‘কেন আমি ভয় পাবো?’ -প্রফেসর কে এস ভগবান by বিখার আহমেদ সাঈদ
প্রফেসর কে এস ভগবান |
মাইসুরুতে কানাড়া ভাষার সাহিত্যিক ৭৩ বছর বয়সি প্রফেসর কে এস ভগবান
দীর্ঘ ৩৭ বছর মাইসুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন।
২০০৫ সালে অবসরে যাওয়া এই অধ্যাপক কানাড়া ভাষায় উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের
নাটকগুলো অনুবাদ করেন। সাহিত্য ও সামাজিক ইস্যুতে ৪০টির বেশি বই লিখেছেন
তিনি, পেয়েছেন কর্নাটক রাজ্যসভা ও কর্নাটক সাহিত্য একাডেমিসহ অসংখ্য
পুরষ্কার।
অষ্টম শতকের হিন্দু দার্শনিক সানকারাকে নিয়ে ১৯৮২ সালে তার একটি
গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এতে ভগবান বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি তুলে
ধরেন যেগুলো চরমপন্থী হিন্দুরা মানতে পারেনি। ফলে তাকে নানাভাবে হুমকি দেয়া
হয়। কিন্তু হুমকির কাছে মাথা নত করার বদলে প্রফেসর ভগবান তার ইতিহাস ও
ধর্মীয় সাহিত্যের উপর ব্যাপক পড়াশুনার ভিত্তিতে হিন্দু ধর্মীয় মতবাদের
বিরুদ্ধে বক্তব্য অব্যাহত রাখেন। বাস্তবতাবাদ ও মানবতাবাদের দৃঢ় সমর্থক এই
ব্যক্তিত্ব অনেক হিন্দু দেব-দেবীর অসারত্ব নিয়ে কথা বলতে দ্বিধা করেননি।
এমনকি মনুসংহিতা ও ভগবত গীতার ত্রুটিগুলোও তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন।
২০১৫ সালে আরেক বিখ্যাত ব্যক্তি এম এম কালবর্গি খুন হওয়ার পর থেকে পুলিশ
প্রহরায় চলতে বাধ্য হচ্ছেন প্রফেসর ভগবান। গৌরি লংকেশ খুন হওয়ার পর
প্রমাণিত হয় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তটি ঠিক ছিলো। খুনীরা মাইসুরে তার
কুভেমপুনগরের বাড়িতেও এসেছিলো। কিন্তু পুলিশ প্রহরা দেখে ফিরে যায়। চরম
হিন্দুবাদী সন্ত্রাসীগ্রুপগুলোর হিটলিস্টে তার নাম রয়েছে। প্রফেসর ভগবান
তার বাড়িতে বসে ফ্রন্টলাইনকে এই সাক্ষাতকার দেন।
সানকারা বইটি প্রকাশের পর থেকেই চরমপন্থী হিন্দুদের টার্গেটে রয়েছেন আপনি? বইতে কী লিখেছেন?
আমি ‘সনকরাচারিয়া ও প্রতিক্রিয়শীল দর্শন’ শীর্ষক বইটি লিখি ১৯৭৯ সালে
এবং এটি প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। আমি দেখিয়েছি যে সানকারা কোন দার্শনিক বা
আদভাইতিন বা যে কিনা সবকিছুর সমতায় বিশ্বাস করেন, এমন কেউ ছিলেন না। তিনি
এগুলো প্রচার করতেন কিন্তু নিজে অনুসরণ করতেন না। আমি তার অনেক সংস্কৃত
উদ্ধৃতি দিয়েছি যেখানে তিনি বলেছেন যে শূদ্রদের জ্ঞান অর্জনের অধিকার নেই।
সানাকারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের শত্রু। তিনি বৌদ্ধস্থাপনা ধ্বংস করেছেন, ভারত
থেকে বৌদ্ধ ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করেছেন। অন্য ধর্মের প্রতি তার বিদ্বেষ ছিলো
অসীম। অত্যন্ত অসহিষ্ণু ছিলেন তিনি এবং পুরোপুরি বর্ণবাদের পক্ষে। তিনি
ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করতেন এবং অব্রাহ্মণরা তার কাছে ছিলো দাস।
তাই আমি যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছি যে একজন দার্শনিকের এমন চরিত্র হতে পারে না
এবং আমরা সানকারাকে কোন আলোকপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে মানতে পারি না।
বইটি প্রকাশের পর ১৯৮০’র দশকে চরমপন্থী হিন্দু গ্রুপগুলোর কাছ থেকে
আমাকে খুন করার হুমকি দিয়ে অনেক ফোন পাই। কয়েক বছর আগে আবারো এই হুমকি দেয়া
শুরু হয়েছে।
কেন আবার শুরু হলো?
