হঠাৎ করে সম্মান আদায়ের এত দরকার পড়ছে কেন? by আতাউস সামাদ
মরমী শিল্পী শাহ আবদুল করিম গত হয়েছেন মাত্র পাঁচ সপ্তাহ আগে। তিনি গান লিখতেন, গান গাইতেন, গানের মাধ্যমে জীবন সম্পর্কে তাঁর দর্শন ছড়িয়ে দিতেন। বাউলের বাউল ফকির লালন শাহের ভক্ত ছিলেন শাহ আবদুল করিম। তাঁর নিজের ভক্তের সংখ্যাও কম নয়। এদিকে লালন শাহ’র মৃত্যুবার্ষিকী সমাগত। এরকম সময়ে লোকউত্সব করলে, তাও সিলেটে, লালন শাহ’র সঙ্গে হাসন রাজা ও শাহ আবদুল করিমকে মনে করতেই হয়।
তাদের আলাদা করে সম্মান জানাতেই হয়। সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি সংগঠন, শিকড় এ দায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে এসেছে। তাদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়ে তারা শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছিল দেশের আরও দু’জন বিখ্যাত ব্যক্তি, যথাক্রমে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে। বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় ভাইস চ্যান্সেলর মোঃ সালেহ উদ্দিন। সিলেটের সুসন্তান জনাব মুহিত মেধাবী ছাত্র হিসেবে সারা বাংলাদেশে পরিচিত ছিলেন তরুণ বয়স থেকেই। ১৯৭১ সালে বিদেশে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং দেশ মুক্ত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনে গুরুদায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দেয়ার আগেই। এখন তিনি মহাজোট সরকারের হয়ে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী। আর দেশ ও বিশ্বের অর্থনীতির কঠিন সময়ে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাল ধরে আছেন। প্রার্থনা করি, সরকারের পুরো মেয়াদে হাল ধরে রাখার কর্তব্য পালন করার সময় তার হাতে যেন খুব বেশি ফোসকা পড়ে না যায়। তবে কিছু ফোসকা হবেই এবং সেটা বিশ্ব আর্থিক দুর্যোগের কারণে না হলেও তাঁর দলের লোকজনের আচরণের ফলে। সে কথাতেই আসছি, তবে অল্প একটু পরে। আলোচ্য অনুষ্ঠানের দুই বিশেষ অতিথির মধ্যে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে বিখ্যাত লেখকদের প্রথম তিন/চারজনের একজন। কিশোরদের মধ্যে জনপ্রিয়তায় আপাতত শীর্ষে আছেন তিনি। বাংলায় বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প-উপন্যাসকে বলতে গেলে নবজীবন দিয়েছেন তিনি। তাঁর আপন বড় ভাই হলেন বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক স্লমায়ূন আহমেদ। তাঁর লেখা মানুষ এত ভালোবাসে আর লিখতে এত ভালোবাসেন তিনি যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে সাহিত্যচর্চা আর ছবি বানানোতে পুরো সময় নিয়োজিত হয়েছেন। তাঁদের পিতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল শুনেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালটেক থেকে ডক্টরেট পেয়েছেন। ক্যালটেক প্রায়ই টঝঅ ঞড়ফধু পত্রিকার হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেরা উচ্চ শিক্ষালয় নির্বাচিত হয়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান তিনি। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার উপরে যিনি, অর্থাত্ ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয়, তাঁর সদয় উপস্থিতির উল্লেখ আগেই করেছি।
