রাজউকের প্লট by ফখরুজ্জামান চৌধুরী
প্রতিশ্রুতি দান এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের উজ্জ্বল নিদর্শন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ—রাজউকের উত্তরা-পূর্বাচল প্রকল্প।
শিব গড়তে বাঁদর গড়ার কাজে সিদ্ধহস্ত দু’বছরের ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ জরুরি সরকারের আমলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে প্লটের জন্য আগ্রহীদের কাছে দরখাস্ত আহ্বান করে ঘোষণা দিয়েছিল রেকর্ড সময়ে ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই প্লট বরাদ্দদানের যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।
শিব গড়তে বাঁদর গড়ার কাজে সিদ্ধহস্ত দু’বছরের ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ জরুরি সরকারের আমলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে প্লটের জন্য আগ্রহীদের কাছে দরখাস্ত আহ্বান করে ঘোষণা দিয়েছিল রেকর্ড সময়ে ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই প্লট বরাদ্দদানের যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।
এক-দেড় মাসের মধ্যে এত বড় একটা কাজ সম্পন্ন করবে রাজউকের মতো ঘুণে ধরা ক্ষয়িষ্ণু একটি প্রতিষ্ঠান, একথা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিল। তখনই আমরা সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছিলাম, এত বড় একটি কাজ এত দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করার মতো যোগ্যতা রাজউকের আছে কি না, এ বিষয়ে আমাদের ঘোরতর সন্দেহ আছে এবং এই দ্রুততা সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। তথ্যাভিজ্ঞ মহল বুঝতে পেরেছিল, প্লট প্রদানের এ প্রক্রিয়াকে রিমোট কন্ট্রোলে পরিচালিত করছে মহলবিশেষ। বেচারা রাজউক শুধু কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন করে যাচ্ছে। অন্যের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করতে গেলে পদে পদে ভুল হয়। ভুল রাজউকেরও হয়। দরখাস্তের ফরম জোগাড় করতে বলা হয় ব্যাংক থেকে। ব্যাংকে স্লমড়ি খেয়ে পড়লেন আগ্রহী ফরম ক্রেতারা। ভিড় সামাল দিতে ব্যাংকের নির্বাহীদের প্রাণান্তকর অবস্থা। ব্যাংকের দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম লাটে উঠল। ইন্টারনেট থেকে ফরম ডাউনলোড করার ব্যবস্থা করা হলো। এরই মধ্যে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এবং জনসাধারণের ভোগান্তি যা হওয়ার হয়েছে। ব্যাংক থেকে ফরম কিনলে এক হাজার টাকা দিয়ে রসিদ নিতে হবে, ইন্টারনেট থেকে নিলেও এক হাজার টাকা ফরম জমা দেয়ার সময় কর্তৃপক্ষকে অতিরিক্ত দিতে হবে! এই হলো সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের নমুনা! বঙ্কিমী ভাষায় প্রশ্ন করি : ইহাকে যদি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান বলি, সওদাগরি প্রতিষ্ঠান কাহাকে বলিব? দেড়শ টাকার কোর্ট ফি দিয়ে হলফনামা সংযুক্ত করার বিধান রাখার ফলে মুহূর্তের মধ্যে কোর্ট ফির সল্ট্যাম্প হয়ে পড়ে দুর্লভ। পারদের মতো বাড়তে থাকে মূল্যের মাত্রা। সল্ট্যাম্প ভেন্ডারদের পোয়াবারো। একশ্রেণীর মানুষ বিনা পুঁজিতে বেশ কামিয়ে নিলেন। মানুষ এতসব কষ্ট করেও দরখাস্ত জমা দিলেন। বর্তমান পূর্ত প্রতিমন্ত্রী যেমনটা কাব্যিক ভাষায় বলেছেন, রাজধানীতে একখণ্ড জমির প্রত্যাশা সবার, ব্যাপারটা তাই। আর এত দ্রুত সময়ে আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই করে প্লট বরাদ্দ করা হবে শুনে যারা আবেদন করার চিন্তাও করেননি তারাও করলেন। ধারদেনা করে টাকা জোগাড় করলেন, কেউ কেউ সুদের বিনিময়েও ধার নিলেন।
যারা সুলুক জানেন, তারা বুঝতে পারলেন, এত তাড়াতাড়ি এত বিশাল কাজ সমাধা করা সম্ভব নয়। আর যদি করা হয় বুঝতে হবে বিশেষ উদ্দেশ্যেই তা করা হবে। একশ্রেণীর মানুষের জন্য তখন যে এ আয়োজন ছিল, এমন সন্দেহের কথা লোকজনের মধ্যে চাউর হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ‘ডিজিটাল’ দ্রুততায় কাজটি সম্পন্ন করতে পারেনি রাজউক তত্কালীন ‘এনালগ’ বাংলাদেশে! জরুরি সরকারের হায়াতে দমে কুলোয়নি বলে।
