মানুষের কারণেই ঝুঁকি বাড়ছে by জামিলুর রেজা চৌধুরী
বাংলাদেশে ভূমিকম্পের কারণে বড় বিপর্যয়ের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি যদিও নেই, তার পরও ভূমিকম্প হঠাৎ আসতেই পারে। ১০ সেপ্টেম্বর রাতে যে ভূমিকম্প ঢাকা মহানগরসহ বাংলাদেশের দক্ষিণের অনেক এলাকায় অনুভূত হয়েছে, সেটার মাত্রা ও তীব্রতা (magnitude & intensity) খুবই কম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেনভারে অবস্থিত ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৮ এবং এর কেন্দ্র ছিল ঢাকার ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে—দাউদকান্দির দক্ষিণে মতলব বাজারের উত্তরে। এখানে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থাপিত ১৮টি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে ভূমিকম্পের মাত্রা, কেন্দ্র ও গভীরতা নির্ণয় করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, ভূপৃষ্ঠের প্রায় নয় কিলোমিটার গভীরে এর উৎপত্তিস্থল। কিন্তু এখানে আমাদের জানামতে, নয় কিলোমিটার গভীরে পলিমাটি থাকার কথা। ভূমিকম্প সৃষ্টি হওয়ার জন্য যে ধরনের ফল্ট বা চ্যুতি থাকা পূর্বশর্ত, তা থাকলেও থাকার কথা আরও গভীরে। সে জন্য উপাত্তগুলো আরও বিশদভাবে বিশ্লেষণ করে সঠিকভাবে এর উৎপত্তিস্থল নির্ণয় করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুসারে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৬ এবং এপিসেন্টার ছিল গোপালগঞ্জের কাছে। কিসের ভিত্তিতে এই মাত্রা ও উৎপত্তিস্থল নির্ণয় করা হয়েছে, তা আবহাওয়া বিভাগের ওয়েবসাইটে এখন পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি। আবহাওয়া বিভাগ ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও রংপুরে যে চারটি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে, তার রেকর্ড বিশ্লেষণ করে আরও সঠিকভাবে এর মাত্রা ও তীব্রতা বিশ্লেষণ করা উচিত।
এ বছরে বিশ্বে বড় দুটি ভূমিকম্প হয় প্রথমে হাইতি ও পরে চিলিতে। বিশ্বে নিকট অতীতের সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পও হয় চিলিতে, ১৯৬০ সালে। তারপর গত ৪০-৫০ বছরে চিলি খুবই আধুনিক ইমারত নির্মাণ বিধিমালা প্রণয়ন করেছে এবং স্থাপনার নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণের বেলায় যাতে এটি মেনে চলা হয়, তা নিশ্চিত করায় তারা সফল হয়েছে। ফলে চিলির ক্ষয়ক্ষতি হাইতির তুলনায় কম হয়েছে। কারণ হাইতিতে কোনো ইমারত নির্মাণ বিধিমালাই নেই এবং সেখানকার ভবনগুলোর ভূমিকম্প প্রতিরোধ করার কোনো ক্ষমতাই ছিল না।
ঢাকা যতটা না প্রাকৃতিক কারণে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে, তার থেকে বেশি মানুষের কারণেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। বলা যায়, আমরাই আমাদের বিপদ ডেকে এনেছি। ঢাকায় যেভাবে নিম্ন জলাভূমি ভরাট করে ভবন নির্মিত হচ্ছে, সেগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ একই মাত্রার ভূমিকম্পে পুরান ঢাকার মাটিতে যে তীব্রতা অনুভূত হবে, নরম মাটিতে তা বেশি অনুভূত হবে।
এ বছর এবারের ভূমিকম্পসহ আগস্ট মাসে আরেকটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল চাঁদপুর অঞ্চলে। তাহলেও চাঁদপুর থেকে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা নেই। বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের উৎসস্থল হলো, শ্রীমঙ্গল, মধুপুর ও বগুড়ার ভূগর্ভের ফল্ট-সিস্টেম বা চ্যুতি। যদি মধুপুরে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, ঢাকায় এর তীব্রতা হবে ৬-৭। তাতে অনেক ক্ষতি হতে পারে। তবে মারাত্মক ভূমিকম্প এলে তা আসবে ভুটান ও নেপাল থেকে। সেখানে ৯ অথবা ৯ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় তা ৭ অথবা ৮ মাত্রার কম্পন হিসেবে অনুভূত হবে।
সরকার সম্প্রতি ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বাধ্যতামূলক করেছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। এর সঙ্গে সংস্লিষ্ট সংস্থাগুলো, যেমন রাজউকের প্রয়োজনীয় জনবল নেই, দক্ষতারও অভাব। জরুরি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এই ঘাটতি দ্রুতই পূরণ করতে হবে। বর্তমান ইমারত নির্মাণ বিধিমালা এ বছরের শেষের দিকে সংস্কার করে আরও উন্নত করা হবে। আশা করা যায়, ২০১১ সালে আমরা নতুন বিধিমালা পাব। এটা যাতে কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। বিনা অনুমতিতে যেভাবে নিচু জমি ও জলাধার ভরাট করে আবাসন-ব্যবসায়ীরা ভবন নির্মাণের জন্য প্লট বিক্রি করছেন, তাতে ঝুঁকি আরও অনেক বেড়ে যাচ্ছে।
