তাহলে তিনি কি প্রদেশের নেত্রী by সোহরাব হাসান
বিএনপির নতুন জাতীয় নির্বাহী কমিটির প্রথম বৈঠকে বেগম খালেদা জিয়া ১৮ মাস বয়সী মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সরকারের চতুর্মুখী ব্যর্থতার কারণে জনজীবনে যে নাভিশ্বাস উঠেছে, তাকে কাজে লাগাতে হবে। রোজার পর আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে বলেও আগাম ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির নেত্রী। এর পাশাপাশি তিনি সরকারের পররাষ্ট্রনীতির সমালোচনা করে বলেছেন, ‘প্রতিবেশি দেশকে চট্টগ্রাম ও মংলাবন্দর ব্যবহার এবং ট্রানজিট দেওয়ার জন্য সরকার চুক্তি করেছে। এব বদলে আমরা পাইনি কিছুই।’ (নয়া দিগন্ত, ১ আগস্ট ২০১০) তাঁর এ বক্তব্যে দোষের কিছু নেই। সরকারের গৃহীত চুক্তি বা পদক্ষেপের সমালোচনা করার অধিকার তাঁর আছে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেকোনো ব্যক্তি মতপ্রকাশ করতে পারেন। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনেরও ডাক দিতে পারেন। কিন্তু একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশকে তিনি প্রদেশে পরিণত করতে পারেন না। অথচ খালেদা জিয়া সেই কাজটিই করেছেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠকে দেওয়া উদ্বোধনী ভাষণে। তিনি বলেছেন, ‘সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে এ দেশ একটি অধীনস্থ প্রদেশে পরিণত হয়েছে।’ (নয়া দিগন্ত)
কোন দেশের অধীনস্থ হয়েছে, সেটি খালেদা জিয়া খোলসা না করলেও কী কারণে হয়েছে তা স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন—শেখ হাসিনা সরকারের নতজানুনীতির কারণে।
বিএনপির নেত্রী কি বুঝেশুনেই কথাটি বলেছেন? দেশ ‘অধীনস্থ প্রদেশ’ হলে তিনিও তো স্বাধীন দেশের সার্বভৌম সংসদের বিরোধী দলের নেত্রী থাকেন না। হয়ে যান অধীনস্থ প্রাদেশিক আইনসভার বিরোধী দলের নেত্রী। তাঁর পদমর্যাদাও স্বাধীন দেশের মন্ত্রীর নয়, প্রাদেশিক মন্ত্রীর। বেগম খালেদা জিয়া কি নিজেকে তা-ই মনে করেন? তিনি কি দেশের মানুষকে আহাম্মক ভাবেন? আবোল-তাবোল যা বলবেন, তারা সেটাই মুখ বুজে মেনে নেবে!
আমাদের মনে আছে, ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগের সরকার যখন পার্বত্য চুক্তি সই করেছিল, তখন খালেদা জিয়া এর বিরোধিতা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এর ফলে বাংলাদেশের এক-দশমাংশ এলাকা বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে যাবে। ফেনীর ওপারে ভারতীয় পতাকা উড়বে।’ পার্বত্য চুক্তির পর ১৩ বছর অতিবাহিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। সেখানে ভারতীয় পতাকাও ওড়েনি। শান্তিচুক্তির পর খালেদা জিয়া পাঁচ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি চুক্তি বাতিল করেননি; বরং বাস্তবায়নের লক্ষ্যে লোক দেখানো হলেও একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। তাঁর কাছে জানতে চাই, দেশের এক-দশমাংশ এলাকা হাতছাড়া করতেই কি তিনি কমিটি গঠন করেছিলেন? আমাদের নেতা-নেত্রীরা বিরোধী দলে থাকতে এক কথা বলেন, ক্ষমতায় গিয়ে উল্টো কাজ করেন।
প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘তারা (আওয়ামী লীগ) ক্ষমতায় এলে মসজিদে আজান শোনা যাবে না, উলুধ্বনি শোনা যাবে।’ জনগণ তাঁর কথায় কান দেয়নি; তারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছিল এবং মসজিদে আজানও শোনা যাচ্ছে। আরেকবার ভারতকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বিএনপি নেত্রী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ নেপাল ও ভুটান নয়, স্বাধীন দেশ। অতএব একে পদানত করার চেষ্টা করবেন না।’ নিজের দেশ নিয়ে গর্ব করার অধিকার সবারই আছে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর কেউ হস্তক্ষেপ করলে অবশ্যই আমরা তার সমুচিত জবাব দেব। কিন্তু নিজের দেশের মাহাত্ম্য প্রচার করতে গিয়ে অন্য দেশকে হেয় করার অধিকার কারও নেই। ওই সময় নেপাল ও ভুটান তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদও করেছিল।
