বাংলাদেশে বিকল্প খুঁজতে হবে ভারতকে by ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রতিবেশী
বাংলাদেশের প্রসঙ্গ এলে গড়পড়তা যেকোনো ভারতীয়ই হয়তো অত পাত্তা দেবেন না।
দেশটিকে অনেকে মনে করেন খুবই হতদরিদ্র, যেটি কিনা কেবল ঝাঁকে ঝাঁকে অবৈধ
অভিবাসী ও ইসলামিস্ট মৌলবাদী রপ্তানি করে। কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ও
নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টিভঙ্গি এ ব্যাপারে একেবারেই
ভিন্ন। তাদের কাছে বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ এক কৌশলগত আংশীদার ও
বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী। গত সপ্তাহে টানা তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হওয়া
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি এই কর্তাব্যক্তিদের অব্যাহত সমর্থন এই
দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে, তাকে ছাড়া নয়াদিল্লির ঢাকা নীতি টিকবে না।
কিন্তু সমস্যা হলো, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিরোধী শিবির ভীত ও বিদীর্ণ হয়ে গেছে। শেখ হাসিনার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছে আদালত। তিনি এখন জেলে। যদিও খালেদা জিয়া এক সময় ভারতের নির্দয় শত্রু ছিলেন, নয়াদিল্লি কিন্তু একবার তাকে ও তার ছেলে তারেক জিয়াকে সমর্থন দিতে রাজি হয়েছিল।
কিন্তু তারা ভারতের বিশ্বাসের পিঠে ছুরি বসান। বাংলাদেশে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে ইচ্ছামতো কাজ করার সুযোগ দেন।
সেই বিশ্বাসঘাতকতা নয়াদিল্লির জন্য হতভম্ভকর ছিল। এরপর থেকে বেগম জিয়াকে আর বিশ্বাস করেনি ভারত। সেই থেকে বাংলাদেশে নয়াদিল্লির কেবল একটিই কার্ড: শেখ হাসিনা। কিন্তু এটি একেবারে আকাক্সিক্ষত কোনো পরিস্থিতি নয়। শেখ হাসিনা ও তার দলের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনৈতিক অঙ্গনে গভীর চিড় ও হতাশা তৈরি করেছে। এমন পরিস্থিতি যেকোনো একদলীয় শাসন ও কার্যক্ষম বিরোধী দল না থাকারই এক অনিবার্য পরিণতি।
শীর্ষে থাকা দুই নেতা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার মতো কোনো ক্যারিশম্যাটিক নেতা বাংলাদেশ দুর্ভাগ্যজনকভাবে সৃষ্টি করতে পারেনি। এ কারণে নয়াদিল্লির পছন্দ আরও সীমিত হয়ে গেছে।
কিন্তু এরপরও বাংলাদেশিদের অনুভূতি ও আকাক্সক্ষা নিয়ে সংবেদনশীল হতে হবে ভারতকে। বাংলাদেশের ব্যাপকভাবে বর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা দেশের রাজনীতির উঠাপড়া নির্ধারণ করে; ও রাজনৈতিক নেতৃত্বে যেখান থেকে আসে, সেই মধ্যবিত্তদের মধ্যে ভারত নিয়ে মিশ্র অনুভূতি রয়েছে। ভারতীয়রা বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে ও নেতিবাচক আচরণ করে- এ নিয়ে এই মধ্যবিত্তদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। তারা এ-ও বিশ্বাস করে, দেশে নয়াদিল্লি অতিমাত্রায় প্রভাব বিস্তার করছে। এছাড়া রাজনীতির সকল ক্ষেত্রে ভারত প্রভাবিত করে। তাদের এই ধারণা কিন্তু অমূলক নয়।
