করুণাধারায় এসো by মমতাজউদদীন আহমদ
একটানা বহু দিন বিদেশ ছিলাম। যুক্তরাষ্ট্র
একটা বিরাট দেশ। আমাদের বাংলাদেশের চেয়ে ৫০ গুণ বড়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে
গরম নেই। আছে, তবে মাত্র কয়েক দিনের জন্য। বাকি সময়টা শীত আর শীত।
বসন্তকালে না শীত, না গরম।
তবে শীত যখন আসে, চতুর্দিক
কাঁপিয়ে আসে। তাতে আছে সাত-আট ফুট বরফ। পথচলা দুষ্কর। শীত আছে, তার সঙ্গে
প্রচুর জামাকাপড়ও আছে। একটার পর একটা শরীরে চাপিয়ে বস্তার বোঝা বয়ে পথে
নামতে হয়। ঘরে ঢুকলে কোথায় শীত! হিটিংয়ের ঠেলায় শীত হারিয়ে যায়।
বাংলায় গ্রীষ্মে যে গরম! ওরে বাপরে, গরম মানে চামড়া ছিঁড়ে জ্বালিয়ে দেওয়া গরম। তাতে বিদ্যুতের বিচলিত অবস্থা। ঘণ্টায় ঘণ্টায় নীরব। এক ফোঁটা বাতাস নেই। গাছের পাতা নড়ে না। গরমের ভাপে বাতাসও ভয়ে জবুথবু। পাতারা চুপ করে ডালে বসে আছে। আগেও কি এমন চামড়াজ্বলা গরম ছিল? বাতাস গরম। আগুনের হলকা ছুটে ছুটে আসে। একেক সময় জ্বলেপুড়ে বিধাতা আর প্রকৃতিকে গালমন্দ করে বলি,- তো, আর কত জ্বালাবে গো প্রকৃতি? এত নিষ্ঠুর তুমি! আমরা ১৬ কোটি নর-নারী-শিশু-বৃদ্ধ তোমার অপকীর্তি উষ্ণতার অত্যাচারে হাহাকার করছি, তুমি কি একটুখানি উদার হতে পার না? বৃষ্টি দাও। বৃষ্টিতে ফাটা মাঠঘাট-গাছপাথরকে ভাসিয়ে দাও। তৃষ্ণার্ত পৃথিবীকে বেঁচে থাকার সান্ত্বনা দাও। শোনে না, নিষ্ঠুর কৃষক বিধাতার মতো কঠোর প্রকৃতি আপন ক্রোধের আনন্দে গরম ঢেলেই যাচ্ছে। মধুমাসের মিষ্টি ফল খাব কী, গরমের জ্বালায় আধমরা হয়ে এ ঘর-ও ঘর করছি। কোথাও একটু নরম-শীতল আশ্রয় নেই। বাংলার বহু জ্বালা। এ দেশের নেই-নেইর হাহাকার তো হাজার বছরের কাহিনী। বাংলার মানুষের জীবনযুদ্ধের মতো কঠোর সংগ্রাম আর কোন দেশের মানুষ করে, তা জানি না। সুদানে, লিবিয়াতে, আরবে কি এত কঠোর উষ্ণ হাহাকারের জীবন? মনে তো হয়, না। এমন নয়। বিধাতার সৃষ্টি অপরূপ বাংলার শত-সহস্র জ্বালা। এ নিয়েই বাংলা অবিনশ্বর। এমন সময় খবর পেলাম, দৈনিক কাগজে বের হয়েছে। খবর হলো, মা-বাবা দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে মানে ছয় মাসের শিশুকে মাত্র ১১০০ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে। মা-বাবার অর্থের বড় প্রয়োজন। জীবনযুদ্ধ যত না ক্ষতবিক্ষত, তার চেয়ে বেশি নেশার তাড়নায় অস্থির। মাদকাসক্ত মা-বাবার আর কোনো সম্বল ছিল না। ছিল ওই এক শিশু। তাকে বেচে যদি মাদক সংগ্রহ করা যায়, তবে মন্দ কী! তাতে তো দিনকয়েক বেশ মজা করে ধোঁয়া টানা যাবে অথবা সুই ফুটিয়ে মাদকের তাগাদাকে শান্ত রাখা যাবে।
