দৈহিক by শেখ আবদুল হাকিম

লাঞ্চের পর কর্মচারীদের নিয়ে মিটিং করছেন সামসুল হক। এইমাত্র তিনি জানালেন, তাঁদের ইনডেন্টিং ব্যবসা গত বছরের মতো ভালো না হলেও, প্রতিবারের মতো এবারও কোরবানির ঈদে এক জোড়া করে গরু-খাসি জবাই করা হবে, তাতে করে পিয়ন থেকে শুরু করে ম্যানেজার পর্যন্ত সবাই কমবেশি ১০ কেজি করে মাংস আশা করতে পারেন।
 
এই সময় পিয়নের গাফিলতিতে মূল অফিস কামরার ভেতর ঢুকে পড়ল এক তরুণ। তার হাবভাব রীতিমতো রহস্যময়, সামসুল হকের সামনে থেমে ফিসফিস করল, যদিও তার ফ্যাঁসফেঁসে গলা কারও আর শুনতে বাকি থাকল না, ‘আপনার সেই মেয়েটি কোথায় থাকে আমরা জেনেছি, স্যার।’

প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও, দ্রুতই নিজেকে সামলে নিলেন সামসুল হক। ‘আজকের মতো মিটিং এখানেই শেষ,’ বলে সবার দিকে পেছন ফিরলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব ভদ্রলোক, চলে গেলেন খোলা জানালার সামনে। ২০ তলা থেকে নিচের রাস্তায় লেগে থাকা যানজট দেখছেন।

প্রায় নিঃশব্দে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তাঁর সব কর্মচারী।

‘এই নিন ঠিকানা।’ বলল তরুণ বেসরকারি গোয়েন্দা। নতুন, তাই এখনো ঠিক পেশাদার হয়ে উঠতে পারেনি, কৌতূহলী শ্রোতা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় হতাশ।

ঘুরে দাঁড়িয়ে তরুণের বাড়ানো হাত থেকে কাগজটা নিলেন সামসুল হক। তাতে লেখা: মোনা বিস্তার, ২৭/৩, ওল্ড মডেল টাউন, ছয়তলা, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ, প্রযত্নে মিসেস সুশীলা বানু।

‘মাত্র এক সপ্তা হলো ওখানে উঠেছেন,’ বলল তরুণ। ‘স্যার, আপনি যদি চান এই মেয়েকে নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে, আমাদের চেয়ে ভালো সার্ভিস আর কেউ...’

‘না, লাগবে না। আমার শুধু ঠিকানাটা দরকার ছিল। কত দিতে হবে?’

‘মাত্র এক দিনের কাজ, আড়াই হাজার দিলেই হবে।’



সেদিন বিকেলেই নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে গেলেন সামসুল হক। গাড়ি নিয়ে নিচে অপেক্ষা করছে ড্রাইভার, নোংরা সিঁড়ি ভেঙে একা ছয়তলায় উঠলেন তিনি। দরজায় নেমপ্লেট আছে, দেখা গেল, সুশীলা বানু খুব নামকরা একটা হোটেলের সাবেক শেফ। আঙুলের গিঁট দিয়ে টোকা মারতে হলো দরজায়।

সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলল, সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে মোনা বিস্তার। বোঝা গেল শব্দটা শোনার অপেক্ষায় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল সে। সামসুল হককে দেখে ওর চোখে আলো জ্বলল, মুখে হাসি খেলল, মায়া জাগানো ঘাড় দুলিয়ে ভেতরে ডাকল তাঁকে। একটা চেয়ার টেনে এনে ঘরের মাঝখানে বসতে দিল। নিজে বসল জানালার পাশে ফেলা অপর চেয়ারে, ধরনটা আয়েশি হলেও ভঙ্গিটা অমার্জিত নয়, তবে সামান্য আড়ষ্ট দেখাচ্ছে ওকে।

পাঁচ ফুট সাড়ে তিন ইঞ্চি লম্বা মোনা বিস্তারের বয়স ২১। থোকা থোকা কোঁকড়া চুল হাঁটার সময় মাথাজুড়ে নাচানাচি করে। একহারা, কিন্তু শক্তিশালী কাঠামো, মুখের তাজা ভাবটা ওর অমূল্য সম্পদ। সাধারণ সালোয়ার-কামিজ পরে আছে; কামিজটা খাটো, সালোয়ারটা আঁটো—সামসুল হকের সামনে একটু লজ্জাই পাচ্ছে, আড়ষ্ট দেখানোর সেটাই কারণ।

‘মোনা,’ সামসুল হক বললেন, সুর মোলায়েম, ‘তুমি আমার ফোন ধরছ না। অনেক চেষ্টা করার পর আজই জানতে পেরেছি, এখানে উঠে এসেছ। তোমার জন্য কেমন অস্থিরতায় ভুগি, সেটা তুমি ভালোই বোঝো, তারপরও কেন এই আচরণ করছ, আমাকে বলবে?’