নয়াদিল্লি বাংলাদেশে শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প দেখে না। তিনি একজন নির্ভরযোগ্য বন্ধু যিনি কিনা ভারতের উদ্বেগ নিয়ে সংবেদনশীল। এই আংশীদারিত্ব অতীতে ফলদায়ক ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আর কতদিন? একজন রাজনৈতিক নেতা ও দলের সঙ্গে অংশীদারিত্ব কি চিরকাল ধরে চলতে পারে? এই প্রশ্ন খুব শিগগিরই আরও জরুরি হয়ে দেখা দিতে পারে কারণ বাংলাদেশের গুরুত্ব ক্রমেই বাড়তে যাচ্ছে। এর প্রথম কারণ হলো অর্থনীতি। এরপর হলো ভূ-রাজনীতি।
বাংলাদেশ একটি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’- এই ধারণা ক্রমেই পরিবর্তিত হচ্ছে। শক্তিশালী রপ্তানিমুখী অর্থনীতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বদৌলতে, দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬ শতাংশ ছিল ২০০৯ থেকে। নয় বছরে চরম দারিদ্র্যে বসবাস করা বাংলাদেশির সংখ্যা ১৯ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশেরও কমে এসে পৌঁছেছে।
উদীয়মান এই অর্থনীতি কয়েক লাখ ভারতীয়কে বাংলাদেশে আকৃষ্ট করেছে যারা দেশটির গার্মেন্টসহ বিভিন্ন ব্যবসাখাতে কাজ করেন। বাংলাদেশের অর্থনীতি যত এগোবে সুযোগ ততই খুলবে। ভারতীয়রা লাভবান হবে যদি এই ভালো সম্পর্ক বজায় থাকে।
নতুবা চীন চলে আসবে। দেশটি ইতিমধ্যেই কৌশলগত ক্ষেত্রে এগিয়েছে। পাকিস্তানের পর চীনা সমরাস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা বাংলাদেশ। চীন থেকে ট্যাংক, বিমান ও সাবমেরিন কিনেছে ঢাকা। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা মনে করেন, এই অঞ্চলে আরো বড় ভূমিকা পালন করবে চীন। তিনি বেশ আগ্রহসহকারে দেশের অবকাঠামোতে চীনা বিনিয়োগ চেয়েছেন।
চীন বাস্তবায়ন করছে এমন বড় ধরনের প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ৩৭০ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিতব্য ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু ও চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন প্রকল্প। নয়াদিল্লি ও রাজধানীর সংবাদমাধ্যম মূলত পশ্চিমে বিশেষ করে পাকিস্তানে চলমান কৌশলগত ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে বিভোর। কারণ, পাকিস্তানে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর পরিচালনা করছে চীন। কিন্তু ভারতের পূর্বে চীন আরো বৃহৎ ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।
এর মধ্যে বিশেষ উদ্বেগের কারণ হলো মিয়ানমারে চীনের কৌশলগত প্রকল্পসমূহ। দুই মাস আগে মিয়ানমারের ক্যাউকপ্যু শহরে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে চীন চুক্তি করেছে। চীনের সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি সংস্থা ১৩০ কোটি ডলার ব্যয়ে এই বন্দর নির্মাণ করবে। ৭০ শতাংশ অর্থায়ন করবে চীন। বন্দর পরিচালনায়ও থাকবে দেশটি।
বিশ্লেষকরা দেখিয়েছেন, এই গভীর বন্দর বঙ্গোপসাগরের বিপরীতে অবস্থিত। বিশাখাপত্তমের কাছে ভারতের নির্মিতব্য সাবমেরিন ঘাঁটি থেকে এটি বেশি দূরে নয়। ক্যাউকপ্যু নির্মাণ শেষ হলে ভারতের চারপাশে একাধারে কয়েকটি (পাকিস্তানে গাদার ও শ্রীলঙ্কায় হাম্বানটোটা) বন্দর নির্মাণ শেষ করবে চীন।
