মালদ্বীপে সাগরতলে মন্ত্রিসভার বৈঠকঃ পরিবেশ শৃগ্ধখলা রক্ষা এখন জরুরি
পৌরাণিক উপাখ্যানের মতো শোনা গেলেও ঘটনাটি সম্পূর্ণ বাস্তব। সারাবিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যে এক ব্যতিক্রমী আয়োজন সম্পন্ন করেছে মালদ্বীপ সরকার। প্রেসিডেন্ট ভবন বা স্থলভাগের অন্য কোথাও নয়। তারা মন্ত্রিসভার বৈঠক করেছেন সাগরতলে অর্থাত্ প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে। স্বভাবতই এ অভূতপূর্ব বৈঠকের খবর বিশ্ববাসী তথা বিশ্বনেতাদের নজর কেড়েছে।
দেশটির ছোট্ট দ্বীপ গিরিফুশির সাগরতলে এ বৈঠকের আয়োজন করা হয় গত ১৭ অক্টোবর। কর্মসূচি অনুযায়ী ডুবুরিদের পোশাক পরে সাগরে নামেন দেশটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ। তাকে অনুসরণ করেন ভাইস প্রেসিডেন্টসহ মন্ত্রিসভার ১১ জন সদস্য। সাগরের ২০ ফুট গভীরে বৈঠকের জন্য ঘোড়ার খুরের আকৃতিতে সাজানো হয় চেয়ার-টেবিল। আধঘণ্টার এ সাগরতল বৈঠকে হাতের ইশারা ও একটি সাদা বোর্ডের মাধ্যমে ভাববিনিময় করেন অংশগ্রহণকারীরা। বোর্ডে লেখা প্রস্তাবে পানিরোধী মার্কার দিয়ে স্বাক্ষর করেন মন্ত্রীরা। বৈঠকের দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার করা হয় মালদ্বীপের জাতীয় টেলিভিশনে। সাগরতলের এ বৈঠকের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার মূল কারণ কার্বন নির্গমন রোধে বিশ্বব্যাপী পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান। জলবায়ুর পরিবর্তন তথা বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারণে মালদ্বীপের এবং অন্যান্য দেশের কী ভয়াবহ পরিণতির মোকাবিলা করতে হবে ভবিষ্যতে এবং এর মোকাবিলায় সবার একযোগে কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত তা নিয়ে আলোচনা করা হয় বৈঠকে। এখন এ কথা আর কারও অজানা নেই যে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমেই বাড়ছে। সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বিশ্বের অনেক নিম্নাঞ্চল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে মালদ্বীপ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ২ দশমিক ১ মিটার বা ৭ ফুট উচ্চতায় রয়েছে দেশটি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এভাবে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়া অব্যাহত থাকলে এই দ্বীপদেশটি সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, আজ যদি মালদ্বীপকে রক্ষা করা না যায়, তাহলে বিশ্বের বাকি দেশগুলোরও একই পরিণতি হতে পারে। প্রেসিডেন্ট নাশিদের এ আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়ার অবকাশ নেই। এর আগে সারা বিশ্বের পরিবেশবিজ্ঞানী, জলবায়ু-আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা কার্বন নির্গমনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার ব্যাপারে দফায় দফায় স্লশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু সমস্যার ভয়াবহতা রোধের বিষয়টি শুধু উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা প্রকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব ক্যাম্ব্রিজের জনৈক বিজ্ঞানী স্লশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রক্রিয়া এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আগামী ১০ বছরের মধ্যে আর্কটিক অঞ্চল গ্রীষ্মকালে পুরোপুরি বরফশূন্য হয়ে পড়বে। এই প্রবণতা প্রকট হয়ে উঠবে উত্তর মেরুতেও। ব্রিটিশ বরফ বিজ্ঞানীদের একটি সার্ভে দল জানিয়েছেন, এ অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে গ্রীষ্মকালে সেখানে জাহাজ চালানোর কথা ভাবতে শুরু করবে মানুষ। এ অবস্থায় বিশ্বের যে ক্ষতি হবে তা অকল্পনীয়। পাল্টে যাবে পৃথিবীর আবহাওয়া, অস্থিরতা দেখা দেবে প্রাকৃতিক অবকাঠামোয়, উষ্ণায়ন প্রক্রিয়ায় নষ্ট হবে ভৌগোলিক ভারসাম্য, প্রতিবেশ-শৃগ্ধখলায় নেমে আসবে অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়, সাগরগর্ভে হারিয়ে যাবে বিস্তীর্ণ অঞ্চল এসব মহাবিপদ সংকেত মাথায় রেখে বিলম্বে হলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কোপেনহেগেনে আগামী ডিসেম্বরে। জাতিসংঘ আয়োজিত এ বৈঠকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে এবং সঙ্কট মোকাবিলায় করণীয় স্থির করা হবে। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট এ বৈঠকের গুরুত্ব অনুধাবন করেই বলেছেন, কোপেনহেগেন সম্মেলন ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না। তাহলে আমরা মারা যাব। প্রাসঙ্গিক যে, বাংলাদেশও মালদ্বীপের মতোই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির আওতাভুক্ত অঞ্চল। কাজেই এ সম্মেলনের সাফল্য বাংলাদেশের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মরা-বাঁচার এই প্রশ্নটিকেই এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, অগ্রাধিকার দিতে হবে। না হলে বিরূপ প্রকৃতির কোপে পড়ে ধুয়ে-মুছে যাবে আমাদের সব তথাকথিত অগ্রাধিকার।
No comments