তরুণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনাকে ঘিরে কৌতূহল by সৈয়দ আবদাল আহমদ
হিনা রব্বানি খার। পাকিস্তানের প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সবচেয়ে কমবয়সী অর্থাত্ মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তিনি পাকিস্তানের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে অভিজ্ঞতা মাত্র আড়াই মাসের। এরই মধ্যে সবার দৃষ্টি কেড়েছেন হিনা। শুধু বিশ্বরাজনীতিই নয়, বিশ্বমিডিয়ার দৃষ্টিও তার ওপর। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে এক সপ্তাহের মধ্যেই ভারত সফরে গিয়ে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। এরপর সফর করেন চীন ও তুরস্ক। বর্তমানে তিনি জাতিসংঘের ৬৬তম অধিবেশনে পাকিস্তানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তাক লাগানো ভাষণ দেন পাকিস্তানের এই তরুণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। শুধু তা-ই নয়, হাক্কানি নেটওয়ার্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্যের পর হিনা হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তার এই হুশিয়ারির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সুর এখন নরম। সিএনএন, বিবিসি, আলজাজিরাসহ বিশ্বমিডিয়া কভার করেছে তার বক্তৃতা।
একজন হিনা হিসেবে যেভাবে গড়ে উঠলেনঃ
হিনার জন্ম পাঞ্জাবের মুলতানের একটি সম্ভ্রান্ত রাজনৈতিক পরিবারে ১৯৭৭ সালের ১৯ জানুয়ারি। তিনি লাহোর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। হিনা একসময় সাবেক পাক-প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগ করলেও পার্লামেন্ট নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়ে যোগ দেন বর্তমান ক্ষমতাসীন পিপলস পার্টিতে। তার স্বামী ফিরোজ গুলজার একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। হিনা পাকিস্তানের বিশিষ্ট রাজনীতিক সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মালিক গোলাম নূর রব্বানি খারের মেয়ে এবং সাবেক গভর্নর মালিক গোলাম মোস্তাফা খারের ভাতিজি। দুই ছেলে এবং এক মেয়ে নিয়ে তাদের সংসার।
হিনা রব্বানি খার ২০০২ সালে প্রথম সংসদ সদস্য হন পাকিস্তান মুসলিম লীগ থেকে। এরপর তিনি ২০০৮ সালে পাকিস্তান পিপলস পার্টি থেকে সংসদ সদস্য হন। ২০০৯ সালের ১৩ জুন থেকে তিনি প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির অফিসে কাজ শুরু করেন। ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১১ তিনি প্রধানমন্ত্রীর অফিসে ফরেন সার্ভিস বিভাগে যোগ দেন এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১১ তিনি ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯ জুলাই প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন এবং ২০ জুলাই তিনি মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
পারিবারিক ও রাজনৈতিক ঐতিহ্যের কারণে তাকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে বেনজির ভুট্টো হিসেবে ভাবতে শুরু করা হয়। আর বেনজির ভুট্টোর পরে হিনাই বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাবশালী পাকিস্তানি মহিলা হিসেবে পরিচিতি পান। ২০০৯ সালে হিনা পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে প্রথম মহিলা হিসেবে বাজেট পেশ করেন।
অন্যদিকে হিনার মধ্যে রয়েছে একজন গর্বিত পাকিস্তানি মনোভাব এবং এটাই তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে প্রকাশ পায়। ২০০৮ সালে হিনা পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রার্থী হিসেবে পাঞ্জাবের মুজাফফরগড় থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে ২০০৩-০৭ পর্যন্ত তিনি পিএমএল-কিউ সরকারে অর্থনীতি ও পরিসংখ্যান দফতরের মন্ত্রী ছিলেন।
২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি গিলানি মন্ত্রিসভায় রদবদলের ফলে হিনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৩ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মোহাম্মদ কোরাইশির পদত্যাগের পর তিনি হন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ১৮ জুলাই তাকে পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি এই মনোনয়নকে জাতীয় জীবনের মূলধারায় নারীদের সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেন।
হিনার ভারত জয়
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই হিনা রব্বানি খার ভারত সফর করেন। পাকিস্তানের প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তার এই সফর ভারতে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নয়নে নেয়া প্রতিটি উদ্যোগই দু’দেশের পারস্পরিক আস্থার সঙ্কট নিরসনে আশার সঞ্চার করে থাকে। গত ২৭ জুলাই নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ইন্দো-পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকও এর ব্যতিক্রম ছিল না। পাকিস্তানের তরুণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার এক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন।
নয়াদিল্লিতে ২৬ জুলাই পৌঁছার পরই তার অসংখ্য ভক্ত জুটে যায়। হিনাকে স্বাগত জানিয়ে ভারতের বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় প্রশংসামূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ভারতের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা টাইমস অব ইন্ডিয়ার শিরোনাম ছিল—‘সবচেয়ে সুন্দর চেহারার পাকিস্তান’। হাস্যরস সৃষ্টি করতেও পিছপা হয়নি কোনো কোনো পত্রিকা। মুম্বাই মিরর-এর শিরোনাম ছিল—‘পাক বোমার ভারতে অবতরণ’। মেইল টুডে ট্যাবলয়েড পত্রিকা বিশাল জায়গাজুড়ে ছাপে হিনার ছবি। এতে বলা হয়, ফ্যাশন ফ্রন্টের জন্য শতভাগ নম্বর পেয়েছেন হিনা। পোশাক-পরিচ্ছদ, রোদচশমা, মুক্তার অলঙ্কার—সব মিলিয়ে তাকে ফ্যাশন-দুরস্ত মনে হয়েছে। রেডিফ ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, হিনা রব্বানি খারের মধ্যে সৌন্দর্য ও মেধার অপূর্ব মিলন ঘটেছে। দৈনিক আনন্দবাজারের শিরোনাম ছিল—‘সৌন্দর্যের ছটায় রাজধানীতে আলোড়ন হিনার’। একটি পত্রিকায় শিরোনাম ছিল—‘ভারতকে মন্ত্রমুগ্ধ করলেন তরুণী হিনা’। আরেকটি পত্রিকার শিরোনাম ছিল—‘ভারতের ওপর পাকিস্তানের হিনা সম্মোহন জাদু’। টুইটারেও তার প্রশংসায় অনেক বার্তা পাঠানো হয়।