মা-বাবা পার্বতীপুর থেকে এসে দিনাজপুরের এক গাঁয়ের এক হিজড়ার কাছে সন্তানকে বেচে অর্থ নিয়ে গেছে। না, এ সময় মন্বন্তরের নয়। খাদ্যে আকাল পড়েনি। ওয়ারেন হেস্টিংয়ের কালে জোর করে খাজনা আদায়ের কারণে ছিয়াত্তর সালে মন্বন্তর দেখা দিয়েছিল, তাতেই গৃহস্থরা বেচে ফেলার জন্য হালের বলদ, ঘরের বউ, কোলের শিশু অথবা নিজে নিজেকে বিক্রি করে বাঁচতে চেয়েছে। বাঁচতে অবশ্যি পারেনি। সবাই বেচতে চায়, বিক্রি হতে চায়। কিন্তু কেনার মানুষ কোথায়? দলে দলে, শয়ে শয়ে মানুষ মরে পড়ে থেকেছে বাংলার পথেঘাটে। আর একবার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জাপানিদের ভয়ে সাম্রাজ্য বাঁচানোর জন্য বাহনের নৌকা যত ছিল, সব ডুবিয়ে দিয়েছিল প্রশাসন। খরা এলো সে বছর। খাদ্যাভাবে শয়ে শয়ে মানুষ আর জন্তুজানোয়ার মরে পড়ে থাকল পথেঘাটে। আরো একবার, ১৯৭৪ সালে মাকির্নিদের ষড়যন্ত্রে খাদ্য জাহাজকে বাংলায় না ভিড়িয়ে সিঙ্গাপুরে পাঠিয়ে দিল। খাদ্যাভাবে বাংলার মানুষ শয়ে শয়ে মরে থাকল পথেঘাটে।
বাংলার বড় জ্বালা। প্রকৃতির রুদ্ররোষ, যুদ্ধবাজদের কূটকৌশল আর মুনাফালোভীদের বেশুমার লালসায় বাংলার সাধারণ মানুষ বারবার নাকাল হয়েছে। না খেয়ে মানুষ কঙ্কাল। মরা মানুষের গোস্ত খেয়ে কুকুর-শৃগালের পোয়াবারো। বাংলা বহুবার জ্বলেছে। এখনো জ্বলছে। এখন এসেছে মাদকের লোভ আর লালসা। দিকে দিকে প্রকৃতির রুদ্ররোষ, গরমে ঘরে-বাইরে টেকা দায়। আর আছে ক্ষুধা। খাদ্যের ক্ষুধার একটা উপায় বাংলার শ্রমজীবী কৃষকরা করেছে; কিন্তু মনের ও দেহের অপরূপ যে নবীন ক্ষুধা মাদক, তাকে নিবৃত্ত করার উপায় খুঁজে পায়নি কেউ। পাশের দেশ ভারত আর মিয়ানমার থেকে থরে থরে বোতলে বোতলে মাদক আসছে অবাধে। তাই সংগ্রহের জন্য বড় বড় চক্র অবিরাম কাজ করছে। কালোবাজারি আর মাদকব্যবসায়ীদের কালো ব্যবসায় বাংলার শহর-গ্রামগঞ্জ এখন রমরম করছে। এই বিপুল আয়োজনে ঘরে ঘরে অনাচার আর খুনখারাবি বাড়ছে।
পার্বতীপুরের দম্পতি শামসুল ও নূরজাহান প্রায় ছুটে আসে দিনাজপুরের চুড়িপট্টিতে। তাদের দরকার হেরোইন। মনের সুখে হেরোইন নিয়ে দম্পতি ফের নিজের ডেরায় ফিরে যায়। এতে যে অর্থ লাগে, তা সংগ্রহ করতে দম্পতির অবস্থা জারেজার। যখন আর কিছুই নেই, তখন কোলের দুগ্ধপোষ্য শিশুর দিকে দৃষ্টি গেল। সেই শিশু নিয়ে ছুটে এলো মা-বাবা। এক হিজড়ার কাছে ১১০০ টাকায় বিক্রি করে দিয়ে মহাসুখে মাদকাসক্ত মা-বাবা ফিরে গেল। হিজড়া সেই শিশু নিয়ে কী করবে, কে জানে!
