রাজনৈতিক বিবেচনায় কর্মচ্যুত সামরিক কর্মকর্তাদের পুনর্বহাল দাবি

বিগত সরকারের আমলে সামরিক কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক কারণে বরখাস্ত ও তাদের ওপর নিপীড়নের প্রতিবাদ জানিয়ে বঞ্চিত সামরিক  কর্মকর্তাদের চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি জানানো হয়েছে। গতকাল রাজধানীর মহাখালীর রাওয়া কনভেনশন হলের ঈগল হলে বৈষম্যমুক্ত সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশ ২.০ বিনির্মাণে প্রয়োজনীয় রূপরেখা শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানান তারা। সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর সাবেক বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলম উপস্থিত ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক কারণে বরখাস্ত ও বৈষম্যের মাধ্যমে নিপীড়িত এসব কর্মকর্তাদের অন্য দাবিগুলো হলো- বঞ্চিত অফিসারদের পুনর্বাসন এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান। এ ছাড়া সামরিক বাহিনীতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে কমিশন গঠন করে সামরিক আইনের সংস্কারের দাবি জানান তারা। সেমিনারে রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার হওয়া প্রাক্তন সামরিক অফিসাররা বৈষম্যহীন ও পেশাদার সামরিক বাহিনী গঠনের গুরুত্ব তুলে ধরেন। পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে চলমান বৈষম্য, রাজনৈতিক প্রভাব এবং ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে সামরিক বাহিনীর ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট সংকটের বিষয়ে গভীর বিশ্লেষণ করা হয়। বক্তারা উল্লেখ করেন যে, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামরিক বাহিনীর রাজনীতিকরণ এবং ক্ষমতাসীনদের হস্তক্ষেপের ফলে এর পেশাদারিত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হত্যা, গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ছাড়াও অযৌক্তিক বিচারে বিভিন্নভাবে চাকরিচ্যুতির বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে।

সামরিক বাহিনীকে দেশের প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পুনর্গঠন করা প্রয়োজন, যাতে এটি রাজনৈতিক স্বার্থ থেকে মুক্ত থাকে। সেমিনারে আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল সামরিক বাহিনীর ভেতরে বিদ্যমান বৈষম্যের শিকার হওয়া অফিসারদের ঘটনাসমূহ। বক্তাদের কথায় উঠে আসে কীভাবে মেধাবী কর্মকর্তা ও সদস্যদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক বরখাস্ত এবং তাদের পেশাদার জীবনে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। নারী কর্মকর্তারাও তাদের দক্ষতা এবং পেশাদারিত্বের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন, কিন্তু তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে। আলোচকগণ ‘বাংলাদেশ ২.০’ বিনির্মাণে সামরিক বাহিনীর রূপরেখা তুলে ধরে বলেন, সামরিক বাহিনীর মধ্যে চলমান বৈষম্য এবং রাজনৈতিক প্রভাবের অবসান ঘটিয়ে একটি মেধাবী ও ন্যায়বিচারপূর্ণ বাহিনী গড়ে তোলা সম্ভব যা শুধু দেশের নিরাপত্তার সেবা করবে না, বরং দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে। বৈষম্যের শিকার হওয়া সামরিক বাহিনীর দক্ষ সদস্যদের অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে নতুন বাংলাদেশের অবকাঠামো, প্রযুক্তি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করতে হবে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে সরকারকে সামরিক আইন সংস্কারের জন্য এবং বঞ্চিত অফিসারদের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কমিশন তৈরির আহ্বান জানানো হয়। এ ছাড়াও, বরখাস্ত ও নিপীড়িত সামরিক কর্মকর্তাদের চাকরিতে পুনর্বহালসহ একটি আর্থিক পুনর্বাসন প্যাকেজ বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়।

বক্তারা যা বললেন-
সেমিনারে লেফটেন্যান্ট (অব.) সাইফুল্লাহ খান সেনাবাহিনী প্রধানের প্রশংসা করে বলেন, আমরা বিশ্বাস করি আমাদের সেনাবাহিনী প্রধান অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ এবং দয়ালু, উনি জুনিয়র অফিসারদের মনের ভাষা বুঝেন। সেনাপ্রধান এই সপ্তাহের মধ্যে আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন এবং আমাদের কথা শুনে তিনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। অনুষ্ঠানের সমন্বয়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাসান নাসির বলেন, বিগত ১৫ বছরে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় চাকরিচ্যুত সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়ে আমরা বৈঠক করি। সবার অভিযোগ আমরা একত্রিত করে চাকরি ফিরে পাবার দরখাস্ত দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেই। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১লা সেপ্টেম্বর সংশ্লিষ্ট বাহিনীর সার্ভিস হেডকোয়ার্টারে আমরা আবেদনগুলো জমা দেই। সার্ভিস হেডকোয়ার্টারের ভূমিকায় সন্তুষ্ট না হয়ে ৫ই সেপ্টেম্বর আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে এগুলো জমা দেই। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের বঞ্চনার সুরাহা পেলেও দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা ও সৈনিকরা তাদের প্রতি ঘটা অবিচারের সুরাহা পাননি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো রিভিউ বোর্ড বা কোনো তদন্ত কমিটিও গঠন এখন পর্যন্ত করেনি। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা জীবনবাজি রেখে এ দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকেন। তিনি বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর প্রায় ৪শ’র বেশি সদস্য বিগত ১৫ বছরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় ও মতাবলম্বী হওয়ার কারণে তাদের চাকরিচ্যুতি ছাড়াও মানসিক ও শারীরিক নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে। এটা শুরু হয় বিডিআর বিদ্রোহের পর থেকে। কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়, এর মধ্যে আমিও একজন। হাসান নাসির আরও বলেন, বিডিআর বিদ্রোহে দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তা হত্যা তৎকালীন পুলিশ, র‍্যাব, এনএসআই এবং ডিজিএফআইয়ের কতিপয় কর্মকর্তাদের মদত ছাড়া সম্ভব নয়। একইভাবে ৫ই মে শাপলা হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী সময়ে ঘটা গুম-খুনের ঘটনায় তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব ছিল না। তারেক সিদ্দিকী ও জিয়াউল আহসানের পাশাপাশি অনেক সেনা কর্মকর্তা এসব ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। অনুষ্ঠানে আয়নাঘরে বন্দির অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে লে: কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান বলেন, ২৮ বছর চাকরি জীবনে কোনো অপরাধ করিনি। জঙ্গি দমন থেকে শুরু করে নানা ধরনের অপরাধ কার্যক্রম বন্ধে ভূমিকা রেখেছি। নিজের কর্মস্থল থেকে হাত-পা বেঁধে গুম করা হয়। শহীদ আবু সাঈদের জন্য আজ এখানে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। আওয়ামী লীগ সরকার আমাকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সঙ্গে কাজ করতে বলেছিল। আমি রাজি হইনি। এরপর আমার প্রতি তারা অবিচার করেছে।