পাকিস্তানের ক্রমশই বেড়ে চলা ঋণের বোঝা ও চীনের ওপর সম্পূর্ণ সামরিক নির্ভরতার কারণে দেশটির অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণ কার্যত ইসলামাবাদ থেকে বেইজিংয়ে চলে গেছে। ধীরগতিতে হলেও শ্রীলঙ্কায়ও একই ধরনের প্রক্রিয়া চলছে। শ্রীলঙ্কায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শক্তিশালী চীন-পন্থী লবির উত্থান হয়েছে। এই লবির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ রাজাপাকসে। এটি একেবারেই নির্ভুল, বেইজিংয়ের কৌশলগত লক্ষ্য হচ্ছে ভারতকে চারপাশ দিয়ে ঘিরে ধরে ভারতকে ঠেকানো। খুব অবাক হওয়ার বিষয় নয়, বেইজিং বাংলাদেশেও কাজ শুরু করে দিয়েছে।
বেশ কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামের দক্ষিণে সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল চীন। নির্মাণের শর্ত বেশ বিপজ্জনক ছিল। নিশ্চিতভাবেই এটি ছিল বেইজিংয়ের ‘ঋণ কূটনীতি’র অংশ। জাপান এগিয়ে না এলে বাংলাদেশ হয়তো ওই টোপ গিলতো। জাপান আরো ভালো ও নিরাপদ প্রকল্পের প্রস্তাব দেয়। এখন কক্সবাজারের পাশে মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করছে জাপান। সেখানে একটি ১২০০ মেগাওয়াটের বিরাট বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল ও অন্যান্য সুবিধাও থাকবে। বলা হচ্ছে, এই প্রকল্প হলো এই অঞ্চলকে শিল্প করিডরে পরিণত করার বৃহত্তর প্রকল্পের অংশ। এটি হবে এশিয়া ও বাকি বিশ্বে প্রবেশের গুরুত্বপূর্ণ দ্বার। খুবই অনুকূল শর্তে এই প্রকল্পের বেশিরভাগ অর্থায়ন করছে জাপান।
সেবার বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থ যেন জাপানই উদ্ধার করে দিয়েছে। কিন্তু ঢাকা এখনও বিভিন্ন বিকল্প খুঁজছে। আর চীন কিন্তু অতীতে নিজেদের স্বার্থ এগিয়ে নিতে বিদেশি রাজনীতিবিদ বা কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে পর্যন্ত পিছপা হয়নি। ভারতের জন্যও সম্ভবত সময় এসেছে বাংলাদেশে নিজের রাজনৈতিক সংযোগ আরও বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় করার।
(ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায় একজন নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক ঝুঁকি বিশ্লেষক। তার নিবন্ধটি ভারতের এশিয়ান এইজ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।)
কিন্তু সমস্যা হলো, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিরোধী শিবির ভীত ও বিদীর্ণ হয়ে গেছে। শেখ হাসিনার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছে আদালত। তিনি এখন জেলে। যদিও খালেদা জিয়া এক সময় ভারতের নির্দয় শত্রু ছিলেন, নয়াদিল্লি কিন্তু একবার তাকে ও তার ছেলে তারেক জিয়াকে সমর্থন দিতে রাজি হয়েছিল।
কিন্তু তারা ভারতের বিশ্বাসের পিঠে ছুরি বসান। বাংলাদেশে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে ইচ্ছামতো কাজ করার সুযোগ দেন।
সেই বিশ্বাসঘাতকতা নয়াদিল্লির জন্য হতভম্ভকর ছিল। এরপর থেকে বেগম জিয়াকে আর বিশ্বাস করেনি ভারত। সেই থেকে বাংলাদেশে নয়াদিল্লির কেবল একটিই কার্ড: শেখ হাসিনা। কিন্তু এটি একেবারে আকাক্সিক্ষত কোনো পরিস্থিতি নয়। শেখ হাসিনা ও তার দলের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনৈতিক অঙ্গনে গভীর চিড় ও হতাশা তৈরি করেছে। এমন পরিস্থিতি যেকোনো একদলীয় শাসন ও কার্যক্ষম বিরোধী দল না থাকারই এক অনিবার্য পরিণতি।