মাদকের নেশা বড় নেশা। যখন নেশা প্রগাঢ় হয়; যখন শরীর মন প্রবল হয়; তখন অর্থ সংগ্রহের জন্য ছেলে মায়ের বাঙ্ ভাঙে। ভাই ভাইয়ের সঞ্চয়ে থাবা দেয়। বাধা পেলে হত্যাকাণ্ডও ঘটে যায়। নেশা তো অনেক। নেশার জন্য সতীসাধ্বী পত্নী পরকীয়ায় মত্ত হয়ে স্বামীকে খুন করে। নাটকের নেশায় নট বা নটী বেপরোয়া হয়ে ওঠে। কত বিত্তবান যে নাট্যনেশায় কপর্দকশূন্য হয়েছে, তার হিসাব নেই। নেশাতেই অবৈধ আকর্ষণ। সেই আকর্ষণের তাড়নায় বাংলাতে শুধু কেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে নিত্যদিন খুনজখম চলছে। মাদকের নেশায় মানুষের প্রকৃতি বিনাশ হয়। তাকে রোধ করার কী উপায়, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
আর এই মাদকের নেশায় যখন ঘরে ঘরে উন্মাদ-উন্মত্ততা, তখন প্রকৃতি রুদ্ররোষে তার সব ক্রোধ মহানন্দে বিস্তার করে চলেছে। বাংলা এখন উষ্ণ হ্রদের মতো কেবলই জ্বলছে।
এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই। আকাশে সাদা মেঘের ছিন্নছিন্ন চলাফেরা। কিন্তু সে মেঘের মধ্যে বৃষ্টির কোনো লক্ষণ নেই। আমরা চাইছি প্রবল বারিপাতে তৃষ্ণার্ত উষ্ণ পৃথিবী নম্র হোক। অনাচার, কুপ্রবৃত্তি দূর হোক। কিন্তু নির্মম প্রকৃতি আমাদের আবেদন শোনে না। এই নির্মম মূক-বধির প্রকৃতিকে ঘরমুখো করার উপায় কী? মেঘ দে, পানি দে বলে পথে পথে গানের মিছিল করলে কি প্রকৃতি মুখ ফেরাবে? যদি তাই হয়, তবে এসো সবাই মিলে মেঘের আবাহনী গান ধরে কুলাডালা নিয়ে পথে পথে বৃষ্টিভিক্ষায় নেমে পড়ি।
তৃষ্ণার্ত, উষ্ণ বাংলায় প্রবলধারায় বৃষ্টি আসুক। বৃষ্টিতে-বাদলে, বাংলা স্নান করে শুচি হোক, হোক পবিত্র। যত গ্লানি, হাহাকার দূর হোক। সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ আর শুনতে চাই না। করুণারসে সিক্ত বাংলাতে প্রেম-স্নেহ ও জীবন আসুক প্লাবনধারায়। শুষ্ক-দীর্ণ জীবন প্লাবিত হোক মুষলধারা বর্ষার আয়োজনে। আর কত দিন অপেক্ষার তৃষ্ণা নিয়ে বসে থাকতে হবে, তা কেবল বিধাতাই জানে।
লেখক : নাট্যব্যক্তিত্ব, শিক্ষাবিদ
বাংলায় গ্রীষ্মে যে গরম! ওরে বাপরে, গরম মানে চামড়া ছিঁড়ে জ্বালিয়ে দেওয়া গরম। তাতে বিদ্যুতের বিচলিত অবস্থা। ঘণ্টায় ঘণ্টায় নীরব। এক ফোঁটা বাতাস নেই। গাছের পাতা নড়ে না। গরমের ভাপে বাতাসও ভয়ে জবুথবু। পাতারা চুপ করে ডালে বসে আছে। আগেও কি এমন চামড়াজ্বলা গরম ছিল? বাতাস গরম। আগুনের হলকা ছুটে ছুটে আসে। একেক সময় জ্বলেপুড়ে বিধাতা আর প্রকৃতিকে গালমন্দ করে বলি,- তো, আর কত জ্বালাবে গো প্রকৃতি? এত নিষ্ঠুর তুমি! আমরা ১৬ কোটি নর-নারী-শিশু-বৃদ্ধ তোমার অপকীর্তি উষ্ণতার অত্যাচারে হাহাকার করছি, তুমি কি একটুখানি উদার হতে পার না? বৃষ্টি দাও। বৃষ্টিতে ফাটা মাঠঘাট-গাছপাথরকে ভাসিয়ে দাও। তৃষ্ণার্ত পৃথিবীকে বেঁচে থাকার সান্ত্বনা দাও। শোনে না, নিষ্ঠুর কৃষক বিধাতার মতো কঠোর প্রকৃতি আপন ক্রোধের আনন্দে গরম ঢেলেই যাচ্ছে। মধুমাসের মিষ্টি ফল খাব কী, গরমের জ্বালায় আধমরা হয়ে এ ঘর-ও ঘর করছি। কোথাও একটু নরম-শীতল আশ্রয় নেই। বাংলার বহু জ্বালা। এ দেশের নেই-নেইর হাহাকার তো হাজার বছরের কাহিনী। বাংলার মানুষের জীবনযুদ্ধের মতো কঠোর সংগ্রাম আর কোন দেশের মানুষ করে, তা জানি না। সুদানে, লিবিয়াতে, আরবে কি এত কঠোর উষ্ণ হাহাকারের জীবন? মনে তো হয়, না। এমন নয়। বিধাতার সৃষ্টি অপরূপ বাংলার শত-সহস্র জ্বালা। এ নিয়েই বাংলা অবিনশ্বর। এমন সময় খবর পেলাম, দৈনিক কাগজে বের হয়েছে। খবর হলো, মা-বাবা দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে মানে ছয় মাসের শিশুকে মাত্র ১১০০ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে। মা-বাবার অর্থের বড় প্রয়োজন। জীবনযুদ্ধ যত না ক্ষতবিক্ষত, তার চেয়ে বেশি নেশার তাড়নায় অস্থির। মাদকাসক্ত মা-বাবার আর কোনো সম্বল ছিল না। ছিল ওই এক শিশু। তাকে বেচে যদি মাদক সংগ্রহ করা যায়, তবে মন্দ কী! তাতে তো দিনকয়েক বেশ মজা করে ধোঁয়া টানা যাবে অথবা সুই ফুটিয়ে মাদকের তাগাদাকে শান্ত রাখা যাবে।
মা-বাবা পার্বতীপুর থেকে এসে দিনাজপুরের এক গাঁয়ের এক হিজড়ার কাছে সন্তানকে বেচে অর্থ নিয়ে গেছে। না, এ সময় মন্বন্তরের নয়। খাদ্যে আকাল পড়েনি। ওয়ারেন হেস্টিংয়ের কালে জোর করে খাজনা আদায়ের কারণে ছিয়াত্তর সালে মন্বন্তর দেখা দিয়েছিল, তাতেই গৃহস্থরা বেচে ফেলার জন্য হালের বলদ, ঘরের বউ, কোলের শিশু অথবা নিজে নিজেকে বিক্রি করে বাঁচতে চেয়েছে। বাঁচতে অবশ্যি পারেনি। সবাই বেচতে চায়, বিক্রি হতে চায়। কিন্তু কেনার মানুষ কোথায়? দলে দলে, শয়ে শয়ে মানুষ মরে পড়ে থেকেছে বাংলার পথেঘাটে। আর একবার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জাপানিদের ভয়ে সাম্রাজ্য বাঁচানোর জন্য বাহনের নৌকা যত ছিল, সব ডুবিয়ে দিয়েছিল প্রশাসন। খরা এলো সে বছর। খাদ্যাভাবে শয়ে শয়ে মানুষ আর জন্তুজানোয়ার মরে পড়ে থাকল পথেঘাটে। আরো একবার, ১৯৭৪ সালে মাকির্নিদের ষড়যন্ত্রে খাদ্য জাহাজকে বাংলায় না ভিড়িয়ে সিঙ্গাপুরে পাঠিয়ে দিল। খাদ্যাভাবে বাংলার মানুষ শয়ে শয়ে মরে থাকল পথেঘাটে।
বাংলার বড় জ্বালা। প্রকৃতির রুদ্ররোষ, যুদ্ধবাজদের কূটকৌশল আর মুনাফালোভীদের বেশুমার লালসায় বাংলার সাধারণ মানুষ বারবার নাকাল হয়েছে। না খেয়ে মানুষ কঙ্কাল। মরা মানুষের গোস্ত খেয়ে কুকুর-শৃগালের পোয়াবারো। বাংলা বহুবার জ্বলেছে। এখনো জ্বলছে। এখন এসেছে মাদকের লোভ আর লালসা। দিকে দিকে প্রকৃতির রুদ্ররোষ, গরমে ঘরে-বাইরে টেকা দায়। আর আছে ক্ষুধা। খাদ্যের ক্ষুধার একটা উপায় বাংলার শ্রমজীবী কৃষকরা করেছে; কিন্তু মনের ও দেহের অপরূপ যে নবীন ক্ষুধা মাদক, তাকে নিবৃত্ত করার উপায় খুঁজে পায়নি কেউ। পাশের দেশ ভারত আর মিয়ানমার থেকে থরে থরে বোতলে বোতলে মাদক আসছে অবাধে। তাই সংগ্রহের জন্য বড় বড় চক্র অবিরাম কাজ করছে। কালোবাজারি আর মাদকব্যবসায়ীদের কালো ব্যবসায় বাংলার শহর-গ্রামগঞ্জ এখন রমরম করছে। এই বিপুল আয়োজনে ঘরে ঘরে অনাচার আর খুনখারাবি বাড়ছে।
পার্বতীপুরের দম্পতি শামসুল ও নূরজাহান প্রায় ছুটে আসে দিনাজপুরের চুড়িপট্টিতে। তাদের দরকার হেরোইন। মনের সুখে হেরোইন নিয়ে দম্পতি ফের নিজের ডেরায় ফিরে যায়। এতে যে অর্থ লাগে, তা সংগ্রহ করতে দম্পতির অবস্থা জারেজার। যখন আর কিছুই নেই, তখন কোলের দুগ্ধপোষ্য শিশুর দিকে দৃষ্টি গেল। সেই শিশু নিয়ে ছুটে এলো মা-বাবা। এক হিজড়ার কাছে ১১০০ টাকায় বিক্রি করে দিয়ে মহাসুখে মাদকাসক্ত মা-বাবা ফিরে গেল। হিজড়া সেই শিশু নিয়ে কী করবে, কে জানে!
