বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লজ্জাজনক তারেক-বন্দনা by রোবায়েত ফেরদৌস, শরিফুজ্জামান শরিফ, নাসির নোমান, সরদার আমিন, ওমর ফারুক, শাওন্তী হায়দার ও শবনম আযীম
সে এক সময় ছিল, যখন রাজদরবারে কিছু লোক থাকত, যারা সঙ সেজে, চটুল রসিকতা করে, কারও জন্য সুপারিশ করে বা রাজা বা রাজপরিবারের সদস্যদের স্তুতি করে ক্ষুন্নিবৃত্তি করত। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বুদ্ধিবৃত্তি করে যাঁদের ক্ষুন্নিবারণ করার কথা, অবাক বিস্ময়ে দেখি, তাঁরাও চাটুকারিতাকেই নিজেদের প্রধান কাজ হিসেবে জাতির সামনে প্রকাশ করতে চাইছেন। প্রিয় পাঠক, দেখেছেন নিশ্চয়ই, ৪ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোসহ দেশের প্রায় সব দৈনিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তারেক-বন্দনার খবর বেশ ফলাও করে বেরিয়েছে। ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি টিচার্স ফর ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে আয়োজিত আলোচনায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বন্দনা করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুসংখ্যক শিক্ষক এমন চাটুবাক্য ব্যবহার করেছেন, যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষকদের এহেন লাগামহীন মোসাহেবিতে আমরা যারপরনাই লজ্জিত হয়েছি। পাঠক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহি-মোসাহেবনামার কিছু নমুনা দেখুন:
‘দেশের আকাশ-বাতাসসহ প্রতিটি কণা আজ “আমি তারেক জিয়া বলছি” ডাকটি শুনতে চায়।’ বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এভাবেই বন্দনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন আবুল বাশার। প্রধান আলোচক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘তারেক রহমান জিয়াউর রহমানের সুযোগ্য পুত্র হওয়ায় তাঁকে ভালোবাসি। তাঁকে ভালোবাসি, কারণ, তিনি একজন সুযোগ্য নেতার কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছেন।’ কলা অনুষদের ডিন সদরুল আমিন বলেন, ‘আমরা চাই, তারেক জিয়া আমাদের মাঝে ফিরে আসুন। তাঁর বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে, তা দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে সরকার তুলে নেবে বলে আমরা আশা করি।’ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন তাজমেরী এস এ ইসলাম বলেন, ‘ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে তারেক রহমানের সুদৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত জেনেই তারা উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছে। তারেক রহমান দেশের বাইরে বসে আত্মসমালোচনা ও আত্মবিশ্লেষণ করছেন।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম বলেন, ‘তারেক রহমান তারুণ্যের অহংকার। তাঁর দেহে দেশপ্রেম ও স্বাধীনচেতার রক্ত বইছে। জনগণ তাঁকে দেশের নেতৃত্বে দেখতে চায়।’ অধ্যাপক আবদুল আজিজ বলেন, ‘আজ আমরা মিছিলে মিছিলে বাকশালের আওয়াজ শুনতে পাই। এদের থামাতে হবে। এ জন্য প্রাণপ্রিয় নেতা তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন দরকার।’ অধ্যাপক আকতার হোসেন বলেন, ‘তারেক রহমানকে তাঁর পিতার গুণে গুণান্বিত হতে হবে। তা থেকে বিচ্যুতি ঘটলে মনে রাখতে হবে, ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।’ (প্রথম আলো, ৪ সেপ্টেম্বর, পৃষ্ঠা-৩)