২০১৬ সালে আমি ভগবত গীতার উপর একটি বক্তৃতা দেই এবং সেখানে বলি যে এর
কিছু অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে কারণ সেখানে সকল অব্রাহ্মণ, শূদ্র ও নারীকে পাপী
হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আমাকে হুমকি দেয়া হয়। আমি বলেছি যে আমাদের মতো
অব্রাহ্মণরা পাপী নই কারণ আমরা সবার জন্য সম্পদ ও খাবার উৎপাদন করছি। তাই
আমরাই পূণ্যের অধিকারী। বরং যারা এসব সম্পদ ও খাবার শোষণ করছে তারাই পাপী।
আমি আরো অনেক সেমিনারে একই কথা বলেছি এবং সুষমা স্বরাজ যখন ভগবত গীতাকে
দেশের ধর্মীয় গ্রন্থ করার কথা বলেন আমি তার বিরোধিতা করেছি।
বর্তমান বিজেপি সরকার ক্ষমতায় থাকলে আপনার বিরুদ্ধে হুমকি আরো বেড়ে যাবে বলে কি মনে করেন?
হ্যা, অবশ্যই! সম্প্রদায়িকতা, গোড়ামি, ইত্যাদির বিকাশ ঘটায় এমন
উপাদানগুলোর মহোৎসব শুরু হবে। গত সপ্তাহে পুনে পুলিশ পাঁচ একটিভিস্টকে
গ্রেফতার করেছে। আমি এর নিন্দা করি। কেন্দ্রিয় সরকারের ব্যর্থতার জন্যই এসব
হচ্ছে। কারণ এই সরকার জনগণের প্রত্যাশা জাগিয়ে তুলতে পারেনি। তারা তাদের
ইশতেহারে ঘোষিত অঙ্গীকারগুলো পূরণ করতে পারেনি। এটা ঠাকতেই জনগণের দৃষ্টি
ভিন্নদিকে ফেরাতে চাচ্ছে।
আপনার নাম হিন্দু চরমপন্থীদের হিটলিস্টে রয়েছে। এরা আপনার মতো লেখক, বুদ্ধিজীবী ও এক্টিভিস্টদের হুমকি দিচ্ছে।
হ্যা, কারণ আমরা জীবনকে তুচ্ছ করে জনগণকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করছি।
তাদেরকে সামাজিক বৈষম্য ও দারিদ্রের কারণের ব্যাপারে সচেতন করছি। আর
তথাকথিত হিন্দু ধর্মের দেবতারা তাদেরকে বিভ্রান্ত করছে এবং শোষণ করছে। আমি
রামের উপর বই লিখেছি: ‘কেন আমাদের রামমন্দির প্রয়োজন নেই’। কয়েকমাস আগে
বইটি প্রকাশিত হয়েছে। রাম, কৃষ্ণের নামে শোষকরা ভুল বার্তা ছড়াচ্ছে। ভগবত
গীতা দেখুন, সেখানে কৃষ্ণ নিজেই অসাম্যের কথা বলছে। কৃষ্ণ নিজেই যখন
অসাম্যের পক্ষে তখন আপনি কীভাবে বলবেন হিন্দু ভালো ধর্ম? রামের ক্ষেত্রেও
তাই। রামায়নে বাল্মিকি স্পষ্টভাবে বলেছেন যে সমাজে চার বর্ণ বা জাত রক্ষা
করা রামের দায়িত্ব। রাজা হিসেবে এই ব্যবস্থা রক্ষার দায়িত্ব রামের।
গবেষণার জন্য আমি সবকিছুর মূল সংস্করণ অধ্যয়ন করেছি। রামের সাতটি খণ্ডে
২৪,৬০০ শ্লোক রয়েছে। এতদিন যা আড়ালে ছিলো আমি জনগণের সামনে তা তুলে ধরেছি।
আপনি কি জানের যে বুদ্ধের নিন্দা করেছেন রাম? আমার বইয়ের বক্তব্যের
ব্যাপারে চরমপন্থী হিন্দুদের কেউই মতামত প্রকাশ করেনি।
তাহলে আপনি কি বলবেন যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা ধর্মীয়ভাবে ন্যায্য হয়নি?