শীর্ষে থাকা দুই নেতা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার মতো কোনো ক্যারিশম্যাটিক নেতা বাংলাদেশ দুর্ভাগ্যজনকভাবে সৃষ্টি করতে পারেনি। এ কারণে নয়াদিল্লির পছন্দ আরও সীমিত হয়ে গেছে।
কিন্তু এরপরও বাংলাদেশিদের অনুভূতি ও আকাক্সক্ষা নিয়ে সংবেদনশীল হতে হবে ভারতকে। বাংলাদেশের ব্যাপকভাবে বর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা দেশের রাজনীতির উঠাপড়া নির্ধারণ করে; ও রাজনৈতিক নেতৃত্বে যেখান থেকে আসে, সেই মধ্যবিত্তদের মধ্যে ভারত নিয়ে মিশ্র অনুভূতি রয়েছে। ভারতীয়রা বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে ও নেতিবাচক আচরণ করে- এ নিয়ে এই মধ্যবিত্তদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। তারা এ-ও বিশ্বাস করে, দেশে নয়াদিল্লি অতিমাত্রায় প্রভাব বিস্তার করছে। এছাড়া রাজনীতির সকল ক্ষেত্রে ভারত প্রভাবিত করে। তাদের এই ধারণা কিন্তু অমূলক নয়।
নয়াদিল্লি বাংলাদেশে শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প দেখে না। তিনি একজন নির্ভরযোগ্য বন্ধু যিনি কিনা ভারতের উদ্বেগ নিয়ে সংবেদনশীল। এই আংশীদারিত্ব অতীতে ফলদায়ক ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আর কতদিন? একজন রাজনৈতিক নেতা ও দলের সঙ্গে অংশীদারিত্ব কি চিরকাল ধরে চলতে পারে? এই প্রশ্ন খুব শিগগিরই আরও জরুরি হয়ে দেখা দিতে পারে কারণ বাংলাদেশের গুরুত্ব ক্রমেই বাড়তে যাচ্ছে। এর প্রথম কারণ হলো অর্থনীতি। এরপর হলো ভূ-রাজনীতি।
বাংলাদেশ একটি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’- এই ধারণা ক্রমেই পরিবর্তিত হচ্ছে। শক্তিশালী রপ্তানিমুখী অর্থনীতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বদৌলতে, দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬ শতাংশ ছিল ২০০৯ থেকে। নয় বছরে চরম দারিদ্র্যে বসবাস করা বাংলাদেশির সংখ্যা ১৯ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশেরও কমে এসে পৌঁছেছে।
উদীয়মান এই অর্থনীতি কয়েক লাখ ভারতীয়কে বাংলাদেশে আকৃষ্ট করেছে যারা দেশটির গার্মেন্টসহ বিভিন্ন ব্যবসাখাতে কাজ করেন। বাংলাদেশের অর্থনীতি যত এগোবে সুযোগ ততই খুলবে। ভারতীয়রা লাভবান হবে যদি এই ভালো সম্পর্ক বজায় থাকে।
নতুবা চীন চলে আসবে। দেশটি ইতিমধ্যেই কৌশলগত ক্ষেত্রে এগিয়েছে। পাকিস্তানের পর চীনা সমরাস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা বাংলাদেশ। চীন থেকে ট্যাংক, বিমান ও সাবমেরিন কিনেছে ঢাকা। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা মনে করেন, এই অঞ্চলে আরো বড় ভূমিকা পালন করবে চীন। তিনি বেশ আগ্রহসহকারে দেশের অবকাঠামোতে চীনা বিনিয়োগ চেয়েছেন।
চীন বাস্তবায়ন করছে এমন বড় ধরনের প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ৩৭০ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিতব্য ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু ও চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন প্রকল্প। নয়াদিল্লি ও রাজধানীর সংবাদমাধ্যম মূলত পশ্চিমে বিশেষ করে পাকিস্তানে চলমান কৌশলগত ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে বিভোর। কারণ, পাকিস্তানে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর পরিচালনা করছে চীন। কিন্তু ভারতের পূর্বে চীন আরো বৃহৎ ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।
