তৈরি পোশাকশিল্প- ‘দুর্ঘটনায় কেন শুধু শ্রমিকই পোড়ে?’ by কাবেরী গায়েন
আসওয়াদ কম্পোজিট মিলস লিমিটেডে
অগ্নিকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কথা হলো এডিনবরার নেপিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের
এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর প্রফেসর রবার্ট ম্যাকক্লাউড
রেসাইডের সঙ্গে।
তিনি ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যখন ফোনে ধরতে
পারলেন আমাকে, তখন, প্রথমে উত্তেজিত অথচ শেষে বিষণ্ন গলায় জানতে চাইলেন
তাজরীন আর রানা প্লাজার এমন সব দুর্ঘটনার পরেও কীভাবে আসওয়াদের এই
‘হত্যাকাণ্ড’ সম্ভব হলো? তিনি আক্ষরিক অর্থেই ‘কিলিং’ শব্দটি ব্যবহার
করলেন।
বাংলাদেশের অনেক বিষয়ে গবেষণা করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই স্কটিস প্রফেসরের সঙ্গে আমার বহুবার বাংলাদেশের নানা প্রসঙ্গে আলাপ হয়েছে। তিনি সব সময়ই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্রমবর্ধমান সূচকটির ব্যাপারে উচ্ছ্বসিত। বাংলাদেশের উন্নতির বিষয়ে তিনি বরাবরই আশাবাদী। তাঁর মতে, ৫০-৬০ বছর আগেও স্কটল্যান্ডের অবস্থা বাংলাদেশের মতোই ছিল। ঊর্ধ্বমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে যখন অবিচলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, মানবিক-নৈতিক-রাজনৈতিক সব ব্যাপারেই এই দেশে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে, সে ব্যাপারে তিনি নিঃসন্দেহ। বিশেষ করে, তাঁর আস্থা ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর। এমন মহৎ ইতিহাসের ওপর দাঁড়ানো জাতি উন্নতি না করে পারে না—এমনই অভিমত তাঁর।
কিন্তু তাজরীনের পরে রানা প্লাজা এবং মঙ্গলবারের দুর্ঘটনায় প্রফেসর রেসাইড বুঝি বা হতবিহ্বল হয়েছেন। আমার সঙ্গে কথা বলার আগেই তিনি ডেইলি স্টার আর অন্যান্য দেশি-বিদেশি ইংরেজি সংবাদসূত্রের বরাতে জেনে গেছেন যে ইতিমধ্যে ঘটনাটিকে কেবল যে ‘দুর্ঘটনা’ নামের লেবেলই দেওয়া হয়েছে এমন নয়, ‘নাশকতা’, ‘ষড়যন্ত্র’—এসবও খুঁজে বেড়ানো হচ্ছে। তিনি এত দ্রুত এত সব তথ্য জেনেছেন সম্ভবত এ কারণেও যে ব্রিটিশ ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন (আইটিভি) জানিয়েছে, আগুন লাগা ওই কারখানায় ছয়টি ব্রিটিশ ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরির কাজ চলছিল। কোম্পানিগুলো হলো নেক্সট, প্রাইমার্ক, জর্জ, গ্যাপ, এইচ অ্যান্ড এম এবং মরিসন্স। এ ছাড়া রানা প্লাজায় সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে কারখানার পরিবেশ এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তুমুল আগ্রহ ও উৎকণ্ঠার বিষয়। ফোনে কথোপকথন শেষ হওয়ার আগে প্রফেসর রেসাইড আচমকা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, যদি এসব কেবল দুর্ঘটনাই হবে, কেন শুধু শ্রমিকেরাই পুড়ে মরে? দুর্ঘটনা হলে তো কোনো না কোনো সময় মালিকপক্ষেরও দু-চারজনের এমন পুড়ে যাওয়ার কথা কোনো না কোনো কারখানায়। তাই তো, নিখাদ দুর্ঘটনার কি কোনো শ্রেণী পক্ষপাত থাকে?
দুই.
