সংশোধিত মজুরি নিয়ে আপত্তি শ্রমিকদের, অবরোধের চেষ্টা
পোশাক
শিল্পের শ্রমিকদের একটি ছাড়া সব গ্রেডের মজুরি কাঠামো সংশোধন করে বেতন
বাড়িয়েছে সরকার। নতুন এই কাঠামোর মধ্যেও আপত্তি আছে বলে মনে করেন শ্রমিকরা।
একারণে গতকাল আবারো বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন তারা। আশুলিয়ায় কয়েক
হাজার শ্রমিক কাজ ছেড়ে রাস্তায় নেমে সকাল থেকে ঢাকা টাঙ্গাইল-মহাসড়ক অবরোধ
করার চেষ্টা করেন। ওই সময় কিছু কারখানার মালিক ভাঙচুরের আশঙ্কায় নিজেরাই
কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন।
আশুলিয়ায় কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, সংশোধিত মজুরিতে কয়েকশ’ টাকা বেড়েছে। নতুন কাঠামোর ছয়টি গ্রেডে ১৫ থেকে ৭৪৭ টাকা পর্যন্ত মজুরি বেড়েছে। আর এটা দেয়া হচ্ছে মূলত খাবার ও যাতায়াত ভাতা হিসেবে আলাদা করে।
কিন্তু আমাদের দাবি সেটা মূল বেতনের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়া হোক।
গত রোববার শ্রম মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মালিক-শ্রমিক ও প্রশাসনের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানান, নতুন কাঠামোতে চিকিৎসা, যাতায়াত, বাড়িভাড়া বাড়ানো ছাড়াও মূল মজুরির সঙ্গে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ঘোষণা করা হয়েছে।
পর্যালোচনা কমিটির ঘোষিত কাঠামোতে দেখা গেছে, এক নম্বর গ্রেডে শ্রমিকদের মজুরি ৭৪৭ টাকা, দুই নম্বর গ্রেডে ৭৮৬ টাকা, তিন নম্বর গ্রেডে ২৫৫ টাকা, চার নম্বর গ্রেডে ১০২ টাকা ও পাঁচ নম্বর গ্রেডে মজুরি ২০ টাকা বেড়েছে। ষষ্ঠ গ্রেডে বেড়েছে ১৫ টাকা। আর সপ্তম গ্রেডে আগের মতোই রাখা হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, সংশোধিত এই কাঠামো ২০১৮ সালের ১লা ডিসেম্বর থেকেই কার্যকর ধরা হবে। বর্ধিত অংশের টাকা ফেব্রুয়ারির বেতনের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। আগামী ৭ দিনের মধ্যে সংশোধিত কাঠামোর গেজেট প্রকাশ করা হবে জানিয়ে শ্রমিকদের কাজে ফেরার আহ্বান জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমি আশা করবো, তারা সবাই শান্তিপূর্ণভাবে কাজে যোগ দেবেন।
সর্বনিম্ন গ্রেডে সবমিলিয়ে বেতন ৮ হাজার টাকা। আর সর্বোচ্চ গ্রেডে ১৮,২৫৭ টাকা। সবমিলিয়ে সর্বশেষ সমন্বিত কাঠামোতেও খুব একটা লাভ হয়নি বলে মনে করছেন শ্রমিকরা।
নতুন মজুরি কাঠামো ব্যাখ্যা করে আশুলিয়ার একটি কারখানার শ্রমিক বলেন, সরকার বেতন বাড়িয়েছে ঠিক। তবে সেটা বেসিক বা মূল বেতনের সঙ্গে নয়। আমরা চাই বেসিকের সঙ্গে সমন্বয় করে দেয়া হোক। কিন্তু তা না করে এটা আলাদা আলাদা করে খাবার ও যাতায়াতের সঙ্গে দেয়া হচ্ছে। যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, বেসিকের পরিমাণ বাড়লে আমাদের ওভারটাইমের হার বাড়ে। আলাদা করে দিলে বাড়বে না। তিনি বলেন, ধরেন আমাদের ওভারটাইমের হার আছে ৪০ বা ৩০ টাকা। বেসিকের সঙ্গে দিলে ওভারটাইমের হার আসবে ঘণ্টায় ৫০ টাকা। সেজন্য আমার দাবি বেতনটা বেসিকের সঙ্গে দেয়া হোক। অন্যদিকে বেসিক বা মূল বেতন বাড়লে ঈদ বোনাস, ছুটি-কালীন টাকা, সার্ভিস বেনিফিটও এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এমনিতেই বাড়তো।
এই শ্রমিকের মতো নতুন ঘোষিত কাঠামোতে খুশি নন বলে জানান অন্য শ্রমিকরা। তাদের মতে, ২০ থেকে আড়াই শ’ টাকায় তাদের জীবনের এমন কোনো পরিবর্তন আসবে না। এ ছাড়া পোশাক শিল্পের শ্রমিকের বেশিরভাগই ওভারটাইমের বাড়তি আয়ের ওপর নির্ভরশীল। রাত ১০টা পর্যন্ত ওভারটাইম করেও আমি সব মিলাইয়া মাত্র পাই ১০ হাজার। এখন ছেলের পড়াশোনার খরচ দেবো? নাকি ২৮০০ টাকা বাসা ভাড়া দেবো? তাহলে আমরা খাবো কি? দেশে পাঠাবো কি?