নির্বাচিত নতুন সরকার এসে বোধগম্য কারণেই দরখাস্ত জমা দেয়ার তারিখ বাড়িয়ে দিলেন ২০০৯ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত। প্লট বরাদ্দের সময়সূচিও ঘোষণা করা হলো। অনেক রেটরিক সহকারে জানান হলো ২০০৯ সালের জুন মাসের মধ্যে প্লট বরাদ্দের যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষ করা হবে। এরই মধ্যে ৬ মাসেরও বেশি সময় কেটে গেছে দরখাস্ত জমা দেয়ার প্রথম তারিখ থেকে। যারা স্বল্প মেয়াদের জন্য ধারদেনা করে টাকা এনে দরখাস্ত করেছিলেন তাদের তখন ত্রিশঙ্কু অবস্থা। সুদের টাকা গুনে গুনে তারা হয়রান। আর দু’মাসের প্রকল্পকে টেনে টেনে দীর্ঘায়িত করায় রাজউক ফাঁকতালে দরখাস্তকারীদের জমা দেয়া টাকা (১ লাখ ৬৫ হাজার আবেদনকারীর কাছ থেকে গড়ে এক লাখ টাকা হিসাবে) থেকে সুদ বাবদ অর্জন করেছে ১৬৫ কোটি টাকার মতো। এক বছর মেয়াদে প্রাপ্ত ১,৬৫০ কোটি টাকা যদি শতকরা ১০ টাকা হারেও সুদের বিনিময়ে মেয়াদি আমানত হিসেবে কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকে রাখা হয় তাহলে এ পরিমাণ টাকা পাওয়া যেতে পারে। এটা কোনো কথার কথা নয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত জাতীয় সংসদের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় এই মর্মে আলোচনা হয়েছে এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটি রাজউককে প্লট বরাদ্দের ব্যাপারে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে অনুরোধ করেছে, আবেদনকারী যারা প্লট বরাদ্দ পাননি তাদের টাকা যখন ফেরত দেবে তখন যেন সুদাসলে দেয়া হয় সে কথাও বলেছে। সল্ট্যান্ডিং কমিটির এই সুপারিশ রাজউকের জন্য অবশ্য পালনীয় কিনা, তা জানি না। এরই মধ্যে টাকা ফেরত দেয়ার সময়সূচি ঘোষণা করেছে রাজউক। বলতে বাধ্য হচ্ছি, রাজউক যে কর্মসূচি নিয়েছে তা সময়ক্ষেপণের কৌশলমাত্র।কেন এই দীর্ঘ সময়, এক মাসের মতো লাগবে টাকা ফেরত দিতে তা বুঝতে কষ্ট হয়।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ব্দিক
যারা সুলুক জানেন, তারা বুঝতে পারলেন, এত তাড়াতাড়ি এত বিশাল কাজ সমাধা করা সম্ভব নয়। আর যদি করা হয় বুঝতে হবে বিশেষ উদ্দেশ্যেই তা করা হবে। একশ্রেণীর মানুষের জন্য তখন যে এ আয়োজন ছিল, এমন সন্দেহের কথা লোকজনের মধ্যে চাউর হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ‘ডিজিটাল’ দ্রুততায় কাজটি সম্পন্ন করতে পারেনি রাজউক তত্কালীন ‘এনালগ’ বাংলাদেশে! জরুরি সরকারের হায়াতে দমে কুলোয়নি বলে।
নির্বাচিত নতুন সরকার এসে বোধগম্য কারণেই দরখাস্ত জমা দেয়ার তারিখ বাড়িয়ে দিলেন ২০০৯ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত। প্লট বরাদ্দের সময়সূচিও ঘোষণা করা হলো। অনেক রেটরিক সহকারে জানান হলো ২০০৯ সালের জুন মাসের মধ্যে প্লট বরাদ্দের যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষ করা হবে। এরই মধ্যে ৬ মাসেরও বেশি সময় কেটে গেছে দরখাস্ত জমা দেয়ার প্রথম তারিখ থেকে। যারা স্বল্প মেয়াদের জন্য ধারদেনা করে টাকা এনে দরখাস্ত করেছিলেন তাদের তখন ত্রিশঙ্কু অবস্থা। সুদের টাকা গুনে গুনে তারা হয়রান। আর দু’মাসের প্রকল্পকে টেনে টেনে দীর্ঘায়িত করায় রাজউক ফাঁকতালে দরখাস্তকারীদের জমা দেয়া টাকা (১ লাখ ৬৫ হাজার আবেদনকারীর কাছ থেকে গড়ে এক লাখ টাকা হিসাবে) থেকে সুদ বাবদ অর্জন করেছে ১৬৫ কোটি টাকার মতো। এক বছর মেয়াদে প্রাপ্ত ১,৬৫০ কোটি টাকা যদি শতকরা ১০ টাকা হারেও সুদের বিনিময়ে মেয়াদি আমানত হিসেবে কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকে রাখা হয় তাহলে এ পরিমাণ টাকা পাওয়া যেতে পারে। এটা কোনো কথার কথা নয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত জাতীয় সংসদের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় এই মর্মে আলোচনা হয়েছে এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটি রাজউককে প্লট বরাদ্দের ব্যাপারে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে অনুরোধ করেছে, আবেদনকারী যারা প্লট বরাদ্দ পাননি তাদের টাকা যখন ফেরত দেবে তখন যেন সুদাসলে দেয়া হয় সে কথাও বলেছে। সল্ট্যান্ডিং কমিটির এই সুপারিশ রাজউকের জন্য অবশ্য পালনীয় কিনা, তা জানি না। এরই মধ্যে টাকা ফেরত দেয়ার সময়সূচি ঘোষণা করেছে রাজউক। বলতে বাধ্য হচ্ছি, রাজউক যে কর্মসূচি নিয়েছে তা সময়ক্ষেপণের কৌশলমাত্র।কেন এই দীর্ঘ সময়, এক মাসের মতো লাগবে টাকা ফেরত দিতে তা বুঝতে কষ্ট হয়।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ব্দিক
No comments