ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির ছায়া সংসদ: বিপ্লব ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যর্থ হবে
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির আয়োজনে ‘রাষ্ট্র সংস্কারের পর জাতীয় নির্বাচন গণতন্ত্রকে সুসংহত করবে’ শীর্ষক ছায়া সংসদে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতার্কিকদের পরাজিত করে কবি নজরুল সরকারি কলেজের বিতার্কিকরা বিজয়ী হয়।
অনুষ্ঠানে মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে তার দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে সাহসী, সততা ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্য ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির পক্ষ থেকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়। প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে ছিলেন ড. এস এম মোর্শেদ, অধ্যাপক শিরিনা বীথি, সাংবাদিক রাসেল আহমেদ, সাংবাদিক মো. হুমায়ুন কবীর ও সাংবাদিক আমেনা আক্তার হীরা। প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ী দলকে ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।
ছায়া সংসদের বিতর্ক চলাকালীন সময়ে রাষ্ট্র সংস্কারের পর জাতীয় নির্বাচন গণতন্ত্রকে সুসংহত করার পক্ষে সংসদে প্রস্তাব উত্থাপন করেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতার্কিকরা। একেকজন বক্তা চার মিনিটের বক্তব্যে সবার আগে রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন। তারা বলেন, ছয়টি সংস্কার কমিশন করা হয়েছে। এই সংস্কারের মধ্যদিয়ে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়া হবে। তারপরেই নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের হাতে ক্ষমতা দেয়া হবে। সরকারি দলের বক্তব্যে রাষ্ট্র সংস্কার না হলে ফ্যাসিস্টরা আবারো ফিরে আসবে বলে বক্তব্যে উঠে আসে। অপরদিকে বিরোধিতা করেন কবি নজরুল সরকারি কলেজের বিতার্কিকরা। তারাও সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে দ্রুত নির্বাচন দেয়ার আহ্বান জানান। তারা সংসদে সরকারি দলকে প্রশ্ন করেন, কতোদিনে এই সংস্কার করা হবে। আর সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। এটা যেকোনো সরকার ক্ষমতায় গেলে তা করতে পারবে বলে ছায়া সংসদের বিতর্কে উঠে আসে। সরকারি দলে শেকৃবি’র পক্ষে সংসদীয় নেতা হিসেবে বক্তব্য রাখেন মরিয়ম জামিলা মারিয়া। তার সঙ্গে মন্ত্রী হিসেবে বক্তব্য রাখেন ফাহমিদা হাসান দিশা ও সংসদ সদস্য ছিলেন সাইফ আল সুফিয়ান। অন্যদিকে বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্য দেন কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী শাফায়াতুর রহমান। এ ছাড়া বিরোধীদলীয় উপনেতা ছিলেন আসিফ আলমগীর ও বিরোধী সংসদ সদস্য ছিলেন শাহীন আলম।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মতিউর রহমান চৌধুরী এক প্রশ্নের জবাবে দেশে সেনা শাসন আসার শঙ্কা নেই বলে জানান। তিনি বলেন, এখনকার যুগে সেনা শাসন সম্ভব নয়। সেনা শাসন হলে উন্নয়ন সহযোগীরা সহায়তা বন্ধ করে দেবে। আমেরিকা, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সেনা শাসনের বিপক্ষে। তবে বিপ্লব ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যর্থ হবে। আর বাংলাদেশ ব্যর্থ হলে আমরা অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি হবো।
তিনি বলেন, আপনারা নিশ্চয়ই জানেন তিউনিশিয়া ও মিশরে বিপ্লব হয়েছিল। তিউনিশিয়াতে এসেছে একটা দুর্বল গণতন্ত্র। আর মিশরে সেনাশাসন এসেছে। বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে। মানুষ হতাশ হয়েছে। আমাদের এখানে সেই আশঙ্কা যে নেই, তা কিন্তু বলা যাবে না। এ কারণে আমাদের সম্মিলিতভাবে রুখতে হবে। স্লোগান দিলেই সংস্কার হবে না। আর এই সরকারও শক্তিশালী হবে না। আপনি দেখেন, প্রতিদিন দাবি জানানো হচ্ছে। আগে এই দাবিগুলো কোথায় ছিল?