মাদকের নেশা বড় নেশা। যখন নেশা প্রগাঢ় হয়; যখন শরীর মন প্রবল হয়; তখন অর্থ সংগ্রহের জন্য ছেলে মায়ের বাঙ্ ভাঙে। ভাই ভাইয়ের সঞ্চয়ে থাবা দেয়। বাধা পেলে হত্যাকাণ্ডও ঘটে যায়। নেশা তো অনেক। নেশার জন্য সতীসাধ্বী পত্নী পরকীয়ায় মত্ত হয়ে স্বামীকে খুন করে। নাটকের নেশায় নট বা নটী বেপরোয়া হয়ে ওঠে। কত বিত্তবান যে নাট্যনেশায় কপর্দকশূন্য হয়েছে, তার হিসাব নেই। নেশাতেই অবৈধ আকর্ষণ। সেই আকর্ষণের তাড়নায় বাংলাতে শুধু কেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে নিত্যদিন খুনজখম চলছে। মাদকের নেশায় মানুষের প্রকৃতি বিনাশ হয়। তাকে রোধ করার কী উপায়, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
আর এই মাদকের নেশায় যখন ঘরে ঘরে উন্মাদ-উন্মত্ততা, তখন প্রকৃতি রুদ্ররোষে তার সব ক্রোধ মহানন্দে বিস্তার করে চলেছে। বাংলা এখন উষ্ণ হ্রদের মতো কেবলই জ্বলছে।
এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই। আকাশে সাদা মেঘের ছিন্নছিন্ন চলাফেরা। কিন্তু সে মেঘের মধ্যে বৃষ্টির কোনো লক্ষণ নেই। আমরা চাইছি প্রবল বারিপাতে তৃষ্ণার্ত উষ্ণ পৃথিবী নম্র হোক। অনাচার, কুপ্রবৃত্তি দূর হোক। কিন্তু নির্মম প্রকৃতি আমাদের আবেদন শোনে না। এই নির্মম মূক-বধির প্রকৃতিকে ঘরমুখো করার উপায় কী? মেঘ দে, পানি দে বলে পথে পথে গানের মিছিল করলে কি প্রকৃতি মুখ ফেরাবে? যদি তাই হয়, তবে এসো সবাই মিলে মেঘের আবাহনী গান ধরে কুলাডালা নিয়ে পথে পথে বৃষ্টিভিক্ষায় নেমে পড়ি।
তৃষ্ণার্ত, উষ্ণ বাংলায় প্রবলধারায় বৃষ্টি আসুক। বৃষ্টিতে-বাদলে, বাংলা স্নান করে শুচি হোক, হোক পবিত্র। যত গ্লানি, হাহাকার দূর হোক। সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ আর শুনতে চাই না। করুণারসে সিক্ত বাংলাতে প্রেম-স্নেহ ও জীবন আসুক প্লাবনধারায়। শুষ্ক-দীর্ণ জীবন প্লাবিত হোক মুষলধারা বর্ষার আয়োজনে। আর কত দিন অপেক্ষার তৃষ্ণা নিয়ে বসে থাকতে হবে, তা কেবল বিধাতাই জানে।
লেখক : নাট্যব্যক্তিত্ব, শিক্ষাবিদ
No comments