প্রথম আলোর অনলাইন আপডেটে দেখতে পাচ্ছি, ইতিমধ্যে বিজিএমইএর সংবাদ সম্মেলনে সমিতির সভাপতি আতিকুল ইসলাম দাবি করেছেন যে কারখানাটিতে দুই বছর আগে থেকেই অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র ছিল। আসওয়াদ কম্পোজিটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাফিস শিকদারের মতে, ‘অগ্নিনির্বাপণের সব ধরনের সরঞ্জাম থাকার পরও এক লাখ ১৫ হাজার বর্গফুট আয়তনের তিনটি ইউনিটে আগুন মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এটা আমাদের জন্য একটি নতুন বার্তা।’ বটে! বার্তাটি আমাদের জন্যও নতুন বৈকি! প্রশ্ন হচ্ছে, অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র ব্যবহারের শিক্ষা কি দেওয়া হয়েছিল? ট্রেনিং কি দেওয়া হয়েছে, হচ্ছে শ্রমিকদের যেকোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে তাঁরা কীভাবে বের হয়ে আসবেন ভবন থেকে? তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে ‘প্রকৃত কারণ’ খুঁজে বের করার জন্য। তদন্ত কমিটি কোন প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করবে? সে ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে এই সংবাদ সম্মেলনেই। তারা খুঁজে বের করবে কোনো নাশকতামূলক ‘ষড়যন্ত্র’ এই দুর্ঘটনার পেছনে দায়ী কি না। তদন্ত কমিটি কি দেখবে অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র ব্যবহারের মহড়া, আপৎকালীন পরিস্থিতিতে শ্রমিকেরা কীভাবে বের হবেন, সে বিষয়ে নিয়মিত মহড়া দেওয়া হয় কি না? যদি না দেওয়া হয়, তবে এই সাত শ্রমিকের মৃত্যু হত্যাকাণ্ড, বড়জোর শুনতে ভালো শব্দে বলা যায় ‘কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড’।
তিন.
প্রথম আলোরই (১০ অক্টোবর, ২০১৩) আরেকটি প্রতিবেদন থেকে দেখতে পাচ্ছি যে গত বছর তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লেগে শতাধিক শ্রমিক পুড়ে মারা যাওয়ার পরে পোশাক কারখানার অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণে যে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল, সেখানে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল বিজিএমইএ। এই টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের তিনজন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পাঁচজন এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ে একজন সদস্যের সমন্বয়ে। শুরুতে উৎসাহ দিলেও পরে রীতিমতো অসহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে বিজিএমইএর বিরুদ্ধে। টাস্কফোর্সের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিজিএমইএ ‘কমপ্লায়েন্ট’ ঘোষণা দিয়েছে, এমন ৩৪টি কারখানার অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এসব ‘কমপ্লায়েন্ট’ খেতাবধারী কারখানাগুলোই অগ্নিনির্বাপণের শর্ত মানছে না। অন্য কারখানাগুলোর অবস্থা অনুমান করাই যায়। এরপর যখন আগুন লেগে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছেন শ্রমিকেরা, তখন কেন এসব হত্যাকাণ্ডকে দুর্ঘটনা বলে পার পেয়ে যাবে বিজিএমইএ, সংশ্লিষ্ট কারখানার মালিকেরা?
চার.
২০০৬ সালের শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো কারখানার ‘কমপ্লায়েন্স’ নির্ধারণের জন্য অন্যতম চারটি বিষয় হলো, কারখানার প্রতি তলায় কতজন শ্রমিক কাজ করছেন, শ্রমিকদের সম্মিলিত ওজন ও শ্রমিকের কাজের জায়গা থেকে বের হওয়ার দরজার দূরত্ব, দরজার প্রস্থ যা আগুন লাগলে শ্রমিকের বের হওয়ার জন্য যথেষ্ট কি না এবং দরজার ধরন। এ বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে টাস্কফোর্স দেখেছে, অধিকাংশ কারখানাই ত্রুটিপূর্ণ। এমনকি কোনো কারখানার একটি তলা হয়তো ‘কমপ্লায়েন্ট’, অন্যগুলো নয় অথচ তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব কারখানায় আগুন লেগে যখন শনাক্ত-অযোগ্য অবয়বে ছাই হয়ে যাচ্ছেন আমাদের শ্রমিকেরা, সেই সব হত্যাকাণ্ডকে দুর্ঘটনা বলে আর কত দিন চালানো হবে?
পাঁচ.