শিকড় নামক সংগঠনের আয়োজন করা লালন-হাসন লোকজ উত্সবের স্থান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এটির উদ্বোধন হয় গত বৃহস্পতিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০০৯। উত্সবটি উত্সর্গ করা হয়েছে প্রয়াত শাহ আবদুল করিমের নামে। এই উত্সবের আয়োজকরা সম্ভবত ধারণা করেছিল যে, মহান তিন ব্যক্তিত্বের নামে যখন তাদের অনুষ্ঠান এবং উদ্বোধনকালে যখন তিন মহত্ ব্যক্তিত্ব উপস্থিত তখন সেখানে কোনো ঝুট-ঝামেলা হবে না। তারা সম্ভবত এও ভেবেছিল যে, আজকাল যে কোনো অনুষ্ঠানে, এমনকি কোনো কোনো সময় পল্লীর ক্ষুদ্র কৃষকের বাড়িতে বিয়ের দাওয়াতে পর্যন্ত, পলিটিক্যাল প্রটোকল তথা রাজনৈতিক শিষ্টাচার নামক অলিখিত কানুনটি প্রায়ই উটকো ঝামেলা বাধায়, সেটি এক্ষেত্রে সামলানো গেছে। নাম ও পদের কর্মটি বেশ শক্তপোক্তই ছিল। একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ও এলাকার কৃতী সন্তান, একজন বিখ্যাত লেখক ও শিক্ষাবিদ যাঁর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়ানো হাস্যোজ্জ্বল আলোকচিত্র অতি সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় দেখা গেছে এবং শ্রদ্ধেয় ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয়কে সম্মান ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করার পর কাউকে অশ্রদ্ধা করার অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে উঠবে না। কিন্তু বিধি বাম। কারও হিসাব অনুযায়ী তারা ভুল করেছিল। সেই হিসাব অনুযায়ী তারা সরকার দলের স্থানীয় সংসদ সদস্য জনাব মোঃ শফিকুর রহমান ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহউদ্দিন সিরাজকে ‘যথাযথ সম্মান প্রদর্শন’ করেনি। এই দুই নেতা লোকজ উত্সবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন, তাঁদের আগমন বার্তা আওয়াজবর্ধক যন্ত্রের মাধ্যমে ঘোষণা করা হয়েছিল, তাঁরা অতিথিদের জন্য সংরক্ষিত সামনের সারির আসনে উপবেশন করেছিলেন, তবে মিনিট দশেক পরে ‘কাজ আছে’ বলে সভাস্থল ত্যাগ করেন (সূত্র : প্রথম আলো পত্রিকা)। এতে অনুষ্ঠান অঙ্গনে কিছু চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। অতঃপর অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত, ভাইস চ্যান্সেলর জনাব সালেহউদ্দিন ও অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সভাস্থল ত্যাগ করার পরই একদল উত্তেজিত যুবক তাদের নেতা ও মাননীয় সংসদ সদস্যকে যথাযোগ্য সম্মান দেখানো হয়নি এই অভিযোগে চেয়ার ভাঙা শুরু করে। এতে অহিংস ফকির লালন শাহ্, হাসন রাজা ও শাহ আবদুল করিমের বিদেহী আত্মা হয়তো যন্ত্রণায় ও লজ্জায় কষ্ট পেয়েছে, তবে সম্মানিত প্রধান অতিথি ও মাননীয় বিশেষ অতিথিদ্বয় সম্ভবত কপালের ঘাম মুছতে মুছতে স্বস্তিবোধ করেছেন একথা ভেবে যে, তাঁদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও ব্যক্তিগতভাবে অপমানিত হতে হয়নি। তবে আমাদের মনে হয়, সম্মান আদায়ের যে নতুন কৃষ্টি আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্যরা ও দলের নব্য নেতারা প্রচলন করেছেন, তাতে দেশের মানুষ নিজেদের ইজ্জত রক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্নই হবে; স্বস্তি পাবে না আদৌ। আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের জাত-মান থাকল কী গেল সেটা বোধহয় শাসকদের মাথা ঘামানোর বিষয় নয়, এটা তাঁদের জন্য চিন্তা-ভাবনার কোনো ব্যাপারই হতে পারে না। রাজাদের রাজকর্মে অবশ্য পালনীয় কিছু বিষয় আছে, আবার দৃকপাতের অযোগ্য ব্যাপার-স্যাপারও আছে। আমাদের মান-সম্মান বা আমাদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান তাঁদের মূল্যবান নেক নজরের বাইরে। তবে আমি ভাবছি দুটি বিষয় নিয়ে। একটা হলো মন্ত্রী মহোদয়কে যথেষ্ট শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা এবং মাননীয় সংসদ সদস্য ও দলের উঠতি নেতাকে সামনের সারিতে বসানোর পরও শেষের দু’জন ‘সম্মান পাননি’ বলে যে ভাবা হলো এটা কি আওয়ামী লীগের ভেতর মূল্যায়নের প্রশ্ন? অর্থাত্ তাঁরা দু’জন কি ভাবছিলেন যে, তাঁরা দলের মধ্যে যথেষ্ট প্রতিপত্তিশালী, আর বাইরের লোকদের সেটা বোঝাতে প্রয়োজন ছিল তাঁদের মঞ্চে প্রধান অতিথির পাশে নিয়ে বসানো? তা যদি হয়ে থাকে তাহলে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর জন্য ‘খবর আছে’। তিনি এখন থেকে ভাবতে পারেন দলের ভেতর যারা প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠছেন তাদের কেউ না কেউ আরও বেশি ‘সম্মানিত’ হওয়ার আকাগ্ধক্ষায় তাঁর মন্ত্রিত্বের চেয়ারটির জন্য হাত বাড়াতে পারেন। তখন তাদের গায়েও হাত লেগে যেতে পারে। পত্রিকান্তরে পড়েছি যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাকি দলে তরুণদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন (গুজব শোনা যায় তাঁর উত্তরাধিকারী নিয়েও নাকি তাঁকে ভাবতে হচ্ছে)। সেক্ষেত্রে বৃদ্ধ বা প্রৌঢ় মন্ত্রীরা যদি নিজে থেকে সরে না দাঁড়ান তাহলে বার্তাটি বুঝিয়ে দেয়ার জন্য তাঁদের এক-আধটু দৈহিক ধাক্কাধাক্কিও করা যেতে পারে। এই ‘কালচারটি’ আমাদের দেশে একেবারে অদৃশ্যপূর্ব ঘটনা বোধকরি নয়।
দ্বিতীয় চিন্তাটি হলো, আমাদের দেশে কি ঘোষণা দিয়ে হোক অথবা অঘোষিতভাবে হোক শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন হতে যাচ্ছে? মাস খানেক আগে শুনেছিলাম, আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, দলীয় সংসদ সদস্যরা যার যার নির্বাচনী এলাকার প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করবেন। থানা-পুলিশ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, পূর্ত ও সড়ক বিভাগের অফিস, সরকারি হেলথ কমপ্লেক্স, স্কুল-কলেজ, খাল-বিল, সড়কের টোল আদায়—এর সবই নাকি চলবে তাঁদের কথামত বা তাঁদের ইশারায়, অথবা তাঁদের ঠিক করে দেয়া লোক মারফত (যেমন—এক মাননীয় সংসদ সদস্য বলেই ফেলেছেন যে, তিনি শ্বশুরবাড়ির এলাকা থেকে নির্বাচিত হয়েছেন কিন্তু সেখানকার লোকজনদের ভালোমত চেনেন না বলে তাঁর শ্যালককে এলাকা দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিয়েছেন)। বলা চলে, এর ফলে এক ধরনের অঘোষিত জমিদারি বা সামন্তপ্রথা চালু হয়েছে। আর জমিদার সাহেবকে ভয় না পেলে এবং তাঁর প্রজারা সেই ভীতির নমুনা হিসেবে উঠতে-বসতে শয়নে-স্বপনে তাঁকে আনত মস্তকে সম্মান প্রদর্শন না করলে তিনি খাজনা আদায় করতে সমর্থ হবেন কীভাবে? অবশ্য এই সামন্তপ্রথায় নাকি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা ছাড়াও জায়গায় জায়গায় স্থানীয়ভাবে প্রতিপত্তিশালী বা কেন্দ্রীয়ভাবে দলে পদাধিকারী এমন ব্যক্তিরাও লাভবান হতে আগ্রহী। আর এই যে আমরা প্রায়ই খবর পড়ি ও ছবি দেখি শাসক দলের গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠী রামদা, লাঠি, পটকা হাতে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া করছে তার কারণ নাকি কে হবেন জমিদার তা-ই নিয়ে ঝগড়া।