ভূমিকম্পে দুর্বল ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রচুর প্রাণহানিও হতাহতের আশঙ্কাও থাকবে। এ জন্য প্রয়োজন ভূমিকম্প-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থা। ধসেপড়া ভবনের নিচে কোনো মানুষ জীবিত আছে কি না, তা নির্ণয়ের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা আবশ্যক। এ ছাড়া ধসেপড়া অংশকে সরানোর প্রযুক্তি আমাদের দেশে প্রায় নেই বললেই চলে। ফায়ার সার্ভিস স্টেশন ও হাসপাতালকে দ্রুত শক্তিশালী করা দরকার, কারণ এগুলো ভেঙে পড়লে সমগ্র ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকার সম্প্রতি যে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে, তার মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে এলাকাভিত্তিক উদ্ধারকাজ করা সম্ভব। তবে বর্তমানে এটি ঢাকা মহানগরের কয়েকটি ওয়ার্ডে সীমিত। এ কার্যক্রম মহানগরের সব এলাকায় এবং ঝুঁকিপূর্ণ বড় শহরে সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন।
জামিলুর রেজা চৌধুরী: সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটি।
বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুসারে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৬ এবং এপিসেন্টার ছিল গোপালগঞ্জের কাছে। কিসের ভিত্তিতে এই মাত্রা ও উৎপত্তিস্থল নির্ণয় করা হয়েছে, তা আবহাওয়া বিভাগের ওয়েবসাইটে এখন পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি। আবহাওয়া বিভাগ ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও রংপুরে যে চারটি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে, তার রেকর্ড বিশ্লেষণ করে আরও সঠিকভাবে এর মাত্রা ও তীব্রতা বিশ্লেষণ করা উচিত।
এ বছরে বিশ্বে বড় দুটি ভূমিকম্প হয় প্রথমে হাইতি ও পরে চিলিতে। বিশ্বে নিকট অতীতের সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পও হয় চিলিতে, ১৯৬০ সালে। তারপর গত ৪০-৫০ বছরে চিলি খুবই আধুনিক ইমারত নির্মাণ বিধিমালা প্রণয়ন করেছে এবং স্থাপনার নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণের বেলায় যাতে এটি মেনে চলা হয়, তা নিশ্চিত করায় তারা সফল হয়েছে। ফলে চিলির ক্ষয়ক্ষতি হাইতির তুলনায় কম হয়েছে। কারণ হাইতিতে কোনো ইমারত নির্মাণ বিধিমালাই নেই এবং সেখানকার ভবনগুলোর ভূমিকম্প প্রতিরোধ করার কোনো ক্ষমতাই ছিল না।
ঢাকা যতটা না প্রাকৃতিক কারণে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে, তার থেকে বেশি মানুষের কারণেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। বলা যায়, আমরাই আমাদের বিপদ ডেকে এনেছি। ঢাকায় যেভাবে নিম্ন জলাভূমি ভরাট করে ভবন নির্মিত হচ্ছে, সেগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ একই মাত্রার ভূমিকম্পে পুরান ঢাকার মাটিতে যে তীব্রতা অনুভূত হবে, নরম মাটিতে তা বেশি অনুভূত হবে।
এ বছর এবারের ভূমিকম্পসহ আগস্ট মাসে আরেকটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল চাঁদপুর অঞ্চলে। তাহলেও চাঁদপুর থেকে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা নেই। বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের উৎসস্থল হলো, শ্রীমঙ্গল, মধুপুর ও বগুড়ার ভূগর্ভের ফল্ট-সিস্টেম বা চ্যুতি। যদি মধুপুরে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, ঢাকায় এর তীব্রতা হবে ৬-৭। তাতে অনেক ক্ষতি হতে পারে। তবে মারাত্মক ভূমিকম্প এলে তা আসবে ভুটান ও নেপাল থেকে। সেখানে ৯ অথবা ৯ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় তা ৭ অথবা ৮ মাত্রার কম্পন হিসেবে অনুভূত হবে।
সরকার সম্প্রতি ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বাধ্যতামূলক করেছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। এর সঙ্গে সংস্লিষ্ট সংস্থাগুলো, যেমন রাজউকের প্রয়োজনীয় জনবল নেই, দক্ষতারও অভাব। জরুরি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এই ঘাটতি দ্রুতই পূরণ করতে হবে। বর্তমান ইমারত নির্মাণ বিধিমালা এ বছরের শেষের দিকে সংস্কার করে আরও উন্নত করা হবে। আশা করা যায়, ২০১১ সালে আমরা নতুন বিধিমালা পাব। এটা যাতে কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। বিনা অনুমতিতে যেভাবে নিচু জমি ও জলাধার ভরাট করে আবাসন-ব্যবসায়ীরা ভবন নির্মাণের জন্য প্লট বিক্রি করছেন, তাতে ঝুঁকি আরও অনেক বেড়ে যাচ্ছে।
ভূমিকম্পে দুর্বল ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রচুর প্রাণহানিও হতাহতের আশঙ্কাও থাকবে। এ জন্য প্রয়োজন ভূমিকম্প-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থা। ধসেপড়া ভবনের নিচে কোনো মানুষ জীবিত আছে কি না, তা নির্ণয়ের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা আবশ্যক। এ ছাড়া ধসেপড়া অংশকে সরানোর প্রযুক্তি আমাদের দেশে প্রায় নেই বললেই চলে। ফায়ার সার্ভিস স্টেশন ও হাসপাতালকে দ্রুত শক্তিশালী করা দরকার, কারণ এগুলো ভেঙে পড়লে সমগ্র ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকার সম্প্রতি যে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে, তার মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে এলাকাভিত্তিক উদ্ধারকাজ করা সম্ভব। তবে বর্তমানে এটি ঢাকা মহানগরের কয়েকটি ওয়ার্ডে সীমিত। এ কার্যক্রম মহানগরের সব এলাকায় এবং ঝুঁকিপূর্ণ বড় শহরে সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন।
জামিলুর রেজা চৌধুরী: সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটি।
No comments