বড় মানুষদের ভাঁড় চাটুকারগণ by শায়ের খান

মোগল সম্রাট আকবরও ভাঁড় চাটুকার পছন্দ করতেন। কথিত আছে, সম্রাটের এক পরোটা ভাজা হতো এক কড়াই ঘি’য়ে আর এক বাটি শাহী হালুয়া রান্না হতো দশ কেজি ঘি’য়ে। এমন তেলে-ঘিয়ের মানুষ একটু তেলবাজি পছন্দ করবেন-এটাই স্বাভাবিক। তার সেনাপতি মানসিংহ ছিল শিখ ঘরানার। মানসিংহের ফুফুকে আকবর করলেন বিয়ে। মানে সেনাপতিকে বানিয়ে ফেললেন ভাতিজা। হয়তো আমাদের এই ঐতিহাসিক ফুফু বলিউডের সায়রা বানু বা শিল্পা শেঠীর চেয়ে কম সুন্দরী ছিলেন না।

ভাঁড় বা চাটুকার এই অঞ্চলের এক চমকপ্রদ চরিত্র। এদের দেখা যায় ধনবান বা ক্ষমতাবানদের আশপাশে। এই রাজা-বাদশাহ-সওদাগর কিংবা প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী এমন। এদের চারপাশেই  নিজেদের সেট করে নেয় ভাঁড় চাটুকাররা। এরা ছলেবলে মূল ব্যক্তিকে প্রাচীরের মতো ঘিরে রাখে। একসময় ভাঁড় চাটুকার হয়ে ওঠে আসল ব্যক্তির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।  বাঁশের চেয়ে যেমন কঞ্চি বড়।  

এ অঞ্চলে আমরা এমন এক ভাঁড়ের নাম জানি- গোপাল ভাঁড়। সে ছিল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পালিত ভাঁড়।  নির্মম সত্য হচ্ছে, ইতিহাস রচিত হয়েছে গোপাল ভাঁড়কে নিয়ে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নিক্ষিপ্ত হয়েছেন ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে।    

মোগল সম্রাট আকবরও ভাঁড় চাটুকার পছন্দ করতেন। কথিত আছে, সম্রাটের এক পরোটা ভাজা হতো এক কড়াই ঘি’য়ে আর এক বাটি শাহী হালুয়া রান্না হতো দশ কেজি ঘি’য়ে। এমন তেলে-ঘিয়ের মানুষ একটু তেলবাজি পছন্দ করবেন-এটাই স্বাভাবিক। তার সেনাপতি মানসিংহ ছিল শিখ ঘরানার। মানসিংহের ফুফুকে আকবর করলেন বিয়ে। মানে সেনাপতিকে বানিয়ে ফেললেন ভাতিজা। হয়তো আমাদের এই ঐতিহাসিক ফুফু বলিউডের সায়রা বানু বা শিল্পা শেঠীর চেয়ে কম সুন্দরী ছিলেন না।
সম্রাট আকবর ছিলেন বড় মাপের মোগল। যে বাংলা নববর্ষ পালনে ঢাকার ভং ধরা এলিটরা ২০০০ টাকা দিয়ে মাটির শানকিতে পান্তা ইলিশ খায়, তাদের বেশির ভাগেরই ধারণা এই নববর্ষ রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতন থেকে এসেছে। আসলে এই পহেলা বৈশাখ চালু করেছিলেন সম্রাট আকবর।
খাজনা দিতে অস্বীকার করায় ঢাকার ঈশা খাঁ-কে শায়েস্তা করতে আকবর দিল্লি থেকে ঢাকায় পাঠান ভাতিজা মানসিংহকে। ঈশা খাঁ’র সঙ্গে যুদ্ধে মানসিংহের তরবারি ভেঙে যায়, তিনি হেরে যান। যুদ্ধটা হয়েছিল আমাদের ঢাকার যাত্রাবাড়ীর কাছে। কাঁচপুর ব্রিজ পার হলে যে জায়গাটা, সেখানে। মানসিংহের এই পরাজয় এই বার্তাই দেয় যে, আপনি যত বড় আর ক্ষমতাবানই হোন, স্বজনপ্রীতি আর চাটুকারিতাকে প্রশ্রয় দিলে আপনি ডুববেন ।
আকবরের নবরত্নের একজন ছিলেন বীরবল। উনাকে অনেকে ভাঁড়  ভাবলেও আসলে ছিলেন একজন ফিলোসফার। তার ছিল সুতীক্ষ্ণ সেন্স অফ হিউমার আর পাণ্ডিত্য। তাকে সঠিক মূল্যায়িত করতে না পারাটা ছিল আকবরের আরেক ব্যর্থতা।