আওয়ামী লীগকে বিচারের সম্মুখীন না করে তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া হবে না বলে জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যতদিন পর্যন্ত মাফ না চায়, যতদিন পর্যন্ত তাদের অপকর্মের জন্য বিচারের সম্মুখীন না হয়, ততদিন তাদের রাজনীতিতে সুযোগ দেয়া হবে না। তিনি বলেন, ৪ঠা আগস্ট এই রাওয়াতে সাবেক সেনা কর্মকর্তারা একটি অনুষ্ঠান করেন। সেখানে তারা আমাদের আন্দোলনের পক্ষে মতামত তুলে ধরেন। তখন আমরা আরও সাহস পাই। এ জন্য সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানাই। একটা বিপ্লবের মধ্যদিয়ে এই সরকার এসেছে। তাই তাদের কাছে যে প্রত্যাশা সেই প্রত্যাশা আমরা এখনো পাইনি। দুই মাস পার হয়েছে। এখন এই সরকারের কাছে প্রশ্ন করার সময় এসেছে পিলখানা হত্যা ঘটনায় তারা কী পদক্ষেপ নিয়েছে। তিনি বলেন, বিদ্যমান সংবিধান আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে না। তাই বিদ্যমান সংবিধান বাতিল করতে হবে। হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ডিজিএফআই নিয়ে অনেক কথা উঠেছে। আমার মনে হয় তাদের ভেতর থেকে এসব নিয়ে বক্তব্য আসা উচিত। তা নাহলে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার দায়ভার তাদের নিতে হবে। তাদের কাছ থেকে সংস্কার প্রস্তাব আসা উচিত। অতীতে আর্মি আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। জেনারেল তারেক সিদ্দিক ও জিয়াউল আহসান ‘র’-এর হয়ে কাজ করেছে। তারা ‘র’-এর এদেশের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করেছে। ক্যান্টনমেন্টে ‘র’-এর অফিস স্থাপন করেছিল। তিনি বলেন, আমরা কনস্টিটিউশনাল ও ইনস্টিটিউশনাল রিফর্ম চাই।

আওয়ামী লীগ সরকার দেশে গণতন্ত্র হত্যা করেছে। তাই তিনটি সংসদে যারা মন্ত্রী ও এমপি হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করতে হবে। রাষ্ট্র থেকে তারা যেসব সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন সেসব ফেরত দিতে হবে। তিনি বলেন, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনার পতন ঘটানো হয়েছে। ওটা ছিল সর্বজনীন আন্দোলন। তাই সবাইকে সঙ্গে নিয়েই দেশ গঠন করতে হবে। তিনি বলেন, ৫ই আগস্টের আগে এক ধরনের আন্দোলন হয়েছে। আর এখন আরেক ধরনের আন্দোলন করতে হবে। এটা হবে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন। তাই বলতে চাই-আমাদের আন্দোলন শেষ হয়ে যায়নি। সেমিনারে ছাত্র-আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, ফ্যাসিস্টদের দোসরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে এই সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের শুধু চাকরিচ্যুত করলেই হবে না তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তা নাহলে ওইসব দোসররা পরবর্তীতে অন্য কোনো ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর হিসেবে কাজ করবে। তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে জনগণের রক্তের উপর দিয়ে। তাই সিক্রেটগুলো ওপেন করতে হবে আর ওপেন সিক্রেটগুলোও এখন ওপেন করতে হবে।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মারুফ জামান, প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান, বিপি বার (অব.),লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফেরদৌস আজিজ (অব.), লেফটেন্যান্ট কর্নেল তৌহিদ (অব.), লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এন শাহীর, বিপি (অব.), লেফটেন্যান্ট মো: ইমরান কাজল (অব.), মেজর আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ (অব.), ক্যাপ্টেন শামস (অব.), ক্যাপ্টেন হেফাজ উদ্দিন (অব.), লেফটেন্যান্ট সাইফুল্লাহ খান (অব.), কমান্ডার মোহাম্মদ শাহরিয়ার আকন, বিএন (অব.), কমান্ডার নেসার আহমেদ জুলিয়াস, বিএন (অব.),ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মিথিলা রোয়াজা, (অব.) সহ দুই শতাধিক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ।

No comments

Powered by Blogger.