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শনিবার ‘জাতীয় ঐক্য রুখবে দারিদ্র্য’ সমাবেশে বলেছেন যে, দুর্নীতি রুখতে না পারলে দারিদ্র্য দূর হবে না। খাঁটি কথা। তবে আমাদের মনে হয় যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর অশেষ বিজ্ঞতায় দুর্নীতি বলতে সরকারি আওতার কাজকর্মে দুর্নীতির কথা বলেছেন। তাই চাঁদাবাজি ও অবৈধ টোল আদায়ও তাঁর ব্যক্ত ‘দুর্নীতি’ শব্দের সংজ্ঞার মধ্যে পড়বে কিনা দেশবাসীর তা স্পষ্ট করে জানা দরকার। তা জানলেও এর প্রতিকার হবে কিনা সে সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। কারণ, প্রথমত, তাহলে নব্য সামন্তরা অর্থবিত্ত হস্তগত করবে কীভাবে। দ্বিতীয়ত, তাদের নিজস্ব এবং দলের প্রভাব বিস্তারের জন্য যে পাইক-বরকন্দাজ-লাঠিয়াল দরকার তাদের খরচ মেটাবে কোথা থেকে। তাই, ব্যত্যয় না হলে আমার ভয় থেকে যাচ্ছে যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি দমনের যে শুভেচ্ছা প্রকাশ করেছেন তার ইতি বঙ্গবন্ব্দু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, ঘরের ভেতর টেলিভিশন সেটের পর্দা ও একদিনের পত্রিকা ছাড়িয়ে দূরে যাবে না। তবে সরকারের বিদেশি শুভাকাগ্ধক্ষীরাও এসব বিষয়ে কিছু বলছেন। যেমন—বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টি গত ১৫ অক্টোবর ওয়াশিংটনে এক আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন সঠিক ট্র্যাকেই আছে, তবে স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতি দমনে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার।’ তিনি স্লশিয়ার করে দিয়েছেন যে, দুর্নীতি দমন করতে বাংলাদেশ যে ব্যবস্থা নিয়েছে তাতে অনেকটা সাফল্য এলেও দুর্নীতির রাস্লগ্রাস বিভিন্ন পর্যায়ে অব্যাহত থাকায় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বিকাশকে ব্যাহত করছে। এর ফলে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি বিনিয়োগ অনুত্সাহিত হচ্ছে (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক)। আর আমার দেশ পত্রিকায় গত ১৭ অক্টোবর প্রথম পৃষ্ঠায় খবর ছিল, ‘দেশে এখন শিল্পবিনিয়োগ নেই।’ হবে কীভাবে? যেখানে সরকারদলীয় সংসদ সদস্যের ছেলেরা এক অভিযানে অন্যদের দু’তিনটি শিপ-ব্রেকিংইয়ার্ড দখল করে বীরদর্পে ঘোরাফেরা করতে পারে, সেখানে কে আসবে নিজের মূলধন খাটিয়ে কলকারখানা গড়ে বিনা বাক্য ব্যয়ে, বিনা পয়সায় অন্যের হাতে তুলে দিতে? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কেউ অন্যায় করলে সে যে দলেরই হোক তাকে আইন অনুযায়ী শাস্তি পেতে হবে। তাঁর এ স্লশিয়ারি সত্ত্বেও একটা প্রশ্ন থাকে। কেউ যে অন্যায় বা দুর্নীতি করেছে সেটা যথাযথ সরকারি কর্তৃপক্ষ মনে করলে তবেই তো তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখন সরকার যদি বিশেষ কোনো দুর্নীতিপরায়ণের দুর্নীতি দেখেও না দেখে তাহলে কী হবে!
লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক এখন
শিকড় নামক সংগঠনের আয়োজন করা লালন-হাসন লোকজ উত্সবের স্থান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এটির উদ্বোধন হয় গত বৃহস্পতিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০০৯। উত্সবটি উত্সর্গ করা হয়েছে প্রয়াত শাহ আবদুল করিমের নামে। এই উত্সবের আয়োজকরা সম্ভবত ধারণা করেছিল যে, মহান তিন ব্যক্তিত্বের নামে যখন তাদের অনুষ্ঠান এবং উদ্বোধনকালে যখন তিন মহত্ ব্যক্তিত্ব উপস্থিত তখন সেখানে কোনো ঝুট-ঝামেলা হবে না। তারা সম্ভবত এও ভেবেছিল যে, আজকাল যে কোনো অনুষ্ঠানে, এমনকি কোনো কোনো সময় পল্লীর ক্ষুদ্র কৃষকের বাড়িতে বিয়ের দাওয়াতে পর্যন্ত, পলিটিক্যাল প্রটোকল তথা রাজনৈতিক শিষ্টাচার নামক অলিখিত কানুনটি প্রায়ই উটকো ঝামেলা বাধায়, সেটি এক্ষেত্রে সামলানো গেছে। নাম ও পদের কর্মটি বেশ শক্তপোক্তই ছিল। একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ও এলাকার কৃতী সন্তান, একজন বিখ্যাত লেখক ও শিক্ষাবিদ যাঁর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়ানো হাস্যোজ্জ্বল আলোকচিত্র অতি সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় দেখা গেছে এবং শ্রদ্ধেয় ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয়কে সম্মান ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করার পর কাউকে অশ্রদ্ধা করার অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে উঠবে না। কিন্তু বিধি বাম। কারও হিসাব অনুযায়ী তারা ভুল করেছিল। সেই হিসাব অনুযায়ী তারা সরকার দলের স্থানীয় সংসদ সদস্য জনাব মোঃ শফিকুর রহমান ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহউদ্দিন সিরাজকে ‘যথাযথ সম্মান প্রদর্শন’ করেনি। এই দুই নেতা লোকজ উত্সবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন, তাঁদের আগমন বার্তা আওয়াজবর্ধক যন্ত্রের মাধ্যমে ঘোষণা করা হয়েছিল, তাঁরা অতিথিদের জন্য সংরক্ষিত সামনের সারির আসনে উপবেশন করেছিলেন, তবে মিনিট দশেক পরে ‘কাজ আছে’ বলে সভাস্থল ত্যাগ করেন (সূত্র : প্রথম আলো পত্রিকা)। এতে অনুষ্ঠান অঙ্গনে কিছু চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। অতঃপর অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত, ভাইস চ্যান্সেলর জনাব সালেহউদ্দিন ও অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সভাস্থল ত্যাগ করার পরই একদল উত্তেজিত যুবক তাদের নেতা ও মাননীয় সংসদ সদস্যকে যথাযোগ্য সম্মান দেখানো হয়নি এই অভিযোগে চেয়ার ভাঙা শুরু করে। এতে অহিংস ফকির লালন শাহ্, হাসন রাজা ও শাহ আবদুল করিমের বিদেহী আত্মা হয়তো যন্ত্রণায় ও লজ্জায় কষ্ট পেয়েছে, তবে সম্মানিত প্রধান অতিথি ও মাননীয় বিশেষ অতিথিদ্বয় সম্ভবত কপালের ঘাম মুছতে মুছতে স্বস্তিবোধ করেছেন একথা ভেবে যে, তাঁদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও ব্যক্তিগতভাবে অপমানিত হতে হয়নি। তবে আমাদের মনে হয়, সম্মান আদায়ের যে নতুন কৃষ্টি আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্যরা ও দলের নব্য নেতারা প্রচলন করেছেন, তাতে দেশের মানুষ নিজেদের ইজ্জত রক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্নই হবে; স্বস্তি পাবে না