আমরা দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-এর কোনো চাটুকার খুঁজে পাইনি। তার ছিল বিশ্বস্ত সহচর যুদ্ধবাজ স্ট্যালিয়ন ঘোড়া ব্যুসেফেলোস। এই ব্যুসেফেলোসকে নিয়ে আলেকজান্ডার বহু যুদ্ধ জয় করেছেন। ব্যুসেফেলোস এশিয়ার এক দেশে যুদ্ধে আহত হয়ে মারা গিয়েছিল। তার স্মরণে আলেকজান্ডার জায়গাটার নাম রেখেছিলেন- ব্যুসেফেলা। ধারণা করা হয় পাকিস্তানের পাঞ্জাবের জেলোম শহর হচ্ছে সেই প্রাচীন ব্যুসেফেলা। চাটুকারের বদলে বিশ্বস্ত সাহসী ব্যুসেফেলোসকে নিয়ে আলেকজান্ডার জিতেছিলেন সব যুদ্ধ।

আরেক দিগ্বিজয়ী বীর নেপোলিয়ন বোনাপার্টও কোনো ভাঁড় চাটুকার পছন্দ করতেন না। একটা ছোট্ট ঘটনায় সেটা বোঝা যাবে।    
নেপোলিয়ন দেখতে ছিলেন ছোটখাটো। একদিন  তার বিশাল লাইব্রেরির উঁচু শেলফ থেকে একটা বই নিতে তার কষ্ট হচ্ছিলো। পাশে দাঁড়ানো এক জেনারেল বললো-‘স্যার, আমি পেড়ে দিচ্ছি, আমি আপনার চেয়ে বড়।’ নেপোলিয়ন ঠাণ্ডা চোখে জেনারেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জেনারেল, আপনি আমার চেয়ে বড় না, আপনি আমার চেয়ে লম্বা।’

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভাঁড়ামি চাটুকারিতাকে সরকারি মর্যাদায় আসন দিয়েছিল স্বৈরশাসক এরশাদ। তার মন্ত্রী-এমপিদের জনসমক্ষে চাটুকারিতা ছিল কিংবদন্তি। একটা উদাহরণ দিলেই বাকিদেরটা জানা যাবে।
এরশাদের প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ এরশাদের সঙ্গে সঙ্গে রোবোটের মতো আচরণ করতেন। এরশাদ হাসলে তিনি হাসতেন, এরশাদ কাঁদলে তিনি কাঁদতেন, এরশাদ তালি দিলে তিনি তালি দিতেন। কখনো এরশাদ হাঁচি দিলে আড়চোখে দেখে নিতেন সেটা হাঁচি না কান্না। হাঁচি কনফার্ম হলে তিনিও একটা হাঁচি দিতেন।

ভাঁড় চাটুকারের বাম্পার ফলন হয়েছিল বিগত সাড়ে পনের বছরের ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়। অলিগলি-রাজপথে চাটুকার। দেশে গড়ে উঠলো চাটুকারের হাজার হাজার ফার্ম। কর্মী চাটুকার, নেতা চাটুকার। অভিনয়শিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, যন্ত্রশিল্পী, মন্ত্রশিল্পী-টনকে টন চাটুকার।  নির্লজ্জ চাটুকার, বেহায়া চাটুকার। সাংবাদিকতা আর সংবাদ সম্মেলনের নামে চলতে লাগলো চাটুকারিতার মহোৎসব। আর ভাঁড়ামি? এই ভাঁড়ের নাম শুনলে লেখক হুমায়ূন আহমেদ স্যার ফিরে এসে ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’র মতো আরেক উপন্যাস লিখবেন- ‘উড়ে যায় কাকপক্ষী’।  তবে এই ‘কাক’ উপন্যাস লিখে তিনি স্ত্রী শাওনের সঙ্গে দেখা করতেন কিনা সন্দেহ। হুমায়ূন স্যার নিশ্চয়ই চাটুকারিতাকে প্রশ্রয় দিতেন না।
বড় মানুষদের ভাঁড় চাটুকার নিয়ে চলতে নেই। তাতে বড় বড় ট্র্যাজিক উপন্যাস রচিত হতে পারে। কেউ হয়তো কাক ছাড়িয়ে লিখে ফেলতে পারে ‘উড়ে যায় চিলপক্ষী’।
মানুষ কি চিলপক্ষীর দিগন্তে উড়ে যাওয়াটা দেখেনি?
(লেখক: নাট্যকার- ফিল্মমেকার)

mzamin

No comments

Powered by Blogger.