হ্যা, কেউ আমার বই পড়লে রামের প্রতি তার ভক্তি থাকবে না। আমিও তাই চাই,
এসব দেবতাকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। তারা দেবতা নন কারণ মনুসংহিতা বলেছেন
যে ব্রাহ্মণরা দেবতার চেয়েও শ্রেষ্ঠ এবং ব্রাহ্মণরাই দেবতা সৃষ্টি করেছেন।
সব দেবতা তাদের নিয়ন্ত্রণে। তাই আমি বলবো রাম ছিলেন ব্রাহ্মণদের দাস।
সম্প্রতি আপনি বলেছেন যে বিজেপি চায় ভারতের সংবিধানকে একপাশে রেখে মনুসংহিতাকে সামনে আনতে। এটা হবে বলে আপনি বিশ্বাস করেন?
হ্যা, আমাদের জনগণ যদি সতর্ক না থাকে এবং বিজেপি’র বিরুদ্ধে ভোট না দেয়
তাহলে এটাই ঘটবে। এটা সত্যিকারের আশংকা। আমরা জনগণকে সচেতন করতে চাই। ২০১৯
সালে বিজেপি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে কেউ শান্তিতে থাকতে পারবে না। এটা
যে ঘটবেই সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। বিরোধীদলগুলো এক হতে পারলে
বিজেপিকে বিতাড়িত করা সম্ভব।
আপনি শুধু হিন্দু ধর্মেরই সমালোচনা করেন, অন্য ধর্মগুলোর করেন না। এ ব্যাপারে কি বলবেন?
হ্যা, এটা ঠিক কারণ আমি হিন্দু ধর্মকেই শুধু জানি। আপনি ইসলাম,
খ্রিস্টান ধর্ম সম্পর্কে জানলে, সে ব্যাপারে বলুন। আমি হিন্দু ধর্মের মধ্যে
বাস করছি এবং দেখছি এখানে কি ঘটছে। আমি আমার ঘর পরিস্কার করার পরেই কেবল
অন্যদের ঘরের প্রতি নজর দেব। আমি ইসলামের দিকে তাকালে দেখি একজন মুসলমান
আরেকজন মুসলমানকে দেখলে কোলাকুলি করে। হিন্দু ধর্মে এই অনুশীলন কোথায়? আপনি
দলিতদের আপনার কাছ থেকে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেন। আমি মানবতাবাদী, কোন
ইজমের বিশ্বাস করিনা।
বিবেকান্দকে চরমপন্থী হিন্দুবাদের প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়, এটা ভুল।
বিবেকানন্দের লেখাগুলো পড়লেই দেখবেন সেখানে হিন্দু ধর্মের বিস্তর সমালোচনা।
এটা সবাই কেন জানে না। বিবেকানন্দ কোন ধর্মের লোক ছিলেন না, তিনি ছিলেন
মানবতার।
হুমকির মুখে আপনাকে পুলিশী সুরক্ষার মধ্যে থাকতে হচ্ছে, এর অর্থ কি?
কালবর্গি খুন হওয়ার পর কর্নাটক সরকার আমাকে পুলিশ প্রটেকশন দিলো। আমি
আমার বাড়িতে পুলিশ দেখে অবাক হয়েছিলাম। যখন জানতে পারলাম তাদের হিটলিস্টে
আমার নাম রয়েছে আমার বেশ ভালো লেগেছিলো।
তাহলে আপনি ভয় পাননি?
মোটেই না! কোন আমি ভয় পাবো? আমি কোন ভুল করিনি, আমি কোন অপরাধ করিনি।
আমি জনগণকে শিক্ষা দিচ্ছি। আমি সংবিধানের ৫১এ ধারা অনুযায়ী একজন নাগরিকেই
দায়িত্ব পালন করছি। মানুষ যেখানে তার অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করে সেখানে
আমি আমার দায়িত্ব পালনের জন্য লড়াই করছি। এটা ভারতে প্রত্যেক নাগরিকের
দায়িত্ব। কালবর্গির হত্যাকাণ্ডের পরও আমি অনেক প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে গিয়েছি।
লেখক হিসেবে জরুরি অবস্থা আপনি দেখেছেন, এখন কি পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে বলে মনে করেন?
হ্যা, পরিস্থিতি আগের চেয়েও খারাপ। লেখক, এক্টিভিস্ট ও বুদ্ধিজীবীদের
সবসময় হুমকির মধ্যে থাকতে হচ্ছে। কেউ একজন আমার স্ত্রীর কাছে এসে বলেছিলো:
“দয়া করে আপনার স্বামীকে প্রকাশ্যে এসব কথা বলতে নিষেধ করুন।” আমার স্ত্রী
জবাব দিয়েছিলো: “সবাই কোন না কোনভাবে মারা যাবে। ভালো কোন কারণে যদি তার
মৃত্যু হয়, তাহলে আমি খুশি হবো।”
No comments