চোখে মোহ জাগানো স্বপ্ন, জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল মোনা। ‘আপনাকে যে কী উত্তর দেব সত্যি আমি জানি না। এটুকু বুঝি যে আপনার প্রস্তাব সত্যি খুব ভালো। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আপনার সঙ্গে থাকতে পারলে সব দিক থেকে আমি সুখী হব। আবার সন্দেহও যায় না। আমি শহরে বড় হয়েছি, বুঝতে শিখেছি ভালোভাবে বেঁচে থাকা কাকে বলে...’

‘বোকা মেয়ে,’ ব্যাকুল একটা ভাব ফুটল সামসুল হকের চেহারায়, ‘তোমাকে আমি বলিনি, আমার সাধ্যের মধ্যে কুলালে তোমার সব চাহিদা পূরণ হবে? তুমি প্রতি সপ্তায় নাটক-সিনেমা দেখতে যাবে, যতবার ইচ্ছা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা করতে পারবে, মাসে এক-আধবার শপিং করলেও আমি কিছু মনে করব না। তুমি আমাকে বিশ্বাস করো তো, নাকি?’

‘পুরো বিশ্বাস করি,’ বলল মোনা, মুখে আন্তরিক হাসি। ‘আমি জানি আপনার মতো দয়ালু মানুষ হয় না। এও বুঝি, যে মেয়েকে আপনি পাবেন সে অতি ভাগ্যবতী। আপনার সম্পর্কে যা কিছু জানার সব আমি চৌধুরীদের ওখানে থাকার সময় জেনেছি।’

‘ও, হ্যাঁ!’ উচ্ছ্বসিত হলেন সামসুল হক, মনে পড়ে যাওয়ায় কোমল আলো জ্বলল চোখে। ‘আমার মনে আছে, ওদের বাড়িতে তোমাকে প্রথম যেদিন দেখলাম। শুধু তোমার প্রশংসা করেই পুরোটা সন্ধে পার করে দিলেন মিসেস চৌধুরী। তারপরও বলব, তোমার প্রতি সুবিচার করা হয়নি। সেই রাতের ডিনার জীবনে কখনো ভুলব না। এসো, মোনা, তুমি আমাকে কথা দাও। আমি তোমাকে চাই। আমার সঙ্গে এলে তোমাকে কখনো পস্তাতে হবে না। এত ভালো একটা বাড়ি আর কেউ তোমাকে দিতে পারবে না।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মোনা, চোখ নামিয়ে নিজের ভাঁজ করা হাতের দিকে তাকাল।

হঠাৎ ঈর্ষা আর সন্দেহে প্রায় কাবু হয়ে পড়লেন সামসুল হক। তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি, জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমাকে সত্যি কথা বলবে, মোনা! তুমি কি...আর কেউ আছে নাকি?’

ধীরে ধীরে লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ল মোনার ফরসা মুখ আর ঘাড়ে, কেউ যেন দুধে আলতা ঢেলে দিয়েছে। ‘এ রকম একটা কথা আমাকে আপনার জিজ্ঞেস করা উচিত নয়,’ বলে জানালা দিয়ে আবার বাইরে তাকাল, খানিকটা দিশাহারা দেখাচ্ছে ওকে। ‘তবু আপনাকে বলছি। আরেকজন আছে—কিন্তু তার কোনো অধিকার নেই—আমি তাকে কোনো প্রতিশ্রুতি দিইনি।’

‘কে সে? নাম কী তার?’ খেপে উঠছেন সামসুল হক, চোখে জেদ।

‘সাদেক।’

‘সাদেক খান!’ বিস্মিত হলেন সামসুল হক, রাগে তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। ‘ওই দুই নম্বর লোক তোমাকে চিনল কীভাবে? তুমি জানো আমার তিন নম্বর ম্যানেজার ছিল সে, চুরি করার অপরাধে চাকরি গেছে?’

‘চুরির সেই টাকা দিয়ে গাড়িও কিনেছে,’ বলল মোনা, জানালা দিয়ে ঝুঁকে নিচের রাস্তা দেখছে, ‘আর সেই গাড়ি খানিক আগে নিচে এসে দাঁড়িয়েছে, আপনারটার পাশে। আমার উত্তর শোনার জন্য ওপরে আসছে সে। হে মাবুদ, কী করতে হবে আমাকে বলে দাও!’

দরজায় টোকা পড়ল। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াচ্ছে মোনা, কিন্তু তার আগে সামসুল হক দাঁড়ালেন। ‘তুমি বসো,’ বললেন তিনি। ‘ওর সঙ্গে ল্যান্ডিংয়ে কথা বলছি আমি।’

সাদেক খানের বয়স ২৯। সুঠাম স্বাস্থ্য, সুদর্শন, সুবেশ।

‘ফিরে যাও,’ দরজা খুলে তাকে বললেন সামসুল হক, হাত দিয়ে সিঁড়ির নিচটা দেখালেন।

‘স্যার, আপনি!’ অবাক হওয়ার ভান করল সাদেক খান। ‘বুড়ো মানুষ, আপনি এখানে কী করছেন, স্যার?’

‘ফিরে যাও,’ কথাটা পুনরাবৃত্তি করলেন সামসুল হক, একবিন্দু মচকাতে রাজি নন। ‘কিছু যদি মনে না করো, এখানে জঙ্গলের আইন খাটবে। চাও, হিংস্র একটা পুরো দল এসে তোমাকে ছিঁড়ে ফেলুক? দ্য কিল ইজ মাইন, মাই ডিয়ার বয়!’

‘আমি এখানে এসেছিলাম বানু আন্টিকে একটা চাকরির খবর দিতে,’ সাহস সঞ্চয় করে বলল সাদেক খান।

‘ঠিক আছে, খবরটা পরে দিয়ো। কিন্তু এখন তুমি যাও।’

সাদেক খান লেজ তুলে পালাল। দরজা বন্ধ করে সামসুল হক তাঁর প্রেমের কাছে ফিরলেন।

‘মোনা, তোমাকে আমার পেতে হবে,’ কর্তৃত্বের সুরে বললেন তিনি। ‘আমি আর কোনো রকম ধানাইপানাই শুনতে রাজি নই।’

‘আপনি আমাকে কখন চাইছেন?’

‘এখনই। তোমার তৈরি হতে যতক্ষণ লাগে।’

চোখে চোখ রেখে শান্ত হয়ে তাঁর সামনে দাঁড়িয়েছে মোনা। ‘আপনি কি ভেবেছেন তাসলিমা ওখানে থাকতে আমি আপনার বাড়িতে পা রাখব?’

যেন অপ্রত্যাশিত একটা ঘুষি ঝাঁকিয়ে দিল সামসুল হককে। তাঁর ভ্রুতে ঘাম ফুটছে। ‘আমার সুখী হওয়ার পথে ওই মেয়েমানুষ যদি বাধা হয়, সেটা আমি সহ্য করব কেন! যেদিন থেকে ওর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, একটা দিনের জন্য সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে পারিনি। তুমি ঠিকই বলেছ, মোনা। তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার আগে তাসলিমাকে অবশ্যই ফেরত পাঠাতে হবে। যাবে সে, যাবে, কেননা এটা আমার সিদ্ধান্ত। আমি তাকে দরজা থেকে বিদায় করে দেব।’

‘কখন? আমি জানতে চাই, সেটা কখন?’

‘আজ রাতে,’ বললেন সামসুল হক। ‘আজ রাতেই আমি তাকে বিদায় করে দেব।’

‘তা যদি পারেন, তাহলে আমার উত্তর হবে—হ্যাঁ,’ বলল মোনা। ‘গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন, পৌঁছে যাব আমি।’

বারিধারা প্রকল্পে লনসহ আধুনিক দোতলা বাড়ি। গাড়িটা আসতে দেখে উর্দিপরা দারোয়ান গেট খুলে দিল। ভেতরে ঢুকে লনের পাশ ঘেঁষে সোজা এগোলেন সামসুল হক। বারান্দার সামনে পৌঁছে গাড়ি থামিয়ে নিচে নামলেন।

বারান্দার ধাপ বেয়ে হেলেদুলে নেমে এলেন তাঁর স্ত্রী, শরীরের চারদিক থেকে উপচে পড়ছে থলথলে চর্বি। গতি সামলাতে কষ্ট, আর একটু হলে হুমড়ি খেয়ে স্বামীর গায়ে পড়তে যাচ্ছিলেন। সামসুল হক এক পা পিছিয়ে বিপদ এড়ালেন।

‘এই শুনছ!’ চাপা স্বরে বললেন মহিলা, অস্থির আর উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে তাঁকে। ‘আম্মি এসেছেন! কিন্তু ডিনারের কোনো ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না।’

‘তোমাকে আমার একটা কথা বলার আছে,’ বারান্দা থেকে বসার ঘরে ঢোকার সময় বললেন সামসুল হক। ‘ভেবেছিলাম পরে একসময় ধীরেসুস্থে বলব, কিন্তু যেহেতু তোমার আম্মি এখানে আছেন, ব্যাপারটা এখনই মিটিয়ে ফেললে ভালো হয়।’ ঝুঁকলেন তিনি, স্ত্রীর কানে নিচুস্বরে কিছু বললেন।

তাঁর স্ত্রী চেঁচিয়ে উঠলেন। মেয়ের চিৎকার শুনে কৌতূহল নিয়ে ছুটে এলেন বৃদ্ধ মা। চিৎকারটা যেন আদর ও ভালোবাসা পেয়ে ধন্য কোনো নারীর গলা থেকে বেরিয়েছে।

‘ও আম্মি!’ উল্লাসে ফেটে পড়লেন মহিলা। ‘তুমি কল্পনা করতে পারো? মোনা আমাদের বাড়িতে রাঁধতে আসছে। এই মেয়ের কথাই তো তোমাকে বলেছিলাম, চৌধুরীদের বাড়িতে পুরো এক বছর ছিল। তুমি এবার, সামসু, সোজা কিচেনে চলে যাও, এই মুহূর্তে নট করে দাও তাসলিমার চাকরি! আজও সে সিগারেট না কি যেন ছাই খেয়ে সেই সন্ধে থেকে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।’

বিদেশি গল্প অবলম্বনে

No comments

Powered by Blogger.