বড় দুর্ভাগা আমরা। এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে যারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটন করেছে, তাদের বিচার ও সাজা প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে মুখোমুখি সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। যে শ্রমিকের শ্রমে-ঘামে-জীবনের দামে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের পোশাকশিল্প, তাঁদের পুড়িয়ে মারার, ‘নন-কমপ্লায়েন্ট’ কারখানায় কাজ করতে বাধ্য করে মেরে ফেলার নাম দেওয়া হয়েছে ‘দুর্ঘটনা’। নামকরণের রাজনীতিতে অনেক কিছুই আসে-যায়। এই উদ্দেশ্যমূলক নামকরণই অতঃপর সাধারণ হয়ে উঠেছে। গণমাধ্যমেও দেখি ‘দুর্ঘটনা’ আখ্যাই দেওয়া হয়ে থাকে। মতনির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দল এবং দেশের মানুষ আমরা এসব ‘দুর্ঘটনা’ আখ্যা দেওয়া হত্যাকাণ্ড রোধের ব্যাপারে কিছুতেই ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারছি না, প্রতিরোধ করা তো দূরে থাক। অথচ মানুষের সংঘবদ্ধ মানবিক শক্তি রুখে দাঁড়ালে এসব কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা যায় না, এমন পরাভবে আমার আস্থা কম। জাতিগতভাবে, ক্ষেত্রবিশেষে, উপেক্ষা করার, উদাসীন থাকার যে অসীম ক্ষমতা আমাদের, তারই ফাঁক গলে স্পেকট্রাম, তাজরীন, রানা, আসওয়াদের হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটতে থাকে। শনাক্ত-অযোগ্য লাশগুলো শনাক্ত করার জন্য তাই প্রয়োজন হয় ডিএনএ পরীক্ষার, যাঁরা পোশাকের গায়ে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ফুটিয়ে তুলে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের পরিচিতি দেন। আর বলিহারি দারিদ্র্য আমাদের, এসব হত্যাকাণ্ডকে ৪০ হাজার, ৫০ হাজার, বড়জোর এক লাখ, দুই লাখ টাকা দিয়ে কিনে ফেলে রীতিমতো পুণ্যলাভের তৃপ্তি ভোগ করা যায়।
জানি যে প্রফেসর রেসাইডের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্ন ‘এসব যদি নেহাত দুর্ঘটনা, কেন শুধু শ্রমিকেরাই পুড়ে যায়?’ কয়েক দিন বাজতে থাকবে কানে, অস্বস্তি তৈরি হবে, ভুলে যাব সব ফের বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগ পর্যন্ত। এসব মৃত্যু আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। আমরা পোশাক কারখানার শ্রমিক নই, আর যা-ই হোক, আমরা তো আর পুড়ে মরছি না! পুড়বে তো শুধু শ্রমিকেরাই। চিন্তা কি, যত দিন শ্রমিকের মজুরি সর্বনিম্ন রাখা যাবে, তত দিন বিদেশি ক্রেতার অভাব হবে না, যত দিন হা-ঘরে দারিদ্র্য থাকবে, তত দিন কারখানার আগুনে পুড়ে মরার জন্য শ্রমিক নামের লাকড়ির জোগান ফুরাবে না।
‘পৃথিবীর সবই ঠিক আছে, আর ঈশ্বরও রয়েছেন স্বর্গে’।
বাংলাদেশের অনেক বিষয়ে গবেষণা করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই স্কটিস প্রফেসরের সঙ্গে আমার বহুবার বাংলাদেশের নানা প্রসঙ্গে আলাপ হয়েছে। তিনি সব সময়ই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্রমবর্ধমান সূচকটির ব্যাপারে উচ্ছ্বসিত। বাংলাদেশের উন্নতির বিষয়ে তিনি বরাবরই আশাবাদী। তাঁর মতে, ৫০-৬০ বছর আগেও স্কটল্যান্ডের অবস্থা বাংলাদেশের মতোই ছিল। ঊর্ধ্বমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে যখন অবিচলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, মানবিক-নৈতিক-রাজনৈতিক সব ব্যাপারেই এই দেশে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে, সে ব্যাপারে তিনি নিঃসন্দেহ। বিশেষ করে, তাঁর আস্থা ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর। এমন মহৎ ইতিহাসের ওপর দাঁড়ানো জাতি উন্নতি না করে পারে না—এমনই অভিমত তাঁর।
কিন্তু তাজরীনের পরে রানা প্লাজা এবং মঙ্গলবারের দুর্ঘটনায় প্রফেসর রেসাইড বুঝি বা হতবিহ্বল হয়েছেন। আমার সঙ্গে কথা বলার আগেই তিনি ডেইলি স্টার আর অন্যান্য দেশি-বিদেশি ইংরেজি সংবাদসূত্রের বরাতে জেনে গেছেন যে ইতিমধ্যে ঘটনাটিকে কেবল যে ‘দুর্ঘটনা’ নামের লেবেলই দেওয়া হয়েছে এমন নয়, ‘নাশকতা’, ‘ষড়যন্ত্র’—এসবও খুঁজে বেড়ানো হচ্ছে। তিনি এত দ্রুত এত সব তথ্য জেনেছেন সম্ভবত এ কারণেও যে ব্রিটিশ ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন (আইটিভি) জানিয়েছে, আগুন লাগা ওই কারখানায় ছয়টি ব্রিটিশ ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরির কাজ চলছিল। কোম্পানিগুলো হলো নেক্সট, প্রাইমার্ক, জর্জ, গ্যাপ, এইচ অ্যান্ড এম এবং মরিসন্স। এ ছাড়া রানা প্লাজায় সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে কারখানার পরিবেশ এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তুমুল আগ্রহ ও উৎকণ্ঠার বিষয়। ফোনে কথোপকথন শেষ হওয়ার আগে প্রফেসর রেসাইড আচমকা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, যদি এসব কেবল দুর্ঘটনাই হবে, কেন শুধু শ্রমিকেরাই পুড়ে মরে? দুর্ঘটনা হলে তো কোনো না কোনো সময় মালিকপক্ষেরও দু-চারজনের এমন পুড়ে যাওয়ার কথা কোনো না কোনো কারখানায়। তাই তো, নিখাদ দুর্ঘটনার কি কোনো শ্রেণী পক্ষপাত থাকে?