আরেকজন শ্রমিক জানান, ইতিমধ্যেই গার্মেন্টে বেতন বাড়ানোর ঘোষণা আসার পরই আমাদের বাসা ভাড়া বেড়ে গেছে। এ ছাড়া অন্য যাবতীয় জিনিসের দামও বেড়ে গেছে। আরেকটি আক্ষেপের কারণ হলো প্রতি বছর সকল প্রাতিষ্ঠানিক পেশার মতোই পোশাক খাতে ৫ শতাংশ হারে মূল বেতন বা বেসিক বেতন বাড়ার কথা, যা সাধারণত ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে বাড়ানো হয়। সেটি এবার দেয়া হচ্ছে না। সেটা যোগ হলে সরকার ঘোষিত কাঠামোর সঙ্গে আরো কিছু টাকা যোগ হতো বলে জানালেন শ্রমিক নেতারা। সার্ভিস বেনিফিট হলো ৫ বছর চাকরি করলে চাকরি ছাড়ার সময় প্রত্যেক শ্রমিককে প্রতি মাসের অর্ধেক বেতন দেয়ার নিয়ম। এ ছাড়া নারীদের মাতৃকালীন চার মাসের বেসিক দেয়ার নিয়ম রয়েছে। সেটিও তারা কম পাবে। পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যাই সিংহভাগ। পোশাক মালিকেরা খুব সূক্ষ্মভাবে এভাবে শ্রমিকদের বঞ্চিত করার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ।
সম্মিলিত গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, ত্রিপক্ষীয় কমিটি যে মজুরি সমন্বয় করেছে, এর মধ্যে ৫ ও ৬ নম্বর গ্রেডের আরেকটু বৃদ্ধি পেলে ভালো হতো। ৬ নম্বর গ্রেডে ১৫ ও ৫ নম্বর গ্রেডে ২০ টাকা বাড়ানো হয়েছে, যা খুবই কম। মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের বলবো, কারখানা পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা করে সমাধান করুন। তিনি বলেন, মূল মজুরি কমে গেলে ওভারটাইম, অবসরকালীন ভাতা, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি কমে যায়। বর্তমানে অন্যান্য সুবিধাদি বাড়লেও মজুরি কিন্তু বাড়ছে না। আমাদের মজুরি বৃদ্ধি দরকার। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু সমন্বয়টি করে দিয়েছেন, সে জন্য আমরা মেনে নিয়েছি। স্বাগত জানিয়েছি। প্রত্যাশা থাকবে, প্রধানমন্ত্রী মূল মজুরি বৃদ্ধির বিষয়টি দেখবেন। শ্রমিকরা আন্দোলন বাদ দিয়ে কাজে ফিরে যাবেন।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বাবুল আখতার বলেন, ত্রিপক্ষীয় কমিটি মজুরি যেটি সমন্বয় করেছে সেটি সবাই দেখেছে। ৩ নম্বর গ্রেডে যে হারে মজুরি বাড়ানো হয়েছে, সেই হারে ৪, ৫ ও ৬ নম্বর গ্রেডের মজুরি বাড়েনি। ৬ নম্বর গ্রেডে বেড়েছে মাত্র ১৫ টাকা ও ৫ নম্বর গ্রেডে বেড়েছে ২০ টাকা এবং ৪ নম্বর গ্রেডে বেড়েছে ১০২ টাকা। এই বৃদ্ধি শ্রমিকদের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে জানি না। তবে শ্রমিকদের কাছে আমরা শ্রমিকনেতারা আহ্বান জানাই, তারা আন্দোলন ছেড়ে উৎপাদনে ফিরবেন।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিলের সাবেক সেক্রেটারি তৌহিদুর রহমান বলেন, যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। তবে কোনো কোনো জায়গায় হয়তো মজুরি বৃদ্ধির মেসেজটি পৌঁছেনি। তাই আন্দোলন হচ্ছে। দুয়েক দিনের মধ্যেই সব সমাধান হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, মালিকরা তো বলেছিলেন কোনো মজুরি বৃদ্ধি করা হবে না। কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমে সামান্য বৃদ্ধির হলেও তো কিছুটা পরিবর্তন করা গেছে। ধীরে ধীরে আগামীতে আরো পরিবর্তন হবে। এক সঙ্গে সব দাবি আদায় হবে আশা করা ঠিক না।