এর মধ্যে বিশেষ উদ্বেগের কারণ হলো মিয়ানমারে চীনের কৌশলগত প্রকল্পসমূহ। দুই মাস আগে মিয়ানমারের ক্যাউকপ্যু শহরে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে চীন চুক্তি করেছে। চীনের সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি সংস্থা ১৩০ কোটি ডলার ব্যয়ে এই বন্দর নির্মাণ করবে। ৭০ শতাংশ অর্থায়ন করবে চীন। বন্দর পরিচালনায়ও থাকবে দেশটি।
বিশ্লেষকরা দেখিয়েছেন, এই গভীর বন্দর বঙ্গোপসাগরের বিপরীতে অবস্থিত। বিশাখাপত্তমের কাছে ভারতের নির্মিতব্য সাবমেরিন ঘাঁটি থেকে এটি বেশি দূরে নয়। ক্যাউকপ্যু নির্মাণ শেষ হলে ভারতের চারপাশে একাধারে কয়েকটি (পাকিস্তানে গাদার ও শ্রীলঙ্কায় হাম্বানটোটা) বন্দর নির্মাণ শেষ করবে চীন।
পাকিস্তানের ক্রমশই বেড়ে চলা ঋণের বোঝা ও চীনের ওপর সম্পূর্ণ সামরিক নির্ভরতার কারণে দেশটির অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণ কার্যত ইসলামাবাদ থেকে বেইজিংয়ে চলে গেছে। ধীরগতিতে হলেও শ্রীলঙ্কায়ও একই ধরনের প্রক্রিয়া চলছে। শ্রীলঙ্কায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শক্তিশালী চীন-পন্থী লবির উত্থান হয়েছে। এই লবির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ রাজাপাকসে। এটি একেবারেই নির্ভুল, বেইজিংয়ের কৌশলগত লক্ষ্য হচ্ছে ভারতকে চারপাশ দিয়ে ঘিরে ধরে ভারতকে ঠেকানো। খুব অবাক হওয়ার বিষয় নয়, বেইজিং বাংলাদেশেও কাজ শুরু করে দিয়েছে।
বেশ কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামের দক্ষিণে সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল চীন। নির্মাণের শর্ত বেশ বিপজ্জনক ছিল। নিশ্চিতভাবেই এটি ছিল বেইজিংয়ের ‘ঋণ কূটনীতি’র অংশ। জাপান এগিয়ে না এলে বাংলাদেশ হয়তো ওই টোপ গিলতো। জাপান আরো ভালো ও নিরাপদ প্রকল্পের প্রস্তাব দেয়। এখন কক্সবাজারের পাশে মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করছে জাপান। সেখানে একটি ১২০০ মেগাওয়াটের বিরাট বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল ও অন্যান্য সুবিধাও থাকবে। বলা হচ্ছে, এই প্রকল্প হলো এই অঞ্চলকে শিল্প করিডরে পরিণত করার বৃহত্তর প্রকল্পের অংশ। এটি হবে এশিয়া ও বাকি বিশ্বে প্রবেশের গুরুত্বপূর্ণ দ্বার। খুবই অনুকূল শর্তে এই প্রকল্পের বেশিরভাগ অর্থায়ন করছে জাপান।
সেবার বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থ যেন জাপানই উদ্ধার করে দিয়েছে। কিন্তু ঢাকা এখনও বিভিন্ন বিকল্প খুঁজছে। আর চীন কিন্তু অতীতে নিজেদের স্বার্থ এগিয়ে নিতে বিদেশি রাজনীতিবিদ বা কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে পর্যন্ত পিছপা হয়নি। ভারতের জন্যও সম্ভবত সময় এসেছে বাংলাদেশে নিজের রাজনৈতিক সংযোগ আরও বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় করার।
(ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায় একজন নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক ঝুঁকি বিশ্লেষক। তার নিবন্ধটি ভারতের এশিয়ান এইজ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।)
No comments