দুই.
প্রথম আলোর অনলাইন আপডেটে দেখতে পাচ্ছি, ইতিমধ্যে বিজিএমইএর সংবাদ সম্মেলনে সমিতির সভাপতি আতিকুল ইসলাম দাবি করেছেন যে কারখানাটিতে দুই বছর আগে থেকেই অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র ছিল। আসওয়াদ কম্পোজিটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাফিস শিকদারের মতে, ‘অগ্নিনির্বাপণের সব ধরনের সরঞ্জাম থাকার পরও এক লাখ ১৫ হাজার বর্গফুট আয়তনের তিনটি ইউনিটে আগুন মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এটা আমাদের জন্য একটি নতুন বার্তা।’ বটে! বার্তাটি আমাদের জন্যও নতুন বৈকি! প্রশ্ন হচ্ছে, অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র ব্যবহারের শিক্ষা কি দেওয়া হয়েছিল? ট্রেনিং কি দেওয়া হয়েছে, হচ্ছে শ্রমিকদের যেকোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে তাঁরা কীভাবে বের হয়ে আসবেন ভবন থেকে? তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে ‘প্রকৃত কারণ’ খুঁজে বের করার জন্য। তদন্ত কমিটি কোন প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করবে? সে ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে এই সংবাদ সম্মেলনেই। তারা খুঁজে বের করবে কোনো নাশকতামূলক ‘ষড়যন্ত্র’ এই দুর্ঘটনার পেছনে দায়ী কি না। তদন্ত কমিটি কি দেখবে অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র ব্যবহারের মহড়া, আপৎকালীন পরিস্থিতিতে শ্রমিকেরা কীভাবে বের হবেন, সে বিষয়ে নিয়মিত মহড়া দেওয়া হয় কি না? যদি না দেওয়া হয়, তবে এই সাত শ্রমিকের মৃত্যু হত্যাকাণ্ড, বড়জোর শুনতে ভালো শব্দে বলা যায় ‘কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড’।
তিন.
প্রথম আলোরই (১০ অক্টোবর, ২০১৩) আরেকটি প্রতিবেদন থেকে দেখতে পাচ্ছি যে গত বছর তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লেগে শতাধিক শ্রমিক পুড়ে মারা যাওয়ার পরে পোশাক কারখানার অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণে যে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল, সেখানে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল বিজিএমইএ। এই টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের তিনজন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পাঁচজন এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ে একজন সদস্যের সমন্বয়ে। শুরুতে উৎসাহ দিলেও পরে রীতিমতো অসহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে বিজিএমইএর বিরুদ্ধে। টাস্কফোর্সের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিজিএমইএ ‘কমপ্লায়েন্ট’ ঘোষণা দিয়েছে, এমন ৩৪টি কারখানার অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এসব ‘কমপ্লায়েন্ট’ খেতাবধারী কারখানাগুলোই অগ্নিনির্বাপণের শর্ত মানছে না। অন্য কারখানাগুলোর অবস্থা অনুমান করাই যায়। এরপর যখন আগুন লেগে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছেন শ্রমিকেরা, তখন কেন এসব হত্যাকাণ্ডকে দুর্ঘটনা বলে পার পেয়ে যাবে বিজিএমইএ, সংশ্লিষ্ট কারখানার মালিকেরা?
চার.