আরেক শ্রমিক নেত্রী কল্পনা আক্তার বলেন, বন্ধ কারখানাগুলো খুলে দিলে হয়তো আন্দোলন থেমে যাবে। আর মজুরি বৃদ্ধির মেসেজটি সবার কাছে পৌঁছাতে হবে। তাহলে পরিস্থিতি শান্ত হবে বলে মনে করেন তিনি।
মজুরি বৈষম্যের অভিযোগ তুলে তা দ্রুত সংশোধনের দাবিতে টানা ৮ দিন গতকাল আশুলিয়ার জামগড়া এলাকার বিভিন্ন কারখানায় বিক্ষোভ করেছে তৈরি পোশাক শ্রমিকরা। বিষয়টি নিরসনে বিকালে পুলিশ স্থানীয় বাড়িওয়ালা, জনপ্রতিনিধি এবং দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছে। এ সময় তৈরি পোশাক শ্রমিকদের কাজে ফেরানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন বিষয়ে উন্মুক্ত আলোচনা করা হয়। মতবিনিময় সভায় কারখানায় কাজ না করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে তাদের এলাকা থেকে বিতাড়িত করা হবে। এ ছাড়া কোনো মতেই বর্তমান পরিস্থিতি এই এলাকায় বাড়ি ভাড়া বাড়ানো যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান বলেন, মঙ্গলবার থেকে জামগড়া এলাকায় মাইকিং করতে হবে যারা কার্ড পাঞ্চ করে চলে যাবেন তাদেরকে ‘নো ওয়ার্ক, নো পে’ পদ্ধতিতে কোনো বেতন পাবেন না বলে জানিয়ে দিতে হবে। এজন্য বাড়িওয়ালা ও দলীয় নেতাকর্মীদের বিষয়টি বুঝানোর জন্য অবশ্যই সকাল থেকে মাঠে থাকতে হবে। শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার সানা শামিনুর রহমান বলেছেন, অনেক বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়াদের শ্রমিক আন্দোলনে উস্কে দেয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। অনেক বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়াদের ইন্ধন দিয়ে দিচ্ছেন বেতন বাড়লে বাড়ি ভাড়াও বাড়বে। আমরা এসব অভিযোগ বিচার বিশ্লেষণ এবং তদন্ত করছি। শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে এসব চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মো. আবু কালাম সিদ্দিক বলেন, গার্মেন্ট সেক্টরে চলমান অসন্তোষ নিরসন সম্ভব না হলে তা অন্য দেশে চলে যাবে। আমাদের অর্থনীতির চাকা অচল হয়ে যাবে। তাই অসন্তোষ নিরসনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুই হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। যেকোনো মূল্যে এ অবস্থার উন্নতি করা হবে। আমরা বিজিএমইএ’র সঙ্গে কথা বলেছি তারা যদি কারখানা বন্ধ করে দেয় তাহলে আপনারা এলাকাবাসীরাও বিপদে পড়বেন। তাই যারা গার্মেন্ট সেক্টর নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে তাদের বিষয়ে কোনো তথ্য থাকলে আমাদের জানাবেন। আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
উল্লেখ্য, গতকাল সকালে আশুলিয়ার জামগড়া এলাকার এনভয় গ্রুপ, উইন্ডি গ্রুপ, হা-মীম গ্রুপ, শারমিন গ্রুপ, পলমলসহ প্রায় ২০টি কারখানার তৈরি পোশাক শ্রমিকরা কারখানায় প্রবেশের পর কার্ড পাঞ্চ করে বের হয়ে যান। এ সময় হাজার হাজার শ্রমিক বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে চাইলে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা তাদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেন। এ ছাড়া জিরাবো, কাঠগড়া, সাভার, হেমায়েতপুরসহ অন্যান্য এলাকার কারখানাগুলোতে শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করেছে শ্রমিকরা।
আশুলিয়ায় কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, সংশোধিত মজুরিতে কয়েকশ’ টাকা বেড়েছে। নতুন কাঠামোর ছয়টি গ্রেডে ১৫ থেকে ৭৪৭ টাকা পর্যন্ত মজুরি বেড়েছে। আর এটা দেয়া হচ্ছে মূলত খাবার ও যাতায়াত ভাতা হিসেবে আলাদা করে।
কিন্তু আমাদের দাবি সেটা মূল বেতনের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়া হোক।
গত রোববার শ্রম মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মালিক-শ্রমিক ও প্রশাসনের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানান, নতুন কাঠামোতে চিকিৎসা, যাতায়াত, বাড়িভাড়া বাড়ানো ছাড়াও মূল মজুরির সঙ্গে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ঘোষণা করা হয়েছে।
পর্যালোচনা কমিটির ঘোষিত কাঠামোতে দেখা গেছে, এক নম্বর গ্রেডে শ্রমিকদের মজুরি ৭৪৭ টাকা, দুই নম্বর গ্রেডে ৭৮৬ টাকা, তিন নম্বর গ্রেডে ২৫৫ টাকা, চার নম্বর গ্রেডে ১০২ টাকা ও পাঁচ নম্বর গ্রেডে মজুরি ২০ টাকা বেড়েছে। ষষ্ঠ গ্রেডে বেড়েছে ১৫ টাকা। আর সপ্তম গ্রেডে আগের মতোই রাখা হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, সংশোধিত এই কাঠামো ২০১৮ সালের ১লা ডিসেম্বর থেকেই কার্যকর ধরা হবে। বর্ধিত অংশের টাকা ফেব্রুয়ারির বেতনের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। আগামী ৭ দিনের মধ্যে সংশোধিত কাঠামোর গেজেট প্রকাশ করা হবে জানিয়ে শ্রমিকদের কাজে ফেরার আহ্বান জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমি আশা করবো, তারা সবাই শান্তিপূর্ণভাবে কাজে যোগ দেবেন।
সর্বনিম্ন গ্রেডে সবমিলিয়ে বেতন ৮ হাজার টাকা। আর সর্বোচ্চ গ্রেডে ১৮,২৫৭ টাকা। সবমিলিয়ে সর্বশেষ সমন্বিত কাঠামোতেও খুব একটা লাভ হয়নি বলে মনে করছেন শ্রমিকরা।
নতুন মজুরি কাঠামো ব্যাখ্যা করে আশুলিয়ার একটি কারখানার শ্রমিক বলেন, সরকার বেতন বাড়িয়েছে ঠিক। তবে সেটা বেসিক বা মূল বেতনের সঙ্গে নয়। আমরা চাই বেসিকের সঙ্গে সমন্বয় করে দেয়া হোক। কিন্তু তা না করে এটা আলাদা আলাদা করে খাবার ও যাতায়াতের সঙ্গে দেয়া হচ্ছে। যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, বেসিকের পরিমাণ বাড়লে আমাদের ওভারটাইমের হার বাড়ে। আলাদা করে দিলে বাড়বে না। তিনি বলেন, ধরেন আমাদের ওভারটাইমের হার আছে ৪০ বা ৩০ টাকা। বেসিকের সঙ্গে দিলে ওভারটাইমের হার আসবে ঘণ্টায় ৫০ টাকা। সেজন্য আমার দাবি বেতনটা বেসিকের সঙ্গে দেয়া হোক। অন্যদিকে বেসিক বা মূল বেতন বাড়লে ঈদ বোনাস, ছুটি-কালীন টাকা, সার্ভিস বেনিফিটও এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এমনিতেই বাড়তো।
এই শ্রমিকের মতো নতুন ঘোষিত কাঠামোতে খুশি নন বলে জানান অন্য শ্রমিকরা। তাদের মতে, ২০ থেকে আড়াই শ’ টাকায় তাদের জীবনের এমন কোনো পরিবর্তন আসবে না। এ ছাড়া পোশাক শিল্পের শ্রমিকের বেশিরভাগই ওভারটাইমের বাড়তি আয়ের ওপর নির্ভরশীল। রাত ১০টা পর্যন্ত ওভারটাইম করেও আমি সব মিলাইয়া মাত্র পাই ১০ হাজার। এখন ছেলের পড়াশোনার খরচ দেবো? নাকি ২৮০০ টাকা বাসা ভাড়া দেবো? তাহলে আমরা খাবো কি? দেশে পাঠাবো কি?
আরেকজন শ্রমিক জানান, ইতিমধ্যেই গার্মেন্টে বেতন বাড়ানোর ঘোষণা আসার পরই আমাদের বাসা ভাড়া বেড়ে গেছে। এ ছাড়া অন্য যাবতীয় জিনিসের দামও বেড়ে গেছে। আরেকটি আক্ষেপের কারণ হলো প্রতি বছর সকল প্রাতিষ্ঠানিক পেশার মতোই পোশাক খাতে ৫ শতাংশ হারে মূল বেতন বা বেসিক বেতন বাড়ার কথা, যা সাধারণত ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে বাড়ানো হয়। সেটি এবার দেয়া হচ্ছে না। সেটা যোগ হলে সরকার ঘোষিত কাঠামোর সঙ্গে আরো কিছু টাকা যোগ হতো বলে জানালেন শ্রমিক নেতারা। সার্ভিস বেনিফিট হলো ৫ বছর চাকরি করলে চাকরি ছাড়ার সময় প্রত্যেক শ্রমিককে প্রতি মাসের অর্ধেক বেতন দেয়ার নিয়ম। এ ছাড়া নারীদের মাতৃকালীন চার মাসের বেসিক দেয়ার নিয়ম রয়েছে। সেটিও তারা কম পাবে। পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যাই সিংহভাগ। পোশাক মালিকেরা খুব সূক্ষ্মভাবে এভাবে শ্রমিকদের বঞ্চিত করার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ।
সম্মিলিত গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, ত্রিপক্ষীয় কমিটি যে মজুরি সমন্বয় করেছে, এর মধ্যে ৫ ও ৬ নম্বর গ্রেডের আরেকটু বৃদ্ধি পেলে ভালো হতো। ৬ নম্বর গ্রেডে ১৫ ও ৫ নম্বর গ্রেডে ২০ টাকা বাড়ানো হয়েছে, যা খুবই কম। মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের বলবো, কারখানা পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা করে সমাধান করুন। তিনি বলেন, মূল মজুরি কমে গেলে ওভারটাইম, অবসরকালীন ভাতা, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি কমে যায়। বর্তমানে অন্যান্য সুবিধাদি বাড়লেও মজুরি কিন্তু বাড়ছে না। আমাদের মজুরি বৃদ্ধি দরকার। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু সমন্বয়টি করে দিয়েছেন, সে জন্য আমরা মেনে নিয়েছি। স্বাগত জানিয়েছি। প্রত্যাশা থাকবে, প্রধানমন্ত্রী মূল মজুরি বৃদ্ধির বিষয়টি দেখবেন। শ্রমিকরা আন্দোলন বাদ দিয়ে কাজে ফিরে যাবেন।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বাবুল আখতার বলেন, ত্রিপক্ষীয় কমিটি মজুরি যেটি সমন্বয় করেছে সেটি সবাই দেখেছে। ৩ নম্বর গ্রেডে যে হারে মজুরি বাড়ানো হয়েছে, সেই হারে ৪, ৫ ও ৬ নম্বর গ্রেডের মজুরি বাড়েনি। ৬ নম্বর গ্রেডে বেড়েছে মাত্র ১৫ টাকা ও ৫ নম্বর গ্রেডে বেড়েছে ২০ টাকা এবং ৪ নম্বর গ্রেডে বেড়েছে ১০২ টাকা। এই বৃদ্ধি শ্রমিকদের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে জানি না। তবে শ্রমিকদের কাছে আমরা শ্রমিকনেতারা আহ্বান জানাই, তারা আন্দোলন ছেড়ে উৎপাদনে ফিরবেন।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিলের সাবেক সেক্রেটারি তৌহিদুর রহমান বলেন, যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। তবে কোনো কোনো জায়গায় হয়তো মজুরি বৃদ্ধির মেসেজটি পৌঁছেনি। তাই আন্দোলন হচ্ছে। দুয়েক দিনের মধ্যেই সব সমাধান হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, মালিকরা তো বলেছিলেন কোনো মজুরি বৃদ্ধি করা হবে না। কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমে সামান্য বৃদ্ধির হলেও তো কিছুটা পরিবর্তন করা গেছে। ধীরে ধীরে আগামীতে আরো পরিবর্তন হবে। এক সঙ্গে সব দাবি আদায় হবে আশা করা ঠিক না।
আরেক শ্রমিক নেত্রী কল্পনা আক্তার বলেন, বন্ধ কারখানাগুলো খুলে দিলে হয়তো আন্দোলন থেমে যাবে। আর মজুরি বৃদ্ধির মেসেজটি সবার কাছে পৌঁছাতে হবে। তাহলে পরিস্থিতি শান্ত হবে বলে মনে করেন তিনি।
মজুরি বৈষম্যের অভিযোগ তুলে তা দ্রুত সংশোধনের দাবিতে টানা ৮ দিন গতকাল আশুলিয়ার জামগড়া এলাকার বিভিন্ন কারখানায় বিক্ষোভ করেছে তৈরি পোশাক শ্রমিকরা। বিষয়টি নিরসনে বিকালে পুলিশ স্থানীয় বাড়িওয়ালা, জনপ্রতিনিধি এবং দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছে। এ সময় তৈরি পোশাক শ্রমিকদের কাজে ফেরানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন বিষয়ে উন্মুক্ত আলোচনা করা হয়। মতবিনিময় সভায় কারখানায় কাজ না করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে তাদের এলাকা থেকে বিতাড়িত করা হবে। এ ছাড়া কোনো মতেই বর্তমান পরিস্থিতি এই এলাকায় বাড়ি ভাড়া বাড়ানো যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান বলেন, মঙ্গলবার থেকে জামগড়া এলাকায় মাইকিং করতে হবে যারা কার্ড পাঞ্চ করে চলে যাবেন তাদেরকে ‘নো ওয়ার্ক, নো পে’ পদ্ধতিতে কোনো বেতন পাবেন না বলে জানিয়ে দিতে হবে। এজন্য বাড়িওয়ালা ও দলীয় নেতাকর্মীদের বিষয়টি বুঝানোর জন্য অবশ্যই সকাল থেকে মাঠে থাকতে হবে। শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার সানা শামিনুর রহমান বলেছেন, অনেক বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়াদের শ্রমিক আন্দোলনে উস্কে দেয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। অনেক বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়াদের ইন্ধন দিয়ে দিচ্ছেন বেতন বাড়লে বাড়ি ভাড়াও বাড়বে। আমরা এসব অভিযোগ বিচার বিশ্লেষণ এবং তদন্ত করছি। শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে এসব চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মো. আবু কালাম সিদ্দিক বলেন, গার্মেন্ট সেক্টরে চলমান অসন্তোষ নিরসন সম্ভব না হলে তা অন্য দেশে চলে যাবে। আমাদের অর্থনীতির চাকা অচল হয়ে যাবে। তাই অসন্তোষ নিরসনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুই হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। যেকোনো মূল্যে এ অবস্থার উন্নতি করা হবে। আমরা বিজিএমইএ’র সঙ্গে কথা বলেছি তারা যদি কারখানা বন্ধ করে দেয় তাহলে আপনারা এলাকাবাসীরাও বিপদে পড়বেন। তাই যারা গার্মেন্ট সেক্টর নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে তাদের বিষয়ে কোনো তথ্য থাকলে আমাদের জানাবেন। আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
উল্লেখ্য, গতকাল সকালে আশুলিয়ার জামগড়া এলাকার এনভয় গ্রুপ, উইন্ডি গ্রুপ, হা-মীম গ্রুপ, শারমিন গ্রুপ, পলমলসহ প্রায় ২০টি কারখানার তৈরি পোশাক শ্রমিকরা কারখানায় প্রবেশের পর কার্ড পাঞ্চ করে বের হয়ে যান। এ সময় হাজার হাজার শ্রমিক বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে চাইলে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা তাদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেন। এ ছাড়া জিরাবো, কাঠগড়া, সাভার, হেমায়েতপুরসহ অন্যান্য এলাকার কারখানাগুলোতে শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করেছে শ্রমিকরা।
No comments