দু’দিনের এই সফরে হিনা রব্বানি খার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণার সঙ্গে সফল বৈঠক করেন। বৈঠকের পর দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। কৃষ্ণা বলেন, সম্পর্ক সঠিকপথে ফিরে এসেছে। আর হিনা বলেন, এর মধ্য দিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার নবযুগের সূচনা হলো। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শান্তি অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থেই দু’দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সম্পর্কোন্নয়নের ওপর জোর দেন।
ভারতের বাণিজ্যিক নগরী মুম্বাইয়ে ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর ১০ জনের একটি সশস্ত্র জঙ্গি দলের হামলায় অন্তত ১৬৬ জন নিহত হয়েছিল। হামলাকারী দলের মধ্যে আজমল কাসাব নামের এক পাকিস্তানি নাগরিক গ্রেফতার হয়। কিন্তু অন্য হামলাকারীরা নিহত হয়। ভারতের অভিযোগ ছিল, পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈইয়েবা ওই হামলা চালায়। এ হামলায় পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর মদত রয়েছে। এর জের হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি আলোচনা বন্ধ করে দেয় ভারত। যদিও আইএসআইর মদত জোগানোর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তান বলে আসছিল, যেসব সন্ত্রাসী এ হামলা চালিয়েছে, তাদের কোনো দেশ নেই।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে অবিশ্বাস দূর করে আস্থা ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয় এ বছরের গোড়ার দিকে। গত ফেব্রুয়ারিতে ভারত-পাকিস্তান শান্তি আলোচনা আবার শুরু করার ঘোষণা দেয়। এর প্রায় পাঁচ মাস পর ২৭ জুলাই দু’দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের ওই আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণা বলেন, আমাদের মধ্যে এখনও সামান্য দূরত্ব রয়ে গেছে। আমাদের মন খোলা। উদ্দেশ্যও ইতিবাচক। আমি নিশ্চিত সৌহার্দ্যপূর্ণ ও পারস্পরিক সহায়ক শক্তি হয়ে এ দূরত্ব অতিক্রম করব। আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছব।
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর থেকে কাশ্মীর নিয়ে বিরোধের জের ধরে প্রতিবেশী দেশ দুটি অন্তত তিনবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। দু’দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠককে কেন্দ্র করে জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণকে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার জন্য অনুমতি পেতে কড়াকড়ি শিথিল করা হয়। এছাড়া মুম্বাই হামলার তদন্ত, সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই, মানবাধিকার ইস্যু, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা, সিয়াচেন শান্তি ও নিরাপত্তাসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে সম্মত হয় উভয় দেশ। চলতি মাসে ইসলামাবাদে পরমাণু বিশেষজ্ঞদের বৈঠকের বিষয়টিও দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে ঠিক হয়েছিল।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের নতুন প্রজন্ম দেশ দুটির মধ্যে নতুন ধরনের সম্পর্ক দেখতে পাবে। গত দুই দশকের অভিজ্ঞতা থেকে যা হবে একেবারে ভিন্ন ধরনের। যদিও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি বলেছেন, পাকিস্তানের ‘নমনীয় ভাবমূর্তি’ প্রকাশ করার উদ্দেশ্যেই হিনাকে (পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে) নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু হিনা যে খুবই সাহসী, তা ইতোমধ্যে প্রমাণ করতে পেরেছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, হিনা ভারতের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে যে অনেকটাই সক্ষম হয়েছেন, এ বিষয়ে তিনি নিজেও বেশ বুঝতে পেরেছেন। তবে বিনয়ের সঙ্গে হিনা খার বলেছেন, ‘আমি মনে করি, আমি আমার ব্যক্তিগত প্রোফাইল দিয়ে নয়, বরং আমি যে দেশ থেকে এসেছি, তার ভাবমূর্তি দিয়েই সবার নজর কাড়তে পেরেছি।’
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণাও হিনা রব্বানির ‘ব্যক্তিগত প্রোফাইলে’র প্রশংসা করেছেন। পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, ‘আপনি দেখতে সুন্দরী শুধু সে কারণে নয়, বরং আপনি যে নতুন বৈচিত্র্যময় মাত্রা নিয়ে এসেছেন, সে কারণে ভারতের অর্ধেক মানুষ আপনার দিকে তাকিয়ে আছে।’
যুক্তরাষ্ট্রকে হিনা
গত ২৩ সেপ্টেম্বর হিনা রব্বানি খার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই বলে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, ওয়াশিংটন প্রকাশ্যে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের কার্যকলাপের সমালোচনা চালিয়ে যেতে থাকলে তারা এক মিত্রকে হারানোর ঝুঁকি নেবে।
তিনি আমেরিকার উদ্দেশে বলেন, আপনারা ধাক্কা দিয়ে পাকিস্তান ও তার জনগণকে দূরে সরিয়ে দিতে পারেন না। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে অবস্থানরত পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার পাকিস্তানের জিও টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাত্কারে এ হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
সাক্ষাত্কারে হিনা রব্বানি খার মার্কিন কর্মকর্তাদের উদ্দেশ করে বলেন, আপনারা যদি ঢালাওভাবে পাকিস্তানের সমালোচনা করে যেতে থাকেন, তাহলে পাকিস্তানের বন্ধুত্ব হারাবেন। হারাতে হবে পাকিস্তানের জনগণের সমর্থন। আমাদের জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে পাল্টা ব্যবস্থা নিলে যুক্তরাষ্ট্রকে তার জন্য চরম মূল্য দিতে হবে।
এর আগে মার্কিন সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের বিদায়ী চেয়ারম্যান অ্যাডমিরাল মাইক মুলেন মার্কিন সিনেটে দেয়া এক ভাষণে দাবি করেছিলেন, সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী হাক্কানি নেটওয়ার্কের সঙ্গে পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। মুলেন এটাও বলেছিলেন, কাবুলে মার্কিন দূতাবাসে গত ১৩ সেপ্টেম্বরের হামলায় মদত জুগিয়েছে আইএসআই।
অ্যাডমিরাল মুলেন আরও দাবি করেন, হাক্কানি নেটওয়ার্ক আইএসআইর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। মুলেনের ওই বক্তব্য এবং এ ব্যাপারে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া দু’দেশের শীতল সম্পর্ককে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
তবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খারের কড়া বক্তব্যের পর সুর নরম করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন এখন বলছে, ‘সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে আমেরিকা পাকিস্তানের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে কাজ করছে।’ অথচ দেশটি এর আগে বলেছিল, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে পাকিস্তান জোরালো ভূমিকা না রাখায় যুক্তরাষ্ট্রের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে।
হিনা খার তার সাক্ষাত্কারে স্পষ্টভাবে এটাও দাবি করেছেন, ‘বিশ্বের বেশিরভাগ সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর গোপন যোগাযোগ রয়েছে। হাক্কানি গোষ্ঠীর জন্ম পাকিস্তানে হয়নি।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার বলেছেন, হাক্কানি নেটওয়ার্ক একসময় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) সুনজরে ছিল। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর সঙ্গে গোষ্ঠীটির সম্পর্ক আছে বলে ওয়াশিংটনের অভিযোগ সত্য নয়। নিউইয়র্কে আলজাজিরা টেলিভিশনের সঙ্গে সাক্ষাত্কারে হিনা বলেন, আমরা যদি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগের কথা বলি, তাহলে আমি নিশ্চিত, সিআইএর সঙ্গে সারা বিশ্বের অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সম্পর্ক রয়েছে। একে আমরা গোয়েন্দা সম্পর্ক বলে বিবেচনা করি। বিশেষ করে এই গোষ্ঠী (হাক্কানি), যাদের নিয়ে এই আলোচনা চলছেই, তারা একসময় সিআইএর সুনজরে ছিল।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের চলমান অধিবেশনে হিনা পাকিস্তান দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন। হাক্কানি নেটওয়ার্ক আইএসআইর ‘প্রকৃত অস্ত্র’ হিসেবে কাজ করছে—মার্কিন কমান্ডার মাইক মুলেনের এমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, এটা এমন অভিযোগ যার কারণে আমাদের ভীষণ বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। এটা ভিত্তিহীন। এর সপক্ষে আমাদের কাছে কোনো তথ্যপ্রমাণ হাজির করা হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হিনা রব্বানি খারের তীক্ষষ্ট বক্তব্য ও সঠিক জায়গায় তীর নিক্ষেপের ফলে যুক্তরাষ্ট্র এখন সুর নরম করেছে। হিনার বক্তব্যের পরদিনই মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র মার্ক টোনার বলেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে তার সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি বলেন, হাক্কানি গোষ্ঠীকে যুক্তরাষ্ট্র একটা উদ্বেগের বিষয় বলে চিহ্নিত করেছে। এরপর আমরা বিষয়টিকে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তুলে ধরেছি। আমরা বলেছি, হাক্কানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার এবং আমরা এখানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, এ বিষয়টি নিয়ে আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে কাজ করতে চাই।
চীনেও নজর কাড়েন হিনা
হিনা রব্বানি খার গত ২৪ আগস্ট বেইজিংয়ে চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াং চে ছি’র সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে বৈঠক করেছেন। বৈঠকের পর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, পাকিস্তান চীনের সঙ্গে একসঙ্গে জ্বালানিসম্পদ, অবকাঠামো, কৃষি ও অর্থসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক কল্যাণমূলক সহযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি পাকিস্তান- চীন কৌশলগত অংশীদারিত্ব সম্পর্কের উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত করতে ইচ্ছুক। তিনি আরও বলেন, চলতি বছর হলো পাকিস্তান ও চীন দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৬০তম বার্ষিকী। এ উপলক্ষে দু’দেশের তরুণ-তরুণীদের তাদের আগের প্রজন্মের রোপিত বন্ধুত্বের বীজ থেকে সুন্দর ফুল ফোটানো এবং সেই সঙ্গে তাদের নিজের দায়িত্ব পালনের কথাও মনে রাখতে হবে।
জাতিসংঘে হিনার জাদু
গত ২৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তাক লাগানো ভাষণ দেন পাকিস্তানের এই তরুণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি ভাষণে বলেন, আমি এ কারণে সুখী যে, পাকিস্তান ও ভারত এখন অর্থবহ শান্তি সংলাপের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানিরা প্রত্যাশা করছে, এই সংলাপ প্রক্রিয়া থেমে থাকবে না, এগিয়ে যাবে। আমরা জম্মু-কাশ্মীরসহ সব সমস্যার সমাধান নির্ণয় করতে চাই। জম্মু-কাশ্মীর সমস্যা হচ্ছে জাতিসংঘেরই একটি পুরনো এজেন্ডা। এই এজেন্ডা নিরাপত্তা পরিষদের একাধিক প্রস্তাবে এসেছে।
তিনি বলেন, পারমাণবিক শক্তিধর দক্ষিণ এশিয়া এখন একটি বাস্তবতা। আর এই বাস্তবতার কারণে পাকিস্তান ও ভারতকেই একসঙ্গে কাজ করার সুকঠিন দায়িত্বটি বহন করতে হবে। এজন্য সৃষ্টি করতে হবে পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ। অস্ত্র প্রতিযোগিতার ঝুঁকি কমাতে হবে এবং কৌশলগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি তার ভাষণে বলেন, ‘পাকিস্তানের মতো সন্ত্রাসের শিকার খুব কম দেশই হয়েছে। ইতোমধ্যে ৩০ হাজার নিরপরাধ পাকিস্তানি সন্ত্রাসের বলি হয়েছে। আমরা আমাদের দেশের কোনো এলাকায় সন্ত্রাস সহ্য করব না।