২০০৬ সালের শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো কারখানার ‘কমপ্লায়েন্স’ নির্ধারণের জন্য অন্যতম চারটি বিষয় হলো, কারখানার প্রতি তলায় কতজন শ্রমিক কাজ করছেন, শ্রমিকদের সম্মিলিত ওজন ও শ্রমিকের কাজের জায়গা থেকে বের হওয়ার দরজার দূরত্ব, দরজার প্রস্থ যা আগুন লাগলে শ্রমিকের বের হওয়ার জন্য যথেষ্ট কি না এবং দরজার ধরন। এ বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে টাস্কফোর্স দেখেছে, অধিকাংশ কারখানাই ত্রুটিপূর্ণ। এমনকি কোনো কারখানার একটি তলা হয়তো ‘কমপ্লায়েন্ট’, অন্যগুলো নয় অথচ তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব কারখানায় আগুন লেগে যখন শনাক্ত-অযোগ্য অবয়বে ছাই হয়ে যাচ্ছেন আমাদের শ্রমিকেরা, সেই সব হত্যাকাণ্ডকে দুর্ঘটনা বলে আর কত দিন চালানো হবে?
পাঁচ.
বড় দুর্ভাগা আমরা। এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে যারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটন করেছে, তাদের বিচার ও সাজা প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে মুখোমুখি সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। যে শ্রমিকের শ্রমে-ঘামে-জীবনের দামে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের পোশাকশিল্প, তাঁদের পুড়িয়ে মারার, ‘নন-কমপ্লায়েন্ট’ কারখানায় কাজ করতে বাধ্য করে মেরে ফেলার নাম দেওয়া হয়েছে ‘দুর্ঘটনা’। নামকরণের রাজনীতিতে অনেক কিছুই আসে-যায়। এই উদ্দেশ্যমূলক নামকরণই অতঃপর সাধারণ হয়ে উঠেছে। গণমাধ্যমেও দেখি ‘দুর্ঘটনা’ আখ্যাই দেওয়া হয়ে থাকে। মতনির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দল এবং দেশের মানুষ আমরা এসব ‘দুর্ঘটনা’ আখ্যা দেওয়া হত্যাকাণ্ড রোধের ব্যাপারে কিছুতেই ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারছি না, প্রতিরোধ করা তো দূরে থাক। অথচ মানুষের সংঘবদ্ধ মানবিক শক্তি রুখে দাঁড়ালে এসব কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা যায় না, এমন পরাভবে আমার আস্থা কম। জাতিগতভাবে, ক্ষেত্রবিশেষে, উপেক্ষা করার, উদাসীন থাকার যে অসীম ক্ষমতা আমাদের, তারই ফাঁক গলে স্পেকট্রাম, তাজরীন, রানা, আসওয়াদের হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটতে থাকে। শনাক্ত-অযোগ্য লাশগুলো শনাক্ত করার জন্য তাই প্রয়োজন হয় ডিএনএ পরীক্ষার, যাঁরা পোশাকের গায়ে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ফুটিয়ে তুলে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের পরিচিতি দেন। আর বলিহারি দারিদ্র্য আমাদের, এসব হত্যাকাণ্ডকে ৪০ হাজার, ৫০ হাজার, বড়জোর এক লাখ, দুই লাখ টাকা দিয়ে কিনে ফেলে রীতিমতো পুণ্যলাভের তৃপ্তি ভোগ করা যায়।
জানি যে প্রফেসর রেসাইডের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্ন ‘এসব যদি নেহাত দুর্ঘটনা, কেন শুধু শ্রমিকেরাই পুড়ে যায়?’ কয়েক দিন বাজতে থাকবে কানে, অস্বস্তি তৈরি হবে, ভুলে যাব সব ফের বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগ পর্যন্ত। এসব মৃত্যু আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। আমরা পোশাক কারখানার শ্রমিক নই, আর যা-ই হোক, আমরা তো আর পুড়ে মরছি না! পুড়বে তো শুধু শ্রমিকেরাই। চিন্তা কি, যত দিন শ্রমিকের মজুরি সর্বনিম্ন রাখা যাবে, তত দিন বিদেশি ক্রেতার অভাব হবে না, যত দিন হা-ঘরে দারিদ্র্য থাকবে, তত দিন কারখানার আগুনে পুড়ে মরার জন্য শ্রমিক নামের লাকড়ির জোগান ফুরাবে না।
‘পৃথিবীর সবই ঠিক আছে, আর ঈশ্বরও রয়েছেন স্বর্গে’।
কাবেরী গায়েন: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments