সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের সংরক্ষিত মাথার খুলি
মানুষই
পারে আত্মত্যাগের দিনকে ভালোবাসার দিনে পাল্টে ফেলতে। ভ্যালেন্টাইনস ডে
মানুন বা নাই মানুন কিংবা একে যতই হুজুগ বলুন না কেন- উপহার ব্যবসায়ীদের তো
পোয়াবারো। তাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত মধ্যযুগীয় এক কবির কাছে। তিনি
ক্যান্টারবেরি টেলস খ্যাত জিওফ্রে চসার। তাকে ইংরেজি সাহিত্যের জনকও বলা
হয়। চসারই প্রথম ভ্যালেন্টাইনস ডের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের গাঁটছড়া বেঁধে
দিলেন। ১৩৭৫ সালে তার রচনায় কৌলীন্য পেল দিনটি। এর আগে খ্রিস্টীয় সমাজে
দিনটি নিয়ে বিশেষ মাতামাতি ছিল না। খ্রিস্ট-পূর্ববর্তী পৌত্তলিক সমাজ শীতের
শেষে বসন্তের শুরুতে এমন একটি দিনকে গুরুত্ব দিত। প্রাচীন রোমান সভ্যতায়
মধ্য ফেব্রুয়ারি ছিল উর্বরতার দেবতা ফনাসের দিন। সেই পার্বণে গ্রামের
অবিবাহিত যুবকরা একটি বাক্স থেকে চিরকুট তুলত। তাতে লেখা থাকত কুমারী
মেয়েদের নাম। যে যুবক যে তরুণীর নাম তুলবে তারা সেদিন থেকে প্রেমের জুটি
বলে বিবেচিত হবে। ডেটিং তো অবশ্যই। মাঝে মাঝে এ সম্পর্ক পৌঁছত বিয়ে অবধি।
খ্রিস্টান ধর্মের প্রসারের পরও এই মজার লোকাচারটি বজায় ছিল, অন্তত পঞ্চম
শতক পর্যন্ত। কিন্তু তারপর পোপ গেলাসিয়াস ঘোষণা করলেন, ১৪ ফেব্রুয়ারি হবে
ভ্যালেন্টাইনস ডে বা সন্ত ভ্যালেন্টাইনের দিন। এর আড়ালে আত্মগোপন করল
উর্বরতার উৎসব। তারপর তো চসার একে আনলেন পাদপ্রদীপের আলোয়। কিন্তু পোপ
গেলাসিয়াস যে সাধু ভ্যালেন্টাইনের জন্য দিন উৎসর্গ করলেন- তিনি কে ছিলেন?
খ্রিস্টধর্মের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় এ নামে একাধিক যাজক, সন্ত ও ধর্ম
প্রচারক ছিলেন। সন্ত ভ্যালেন্টাইন হিসেবে রোমান ক্যাথলিক চার্চ যাকে
প্রাধান্য দেয়- তিনি ছিলেন তৃতীয় শতকে ইতালির তার্নি শহরের বাসিন্দা।
মধ্যযুগীয় বিবরণ থেকে জানা যায়, তাকে হত্যা করিয়েছিলেন রোমান সম্রাট
দ্বিতীয় ক্লদিয়াস। দ্বিতীয় ক্লদিয়াস মনে করতেন অবিবাহিত তরুণদের দিয়ে ভালো
সেনাবাহিনী গড়া যায়। তাই তিনি তার সাম্রাজ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ করে দেন। এটি
যাজক ভ্যালেন্টাইন ভালোভাবে নেননি। তিনি গোপনে বিয়ে দিতে লাগলেন খ্রিস্ট
ধর্মাবলম্বীদের। তার এই বিরুদ্ধাচরণে ক্ষিপ্ত ক্লদিয়াস শির-েদ করে তাকে
হত্যা করান। প্রেমের জন্য আত্মাহুতি দেন এই সন্ত। কেউ কেউ মনে করেন তিনি