ড. ইউনূস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রফেসর ইউনূসকে আমরা পেয়েছি। প্রফেসর ইউনূসের সমস্যাটা কি? অবশ্যই সমস্যা আছে। একদিকে শান্তিতে তিনি নোবেল বিজয়ী। তিনি মানুষের উপর কঠোর হতে পারেন না। শেখ হাসিনার মতো গুলি চালাতে পারেন না। তার পুরস্কার তাকে বাধা দিচ্ছে। আরেকটা হচ্ছে তিনি সরকার প্রধান। এই দুইয়ের কন্ট্রাডিকশনের কারণে সরকার দুর্বল।
দেশের চলমান পরিস্থিতিতে সংবিধানকে পুনর্লিখন না করে সংস্কার করা যায় বলে মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, সংবিধান পুনর্লিখন নয়, সংস্কার করা যেতে পারে। পুনর্লিখন করলে বিপদ হবে।
মানবজমিন প্রধান সম্পাদক আরও বলেন, জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচার বিলম্ব হলে ফ্যাসিস্টরা আবার ফিরে আসার ঝুঁকি রয়েছে। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রাপ্তিতেও সংশয় তৈরি হবে।
দেশ নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, নানা ষড়যন্ত্র হচ্ছে এখন। এই ষড়যন্ত্রের মধ্যদিয়ে আমি আগেই বলেছিলাম রাষ্ট্র গঠনের যে মূল চেতনা এই চেতনা যদি কোনো কারণে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে তাহলে আমরা সবাই অপরাধী হবো। আমাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে। আর জবাবদিহিতা নাই বলেই আজকে বাংলাদেশের এই সংকট।
মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, আজকের এই ছায়া সংসদে যে বিতর্ক হলো এই বিতর্ক থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। আমি অনেক কিছু শিখেছি। আপনারা রাজনীতিবিদদের সামনে এই কথাগুলো যদি বলতে পারতেন, তাহলে তারা বুঝতেন কোথায় ভুল করছেন।
সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, সীমাহীন অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম, হামলা-মামলা, গুম-খুন করার চরম পরিণতিতে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মুখে এক কাপড়ে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে পতিত সরকারের প্রধান সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে। বিগত সরকারের শাসনামলে অন্যায়, দুর্নীতি, দুঃশাসন প্রতিরোধের অংশ হিসেবে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ শুরু করেছে বর্তমান সরকার। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কতোদিন হওয়া উচিত তা নিয়ে টানাপড়েন শুরু হয়েছে। আমি মনে করি এক-দেড় বছরের আগে নির্বাচন হলে বিদ্যমান ব্যবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হবে না। জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য একটা যৌক্তিক সময় অন্তর্বর্তী সরকারকে দেয়া উচিত। তা না হলে ছাত্র-জনতা যে ম্যান্ডেট দিয়ে বর্তমান সরকারকে দায়িত্ব প্রদান করেছে, সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য সরকার অর্জন করতে পারবে না। তবে অবশ্যই যত দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্ভব রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দূরত্ব বাড়লে সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাবে। সকল রাজনৈতিক দলকে খেয়াল রাখতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা হলে স্বৈরাচারের পতনের সুফল বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বৈরাচারের হাত থেকে দেশ মুক্তি পেলেও আমাদের মুক্তির আন্দোলন এখনো শেষ হয়নি। ডামি নির্বাচন যারা করেছে, দিনের ভোট রাতে নিয়েছে, শতভাগ ভোট কাস্ট করেছে, মৃত মানুষ ভোট দিয়েছে, নাবালক শিশুদের দিয়ে ভোট দেওয়ানো হয়েছে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। যারা দুর্নীতির লক্ষ্যে গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করেছে, আয়নাঘর সৃষ্টি করেছে, গুম-খুন ও হত্যার রাজনীতি করেছে তাদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত মুক্তির আন্দোলন শেষ হবে না।
No comments