পাঠক, আপনারাই বিচার করুন, এসব স্তুতি কোনো শিক্ষকের মুখ থেকে বের হতে পারে? নাকি বের হওয়া উচিত? নৈতিকতা, সাংস্কৃতিক মান আর রুচিবোধ তাহলে কোথায় গিয়ে ঠেকল? এত দিন আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গাঢ় নীল, ধবধবে সাদা, হালকা গোলাপি, মেজেন্টা, ফিরোজা ইত্যাকার নানাবিধ রঙে রঞ্জিত/বিভক্ত হতে দেখেছি। আর সেই বিভক্তির কারণে শিক্ষকদের মধ্যে শিক্ষার গুণগত উৎকর্ষের আলোচনার চেয়ে রাজনৈতিক সংকীর্ণতা, পরচর্চার আধিক্য লক্ষ করেছি। এর যে ব্যতিক্রম নেই তা নয়, কিন্তু তা সামান্যই। শিক্ষকদের বর্ণকেন্দ্রিক বিভক্তির বাইরে আমরা ৩ সেপ্টেম্বর হঠাৎ নতুন নামের একটি সংগঠনের আবির্ভাব দেখলাম। নামটির সঙ্গে ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট অর্থাৎ জাতীয় স্বার্থ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা খুশি হতাম যদি সেই সংগঠনের সভায় প্রকৃত জাতীয় সমস্যা আর জনস্বার্থ নিয়ে আলোচনা হতো। আমাদের জাতীয় সম্পদ নিয়ে লুটপাটের মহা-আয়োজন, নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব নিরসনের মতো বিষয় যদি আলোচনা হতো, তাহলে জাতি উপকৃত হতো। কিন্তু সেদিনের সভায় শিক্ষকেরা ব্যক্তি-বন্দনায় মালকোঁচা মেরে অংশ নিয়েছেন। ভাবতে অবাক লাগে, তাঁরা প্রায় সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক। প্রশ্ন রাখতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়নে কী করা যায়, শিক্ষার্থীদের সবাইকে ইন্টারনেট-সুবিধার আওতায় কীভাবে নিয়ে আসা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টি কেন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে—এ বিষয়ে কোনো আলোচনা সভা আহ্বান করলে এবং এসব শিক্ষকের বাসায় গিয়েও আমন্ত্রণ জানালেও কি তাঁরা এত সংখ্যায় দল বেঁধে আসতেন? আশঙ্কা এক শ ভাগ। তাহলে তাঁরা সেদিন দল বেঁধে কেন গেলেন? গেলেন তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেতা তারেকের বন্দনা-কোরাসে যোগ দিতে। সত্যিই বিস্ময়কর!
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের কাছে জাতির প্রত্যাশা সবচেয়ে বেশি। এখনো সংকটের সময় মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মানুষ মনে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা বিবেকের তাড়নায় বুদ্ধি, মেধা আর বিচক্ষণতা দিয়ে অশুভ শক্তি বিনাশের মন্ত্র মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেবেন। কিন্তু যাঁদের কাছে এই প্রত্যাশা, সেই শিক্ষকেরা আজ এমন কিছু মন্তব্য করছেন, যা আমাদের ব্যথিত করছে। তাঁরা যাঁর বন্দনা করেছেন, স্তুতি গেয়েছেন, তিনি দেশের সাম্প্রতিক রাজনীতির অনেক বিতর্কের জন্মদাতা। তাঁকে কেন্দ্র করে আমাদের নীতিহীন রাজনীতির বৃক্ষে অনেক ডাল ও পত্র পল্লবিত হয়েছে; যা শুধু তাঁরই নয়, তাঁর পরিবার, দল—সর্বোপরি আমাদের কারও জন্য সুখকর নয়। তাঁর নেতৃত্বে হাওয়া ভবনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ‘তরুণ তুর্কিরা’ যে কতটা বেপরোয়া আর ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিল, এ জাতি তা জানে। সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট, স্বজনপ্রীতি, বিদেশে কোটি কোটি টাকা পাচারের সঙ্গে হামেশা যাঁর নাম উচ্চারিত হয়, যে নাম রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্লাসে দুর্নীতির সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহূত হয়, তাঁকে নিয়ে এই প্রশংসা; আর প্রশংসাকারী হচ্ছেন মহান পেশায় নিয়োজিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত(?) শিক্ষকেরা! এ লজ্জা রাখি কোথায়?
