দুর্নীতি নির্মূলে সরকারের অঙ্গীকারঃ ভূতের মুখে রামনাম
ঢাকঢোল পিটিয়ে দেশজুড়ে আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য নিরসন দিবস পালন করা হলো। রাজধানীর কেন্দ্রীয় আয়োজনের দিকেই মানুষের নজর ছিল বেশি। ‘জাতীয় ঐক্য রুখবে দারিদ্র্য’ শীর্ষক প্রচারণায় মানুষকে দারিদ্র্যমুক্তির খোয়াব দেখানোর কসরত যে এমনভাবে মুখ থুবড়ে পড়বে সেটা নিশ্চয়ই আয়োজকরা ভেবে দেখেননি। দুই নেত্রীকে এক টেবিলে এনে জাতীয় ঐক্যের চমক সৃষ্টির উদ্যোগ এবারই প্রথম নয়।
আগেও বিভিন্ন সময়ে নেত্রীদ্বয় ঠিকই একত্রিত হয়েছেন, হেসে কথাও বলেছেন। কিন্তু ফটোসেশন ছাড়া তার ফল কিছুই হয়নি। এরপরও যারা শুধু নেত্রীদের দিয়েই জাতীয় ঐক্যের কথায় মুখে ফেনা তোলেন তারা কি জাতিকে মিথ্যে আশ্বাস দিতে চান? বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে ফায়দা লুটতে চান?
এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, চলমান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াই জাতীয় রাজনীতির শীর্ষে অবস্থান করছেন। কোনো বিষয়ে তাদের মধ্যকার ঐকমত্য সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বিষয় বাদ দিয়ে শুধু ব্যক্তিকে গুরুত্ব দেয়াটা মোটেই বাস্তববুদ্ধির পরিচায়ক নয়। এ দেশে অবশ্য এমনটাই ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতার পরপরই ‘এক নেতা এক দেশ-বঙ্গবন্ব্দুর বাংলাদেশ’ জাতীয় স্লোগানে কান ঝালাপালা করে তোলার কথা নিশ্চয়ই সবাই ভুলে যাননি।
দারিদ্র্য বিমোচনকে যেভাবে মুখের বুলিতে পরিণত করা হয়েছে বিষয়টা যে মোটেই তেমন হালকা নয় সেটা সচেতন ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করবেন। বিগত দীর্ঘ সময়কালে ক্ষমতাসীন প্রতিটি সরকারই দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে অনেক হইচই করেছে। বিদেশি ঋণদাতাদের বুদ্ধিতে হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প নেয়া হয়েছে। দামি গাড়ি এসেছে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস হয়েছে, কিছু লোকের মোটা বেতনে চাকরিও হয়েছে। কিন্তু দেশে গণদারিদ্র্য রয়েই গেছে। বেড়ে গেছে বিদেশি ঋণের পরিমাণ। সরকারের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা এনজিওগুলোর দারিদ্র্য বিমোচনের নামে বিভিন্নমুখী কর্মকাণ্ড দরিদ্রদের কতটা উপকারে এসেছে সেটাও এক মহাবিতর্কের বিষয়। দারিদ্র্য মোচনের ম্যাজিক হিসেবে ক্ষুদ্রঋণের জনকের শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি জাতির মুখ উজ্জ্বল করলেও কত পরিবারের শেষ শান্তিটুকু কেড়ে নিয়েছে তার হিসাব কেউ রাখে না। আসলে দারিদ্র্য দূর করার বিষয়টি এতটাই জটিল যে, এ নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়েও মতবিরোধের শেষ নেই। বঙ্গবন্ব্দু সরকার থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রতিটি সরকারই দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়েই দারিদ্র্য মোচনে কর্মসূচি নিয়েছে সত্য; কিন্তু এর কোনো একটি সরকার এ ক্ষেত্রে যে সফলতা দূরে থাক তাত্পর্যময় অগ্রগতি অর্জন করেছে, তেমন কথা বলা সত্যের অপলাপ মাত্র। গণবেকারত্বের সমাধানে বিভিন্ন দলের সরকারের মধ্যে এ সম্পর্কিত নীতি পরিকল্পনা পদক্ষেপে পার্থক্য দৃশ্যমান। ফলে পূর্বতন প্রকল্প বাতিল বা বন্ব্দ করে দেয়াই স্বাভাবিক রীতি হয়ে উঠেছে। অতএব দারিদ্র্য বিমোচনের পথ, পদ্ধতি ও পরিকল্পনা নিয়ে খোলামেলা বিতর্ক, অভিজ্ঞতা বিনিময়, অগ্রাধিকার ঠিক করার মতো বিষয়গুলোয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রস্তুত করাই সবচেয়ে জরুরি। এর বদলে ব্যক্তি নিয়ে আনুষ্ঠানিক টানাটানির প্রকৃত উদ্দেশ্য সন্দেহের উদ্রেক করতেই পারে। আর যেখানে বর্তমান সরকারের দশ মাসের শাসন সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যকার দূরত্ব না কমিয়ে বাড়িয়েছে, জাতীয় সংসদ কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছে; সেখানে হঠাত্ করে একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী নেত্রীকে এক টেবিলে বসিয়ে দারিদ্র্য মোচনে ঐকমত্য সৃষ্টির কথা বলা শুধু বোকামি নয়, উদ্দেশ্যমূলক। জাতিকে প্রতারণার শামিল।
তবে বিরোধী নেত্রী বয়কট করলেও প্রধানমন্ত্রী সেখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কথাই বলেছেন। দুর্নীতি রুখতে না পারলে দারিদ্র্য দূর করা যাবে না। দুর্নীতি নির্মূলে সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, যে দলেরই হোক দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। দুর্নীতি করে কেউ রেহাই পাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে দেশের মানুষ এরই মধ্যে সচিবালয় থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত বিভিন্ন অফিস, আদালত ও প্রতিষ্ঠানে সরকারদলীয় লোকজনের যে ধরনের দুর্নীতি ও নানামুখী উত্পাতের শিকার হয়েছে এবং সরকার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও দলের যে ভূমিকা দেখছে তাতে প্রধানমন্ত্রীর কথায় নিজের কানকে বিশ্বাস করাও কঠিন মনে হয়েছে। প্রকৃত অর্থে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ালে তার নিজ দলই সর্বপ্রথম বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং সরকারের খোলনলচে পাল্টাতে হবে। প্রধানমন্ত্রী কি এ জন্য প্রস্তুত আছেন। নইলে ভূতের মুখে রামনাম শুনতে অভ্যস্ত এদেশের মানুষকে নতুন করে কথার খেলা দেখানোর দরকার কী!
No comments