আদৌ। আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের জাত-মান থাকল কী গেল সেটা বোধহয় শাসকদের মাথা ঘামানোর বিষয় নয়, এটা তাঁদের জন্য চিন্তা-ভাবনার কোনো ব্যাপারই হতে পারে না। রাজাদের রাজকর্মে অবশ্য পালনীয় কিছু বিষয় আছে, আবার দৃকপাতের অযোগ্য ব্যাপার-স্যাপারও আছে। আমাদের মান-সম্মান বা আমাদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান তাঁদের মূল্যবান নেক নজরের বাইরে। তবে আমি ভাবছি দুটি বিষয় নিয়ে। একটা হলো মন্ত্রী মহোদয়কে যথেষ্ট শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা এবং মাননীয় সংসদ সদস্য ও দলের উঠতি নেতাকে সামনের সারিতে বসানোর পরও শেষের দু’জন ‘সম্মান পাননি’ বলে যে ভাবা হলো এটা কি আওয়ামী লীগের ভেতর মূল্যায়নের প্রশ্ন? অর্থাত্ তাঁরা দু’জন কি ভাবছিলেন যে, তাঁরা দলের মধ্যে যথেষ্ট প্রতিপত্তিশালী, আর বাইরের লোকদের সেটা বোঝাতে প্রয়োজন ছিল তাঁদের মঞ্চে প্রধান অতিথির পাশে নিয়ে বসানো? তা যদি হয়ে থাকে তাহলে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর জন্য ‘খবর আছে’। তিনি এখন থেকে ভাবতে পারেন দলের ভেতর যারা প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠছেন তাদের কেউ না কেউ আরও বেশি ‘সম্মানিত’ হওয়ার আকাগ্ধক্ষায় তাঁর মন্ত্রিত্বের চেয়ারটির জন্য হাত বাড়াতে পারেন। তখন তাদের গায়েও হাত লেগে যেতে পারে। পত্রিকান্তরে পড়েছি যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাকি দলে তরুণদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন (গুজব শোনা যায় তাঁর উত্তরাধিকারী নিয়েও নাকি তাঁকে ভাবতে হচ্ছে)। সেক্ষেত্রে বৃদ্ধ বা প্রৌঢ় মন্ত্রীরা যদি নিজে থেকে সরে না দাঁড়ান তাহলে বার্তাটি বুঝিয়ে দেয়ার জন্য তাঁদের এক-আধটু দৈহিক ধাক্কাধাক্কিও করা যেতে পারে। এই ‘কালচারটি’ আমাদের দেশে একেবারে অদৃশ্যপূর্ব ঘটনা বোধকরি নয়।
দ্বিতীয় চিন্তাটি হলো, আমাদের দেশে কি ঘোষণা দিয়ে হোক অথবা অঘোষিতভাবে হোক শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন হতে যাচ্ছে? মাস খানেক আগে শুনেছিলাম, আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, দলীয় সংসদ সদস্যরা যার যার নির্বাচনী এলাকার প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করবেন। থানা-পুলিশ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, পূর্ত ও সড়ক বিভাগের অফিস, সরকারি হেলথ কমপ্লেক্স, স্কুল-কলেজ, খাল-বিল, সড়কের টোল আদায়—এর সবই নাকি চলবে তাঁদের কথামত বা তাঁদের ইশারায়, অথবা তাঁদের ঠিক করে দেয়া লোক মারফত (যেমন—এক মাননীয় সংসদ সদস্য বলেই ফেলেছেন যে, তিনি শ্বশুরবাড়ির এলাকা থেকে নির্বাচিত হয়েছেন কিন্তু সেখানকার লোকজনদের ভালোমত চেনেন না বলে তাঁর শ্যালককে এলাকা দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিয়েছেন)। বলা চলে, এর ফলে এক ধরনের অঘোষিত জমিদারি বা সামন্তপ্রথা চালু হয়েছে। আর জমিদার সাহেবকে ভয় না পেলে এবং তাঁর প্রজারা সেই ভীতির নমুনা হিসেবে উঠতে-বসতে শয়নে-স্বপনে তাঁকে আনত মস্তকে সম্মান প্রদর্শন না করলে তিনি খাজনা আদায় করতে সমর্থ হবেন কীভাবে? অবশ্য এই সামন্তপ্রথায় নাকি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা ছাড়াও জায়গায় জায়গায় স্থানীয়ভাবে প্রতিপত্তিশালী বা কেন্দ্রীয়ভাবে দলে পদাধিকারী এমন ব্যক্তিরাও লাভবান হতে আগ্রহী। আর এই যে আমরা প্রায়ই খবর পড়ি ও ছবি দেখি শাসক দলের গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠী রামদা, লাঠি, পটকা হাতে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া করছে তার কারণ নাকি কে হবেন জমিদার তা-ই নিয়ে ঝগড়া।