আমাদের নেতা-নেত্রীরা কখন কী বলেন, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। ক্ষমতা পেলে বিরোধীদের শায়েস্তা করতে তাঁদের হাত নিশপিশ করে। আর ক্ষমতা হারালে মুখ বেসামাল হয়ে যায়। তাঁরা যুক্তির ধার ধারেন না। বিএনপির নেতারা গরম বক্তৃতা দিয়ে দেশের মানুষকে ভারতের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুললেও তাঁদের আমলেই ভারতের জন্য বাংলাদেশের বাজার খুলে দেওয়া হয়। বিএনপির লোকজনও ভারতের সঙ্গে চুটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য বেশি করছেন।
বিএনপির নেত্রী সরকারের কোন কোন চুক্তি দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছে তার একটি হিসাব দিতে পারতেন। সরকারের ভুল নীতির কুফল সম্পর্কে জনগণকে সজাগ করেও দিতে পারতেন। পারতেন সে সবের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশকে ‘অধীনস্থ প্রদেশ’ বানিয়ে ১৬ কোটি মানুষকে অপমান করতে পারেন না।
বিরোধীদলীয় নেত্রী যা বলেছেন, তা যদি সত্যি সত্যি তিনি বিশ্বাস করেন, তা হলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে তাঁর বক্তৃতা দেওয়ার কথা নয়। ‘দেশনেত্রী’ হিসেবে তাঁর প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হচ্ছে ‘অধীনস্থ প্রদেশ’টিকে স্বাধীন করা। ১৯৭১ সালে জিয়াউর রহমান দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। সে সময় খালেদা জিয়া যুদ্ধে যেতে পারেননি। এবারে সেই সুযোগ এসেছে। আর যদি তিনি যুদ্ধে যেতে রাজি না হন, তা হলে ভাবব এসব বুজরুকি, ধাপ্পাবাজি। জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল।
খালেদা জিয়ার মতো একজন নেত্রী, যিনি দু-দুবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং ভবিষ্যতেও হওয়ার আশা রাখেন, তাঁর কাছে দেশবাসী দায়িত্বশীল বক্তব্য ও আচরণই আশা করে।
শুনেছি, খালেদা জিয়া যেকোনো সভা-অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়ার আগে উপদেষ্টাদের ব্রিফ নেন। তাঁরা হয় পুরো বক্তৃতা লিখে দেন অথবা নোট দেন। পররাষ্ট্র বিষয়েও তাঁর একাধিক পরামর্শক আছেন। তাঁরা কি তাঁকে ঠিকমতো পরামর্শ দিয়েছেন? বুঝেশুনে দিয়েছেন? তাঁরা যে উপদেশ বা পরামর্শই দিন না কেন, বিপদে পড়লে দায় নেবেন না। নেত্রী হিসেবে জবাবদিহি করতে হবে খালেদা জিয়াকেই। অতএব কথাবার্তা ভেবেচিন্তেই বলা উচিত।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেকোনো ব্যক্তি মতপ্রকাশ করতে পারেন। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনেরও ডাক দিতে পারেন। কিন্তু একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশকে তিনি প্রদেশে পরিণত করতে পারেন না। অথচ খালেদা জিয়া সেই কাজটিই করেছেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠকে দেওয়া উদ্বোধনী ভাষণে। তিনি বলেছেন, ‘সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে এ দেশ একটি অধীনস্থ প্রদেশে পরিণত হয়েছে।’ (নয়া দিগন্ত)
কোন দেশের অধীনস্থ হয়েছে, সেটি খালেদা জিয়া খোলসা না করলেও কী কারণে হয়েছে তা স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন—শেখ হাসিনা সরকারের নতজানুনীতির কারণে।
বিএনপির নেত্রী কি বুঝেশুনেই কথাটি বলেছেন? দেশ ‘অধীনস্থ প্রদেশ’ হলে তিনিও তো স্বাধীন দেশের সার্বভৌম সংসদের বিরোধী দলের নেত্রী থাকেন না। হয়ে যান অধীনস্থ প্রাদেশিক আইনসভার বিরোধী দলের নেত্রী। তাঁর পদমর্যাদাও স্বাধীন দেশের মন্ত্রীর নয়, প্রাদেশিক মন্ত্রীর। বেগম খালেদা জিয়া কি নিজেকে তা-ই মনে করেন? তিনি কি দেশের মানুষকে আহাম্মক ভাবেন? আবোল-তাবোল যা বলবেন, তারা সেটাই মুখ বুজে মেনে নেবে!
আমাদের মনে আছে, ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগের সরকার যখন পার্বত্য চুক্তি সই করেছিল, তখন খালেদা জিয়া এর বিরোধিতা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এর ফলে বাংলাদেশের এক-দশমাংশ এলাকা বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে যাবে। ফেনীর ওপারে ভারতীয় পতাকা উড়বে।’ পার্বত্য চুক্তির পর ১৩ বছর অতিবাহিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। সেখানে ভারতীয় পতাকাও ওড়েনি। শান্তিচুক্তির পর খালেদা জিয়া পাঁচ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি চুক্তি বাতিল করেননি; বরং বাস্তবায়নের লক্ষ্যে লোক দেখানো হলেও একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। তাঁর কাছে জানতে চাই, দেশের এক-দশমাংশ এলাকা হাতছাড়া করতেই কি তিনি কমিটি গঠন করেছিলেন? আমাদের নেতা-নেত্রীরা বিরোধী দলে থাকতে এক কথা বলেন, ক্ষমতায় গিয়ে উল্টো কাজ করেন।
প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘তারা (আওয়ামী লীগ) ক্ষমতায় এলে মসজিদে আজান শোনা যাবে না, উলুধ্বনি শোনা যাবে।’ জনগণ তাঁর কথায় কান দেয়নি; তারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছিল এবং মসজিদে আজানও শোনা যাচ্ছে। আরেকবার ভারতকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বিএনপি নেত্রী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ নেপাল ও ভুটান নয়, স্বাধীন দেশ। অতএব একে পদানত করার চেষ্টা করবেন না।’ নিজের দেশ নিয়ে গর্ব করার অধিকার সবারই আছে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর কেউ হস্তক্ষেপ করলে অবশ্যই আমরা তার সমুচিত জবাব দেব। কিন্তু নিজের দেশের মাহাত্ম্য প্রচার করতে গিয়ে অন্য দেশকে হেয় করার অধিকার কারও নেই। ওই সময় নেপাল ও ভুটান তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদও করেছিল।
আমাদের নেতা-নেত্রীরা কখন কী বলেন, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। ক্ষমতা পেলে বিরোধীদের শায়েস্তা করতে তাঁদের হাত নিশপিশ করে। আর ক্ষমতা হারালে মুখ বেসামাল হয়ে যায়। তাঁরা যুক্তির ধার ধারেন না। বিএনপির নেতারা গরম বক্তৃতা দিয়ে দেশের মানুষকে ভারতের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুললেও তাঁদের আমলেই ভারতের জন্য বাংলাদেশের বাজার খুলে দেওয়া হয়। বিএনপির লোকজনও ভারতের সঙ্গে চুটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য বেশি করছেন।
বিএনপির নেত্রী সরকারের কোন কোন চুক্তি দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছে তার একটি হিসাব দিতে পারতেন। সরকারের ভুল নীতির কুফল সম্পর্কে জনগণকে সজাগ করেও দিতে পারতেন। পারতেন সে সবের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশকে ‘অধীনস্থ প্রদেশ’ বানিয়ে ১৬ কোটি মানুষকে অপমান করতে পারেন না।
বিরোধীদলীয় নেত্রী যা বলেছেন, তা যদি সত্যি সত্যি তিনি বিশ্বাস করেন, তা হলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে তাঁর বক্তৃতা দেওয়ার কথা নয়। ‘দেশনেত্রী’ হিসেবে তাঁর প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হচ্ছে ‘অধীনস্থ প্রদেশ’টিকে স্বাধীন করা। ১৯৭১ সালে জিয়াউর রহমান দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। সে সময় খালেদা জিয়া যুদ্ধে যেতে পারেননি। এবারে সেই সুযোগ এসেছে। আর যদি তিনি যুদ্ধে যেতে রাজি না হন, তা হলে ভাবব এসব বুজরুকি, ধাপ্পাবাজি। জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল।
খালেদা জিয়ার মতো একজন নেত্রী, যিনি দু-দুবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং ভবিষ্যতেও হওয়ার আশা রাখেন, তাঁর কাছে দেশবাসী দায়িত্বশীল বক্তব্য ও আচরণই আশা করে।
শুনেছি, খালেদা জিয়া যেকোনো সভা-অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়ার আগে উপদেষ্টাদের ব্রিফ নেন। তাঁরা হয় পুরো বক্তৃতা লিখে দেন অথবা নোট দেন। পররাষ্ট্র বিষয়েও তাঁর একাধিক পরামর্শক আছেন। তাঁরা কি তাঁকে ঠিকমতো পরামর্শ দিয়েছেন? বুঝেশুনে দিয়েছেন? তাঁরা যে উপদেশ বা পরামর্শই দিন না কেন, বিপদে পড়লে দায় নেবেন না। নেত্রী হিসেবে জবাবদিহি করতে হবে খালেদা জিয়াকেই। অতএব কথাবার্তা ভেবেচিন্তেই বলা উচিত।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments