাশে সাদা সাদা মেঘ। বাকি আকাশটা নীল। রোদে ঝকঝক করছে। ছাদের রেলিংয়ে কাক। দুটো কবুতর। ছাদে কতগুলো ফুলের গাছ।
নীলাক্ষী বলে, ‘ইশ্, এবার একটু হাত-পা ছেড়ে দাঁড়াতে পারব।’
নীলাক্ষী আড়মোড়া ভাঙে। তারপর সে বড় হতে থাকে। তপু অবাক হয়ে দেখে, নীলাক্ষীর মাথা একেবারে মেঘের গা ফুঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
তপু ভয় পায়। ‘এই দৈত্যটা এত বড়ও হতে পারে!’
তপু বলে, ‘এই, তুমি এত বড় হোয়ো না। একটু কাছে আসো।’
নীলাক্ষী বলে, ‘এটা কি তোমার দুই নম্বর আদেশ?’
‘না না। আমার দুই নম্বর আদেশ হলো, আমাকে একটা আইসক্রিম দাও।’
‘মাত্র একটা আইসক্রিম। আচ্ছা, কাপ না ললিপপ?’
‘ললিপপ।’
‘কমলা না সবুজ? নাকি চকবার?’
‘চকবার।’
‘ঠিক আছে। এই নাও, তোমার চকবার।’
তপু চকবার খায়। কী যে মজা। যেন মধুতে তার মুখ গেল ভরে।
নীলাক্ষী বলে, ‘শোনো, এর কাঠিটা ফেলে দিয়ো না। ফ্রিজে রেখে দেবে। প্রতিবার ফ্রিজ খুললেই দেখবে একটা আস্ত চকবার। শুধু কখনোই কাঠিটা ফেলে দেবে না।’
তপু বলে, ‘বেশ বেশ। তাহলে আর চিন্তা নেই। নইলে তো আবার চিন্তা হতো, আগামীকাল কী খাব।’ তপু চকবারে একটা কামড় দেয়।
নীলাক্ষী বলে, ‘এবার আমাকে তিন নম্বর হুকুমটা দাও।’
তপু ভাবতে থাকে। কী চাইবে। একটা মোটরগাড়ি? যাতে তারা স্কুলে যেতে পারে গাড়ি চড়ে। বাবা অফিসে যাবেন, মা অফিসে যাবেন। কিন্তু গাড়ি চালাবেন কে? ড্রাইভার কই পাওয়া যাবে। তেলের দাম দেবে কে? নাকি গাড়িটা বেচে তারা টাকা নেবে।
নাকি একটা বিশাল রাজপ্রাসাদ চাইবে। আচ্ছা হলো। একটা বিশাল রাজপ্রাসাদ পাওয়া গেল। সেখান থেকে তপু একা একা ফিরবে কী করে নিজের বাসায়? বাবা-মাকে খুঁজে পাবে কী করে? তিন্নি আপুকে?
তাহলে?
নীলাক্ষী বলে, ‘বস, তিন নম্বর হুকুমটা দাও। আমি সেটা পালন করে চলে যাই।’
তপু বলে, ‘একটু ভাবি।’
নীলাক্ষী বলে, ‘না, আর ভাবার সময় দেওয়া যাবে না।’
তপু তখন বলে, ‘আচ্ছা, তুমি এত বড় শরীরটা কেমন করে এতটুকুন বোতলে ঢুকিয়েছিলে, দেখাও তো।’
নীলাক্ষী সঙ্গে সঙ্গে নীল ধোঁয়া হয়ে ঢুকে পড়ে বোতলে। আর অমনি তপু বোতলের ছিপিটা মুখ থেকে বের করে পেঁচিয়ে লাগিয়ে দেয়। তারপর বোতলটাকে পকেটে রাখে।
আইসক্রিমের কাঠিটাও।
এখন সমস্যা হলো, তাদের ছাদে তালা দেওয়া। সে এখন বের হবে কী করে ছাদ থেকে? কী করে বাসায় যাবে? সে ছাদের কিনারে যায়। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নিচে তাকায়। সামনের রাস্তা দিয়ে লোকজন যাচ্ছে। তাদের কাউকে ডাকতে হবে। সে ছয়তলা থেকে চিৎকার করতে থাকে। কিন্তু কেউ তার কথা শুনতে পায় বলে মনে হয় না। এখন সে কী করবে?
সে ছাদের টিনের দরজাটায় আঘাত করতে থাকে।
জোরে জোরে শব্দ করে।
কেউ শোনে না।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। ওই যে তিন্নি আপু রিকশাভ্যান থেকে নামলেন। ‘আপু আপু...’ সে একটা ঢিলও ছোড়ে। তিন্নি তাকানই না...এখন...