তিক্ততায় ভরা যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্ক
যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্ক এখন তিক্ততায় ভরা। চলতি বছরের ২ মে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেন হত্যার পর থেকেই এ সম্পর্কে চিড় ধরে। এরপর দু’দেশের সম্পর্ক ক্রমেই অবনতি হতে থাকে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, সিনেটর জন ক্যারি এবং মার্কিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পাকিস্তান সফর সত্ত্বেও দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি হয়নি। পাকিস্তানের বক্তব্য হলো, ওসামা বিন লাদেন অ্যাবোটাবাদে আত্মগোপন করে যেমন সে দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে, তেমনি অ্যাবোটাবাদে গোপন অপারেশন চালিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের বিদায়ী চেয়ারম্যান অ্যাডমিরাল মাইক মুলেনের একটি মন্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তানের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে। মাইক মুলেন বলেছিলেন, জঙ্গি সংগঠন হাক্কানি নেটওয়ার্ক পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর ‘সত্যিকারের শাখা’। সম্পর্কের অবনতির জের ধরে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দিতে পারে। এরই মধ্যে খবর বের হয়েছে, পাকিস্তানকে দেয়া সব ধরনের সাহায্য বন্ধ রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে বিল উত্থাপন করা হয়েছে। টেক্সাস অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচিত পরিষদের একজন সদস্য বিলটি উত্থাপন করেন। এটি এখন পরিষদের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। কমিটি বিলে সম্মতি দিলে তা আবার পরিষদে পাঠানো হবে। এ বিল পাস হলে কেবল পারমাণবিক অস্ত্র নিরাপদ রাখার উদ্দেশ্যে দেয়া সহায়তা ছাড়া পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য সব ধরনের সাহায্য বন্ধ থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রের এ তত্পরতার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে পাকিস্তান তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছে। জঙ্গিদের নিয়ে পাকিস্তান দ্বৈত খেলা খেলছে বলে যুক্তরাষ্ট্র যে দোষারোপ করে আসছে, তা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে পাকিস্তান। গত মঙ্গলবার রয়টার্সের সঙ্গে সাক্ষাত্কারে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন যে, হাক্কানি নেটওয়ার্কের জঙ্গিদের দমনে পাকিস্তানের ভেতর যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা সেনা অভিযান হবে তার দেশের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন। হাক্কানি নেটওয়ার্ক পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর শাখা বলে মাইক মুলেনের মন্তব্য সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী গিলানি বলেন, এ ধরনের নেতিবাচক বার্তা আমাদের জনগণের শান্তি নষ্ট করছে। যদি এমন কোনো বার্তা পাঠানো হয় যা আমাদের বন্ধুত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তাহলে এ ব্যাপারে আমাদের জনগণকে মানানো খুব কঠিন হবে। কাজেই বন্ধুত্বের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রকে ইতিবাচক বার্তা পাঠাতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র হঠাত্ করে এমন মন্তব্য ও সমালোচনায় মুখর হলো কেন—সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে গিলানি বলেন, এটি হচ্ছে আফগানযুদ্ধ নিয়ে ওয়াশিংটনের হতাশার বহিঃপ্রকাশ। ২০১৪ সালে এদেশ থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নিতে হবে। কাজেই তারা আরও বেশি সাফল্য আশা করছে সেখানে। কিন্তু বাস্তবে তা আসছে না।
সম্পর্ক অবনতি হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র বেসামরিক পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তিতেও রাজি হচ্ছে না। এ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী গিলানি বলেন, ‘পাকিস্তান তীব্র বিদ্যুত্ সঙ্কটে ভুগছে। এজন্য সহিংস ঘটনা ঘটছে। বিরোধীরা পার্লামেন্ট গরম করে ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি করছে না। অথচ ঠিকই ভারতের সঙ্গে একই চুক্তি তারা করছে। তাহলে আমি কীভাবে দেশের মানুষকে বোঝাবো ওরা আমাদের বন্ধু, ভারতের নয়। বিবেচনা বলে একটা কথা তো আছে!’ অবস্থার এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ ধরনের শীতল সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান চীন ও সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক আরও পাকাপোক্ত করছে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী গিলানি চীনকে পাকিস্তানের ‘সবসময়ের বন্ধু’ অভিহিত করে বলেছেন, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে লড়াইয়ে এই প্রতিবেশী দেশকে সর্বোচ্চ সহায়তা দেবে তারা। এরই মধ্যে ইসলামাবাদ সফর করেছেন চীনের নিরাপত্তা বিষয়কমন্ত্রী মেং জিয়ান ঝু। পাকিস্তানের প্রতি চীনের ‘দ্বিধাহীন সমর্থনের’ জন্য চীনা মন্ত্রীকে ধন্যবাদও জানান সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানি। পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিশ্লেষক হাসান আসকারি রিজভি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ প্রশমনের জন্য পাকিস্তান কূটনৈতিক প্রয়াস চালাচ্ছে। পাকিস্তান আশা করছে, এ সঙ্কট মোকাবিলায় চীন তাদের সাহায্য করবে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ উপেক্ষা করে চীন ঠিকই বেসামরিক পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য দ্বিতীয় পারমাণবিক চুল্লি বসাচ্ছে পাকিস্তানে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণেও বন্ধু পাকিস্তানকে সবধরনের সাহায্য করছে চীন। প্রধানমন্ত্রী গিলানি বলেন, পাকিস্তান ও চীন প্রকৃত বন্ধু। কাজেই চীনের শত্রু মানে পাকিস্তানের শত্রু। নিরাপত্তার বিষয়ে চীনকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন তারা। পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের মিত্র সৌদি আরবও সেদেশের শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ইসলামাবাদে পাঠিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমেই বাড়তে থাকা উত্তেজনা নিয়ে পাকিস্তানের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তারা। প্রধানমন্ত্রী গিলানি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনার বক্তব্য এবং চীনের সঙ্গে জোরালো কূটনৈতিক সম্পর্কই বলে দেবে আগামীতে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কটি কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