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শনিবার ‘জাতীয় ঐক্য রুখবে দারিদ্র্য’ সমাবেশে বলেছেন যে, দুর্নীতি রুখতে না পারলে দারিদ্র্য দূর হবে না। খাঁটি কথা। তবে আমাদের মনে হয় যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর অশেষ বিজ্ঞতায় দুর্নীতি বলতে সরকারি আওতার কাজকর্মে দুর্নীতির কথা বলেছেন। তাই চাঁদাবাজি ও অবৈধ টোল আদায়ও তাঁর ব্যক্ত ‘দুর্নীতি’ শব্দের সংজ্ঞার মধ্যে পড়বে কিনা দেশবাসীর তা স্পষ্ট করে জানা দরকার। তা জানলেও এর প্রতিকার হবে কিনা সে সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। কারণ, প্রথমত, তাহলে নব্য সামন্তরা অর্থবিত্ত হস্তগত করবে কীভাবে। দ্বিতীয়ত, তাদের নিজস্ব এবং দলের প্রভাব বিস্তারের জন্য যে পাইক-বরকন্দাজ-লাঠিয়াল দরকার তাদের খরচ মেটাবে কোথা থেকে। তাই, ব্যত্যয় না হলে আমার ভয় থেকে যাচ্ছে যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি দমনের যে শুভেচ্ছা প্রকাশ করেছেন তার ইতি বঙ্গবন্ব্দু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, ঘরের ভেতর টেলিভিশন সেটের পর্দা ও একদিনের পত্রিকা ছাড়িয়ে দূরে যাবে না। তবে সরকারের বিদেশি শুভাকাগ্ধক্ষীরাও এসব বিষয়ে কিছু বলছেন। যেমন—বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টি গত ১৫ অক্টোবর ওয়াশিংটনে এক আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন সঠিক ট্র্যাকেই আছে, তবে স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতি দমনে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার।’ তিনি স্লশিয়ার করে দিয়েছেন যে, দুর্নীতি দমন করতে বাংলাদেশ যে ব্যবস্থা নিয়েছে তাতে অনেকটা সাফল্য এলেও দুর্নীতির রাস্লগ্রাস বিভিন্ন পর্যায়ে অব্যাহত থাকায় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বিকাশকে ব্যাহত করছে। এর ফলে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি বিনিয়োগ অনুত্সাহিত হচ্ছে (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক)। আর আমার দেশ পত্রিকায় গত ১৭ অক্টোবর প্রথম পৃষ্ঠায় খবর ছিল, ‘দেশে এখন শিল্পবিনিয়োগ নেই।’ হবে কীভাবে? যেখানে সরকারদলীয় সংসদ সদস্যের ছেলেরা এক অভিযানে অন্যদের দু’তিনটি শিপ-ব্রেকিংইয়ার্ড দখল করে বীরদর্পে ঘোরাফেরা করতে পারে, সেখানে কে আসবে নিজের মূলধন খাটিয়ে কলকারখানা গড়ে বিনা বাক্য ব্যয়ে, বিনা পয়সায় অন্যের হাতে তুলে দিতে? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কেউ অন্যায় করলে সে যে দলেরই হোক তাকে আইন অনুযায়ী শাস্তি পেতে হবে। তাঁর এ স্লশিয়ারি সত্ত্বেও একটা প্রশ্ন থাকে। কেউ যে অন্যায় বা দুর্নীতি করেছে সেটা যথাযথ সরকারি কর্তৃপক্ষ মনে করলে তবেই তো তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখন সরকার যদি বিশেষ কোনো দুর্নীতিপরায়ণের দুর্নীতি দেখেও না দেখে তাহলে কী হবে!
লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক এখন
No comments