তখন তপুর মাথায় বুদ্ধিটা চলে আসে। ছাদে পানির পাইপ আছে। সেই পাইপে চাবি আছে। সে গায়ের জোরে চাবি ঘোরায়। খ-য়ের প্যাঁচে খোলা। আ-এর প্যাঁচে আটকানো। তাকে আটকাতে হবে। সে নিচের তলাগুলোয় পানি যাওয়ার সব পথ বন্ধ করে দেয়।
তারপর ছাদের একটা ছায়াওয়ালা জায়গায় বসে থাকে। আকাশের রং বদলে যাওয়া দেখে। দুটো চড়ুই পাখি কিচিরমিচির করছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
তারপর দেখে মা এলেন। বাসায় না-জানি কত কান্নাকাটি পড়ে গেছে। তিন্নি আপু এসে দেখেছেন, তপু ঘরে নেই। আবার ঘরের দরজাও বন্ধ। মা এসে দেখেছেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে। তাঁরা নিশ্চয়ই একে-ওকে ফোন করে পৃথিবী উল্টে দিচ্ছেন।
মা নিশ্চয়ই কাঁদছেন। তিন্নি আপু কাঁদছেন।
তপুও কাঁদছে বসে।
বাবা আসেন ছুটতে ছুটতে। তাঁকে সে নামতে দেখে সিএনজি-যান থেকে।
সন্ধ্যা নেমে আসে। বাসার সামনে পুলিশের ভ্যান। কিন্তু কোনো একজন ছাদে আসবে না?
আকাশে যখন একটা তারা ফুটে ওঠে, তখন দারোয়ান চাচা ছাদের দরজা খোলেন। খুলেই তপুকে সামনে পান। তিনি চিৎকার করে ওঠেন, ‘এই তো তপু আংকেল। এই তো ...’
তিনি তাকে ধরে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকেন।
তারপর কত প্রশ্ন। সে কী করে তালাবদ্ধ ছাদে গেল। তপু বলে, ‘তালা খোলাই ছিল।’
‘তাহলে কে লাগাল?’
‘আমি কী জানি।’
সে তার বোতলটা ড্রয়ারে রেখে দেয়। আর আইসক্রিমের কাঠিটা ফ্রিজে। রোজ দুপুরে সে একটা করে আইসক্রিম বের করে খায়।
আর সে ঠিক করেছে, তিন্নিকে দিয়ে বোতলটা আবার খোলাবে। তার আগেই ঠিক করে নিতে হবে, তিন্নি আপু তিনটা আদেশ কী কী করবেন?
‘চলো।’ নীলাক্ষী তপুর হাত ধরে। আর এক পলকেই তপু দেখতে পায়, তারা তাদের ছয়তলা বাড়ির ছাদে।
বিকেলবেলা। শরৎকালের বিকেল। আকাশে সাদা সাদা মেঘ। বাকি আকাশটা নীল। রোদে ঝকঝক করছে। ছাদের রেলিংয়ে কাক। দুটো কবুতর। ছাদে কতগুলো ফুলের গাছ।
নীলাক্ষী বলে, ‘ইশ্, এবার একটু হাত-পা ছেড়ে দাঁড়াতে পারব।’
নীলাক্ষী আড়মোড়া ভাঙে। তারপর সে বড় হতে থাকে। তপু অবাক হয়ে দেখে, নীলাক্ষীর মাথা একেবারে মেঘের গা ফুঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
তপু ভয় পায়। ‘এই দৈত্যটা এত বড়ও হতে পারে!’
তপু বলে, ‘এই, তুমি এত বড় হোয়ো না। একটু কাছে আসো।’
নীলাক্ষী বলে, ‘এটা কি তোমার দুই নম্বর আদেশ?’
‘না না। আমার দুই নম্বর আদেশ হলো, আমাকে একটা আইসক্রিম দাও।’
‘মাত্র একটা আইসক্রিম। আচ্ছা, কাপ না ললিপপ?’
‘ললিপপ।’
‘কমলা না সবুজ? নাকি চকবার?’
‘চকবার।’
‘ঠিক আছে। এই নাও, তোমার চকবার।’
তপু চকবার খায়। কী যে মজা। যেন মধুতে তার মুখ গেল ভরে।
নীলাক্ষী বলে, ‘শোনো, এর কাঠিটা ফেলে দিয়ো না। ফ্রিজে রেখে দেবে। প্রতিবার ফ্রিজ খুললেই দেখবে একটা আস্ত চকবার। শুধু কখনোই কাঠিটা ফেলে দেবে না।’
তপু বলে, ‘বেশ বেশ। তাহলে আর চিন্তা নেই। নইলে তো আবার চিন্তা হতো, আগামীকাল কী খাব।’ তপু চকবারে একটা কামড় দেয়।
নীলাক্ষী বলে, ‘এবার আমাকে তিন নম্বর হুকুমটা দাও।’
তপু ভাবতে থাকে। কী চাইবে। একটা মোটরগাড়ি? যাতে তারা স্কুলে যেতে পারে গাড়ি চড়ে। বাবা অফিসে যাবেন, মা অফিসে যাবেন। কিন্তু গাড়ি চালাবেন কে? ড্রাইভার কই পাওয়া যাবে। তেলের দাম দেবে কে? নাকি গাড়িটা বেচে তারা টাকা নেবে।
নাকি একটা বিশাল রাজপ্রাসাদ চাইবে। আচ্ছা হলো। একটা বিশাল রাজপ্রাসাদ পাওয়া গেল। সেখান থেকে তপু একা একা ফিরবে কী করে নিজের বাসায়? বাবা-মাকে খুঁজে পাবে কী করে? তিন্নি আপুকে?