abdal62@gmail.com
হিনার জন্ম পাঞ্জাবের মুলতানের একটি সম্ভ্রান্ত রাজনৈতিক পরিবারে ১৯৭৭ সালের ১৯ জানুয়ারি। তিনি লাহোর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। হিনা একসময় সাবেক পাক-প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগ করলেও পার্লামেন্ট নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়ে যোগ দেন বর্তমান ক্ষমতাসীন পিপলস পার্টিতে। তার স্বামী ফিরোজ গুলজার একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। হিনা পাকিস্তানের বিশিষ্ট রাজনীতিক সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মালিক গোলাম নূর রব্বানি খারের মেয়ে এবং সাবেক গভর্নর মালিক গোলাম মোস্তাফা খারের ভাতিজি। দুই ছেলে এবং এক মেয়ে নিয়ে তাদের সংসার।
হিনা রব্বানি খার ২০০২ সালে প্রথম সংসদ সদস্য হন পাকিস্তান মুসলিম লীগ থেকে। এরপর তিনি ২০০৮ সালে পাকিস্তান পিপলস পার্টি থেকে সংসদ সদস্য হন। ২০০৯ সালের ১৩ জুন থেকে তিনি প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির অফিসে কাজ শুরু করেন। ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১১ তিনি প্রধানমন্ত্রীর অফিসে ফরেন সার্ভিস বিভাগে যোগ দেন এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১১ তিনি ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯ জুলাই প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন এবং ২০ জুলাই তিনি মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
পারিবারিক ও রাজনৈতিক ঐতিহ্যের কারণে তাকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে বেনজির ভুট্টো হিসেবে ভাবতে শুরু করা হয়। আর বেনজির ভুট্টোর পরে হিনাই বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাবশালী পাকিস্তানি মহিলা হিসেবে পরিচিতি পান। ২০০৯ সালে হিনা পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে প্রথম মহিলা হিসেবে বাজেট পেশ করেন।
অন্যদিকে হিনার মধ্যে রয়েছে একজন গর্বিত পাকিস্তানি মনোভাব এবং এটাই তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে প্রকাশ পায়। ২০০৮ সালে হিনা পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রার্থী হিসেবে পাঞ্জাবের মুজাফফরগড় থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে ২০০৩-০৭ পর্যন্ত তিনি পিএমএল-কিউ সরকারে অর্থনীতি ও পরিসংখ্যান দফতরের মন্ত্রী ছিলেন।
২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি গিলানি মন্ত্রিসভায় রদবদলের ফলে হিনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৩ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মোহাম্মদ কোরাইশির পদত্যাগের পর তিনি হন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ১৮ জুলাই তাকে পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি এই মনোনয়নকে জাতীয় জীবনের মূলধারায় নারীদের সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেন।
হিনার ভারত জয়
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই হিনা রব্বানি খার ভারত সফর করেন। পাকিস্তানের প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তার এই সফর ভারতে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নয়নে নেয়া প্রতিটি উদ্যোগই দু’দেশের পারস্পরিক আস্থার সঙ্কট নিরসনে আশার সঞ্চার করে থাকে। গত ২৭ জুলাই নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ইন্দো-পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকও এর ব্যতিক্রম ছিল না। পাকিস্তানের তরুণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার এক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন।
নয়াদিল্লিতে ২৬ জুলাই পৌঁছার পরই তার অসংখ্য ভক্ত জুটে যায়। হিনাকে স্বাগত জানিয়ে ভারতের বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় প্রশংসামূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ভারতের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা টাইমস অব ইন্ডিয়ার শিরোনাম ছিল—‘সবচেয়ে সুন্দর চেহারার পাকিস্তান’। হাস্যরস সৃষ্টি করতেও পিছপা হয়নি কোনো কোনো পত্রিকা। মুম্বাই মিরর-এর শিরোনাম ছিল—‘পাক বোমার ভারতে অবতরণ’। মেইল টুডে ট্যাবলয়েড পত্রিকা বিশাল জায়গাজুড়ে ছাপে হিনার ছবি। এতে বলা হয়, ফ্যাশন ফ্রন্টের জন্য শতভাগ নম্বর পেয়েছেন হিনা। পোশাক-পরিচ্ছদ, রোদচশমা, মুক্তার অলঙ্কার—সব মিলিয়ে তাকে ফ্যাশন-দুরস্ত মনে হয়েছে। রেডিফ ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, হিনা রব্বানি খারের মধ্যে সৌন্দর্য ও মেধার অপূর্ব মিলন ঘটেছে। দৈনিক আনন্দবাজারের শিরোনাম ছিল—‘সৌন্দর্যের ছটায় রাজধানীতে আলোড়ন হিনার’। একটি পত্রিকায় শিরোনাম ছিল—‘ভারতকে মন্ত্রমুগ্ধ করলেন তরুণী হিনা’। আরেকটি পত্রিকার শিরোনাম ছিল—‘ভারতের ওপর পাকিস্তানের হিনা সম্মোহন জাদু’। টুইটারেও তার প্রশংসায় অনেক বার্তা পাঠানো হয়।
দু’দিনের এই সফরে হিনা রব্বানি খার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণার সঙ্গে সফল বৈঠক করেন। বৈঠকের পর দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। কৃষ্ণা বলেন, সম্পর্ক সঠিকপথে ফিরে এসেছে। আর হিনা বলেন, এর মধ্য দিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার নবযুগের সূচনা হলো। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শান্তি অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থেই দু’দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সম্পর্কোন্নয়নের ওপর জোর দেন।