ছিলেন রোমের যাজক। ল্যাটিন শব্দ ‘ভ্যালেন্তিনাস’-এর অর্থ হল শক্তিশালী। এ
নামের মহিমা এমনই- খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসে দ্বিতীয় থেকে অষ্টম শতক পর্যন্ত
বহু ভ্যালেন্টাইনের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাদের অনেকেই রাজরোষে প্রাণ
দিয়েছিলেন। তাই ঠিক কার জন্য ভ্যালেন্টাইন ডে পালিত হয়- তা নিয়ে অনেক
জটিলতা দেখা দেয়। শেষে রোমান ক্যাথলিক চার্চ ১৯৬৯ সালে জেনারেল রোমান
ক্যালেন্ডার থেকে বাদ দিয়ে দেয় তার নাম। রয়ে যায় স্থানীয় ক্যালেন্ডারে। তবে
তাতে তার সন্ত পরিচয়ে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। তৃতীয় খ্রিস্টাব্দে ১৪
ফেব্রুয়ারি বা তার কাছাকাছি কোনো এক দিনে রোমের শহরতলিতে হত্যা করা হয়েছিল
সন্ত ভ্যালেন্টাইনকে। প্রেমের দূত এই সন্তের মাথার খুলি এখনও সংরক্ষিত আছে
তার বধ্যভূমি রোমেই।
এ অঞ্চলে উনিশ শতকে খননে পাওয়া যায় এক নরকঙ্কাল। ধরে
নেয়া হয় সেটি সন্ত ভ্যালেন্টাইনের। তার মাথার খুলি কসমেদিয়ানে ব্যাসিলিকা
অফ সান্তা মারিয়ায় ফুল দিয়ে সাজানো আছে। এছাড়া অন্যান্য দেহাংশ আছে চেক
প্রজাতন্ত্র, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের বিভিন্ন
গির্জায়। অনেক ইতিহাসবিদের মতে- প্রাচীন পৌত্তলিক সভ্যতার রীতিনীতি, উৎসব,
পালাপার্বণকে আত্তীকরণ করেছিল খ্রিস্টান সভ্যতা। ভ্যালেন্টাইনস ডেও তার
ব্যতিক্রম নয়। যেখানে প্রাচীন রোমের উর্বরতার উৎসব নতুন রূপে দেখা দেয়। এর
সঙ্গে যোগ হয় খ্রিস্টান সন্তের নাম। প্রেমের দিন উদযাপনের সঙ্গে
অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে যায় কিউপিড লাল গোলাপ আর কার্ড। সেখানেও কিন্তু
প্রাচীনত্বের অনুষঙ্গ। রোমান পুরাণে প্রেমের দেবী হলেন ভেনাস। তার এবং
যুদ্ধের দেবতা মার্সের পুত্র হলেন কিউপিড। ভেনাসের প্রিয় ফুল লাল গোলাপ।
দেবীর প্রিয় ফুল ও পুত্র দুজনেই ঢুকে পড়লেন প্রেমের পার্বণে। একেবারে
অবিচ্ছেদ্য। এবার কার্ড। বলা হয়- সন্ত ভ্যালেন্টাইন কারাগার থেকে চিঠি
লিখেছিলেন এক প্রিয় নারীকে। সন্ত হলে কী করে তা সম্ভব- তাই নিয়ে আছে বহু
তর্কবিতর্ক। যাই হোক, সেই চিঠির শেষে ল্যাটিন ভাষায় যা লেখা ছিল তার অর্থ
হল- তোমার ভ্যালেন্টাইন। সেই থেকেই মনের মানুষকে এই দিনে শুভেচ্ছা কার্ড
দেয়ার রীতি চলে আসছে। সেই প্রাচীন কাল থেকে পালিত হয়ে আসছে আবহমান প্রেমের
এই উৎসব।
No comments