জরুরি অবস্থার পর বিএনপি দুর্নীতির দুর্গ-খ্যাত ওই হাওয়া ভবন ত্যাগ করেছিল নিভৃতে; জানা যায়, তারেক রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিএনপির চেয়ারপারসন বা তাঁদের দলের নেতারা ওই পথ আর মাড়াননি। এই ভবন এখনো তাঁদের বিব্রত করে। এই নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, জনপ্রশাসন ধ্বংস, জঙ্গিবাদের উত্থান, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, দুর্বৃত্তদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, খুনিকে অর্থের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার মতো নিকৃষ্ট কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ শুধু আওয়ামী লীগের কর্মীরাই করেন এমনটি নয়, দেশের মানুষও অনেকাংশে তা বিশ্বাস করে। অথচ শিক্ষকেরা তাঁরই বন্দনায় মেতে উঠেছেন। বন্দনা-সভায় উপস্থিতদের কেউ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, কেউ পদার্থবিজ্ঞানী, কেউ জীববিজ্ঞানী বা কেউ সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত। আলোচকদের কেউ কবিতার ভাষায়, কেউ করুণ কণ্ঠে, কেউ বা ভবিষ্যৎ বেত্তা হিসেবে জ্বালাময়ী, চাটুরসসমৃদ্ধ আর আবেগঘন বক্তৃতা করেছেন। ওই সভায় উদ্বিগ্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী, বন্দনাকারীরা কোনো না কোনোভাবে তারেককে মহান নেতা বানানোর চেষ্টা করেছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে, এঁরা কি বুদ্ধিজীবী! এত নিচে নামতে পারে শিক্ষকদের সাংস্কৃতিক রুচি, এই নৈতিক অধঃপতন জাতির জন্য সত্যিই ভয়ংকর আর বিপজ্জনক!
আজ এ কথা বলার সময় এসেছে যে সামরিক শাসকেরা রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্যই শুধু কঠিন করেননি, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত(?) কিছু মানুষের বোধশক্তিকে ধ্বংস করেছেন, সমাজে সীমাহীন লোভ তৈরি করেছেন আর বিবেককে বন্ধক দিতে প্ররোচিত করেছেন। তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকেরা কেন তাঁদের সন্তানের বয়সী একজন বহুল বিতর্কিত ‘রাজনৈতিক-আপদে’র বন্দনা করতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন? হয়তো রাজনৈতিক আনুকূল্য নিয়ে আরও বেশি হালুয়া-রুটির ভাগ নেওয়া। আগে যিনি হালুয়া পেয়েছেন, তাঁর লক্ষ্য ভবিষ্যতে আরও বেশি অংশীদারি। তাঁরা বিবেক বন্ধক রেখে প্রতিযোগিতায় নামেন, ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন বলেই আজ আর শিক্ষকদের মধ্যে আবদুর রাজ্জাক, সরদার ফজলুল করিম, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আনিসুজ্জামান কিংবা হুমায়ুন আজাদদের প্রতিচ্ছবি দেখি না। এটা শুধু লজ্জারই নয়, শঙ্কারও। সমাজকে, বুদ্ধি-বিচক্ষণতাকে, শিক্ষিত মানুষের মগজ আর ব্যক্তিত্বকে লোভ-নীতিহীনতা যখন গ্রাস করেছে, অবক্ষয় যখন গাঢ় হচ্ছে, তখন আমাদের বাতিঘরগুলোর আলো নিভে যাচ্ছে; এখান থেকে মুক্তি মিলবে কবে? তারেক-জয়ের বন্দনা শুনতে চাই না, জাতির আলোকিত সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছ থেকে সত্য-ন্যায় আর সুন্দরের কথা শুনতে চাই, তা যদি নির্মমও হয়। কিন্তু কষ্টের ব্যাপার হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশ আজ নিজেদের মৌলিক পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় না, শ্রেণীকক্ষে ছাত্রদের সক্রেটিসের দর্শন পড়ালেও নিজেরা সত্য কথাটি বলতে চান না। তাঁরা পরিচিত হতে চান আওয়ামী বা বিএনপিপন্থী শিক্ষক হিসেবে, আর সেই কারণে হয়তো ক্যাম্পাসে ব্যানার হাতে মিছিল করেন নেতা বা নেত্রীর নামের মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন না করে মাসের পর মাস ফেলে রেখে পরচর্চা আর বন্দনায় সময় ব্যয় করেন, রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে গিয়ে ‘হাজিরা খাতায় নাম তুলতে’ ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ অবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে কবে? আদৌ মিলবে কি?
লেখকেরা: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও প্রকৌশলী।
‘দেশের আকাশ-বাতাসসহ প্রতিটি কণা আজ “আমি তারেক জিয়া বলছি” ডাকটি শুনতে চায়।’ বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এভাবেই বন্দনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন আবুল বাশার। প্রধান আলোচক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘তারেক রহমান জিয়াউর রহমানের সুযোগ্য পুত্র হওয়ায় তাঁকে ভালোবাসি। তাঁকে ভালোবাসি, কারণ, তিনি একজন সুযোগ্য নেতার কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছেন।’ কলা অনুষদের ডিন সদরুল আমিন বলেন, ‘আমরা চাই, তারেক জিয়া আমাদের মাঝে ফিরে আসুন। তাঁর বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে, তা দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে সরকার তুলে নেবে বলে আমরা আশা করি।’ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন তাজমেরী এস এ ইসলাম বলেন, ‘ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে তারেক রহমানের সুদৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত জেনেই তারা উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছে। তারেক রহমান দেশের বাইরে বসে আত্মসমালোচনা ও আত্মবিশ্লেষণ করছেন।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম বলেন, ‘তারেক রহমান তারুণ্যের অহংকার। তাঁর দেহে দেশপ্রেম ও স্বাধীনচেতার রক্ত বইছে। জনগণ তাঁকে দেশের নেতৃত্বে দেখতে চায়।’ অধ্যাপক আবদুল আজিজ বলেন, ‘আজ আমরা মিছিলে মিছিলে বাকশালের আওয়াজ শুনতে পাই। এদের থামাতে হবে। এ জন্য প্রাণপ্রিয় নেতা তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন দরকার।’ অধ্যাপক আকতার হোসেন বলেন, ‘তারেক রহমানকে তাঁর পিতার গুণে গুণান্বিত হতে হবে। তা থেকে বিচ্যুতি ঘটলে মনে রাখতে হবে, ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।’ (প্রথম আলো, ৪ সেপ্টেম্বর, পৃষ্ঠা-৩)
পাঠক, আপনারাই বিচার করুন, এসব স্তুতি কোনো শিক্ষকের মুখ থেকে বের হতে পারে? নাকি বের হওয়া উচিত? নৈতিকতা, সাংস্কৃতিক মান আর রুচিবোধ তাহলে কোথায় গিয়ে ঠেকল? এত দিন আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গাঢ় নীল, ধবধবে সাদা, হালকা গোলাপি, মেজেন্টা, ফিরোজা ইত্যাকার নানাবিধ রঙে রঞ্জিত/বিভক্ত হতে দেখেছি। আর সেই বিভক্তির কারণে শিক্ষকদের মধ্যে শিক্ষার গুণগত উৎকর্ষের আলোচনার চেয়ে রাজনৈতিক সংকীর্ণতা, পরচর্চার আধিক্য লক্ষ করেছি। এর যে ব্যতিক্রম নেই তা নয়, কিন্তু তা সামান্যই। শিক্ষকদের বর্ণকেন্দ্রিক বিভক্তির বাইরে আমরা ৩ সেপ্টেম্বর হঠাৎ নতুন নামের একটি সংগঠনের আবির্ভাব দেখলাম। নামটির সঙ্গে ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট অর্থাৎ জাতীয় স্বার্থ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা খুশি হতাম যদি সেই সংগঠনের সভায় প্রকৃত জাতীয় সমস্যা আর জনস্বার্থ নিয়ে আলোচনা হতো। আমাদের জাতীয় সম্পদ নিয়ে লুটপাটের মহা-আয়োজন, নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব নিরসনের মতো বিষয় যদি আলোচনা হতো, তাহলে জাতি উপকৃত হতো। কিন্তু সেদিনের সভায় শিক্ষকেরা ব্যক্তি-বন্দনায় মালকোঁচা মেরে অংশ নিয়েছেন। ভাবতে অবাক লাগে, তাঁরা প্রায় সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক। প্রশ্ন রাখতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়নে কী করা যায়, শিক্ষার্থীদের সবাইকে ইন্টারনেট-সুবিধার আওতায় কীভাবে নিয়ে আসা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টি কেন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে—এ বিষয়ে কোনো আলোচনা সভা আহ্বান করলে এবং এসব শিক্ষকের বাসায় গিয়েও আমন্ত্রণ জানালেও কি তাঁরা এত সংখ্যায় দল বেঁধে আসতেন? আশঙ্কা এক শ ভাগ। তাহলে তাঁরা সেদিন দল বেঁধে কেন গেলেন? গেলেন তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেতা তারেকের বন্দনা-কোরাসে যোগ দিতে। সত্যিই বিস্ময়কর!
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের কাছে জাতির প্রত্যাশা সবচেয়ে বেশি। এখনো সংকটের সময় মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মানুষ মনে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা বিবেকের তাড়নায় বুদ্ধি, মেধা আর বিচক্ষণতা দিয়ে অশুভ শক্তি বিনাশের মন্ত্র মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেবেন। কিন্তু যাঁদের কাছে এই প্রত্যাশা, সেই শিক্ষকেরা আজ এমন কিছু মন্তব্য করছেন, যা আমাদের ব্যথিত করছে। তাঁরা যাঁর বন্দনা করেছেন, স্তুতি গেয়েছেন, তিনি দেশের সাম্প্রতিক রাজনীতির অনেক বিতর্কের জন্মদাতা। তাঁকে কেন্দ্র করে আমাদের নীতিহীন রাজনীতির বৃক্ষে অনেক ডাল ও পত্র পল্লবিত হয়েছে; যা শুধু তাঁরই নয়, তাঁর পরিবার, দল—সর্বোপরি আমাদের কারও জন্য সুখকর নয়। তাঁর নেতৃত্বে হাওয়া ভবনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ‘তরুণ তুর্কিরা’ যে কতটা বেপরোয়া আর ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিল, এ জাতি তা জানে। সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট, স্বজনপ্রীতি, বিদেশে কোটি কোটি টাকা পাচারের সঙ্গে হামেশা যাঁর নাম উচ্চারিত হয়, যে নাম রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্লাসে দুর্নীতির সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহূত হয়, তাঁকে নিয়ে এই প্রশংসা; আর প্রশংসাকারী হচ্ছেন মহান পেশায় নিয়োজিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত(?) শিক্ষকেরা! এ লজ্জা রাখি কোথায়?
জরুরি অবস্থার পর বিএনপি দুর্নীতির দুর্গ-খ্যাত ওই হাওয়া ভবন ত্যাগ করেছিল নিভৃতে; জানা যায়, তারেক রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিএনপির চেয়ারপারসন বা তাঁদের দলের নেতারা ওই পথ আর মাড়াননি। এই ভবন এখনো তাঁদের বিব্রত করে। এই নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, জনপ্রশাসন ধ্বংস, জঙ্গিবাদের উত্থান, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, দুর্বৃত্তদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, খুনিকে অর্থের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার মতো নিকৃষ্ট কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ শুধু আওয়ামী লীগের কর্মীরাই করেন এমনটি নয়, দেশের মানুষও অনেকাংশে তা বিশ্বাস করে। অথচ শিক্ষকেরা তাঁরই বন্দনায় মেতে উঠেছেন। বন্দনা-সভায় উপস্থিতদের কেউ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, কেউ পদার্থবিজ্ঞানী, কেউ জীববিজ্ঞানী বা কেউ সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত। আলোচকদের কেউ কবিতার ভাষায়, কেউ করুণ কণ্ঠে, কেউ বা ভবিষ্যৎ বেত্তা হিসেবে জ্বালাময়ী, চাটুরসসমৃদ্ধ আর আবেগঘন বক্তৃতা করেছেন। ওই সভায় উদ্বিগ্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী, বন্দনাকারীরা কোনো না কোনোভাবে তারেককে মহান নেতা বানানোর চেষ্টা করেছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে, এঁরা কি বুদ্ধিজীবী! এত নিচে নামতে পারে শিক্ষকদের সাংস্কৃতিক রুচি, এই নৈতিক অধঃপতন জাতির জন্য সত্যিই ভয়ংকর আর বিপজ্জনক!
আজ এ কথা বলার সময় এসেছে যে সামরিক শাসকেরা রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্যই শুধু কঠিন করেননি, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত(?) কিছু মানুষের বোধশক্তিকে ধ্বংস করেছেন, সমাজে সীমাহীন লোভ তৈরি করেছেন আর বিবেককে বন্ধক দিতে প্ররোচিত করেছেন। তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকেরা কেন তাঁদের সন্তানের বয়সী একজন বহুল বিতর্কিত ‘রাজনৈতিক-আপদে’র বন্দনা করতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন? হয়তো রাজনৈতিক আনুকূল্য নিয়ে আরও বেশি হালুয়া-রুটির ভাগ নেওয়া। আগে যিনি হালুয়া পেয়েছেন, তাঁর লক্ষ্য ভবিষ্যতে আরও বেশি অংশীদারি। তাঁরা বিবেক বন্ধক রেখে প্রতিযোগিতায় নামেন, ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন বলেই আজ আর শিক্ষকদের মধ্যে আবদুর রাজ্জাক, সরদার ফজলুল করিম, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আনিসুজ্জামান কিংবা হুমায়ুন আজাদদের প্রতিচ্ছবি দেখি না। এটা শুধু লজ্জারই নয়, শঙ্কারও। সমাজকে, বুদ্ধি-বিচক্ষণতাকে, শিক্ষিত মানুষের মগজ আর ব্যক্তিত্বকে লোভ-নীতিহীনতা যখন গ্রাস করেছে, অবক্ষয় যখন গাঢ় হচ্ছে, তখন আমাদের বাতিঘরগুলোর আলো নিভে যাচ্ছে; এখান থেকে মুক্তি মিলবে কবে? তারেক-জয়ের বন্দনা শুনতে চাই না, জাতির আলোকিত সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছ থেকে সত্য-ন্যায় আর সুন্দরের কথা শুনতে চাই, তা যদি নির্মমও হয়। কিন্তু কষ্টের ব্যাপার হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশ আজ নিজেদের মৌলিক পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় না, শ্রেণীকক্ষে ছাত্রদের সক্রেটিসের দর্শন পড়ালেও নিজেরা সত্য কথাটি বলতে চান না। তাঁরা পরিচিত হতে চান আওয়ামী বা বিএনপিপন্থী শিক্ষক হিসেবে, আর সেই কারণে হয়তো ক্যাম্পাসে ব্যানার হাতে মিছিল করেন নেতা বা নেত্রীর নামের মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন না করে মাসের পর মাস ফেলে রেখে পরচর্চা আর বন্দনায় সময় ব্যয় করেন, রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে গিয়ে ‘হাজিরা খাতায় নাম তুলতে’ ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ অবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে কবে? আদৌ মিলবে কি?
লেখকেরা: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও প্রকৌশলী।
No comments