ভারতের বাণিজ্যিক নগরী মুম্বাইয়ে ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর ১০ জনের একটি সশস্ত্র জঙ্গি দলের হামলায় অন্তত ১৬৬ জন নিহত হয়েছিল। হামলাকারী দলের মধ্যে আজমল কাসাব নামের এক পাকিস্তানি নাগরিক গ্রেফতার হয়। কিন্তু অন্য হামলাকারীরা নিহত হয়। ভারতের অভিযোগ ছিল, পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈইয়েবা ওই হামলা চালায়। এ হামলায় পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর মদত রয়েছে। এর জের হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি আলোচনা বন্ধ করে দেয় ভারত। যদিও আইএসআইর মদত জোগানোর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তান বলে আসছিল, যেসব সন্ত্রাসী এ হামলা চালিয়েছে, তাদের কোনো দেশ নেই।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে অবিশ্বাস দূর করে আস্থা ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয় এ বছরের গোড়ার দিকে। গত ফেব্রুয়ারিতে ভারত-পাকিস্তান শান্তি আলোচনা আবার শুরু করার ঘোষণা দেয়। এর প্রায় পাঁচ মাস পর ২৭ জুলাই দু’দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের ওই আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণা বলেন, আমাদের মধ্যে এখনও সামান্য দূরত্ব রয়ে গেছে। আমাদের মন খোলা। উদ্দেশ্যও ইতিবাচক। আমি নিশ্চিত সৌহার্দ্যপূর্ণ ও পারস্পরিক সহায়ক শক্তি হয়ে এ দূরত্ব অতিক্রম করব। আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছব।
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর থেকে কাশ্মীর নিয়ে বিরোধের জের ধরে প্রতিবেশী দেশ দুটি অন্তত তিনবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। দু’দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠককে কেন্দ্র করে জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণকে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার জন্য অনুমতি পেতে কড়াকড়ি শিথিল করা হয়। এছাড়া মুম্বাই হামলার তদন্ত, সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই, মানবাধিকার ইস্যু, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা, সিয়াচেন শান্তি ও নিরাপত্তাসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে সম্মত হয় উভয় দেশ। চলতি মাসে ইসলামাবাদে পরমাণু বিশেষজ্ঞদের বৈঠকের বিষয়টিও দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে ঠিক হয়েছিল।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের নতুন প্রজন্ম দেশ দুটির মধ্যে নতুন ধরনের সম্পর্ক দেখতে পাবে। গত দুই দশকের অভিজ্ঞতা থেকে যা হবে একেবারে ভিন্ন ধরনের। যদিও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি বলেছেন, পাকিস্তানের ‘নমনীয় ভাবমূর্তি’ প্রকাশ করার উদ্দেশ্যেই হিনাকে (পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে) নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু হিনা যে খুবই সাহসী, তা ইতোমধ্যে প্রমাণ করতে পেরেছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, হিনা ভারতের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে যে অনেকটাই সক্ষম হয়েছেন, এ বিষয়ে তিনি নিজেও বেশ বুঝতে পেরেছেন। তবে বিনয়ের সঙ্গে হিনা খার বলেছেন, ‘আমি মনে করি, আমি আমার ব্যক্তিগত প্রোফাইল দিয়ে নয়, বরং আমি যে দেশ থেকে এসেছি, তার ভাবমূর্তি দিয়েই সবার নজর কাড়তে পেরেছি।’
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণাও হিনা রব্বানির ‘ব্যক্তিগত প্রোফাইলে’র প্রশংসা করেছেন। পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, ‘আপনি দেখতে সুন্দরী শুধু সে কারণে নয়, বরং আপনি যে নতুন বৈচিত্র্যময় মাত্রা নিয়ে এসেছেন, সে কারণে ভারতের অর্ধেক মানুষ আপনার দিকে তাকিয়ে আছে।’
যুক্তরাষ্ট্রকে হিনা
গত ২৩ সেপ্টেম্বর হিনা রব্বানি খার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই বলে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, ওয়াশিংটন প্রকাশ্যে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের কার্যকলাপের সমালোচনা চালিয়ে যেতে থাকলে তারা এক মিত্রকে হারানোর ঝুঁকি নেবে।
তিনি আমেরিকার উদ্দেশে বলেন, আপনারা ধাক্কা দিয়ে পাকিস্তান ও তার জনগণকে দূরে সরিয়ে দিতে পারেন না। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে অবস্থানরত পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার পাকিস্তানের জিও টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাত্কারে এ হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
সাক্ষাত্কারে হিনা রব্বানি খার মার্কিন কর্মকর্তাদের উদ্দেশ করে বলেন, আপনারা যদি ঢালাওভাবে পাকিস্তানের সমালোচনা করে যেতে থাকেন, তাহলে পাকিস্তানের বন্ধুত্ব হারাবেন। হারাতে হবে পাকিস্তানের জনগণের সমর্থন। আমাদের জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে পাল্টা ব্যবস্থা নিলে যুক্তরাষ্ট্রকে তার জন্য চরম মূল্য দিতে হবে।
এর আগে মার্কিন সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের বিদায়ী চেয়ারম্যান অ্যাডমিরাল মাইক মুলেন মার্কিন সিনেটে দেয়া এক ভাষণে দাবি করেছিলেন, সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী হাক্কানি নেটওয়ার্কের সঙ্গে পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। মুলেন এটাও বলেছিলেন, কাবুলে মার্কিন দূতাবাসে গত ১৩ সেপ্টেম্বরের হামলায় মদত জুগিয়েছে আইএসআই।
অ্যাডমিরাল মুলেন আরও দাবি করেন, হাক্কানি নেটওয়ার্ক আইএসআইর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। মুলেনের ওই বক্তব্য এবং এ ব্যাপারে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া দু’দেশের শীতল সম্পর্ককে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
তবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খারের কড়া বক্তব্যের পর সুর নরম করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন এখন বলছে, ‘সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে আমেরিকা পাকিস্তানের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে কাজ করছে।’ অথচ দেশটি এর আগে বলেছিল, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে পাকিস্তান জোরালো ভূমিকা না রাখায় যুক্তরাষ্ট্রের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে।
হিনা খার তার সাক্ষাত্কারে স্পষ্টভাবে এটাও দাবি করেছেন, ‘বিশ্বের বেশিরভাগ সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর গোপন যোগাযোগ রয়েছে। হাক্কানি গোষ্ঠীর জন্ম পাকিস্তানে হয়নি।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার বলেছেন, হাক্কানি নেটওয়ার্ক একসময় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) সুনজরে ছিল। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর সঙ্গে গোষ্ঠীটির সম্পর্ক আছে বলে ওয়াশিংটনের অভিযোগ সত্য নয়। নিউইয়র্কে আলজাজিরা টেলিভিশনের সঙ্গে সাক্ষাত্কারে হিনা বলেন, আমরা যদি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগের কথা বলি, তাহলে আমি নিশ্চিত, সিআইএর সঙ্গে সারা বিশ্বের অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সম্পর্ক রয়েছে। একে আমরা গোয়েন্দা সম্পর্ক বলে বিবেচনা করি। বিশেষ করে এই গোষ্ঠী (হাক্কানি), যাদের নিয়ে এই আলোচনা চলছেই, তারা একসময় সিআইএর সুনজরে ছিল।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের চলমান অধিবেশনে হিনা পাকিস্তান দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন। হাক্কানি নেটওয়ার্ক আইএসআইর ‘প্রকৃত অস্ত্র’ হিসেবে কাজ করছে—মার্কিন কমান্ডার মাইক মুলেনের এমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, এটা এমন অভিযোগ যার কারণে আমাদের ভীষণ বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। এটা ভিত্তিহীন। এর সপক্ষে আমাদের কাছে কোনো তথ্যপ্রমাণ হাজির করা হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হিনা রব্বানি খারের তীক্ষষ্ট বক্তব্য ও সঠিক জায়গায় তীর নিক্ষেপের ফলে যুক্তরাষ্ট্র এখন সুর নরম করেছে। হিনার বক্তব্যের পরদিনই মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র মার্ক টোনার বলেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে তার সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি বলেন, হাক্কানি গোষ্ঠীকে যুক্তরাষ্ট্র একটা উদ্বেগের বিষয় বলে চিহ্নিত করেছে। এরপর আমরা বিষয়টিকে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তুলে ধরেছি। আমরা বলেছি, হাক্কানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার এবং আমরা এখানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, এ বিষয়টি নিয়ে আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে কাজ করতে চাই।
চীনেও নজর কাড়েন হিনা
হিনা রব্বানি খার গত ২৪ আগস্ট বেইজিংয়ে চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াং চে ছি’র সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে বৈঠক করেছেন। বৈঠকের পর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, পাকিস্তান চীনের সঙ্গে একসঙ্গে জ্বালানিসম্পদ, অবকাঠামো, কৃষি ও অর্থসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক কল্যাণমূলক সহযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি পাকিস্তান- চীন কৌশলগত অংশীদারিত্ব সম্পর্কের উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত করতে ইচ্ছুক। তিনি আরও বলেন, চলতি বছর হলো পাকিস্তান ও চীন দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৬০তম বার্ষিকী। এ উপলক্ষে দু’দেশের তরুণ-তরুণীদের তাদের আগের প্রজন্মের রোপিত বন্ধুত্বের বীজ থেকে সুন্দর ফুল ফোটানো এবং সেই সঙ্গে তাদের নিজের দায়িত্ব পালনের কথাও মনে রাখতে হবে।
জাতিসংঘে হিনার জাদু
গত ২৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তাক লাগানো ভাষণ দেন পাকিস্তানের এই তরুণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি ভাষণে বলেন, আমি এ কারণে সুখী যে, পাকিস্তান ও ভারত এখন অর্থবহ শান্তি সংলাপের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানিরা প্রত্যাশা করছে, এই সংলাপ প্রক্রিয়া থেমে থাকবে না, এগিয়ে যাবে। আমরা জম্মু-কাশ্মীরসহ সব সমস্যার সমাধান নির্ণয় করতে চাই। জম্মু-কাশ্মীর সমস্যা হচ্ছে জাতিসংঘেরই একটি পুরনো এজেন্ডা। এই এজেন্ডা নিরাপত্তা পরিষদের একাধিক প্রস্তাবে এসেছে।
তিনি বলেন, পারমাণবিক শক্তিধর দক্ষিণ এশিয়া এখন একটি বাস্তবতা। আর এই বাস্তবতার কারণে পাকিস্তান ও ভারতকেই একসঙ্গে কাজ করার সুকঠিন দায়িত্বটি বহন করতে হবে। এজন্য সৃষ্টি করতে হবে পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ। অস্ত্র প্রতিযোগিতার ঝুঁকি কমাতে হবে এবং কৌশলগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি তার ভাষণে বলেন, ‘পাকিস্তানের মতো সন্ত্রাসের শিকার খুব কম দেশই হয়েছে। ইতোমধ্যে ৩০ হাজার নিরপরাধ পাকিস্তানি সন্ত্রাসের বলি হয়েছে। আমরা আমাদের দেশের কোনো এলাকায় সন্ত্রাস সহ্য করব না।
তিক্ততায় ভরা যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্ক
যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্ক এখন তিক্ততায় ভরা। চলতি বছরের ২ মে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেন হত্যার পর থেকেই এ সম্পর্কে চিড় ধরে। এরপর দু’দেশের সম্পর্ক ক্রমেই অবনতি হতে থাকে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, সিনেটর জন ক্যারি এবং মার্কিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পাকিস্তান সফর সত্ত্বেও দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি হয়নি। পাকিস্তানের বক্তব্য হলো, ওসামা বিন লাদেন অ্যাবোটাবাদে আত্মগোপন করে যেমন সে দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে, তেমনি অ্যাবোটাবাদে গোপন অপারেশন চালিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের বিদায়ী চেয়ারম্যান অ্যাডমিরাল মাইক মুলেনের একটি মন্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তানের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে। মাইক মুলেন বলেছিলেন, জঙ্গি সংগঠন হাক্কানি নেটওয়ার্ক পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর ‘সত্যিকারের শাখা’। সম্পর্কের অবনতির জের ধরে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দিতে পারে। এরই মধ্যে খবর বের হয়েছে, পাকিস্তানকে দেয়া সব ধরনের সাহায্য বন্ধ রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে বিল উত্থাপন করা হয়েছে। টেক্সাস অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচিত পরিষদের একজন সদস্য বিলটি উত্থাপন করেন। এটি এখন পরিষদের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। কমিটি বিলে সম্মতি দিলে তা আবার পরিষদে পাঠানো হবে। এ বিল পাস হলে কেবল পারমাণবিক অস্ত্র নিরাপদ রাখার উদ্দেশ্যে দেয়া সহায়তা ছাড়া পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য সব ধরনের সাহায্য বন্ধ থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রের এ তত্পরতার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে পাকিস্তান তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছে। জঙ্গিদের নিয়ে পাকিস্তান দ্বৈত খেলা খেলছে বলে যুক্তরাষ্ট্র যে দোষারোপ করে আসছে, তা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে পাকিস্তান। গত মঙ্গলবার রয়টার্সের সঙ্গে সাক্ষাত্কারে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন যে, হাক্কানি নেটওয়ার্কের জঙ্গিদের দমনে পাকিস্তানের ভেতর যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা সেনা অভিযান হবে তার দেশের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন। হাক্কানি নেটওয়ার্ক পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর শাখা বলে মাইক মুলেনের মন্তব্য সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী গিলানি বলেন, এ ধরনের নেতিবাচক বার্তা আমাদের জনগণের শান্তি নষ্ট করছে। যদি এমন কোনো বার্তা পাঠানো হয় যা আমাদের বন্ধুত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তাহলে এ ব্যাপারে আমাদের জনগণকে মানানো খুব কঠিন হবে। কাজেই বন্ধুত্বের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রকে ইতিবাচক বার্তা পাঠাতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র হঠাত্ করে এমন মন্তব্য ও সমালোচনায় মুখর হলো কেন—সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে গিলানি বলেন, এটি হচ্ছে আফগানযুদ্ধ নিয়ে ওয়াশিংটনের হতাশার বহিঃপ্রকাশ। ২০১৪ সালে এদেশ থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নিতে হবে। কাজেই তারা আরও বেশি সাফল্য আশা করছে সেখানে। কিন্তু বাস্তবে তা আসছে না।
সম্পর্ক অবনতি হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র বেসামরিক পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তিতেও রাজি হচ্ছে না। এ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী গিলানি বলেন, ‘পাকিস্তান তীব্র বিদ্যুত্ সঙ্কটে ভুগছে। এজন্য সহিংস ঘটনা ঘটছে। বিরোধীরা পার্লামেন্ট গরম করে ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি করছে না। অথচ ঠিকই ভারতের সঙ্গে একই চুক্তি তারা করছে। তাহলে আমি কীভাবে দেশের মানুষকে বোঝাবো ওরা আমাদের বন্ধু, ভারতের নয়। বিবেচনা বলে একটা কথা তো আছে!’ অবস্থার এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ ধরনের শীতল সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান চীন ও সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক আরও পাকাপোক্ত করছে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী গিলানি চীনকে পাকিস্তানের ‘সবসময়ের বন্ধু’ অভিহিত করে বলেছেন, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে লড়াইয়ে এই প্রতিবেশী দেশকে সর্বোচ্চ সহায়তা দেবে তারা। এরই মধ্যে ইসলামাবাদ সফর করেছেন চীনের নিরাপত্তা বিষয়কমন্ত্রী মেং জিয়ান ঝু। পাকিস্তানের প্রতি চীনের ‘দ্বিধাহীন সমর্থনের’ জন্য চীনা মন্ত্রীকে ধন্যবাদও জানান সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানি। পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিশ্লেষক হাসান আসকারি রিজভি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ প্রশমনের জন্য পাকিস্তান কূটনৈতিক প্রয়াস চালাচ্ছে। পাকিস্তান আশা করছে, এ সঙ্কট মোকাবিলায় চীন তাদের সাহায্য করবে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ উপেক্ষা করে চীন ঠিকই বেসামরিক পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য দ্বিতীয় পারমাণবিক চুল্লি বসাচ্ছে পাকিস্তানে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণেও বন্ধু পাকিস্তানকে সবধরনের সাহায্য করছে চীন। প্রধানমন্ত্রী গিলানি বলেন, পাকিস্তান ও চীন প্রকৃত বন্ধু। কাজেই চীনের শত্রু মানে পাকিস্তানের শত্রু। নিরাপত্তার বিষয়ে চীনকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন তারা। পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের মিত্র সৌদি আরবও সেদেশের শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ইসলামাবাদে পাঠিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমেই বাড়তে থাকা উত্তেজনা নিয়ে পাকিস্তানের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তারা। প্রধানমন্ত্রী গিলানি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনার বক্তব্য এবং চীনের সঙ্গে জোরালো কূটনৈতিক সম্পর্কই বলে দেবে আগামীতে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কটি কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
abdal62@gmail.com
No comments