তাহলে?
নীলাক্ষী বলে, ‘বস, তিন নম্বর হুকুমটা দাও। আমি সেটা পালন করে চলে যাই।’
তপু বলে, ‘একটু ভাবি।’
নীলাক্ষী বলে, ‘না, আর ভাবার সময় দেওয়া যাবে না।’
তপু তখন বলে, ‘আচ্ছা, তুমি এত বড় শরীরটা কেমন করে এতটুকুন বোতলে ঢুকিয়েছিলে, দেখাও তো।’
নীলাক্ষী সঙ্গে সঙ্গে নীল ধোঁয়া হয়ে ঢুকে পড়ে বোতলে। আর অমনি তপু বোতলের ছিপিটা মুখ থেকে বের করে পেঁচিয়ে লাগিয়ে দেয়। তারপর বোতলটাকে পকেটে রাখে।
আইসক্রিমের কাঠিটাও।
এখন সমস্যা হলো, তাদের ছাদে তালা দেওয়া। সে এখন বের হবে কী করে ছাদ থেকে? কী করে বাসায় যাবে? সে ছাদের কিনারে যায়। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নিচে তাকায়। সামনের রাস্তা দিয়ে লোকজন যাচ্ছে। তাদের কাউকে ডাকতে হবে। সে ছয়তলা থেকে চিৎকার করতে থাকে। কিন্তু কেউ তার কথা শুনতে পায় বলে মনে হয় না। এখন সে কী করবে?
সে ছাদের টিনের দরজাটায় আঘাত করতে থাকে।
জোরে জোরে শব্দ করে।
কেউ শোনে না।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। ওই যে তিন্নি আপু রিকশাভ্যান থেকে নামলেন। ‘আপু আপু...’ সে একটা ঢিলও ছোড়ে। তিন্নি তাকানই না...এখন...
তখন তপুর মাথায় বুদ্ধিটা চলে আসে। ছাদে পানির পাইপ আছে। সেই পাইপে চাবি আছে। সে গায়ের জোরে চাবি ঘোরায়। খ-য়ের প্যাঁচে খোলা। আ-এর প্যাঁচে আটকানো। তাকে আটকাতে হবে। সে নিচের তলাগুলোয় পানি যাওয়ার সব পথ বন্ধ করে দেয়।
তারপর ছাদের একটা ছায়াওয়ালা জায়গায় বসে থাকে। আকাশের রং বদলে যাওয়া দেখে। দুটো চড়ুই পাখি কিচিরমিচির করছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
তারপর দেখে মা এলেন। বাসায় না-জানি কত কান্নাকাটি পড়ে গেছে। তিন্নি আপু এসে দেখেছেন, তপু ঘরে নেই। আবার ঘরের দরজাও বন্ধ। মা এসে দেখেছেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে। তাঁরা নিশ্চয়ই একে-ওকে ফোন করে পৃথিবী উল্টে দিচ্ছেন।
মা নিশ্চয়ই কাঁদছেন। তিন্নি আপু কাঁদছেন।
তপুও কাঁদছে বসে।
বাবা আসেন ছুটতে ছুটতে। তাঁকে সে নামতে দেখে সিএনজি-যান থেকে।
সন্ধ্যা নেমে আসে। বাসার সামনে পুলিশের ভ্যান। কিন্তু কোনো একজন ছাদে আসবে না?
আকাশে যখন একটা তারা ফুটে ওঠে, তখন দারোয়ান চাচা ছাদের দরজা খোলেন। খুলেই তপুকে সামনে পান। তিনি চিৎকার করে ওঠেন, ‘এই তো তপু আংকেল। এই তো ...’
তিনি তাকে ধরে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকেন।
তারপর কত প্রশ্ন। সে কী করে তালাবদ্ধ ছাদে গেল। তপু বলে, ‘তালা খোলাই ছিল।’
‘তাহলে কে লাগাল?’
‘আমি কী জানি।’
সে তার বোতলটা ড্রয়ারে রেখে দেয়। আর আইসক্রিমের কাঠিটা ফ্রিজে। রোজ দুপুরে সে একটা করে আইসক্রিম বের করে খায়।
আর সে ঠিক করেছে, তিন্নিকে দিয়ে বোতলটা আবার খোলাবে। তার আগেই ঠিক করে নিতে হবে, তিন্নি আপু তিনটা আদেশ কী কী করবেন?
No comments